স্মৃতিচারণ

স্মৃতিচারণ

সত্যেন বসু কী বললেন -অমিয় দত্ত

 ১৯৭৩। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে যাত্রা উৎসবের উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন কে করবেন তা নিয়ে নানান চিন্তাভাবনা চলছে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ঘরে, মহাকরণে। এক সময়ে নাম উঠল বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন বসুর। কে গিয়ে তাঁকে জানাবে আমন্ত্রণ, এ নিয়েও আলোচনা হল। যেহেতু সত্যেন বসু আমারই বাড়ির কাছে থাকেন তাই আমারই ওপর ভার পড়ল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারের পক্ষ থেকে এই আমন্ত্রণ জানাবার।

এর পরের দিন স্কটিশ চার্চ স্কুলের পাশের গলি ঈশ্বর মিল লেনের লালবাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। একতলা বাড়ি। নীল রঙের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই একেবারে সামনে পড়লাম তাঁর। আমি নমস্কার করতেই সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি তখন একটি খাটে বসে কী যেন লিখছেন। আমারই সামনে দু-দুবার কী লিখলেন আবার তা মুড়ে ফেলে দিলেন। খাটের নীচে এমন অনেক কাগজ মোড়া পড়ে আছে।

বেশ কিছুক্ষণ কাটল, ততক্ষণে প্লেন উইলস সিগারেট একটি পুড়ে গেছে। এবার তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

আমি আমার উদ্দেশ্য বললাম।

তিনি বললেন, জানো, আমি যাত্রা খুব ভালোবাসি, তারপর থিয়েটার। সিনেমা আমি দেখি না।

আমি বললাম, সরকারি প্রচেষ্টায় এই প্রথম আমরা যাত্রা উৎসব করছি। আমাদের ইচ্ছা আপনার মতো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ও জাতীয় অধ্যাপককে দিয়ে এর উদ্বোধন করি।

তিনি হেসে বললেন, ওসব শিল্পের কাজ শিল্পীকে দিয়েই করো।

আমি তখন চট করে বলে ফেললাম, আপনিও তো একজন শিল্পী, এসরাজ বেহালা বাজান, রবীন্দ্রসঙ্গীত গান।

তিনি হেসে বললেন, তুমি তো ভীষণ সাংঘাতিক লোক হে, এ সব জানলে কী করে?

আমি তখন তাঁর ভাগনির কথা বললাম, যে আমার একজন নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ। এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী ভাবলেন। একটা সিগারেট ধরালেন, তারপর সেই সামনের কাগজে কী যেন আঁকাজোঁকা করলেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার শরীর খারাপ, আমি যেতে পারব না, তোমায় একজন উপযুক্ত লোকের কথা বলছি তাঁকে দিয়েই তোমাদের যাত্রা উৎসব উদ্বোধন করাও।

আমি বললাম, আজ পশ্চিম বাংলায় আপনার পরিবর্ত আর কেউ নেই।

তিনি এবার যেন ধমকে বলেন, কেন ভানু আছে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ভানুবাবু!

উনি বললেন, হ্যাঁ ভানু। ও আমার থেকে অনেক বড় গুণী।

আমি আবার বললাম, আপনি বলছেন কী?

তিনি যেন আবার আমাকে ধমকে বললেন, জানো, ও ঢাকাতে আমার ছাত্র ছিল, গর্ব করার মতো ছাত্র। ওর ওপর আমার অনেক আশা ছিল। তবে ও শিক্ষাজগতে আমাদের আশা পূরণ না করলেও শিল্পজগতে অনেকের আশা পূরণ করেছে। আজ গ্রামে-গঞ্জে আমাকে লোকে চেনে না কিন্তু ভানুকে সবাই চেনে। ও সবাইকে হাসায়, এ কি কম কথা! ওকে দিয়েই তোমরা তোমাদের সরকারি যাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করো। ও আমার থেকে যোগ্য ব্যক্তি।

আমি তখন বললাম, আমাদের একটা কমিটি তৈরি হয়েছে, ভানুবাবু তার একজন সভ্য। ওঁকে দিয়ে তো এ কাজ করানো যাবে না। বাইরের কোনো লোককে দিয়েই এ কাজ করতে হবে।

তিনি এবার হেসে বললেন, উপযুক্ত গুণী সভ্যকে বাদ দিয়ে আমার মতো একজন অ-সভ্যকে দিয়ে একটা মহৎ কাজ করাতে চাও? বেশ, তাই করো গে, তবে আমি যেতে পারছি না।

আমি তারপর রসগোল্লা খেয়ে ওঁকে প্রণাম করে চলে এলাম। আসার সময় আমায় বললেন, আমার কাছে যা খেলে তা শুধু গোল্লা, ভানুর কাছে রসটা পাবে, বুঝলে।

আমার স্বামী – নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়

 আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে যে আমার স্বামী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার চোখে কেমন সেটা সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। তার মানে হচ্ছে সেই বিয়ের সময়কার অনুষ্ঠানের এক পর্ব—’দোষটুকু ঢেকে গুণটুকু বলতে হবে।’ স্ত্রীর পক্ষে এটা কী ভীষণ সমস্যা বলুন তো? কারণ ওই ফর্মুলা মেনে যদি লিখতে বসি, তবে প্রাণের আবেগে হয়তো এত বেশি লিখে ফেলব যে, অনেকেই বলবেন, আহা, ওঁর যেন কোনও দোষই নেই, সবই গুণ? (যেমন আমি অন্য অনেকের লেখা পড়ে বলে থাকি)। আর তাছাড়া এই মুহূর্তে লিখতে বসেই গৃহিণীদের স্বামী সম্বন্ধে যেসব জাতীয় অনুযোগ, অভিযোগ যা-ই বলুন মনের মধ্যে কিলবিল করে উঠছে, যেমন—সংসার সম্বন্ধে কোনও জ্ঞান নেই, ভালো মানুষ পেয়ে সবাই ঠকিয়ে নেয়, বাড়ির লোকের কথা ভালো লাগে না…ইত্যাদির ভিড় সরিয়ে শুধু গুণগান করাও খুবই বিড়ম্বনার নয় কি?

আমার শ্বাশুড়ি বলতেন, মিনমিনে স্বামী আর পিনপিনে গলা উনি মোটেই সহ্য করতে পারেন না। তা তাঁর ছেলেটির গলা সম্বন্ধে আমার আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তবুও একটা দৃষ্টান্তেই বুঝতে পারবেন। একদিন উনি ফোনে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। আমার মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, তুমি যাঁর সঙ্গে কথা বলছ তিনি কোথায় থাকেন? উনি বললেন, শ্যামবাজারে। বাসবী বলল, তুমি রিসিভারটা নামিয়ে রেখে কথা বলো, ভদ্রলোক এমনিতেই তোমার গলা শুনতে পাবেন। কাজেই বুঝতে পারছেন!

আপনি ভাবছেন কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝি বাড়িতে সব সময়েই হালকা চালে কথা বলেন বা সবাই-ই তাঁর সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করতে পারেন? তা কিন্তু মোটেই না। ব্যক্তিগত জীবনে উনি ভীষণ সিরিয়াস। যার তার সঙ্গে বিশেষ করে বয়সে অনেক ছোট বা গুরুজনদের সঙ্গে উনি কখনওই এটা পছন্দ করেন না। আমরা বাড়ির সবাই বেশ তটস্থ হয়েই কথাবার্তা বলি। বেচাল হলে খুবই অসন্তুষ্ট হন। যদিও পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে নানান মজার গল্পগুজব যথেষ্টই করেন।

জ্ঞানী, গুণী, বিশেষ করে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কখনও কুণ্ঠিত হন না। এতে ধনী, দরিদ্র বা দলগত মত পার্থক্যে কিছু আসে যায় না। কথা দিয়ে কথা রাখা, সময়ানুবর্তিতা, মন খুলে কথা বলা এবং কোনও কাজের ভার নিলে তা নিষ্ঠাসহকারে সম্পন্ন করা ওঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এইসব আদর্শের সঙ্গে তাল রেখে চলতে আমরা এবং তাঁর চারপাশের সবাই সব সময় হিমশিম খেয়ে যাই। আমার স্বামীটি খুব জেদি এবং স্পষ্টবাদী। যা বলবেন তা করে ছাড়বেন। এবং যাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হবেন তাঁকে তাঁর মুখের ওপরেই বলে দিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু কারুর অসাক্ষাতে কখনও মন্তব্য করেন না।

আমরা হয়তো কোনও নেমন্তন্নে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যাব—আমাদের ভাবটা সব সময়েই যেন আমরা ট্রেন ফেল করছি এরকম হয়ে থাকে। শুটিং, রেকর্ডিং ইত্যাদিতে সর্বদাই সময়ের একঘণ্টা আগে পৌঁছে যাবেন। বাড়ির কারুর ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলেই ঘর-বার করতে থাকবেন, তারপর রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, নয়তো গাড়ি বা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন খুঁজতে। অথচ সেই লোক যখন ফিরে আসবে, তখনই কিন্তু তাকে একটা কথাও বলবেন না। সে বুঝতেই পারবে না যে এতক্ষণ উনি উদবিন্ন হয়ে বাড়ির সবাইকে কী অস্থির করে তুলেছিলেন!

সবসময় এত ব্যস্ত অন্যমনস্ক থাকেন যে কোথাও যাওয়ার তাড়ায় কখনওই নিজেকে পুরো গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া একবারে সম্ভব হয় না। গাড়িতে উঠেই মনে পড়ে যায়, হয় চুল আঁচড়ানো হয়নি, নয় ঘড়ি পরতে ভুলে গেছেন, নয়তো চশমা নিতে মনে নেই ইত্যাদি। সংসারের কোনও ব্যাপারে কিংবা কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনওই নাক গলান না। কর্মজগতের কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা কখনওই বাড়িতে আলোচনা করেন না এবং অনেক মুখরোচক খবরও উনি আমাদের মতোই অনেক পরে অন্যের মুখে জানতে পারেন।

খুব অল্পতেই আমার স্বামী সন্তুষ্ট। সামান্য কারণেই যেমন চটে যান, তেমনি তা নিভতেও সময় লাগে না। যাকে ভালোবাসেন তার জন্য জীবন দেবেন। কারুর বিপদ শুনলে (শত্রু-মিত্র যে-ই হোন) সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ঢাকার লোক শুনলেই আনন্দে গলে যাবেন। তক্ষুনি তাঁর পিতৃ-মাতৃবংশের এবং পাড়া-পড়শিরকে কোথায় কেমন আছেন দিয়ে স্মৃতিচারণা শুরু হয়ে যাবে।

তৎকালীন বড় বড় দিকপাল যেমন—প্রফেসর সত্যেন বোস, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, কবি মোহিতলাল মজুমদার, বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত, বিনয় বোস, অনন্ত সিং, অভিনেতা ছবি বিশ্বাস প্রমুখ আরও অনেকের সান্নিধ্য ও স্নেহধন্য বলে তিনি বেশ একটু গর্বিত । ওঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর এবং যেটুকু জানেন সেটুকু খুব ভালো করেই জানেন। কোনও বিষয়ে ভালো করে না জেনে ওঁর সঙ্গে তর্ক করতে যাওয়া খুব বিপদের। কারণ তিনি সেই বিষয়ের জন্ম, তারিখ, সাল, এমনকী পিতৃ-মাতৃ বংশের তালিকাসুদ্ধ গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে আপনাকে নাজেহাল করে ছাড়বেন। সেই ২৮ ইঞ্চি বুকের সময় থেকে এই ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত দেখে আসছি কোনও গোলমাল দেখলে ভয়ে পিছিয়ে আসা তো দূরের কথা, বুক ফুলিয়ে এখনও এগিয়ে যাবেন। এঁকে নিয়ে কী করি বলুন তো?

আমার স্বামী প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়েও এখনও অন্যের মতামত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেন। ন্যাকামি, প্রবঞ্চনা, শঠতা খুবই অপছন্দ করেন। কারুর অনিষ্ট চিন্তা কখনওই করেন না। কেউ আড়ালে ওঁর বিরুদ্ধাচরণ করছে শুনে রেগে এখন ভাব দেখাবেন যে সেই ব্যক্তিটিকে সামনে পেলে মেরেই ফেলবেন। কিন্তু সেই লোকই যদি কোনও বিপদে সাহায্যের জন্য সামনে এসে দাঁড়ায়, তবে আমার স্বামীটি তার সমস্ত অপরাধ ভুলে গিয়ে ছুটবেন তাকে উদ্ধার করতে। এটিই তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।

ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ, কারুর অসুখ শুনলে তার খবর নিশ্চয়ই নেবেন। আবার নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লেও যাদের উনি ভালোবাসেন তারা না এলে ভীষণ অভিমান হয় এবং অনবরত তাদের কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। অসুস্থতার সময় ডাক্তার যদি কথা না-বলার নির্দেশ দেন, তবে উনি বলেন যে, এই ডাক্তার দিয়ে আমার চিকিৎসা করানো চলবে না, কারণ এই ডাক্তার জানে না যে কথা না বলতে পারলে আমার অসুখ সারবে না।

নিজে কোনও ভুল বা অপরাধ করলে অবলীলায় তা স্বীকার করেন। অনেক সময় অনেক ব্যাপারেই উপস্থিত থেকেও তিনি এমন ভাব দেখান যে সবাই ভাবে উনি তাদের চালাকি ধরতেই পারেননি। কিন্তু মোটেই তা নয়, পরে দেখা গেছে উনি জেনেশুনেই বোকা সেজে ছিলেন। ওঁর কথাতেই বলি, আমাকে assess করা এত সোজা নয়। তাই কি? না না! আমার সঙ্গে পেরে উঠবেন কেন? দীর্ঘ ৩৫ বছর বিবাহিত জীবনে আমার চোখে যা ধরা পড়েছে তা প্রকাশ করলাম, এখনও যেটুকু জানতে বাকি আছে আগামী ৩৫ বছরে নিশ্চয়ই সেটুকু ধরে ফেলব। কী বলেন?

হাস্যভানু – মন্মথ রায়

 হাস্যভানু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানুকে আমি ‘হাস্যভানু’ই বলি। হাসির সূর্য। যেখানে ভানু সেইখানেই হাসি। অন্ধকারের মেঘ নিমিষে উড়িয়ে দিতে পারে আমাদের ওই হাস্যভানুটি।

সূর্যকে যেমন চিনিয়ে দিতে হয় না, আমাদের ভানুকেও না। নির্মলহাস্যে আলোকিত রেখেছে গোটা দেশ, আজ কয়েক যুগ। হাসি হচ্ছে আমাদের জীবনের অক্সিজেন। সেই অক্সিজেনের যোগান ও দিয়ে চলেছে দেশকে এতকাল। আজ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমাদের কালের আরও কয়েক রসরাজের কথা—চিত্তরঞ্জন গোস্বামী, নবদ্বীপ হালদার, জহর রায়—এক-একটি হাস্য দিকপাল। তাঁরা সব পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য ভানু দয়া করে অক্সিজেন সাপ্লাই করে আমাদের এখনও সঞ্জীবিত রাখছে।

তা ছাড়া কী! দেশের যা দুরবস্থা—জিনিসপত্রের যা আকাশছোঁয়া দাম—চাল, ডাল, তেল, নুন, জ্বালানি, মাথা গুঁজবার জায়গা—সব কিছুই আজ এক-একটা সংকট, এক-একটা সমস্যা। সবসময়ই মনে দুরু দুরু আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, জীবনীশক্তির ক্ষয়। এই পরিস্থিতিতে যিনি আমাদের মুখে হাসি এনে দেন, মনে দেন আনন্দ, তাকে অনায়াসেই বলতে পারি ঈশ্বরের আশীর্বাদ। আনন্দদান অন্নদানের চেয়েও বড়।

ভানুর জীবনকাহিনি অনেকেরই জানা। তার মনোমুগ্ধকর চরিত্রবৈশিষ্ট্য, কিংবা তার পরোপকার-কাহিনি, সপ্রতিভ কথাবার্তা, জীবন সংগ্রাম এসব কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি তাকে জানি বহুকাল থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে যখন পড়ত তখন আমার পিসতুতো ভাই নির্মল সেন ছিল তাঁর সতীর্থ বন্ধু। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভানুর অবদান কিছু কম ছিল না। পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও যখন আঘাত এসেছে, ভানু আমাদের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে, লড়াই করেছে। থিয়েটারে তার জনপ্রিয়তা অসামান্য। সে একাই একশো। সবদিক থেকেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আজ একটি দেশখ্যাত নাম।

এই কিছুদিন আগে তার মুখেই শুনছিলাম, আমেরিকা প্রবাসী পুত্রের সঙ্গে ট্রাঙ্ক-কলে তার কথাবার্তা হচ্ছিল। অপারেটর ভানুকে বলল, Time is up’। ভানু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘শুয়োরের বাচ্চা, বাজে বক-বক করেই টাইমটা উড়িয়ে দিল, কেটে দিন।’ অপারেটর লাইন কেটে দিয়ে ভানুকে বললেন, ‘আপনি কেমন ভদ্রলোক? শুয়োরের বাচ্চা বললেন!’

ভানু তদুত্তরে তাঁকে জানাল, ‘কোনও দোষ করিনি ম্যাডাম! ওই শুয়োরটি আমি, আর—বাচ্চাটি আমার।’

ভানু অক্ষয় হয়ে, অমর হয়ে জাতির প্রাণশক্তিকে সজীব রাখুক এই প্রার্থনা।

স্নেহের ভানু – দেবনারায়ণ গুপ্ত

 ১৯৪৫ সালে ভানুকে আমি প্রথম দেখি—’রঙমহল’ থিয়েটারে সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে অভিনয় করতে। সেই প্রথম অভিনয় দেখে বুঝেছিলাম রঙ্গজগতে এই মানুষটি রঙ্গ-ব্যঙ্গর অভিনয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। আমার ধারণা অল্পদিনের মধ্যেই যে কার্যকরী হয়েছিল তা সেদিনের, বিশেষ করে চিত্রজগতের ইতিহাসের পাতা উলটোলেই দেখতে পাওয়া যাবে।

শ্রীরঙ্গমে আমার নাট্য রূপায়িত ‘বিন্দুর ছেলে’ অভিনয় শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই স্বর্গত নটশেখর নরেশচন্দ্র মিত্র শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’র কাহিনি চিত্রায়িত করেন। সেই চিত্রে ভানু ছোট্ট একটি চরিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বিন্দুবাসিনীর নতুন গৃহে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষ্যে পুরোহিতের ভূমিকায় তাকে দেখা গিয়েছিল। আমার নাটকে এ-চরিত্রটি ছিল না। এটি স্বর্গত নরেশদার সৃষ্টি। ওই ছোট্ট চরিত্রের অভিনয় দেখে দর্শকরা প্রচুর আনন্দ লাভ করেছিলেন। বিন্দুবাসিনীর উগ্র মন-মেজাজের সঙ্গে পুরোহিতের দ্বিধাগ্রস্থ এবং ভীত ভাবটি ভানু এমনই সুষ্ঠুভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল যা আজও আমার স্মরণপথে অবিস্মরণীয় রূপে ধরা আছে।

এরপর ভানুকে আমার ‘রামী চণ্ডীদাস’ ছায়াছবিতে একটি ভূমিকায় নির্বাচন করি। সেই ভূমিকার সঙ্গে আর দুই মূর্তি ওতপ্রাোতভাবে জড়িত ছিলেন—একজন তুলসী চক্রবর্তী ও অপরজন গঙ্গাপদ বসু। এই তিন মূর্তি চণ্ডীদাসের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচরণ ও চক্রান্তকারী রূপে সামগ্রিকভাবে যে অভিনয় করেছিলেন তা আমার ওই ছায়াচিত্রের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল।

১৯৫৩ সালে সলিল মিত্র মহাশয় স্টার থিয়েটারের সংস্কারসাধন করে নিরূপমাদেবীর ‘শ্যামলী’ মঞ্চস্থ করেন। শ্যামলী নাটকে পাকাপাকিভাবে ভানু আত্মপ্রকাশ করে। এই নাটকে সে একটি পেটুক গ্রাম্য যুবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হত। তার সঙ্গে সহযোগিতায় থাকত শ্যাম লাহা। এই নাটকে এদের আবির্ভাব, বিশেষ করে ভানুর আবির্ভাব দর্শকদের কাছে খুবই অভিনন্দিত হয়েছিল। ১৯৫৩ সাল থেকে ‘৬৭-‘৬৮ সাল পর্যন্ত ভানু স্থায়ীভাবে স্টার থিয়েটারের প্রতিটি নাটকে আত্মপ্রকাশ করেছিল। দর্শকদের কাজে এ সময় ভানুর আকর্ষণ প্রবল হয়ে ওঠে। কাজে কাজেই বিভিন্ন নাটকে ভানুর জন্যে একটি করে চরিত্র আমাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। এই সকল চরিত্রগুলির মধ্যে ‘পরিণীতা’ নাটকে সাম্যময় (যা ভানুর আসল নাম) সেই নামেই এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলাম। এরপর ভানু অবিস্মরণীয় একটি অভিনয় করেছে ‘শ্রীকান্ত’ নাটকে নন্দ মিস্ত্রীর ভূমিকা। টগর বোষ্টমির ভূমিকায় অভিনয় করতেন বেলারাণী। ভানুর সঙ্গে তাঁর বয়সের তফাত ছিল অনেক। কাজেই টগর বৈষ্ণবীর বয়সের সঙ্গে তাল রেখে ভানুকে মেক-আপ নিতে হত। এই ভূমিকায় অভিনয় করার পর ভানু যদি মঞ্চের অভিনয় ছেড়েও দিত তাহলে মঞ্চজগতে ভানুর নন্দ মিস্ত্রীর ভূমিকাটি কিংবদন্তী রূপেই থেকে যেত।

সুদীর্ঘকাল ভানুর সঙ্গে মঞ্চে ও ছায়াছবিতে আমি কাজ করেছি। দেখেছি, অভিনয়ের প্রতি তার নিষ্ঠা, মননশীলতা ও অধ্যবসায়।

ভানুকে অনেকেই জানেন কমেডিয়ান শিল্পীরূপে। কিন্তু ভানু সিরিয়াস অভিনয় করারও ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কমেডিয়ান রূপে রঙ্গজগতে একবার প্রতিষ্ঠালাভ করলে তখন আর তার সিরিয়াস অভিনয় দর্শকদের কাছে মন:পূত হয় না। ভানু একদিন আমার কাছে গল্পচ্ছলে বলেছিল, দাদা, কী বিপদ বলুন তো! মা-র অসুখে হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারখানায় ওষুধ আনতে যাচ্ছি, কয়েকটি ছেলে আমায় পথের মাঝে ধরে বলল, এমন ব্যস্তভাবে কোথায় চলেছেন? বললাম, মা-র অসুখ, ওষুধ আনতে যাচ্ছি। ছেলেগুলো দন্তবিকশিত করে বলল, আপনার মা-র অসুখ বুঝি? তাদের বলার ধরণটি এমনই যে আমার মা-র যেন অসুখ করতে নেই! কমেডিয়ানের জীবন সত্যই বিড়ম্বনাময়।

ভানু যখন থিয়েটার ছেড়ে যাত্রাদল গঠন করার সংকল্প করে তখন আমি তাকে নানাভাবে প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। যাত্রার অমানুষিক পরিশ্রম তার শরীরের পক্ষে পোষাবে কিনা এই আশঙ্কা করে আমি তাকে ছাড়তে চাইনি। কিন্তু সে মঞ্চ থেকে যাত্রাজগতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ নাটকে গোকুলের চরিত্রে রূপদান করে সে দর্শকদের কাছে প্রমাণ করেছে যে সে সিরিয়াস অ্যাকটিং জানে। ভানু মঞ্চে থাকলে মঞ্চের ব্যবসায়িক দিকের কথা ভেবে আমি তাকে কোনওদিনই এইরকম সিরিয়াস ভূমিকায় অভিনয় করতে দিতে পারতাম না।

ভানু যাত্রায় গেলেও আমার সঙ্গে তার বরাবরই যোগাযোগ ছিল। প্রায়ই টেলিফোন করেছে, খবর নিয়েছে, অসুখ হলে ছুটে দেখতে এসেছে, তার সৌজন্যমূলক সামাজিক ব্যবহার আজকের দিনে দুর্লভ। কাজের ব্যাপার নিয়ে অনেক সময় তাকে বকাবকি করেছি, কিন্তু সে অবনত মস্তকে তা সহ্য করেছে। কোনওদিনই প্রত্যুত্তর করেনি। এরই মধ্যে কয়েক বছর পরে আবার আমাদের অগ্রজ-অনুজের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে—রঙ্গনায় চলতি ‘জয়মা কালী বোর্ডিং’ নাটকে। এই নাটকের অসম্ভব জনপ্রিয়তার মূলেও সে। এ-নাটকের পরিচালকও সে। অগ্রজের ভূমিকায় আমি তার সঙ্গে যুক্ত আছি।

নটনাথের চরণে প্রার্থনা করছি, ভানু সুদীর্ঘ জীবন ও সুস্বাস্থ্য লাভ করে যাত্রার ফেলে-আসা জীবন, ফিরে আসা মঞ্চজীবনে সুদীর্ঘকাল সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে চলুক। জীবনসায়াহ্নে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যেন তার অভিনয় জীবনের সাফল্য আমি দেখে যেতে পারি।

ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন অভিনয় – প্রেমেন্দ্র মিত্র

 ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আজকের দিনের চিত্র ও মঞ্চজগতে কৌতুক রসের অভিনয়ে একটি সর্বাগ্রগণ্য নাম। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে এই জাতীয় অভিনয়ের যে অসামান্য যোগ্যতা প্রচ্ছন্ন ছিল তা প্রথম অনাবৃত করে দেবার কৃতিত্বটুকু বোধহয় আমিই দাবি করতে পারি। ছায়াচিত্রে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার রচিত-পরিচালিত ‘সেতু’ ছবিতেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। চিত্র ও মঞ্চজগতের সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও তার জন্যে একটি বিশেষ ভূমিকা সৃষ্টি করে তাকে ছবিতে নামাতে আমি দ্বিধা করিনি তার কারণ তার মধ্যে আমি সাধারণ আলাপেই এমন একটি সহজ স্বাভাবিক কৌতুক রসসৃষ্টির ক্ষমতা দেখেছিলাম যার মধ্যে কোনওরকম কৃত্রিমতা নেই।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন যে চেহারায় আমার ছবিতে দেখা গিয়েছিল তার সে-চেহারা অবশ্যই আজ নেই। প্রধাণত কৌতুক রসই তার অভিনয়ের লক্ষ্য হলেও নানা বিচিত্র চরিত্রে সে নিজের বহুমুখী ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে বেশ কয়েকটি অবিস্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টি করেছে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা হল এই যে, এখনও একটি বিশেষ ছাঁচে সে পাকাপাকিভাবে ঢালা হয়ে যায়নি। তার মধ্যে এখনও নতুন করে চমক দেবার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ আছে।

আর এক ভানু – শৈলেশ দে

 দুই ভানু। এক ভানু সবার চেনা। আর এক ভানু আজও অপরিচিত রয়ে গেছে সবার কাছে।বিশেষ করে সেই ভানুর কথাই আমি কিছুটা বলতে চেষ্টা করব বর্তমান নিবন্ধে।

ভানু আমার বাল্যবন্ধু। স্কুলে একই সঙ্গে পড়েছি আমরা। থাকতামও একই পাড়ায়। একইসঙ্গে আমরা পাশ করেছি, আবার ক্লাসে দুষ্টুমি করে শাস্তিও ভোগ করেছি একইসঙ্গে। তাই স্বভাবতই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল আমাদের দুজনের মধ্যে।

সেই কবেকার কথা। আজও আবছা-আবছা মনে পড়ে। মনের খাতা ওলটাতে গিয়ে আজও ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসে বিস্মৃতপ্রায় অতীতের সেই ধূসর পাণ্ডুলিপি। অস্পষ্ট, কিন্তু অবিস্মরণীয়।

ইতিমধ্যে কত যুগ কেটে গেছে। সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেছে বাল্যবন্ধু ভানুরও। আজকের ভানুর মধ্যে সেদিনের ভানুকে খুঁজতে যাওয়া বৃথা। ইতিহাসের পাতা একবার উলটে গেলে আর তাকে ফেরানো যায় না। সেই ভানুকেও আর ফিরে পাওয়া যাবে না কোনও দিনও।

সেই হারিয়ে যাওয়া ভানু ছিল জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন বসু, আচার্য ড: জ্ঞান ঘোষ, বিদদ্ধ মনীষী মোহিতলাল মজুমদারের একান্ত স্নেহধন্য প্রিয় ছাত্র, যার কাছে সেদিন অনেক প্রত্যাশা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এক কথায় যাকে বলে—ব্রিলিয়ান্ট বয়, ভানু ছিল তাই।

অস্বীকার করে লাভ নেই, সেদিন একটা ব্যাপারে সবাই আমরা ঈর্ষা করতাম ভানুকে। সেটা ছিল নির্বাক ছবির যুগ। মাঝে মাঝেই রবিবার আমরা ম্যাটিনি শো দেখতে যেতাম বাড়ি থেকে পালিয়ে। আমি যেতাম পায়ে হেঁটে। আর দিব্য মজা করে ভানু যেত একজনের সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে। ভাবতে গেলে আজও যেন সেই ছবিটা বার বার ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

আমাদের সবারই সেদিন প্রচণ্ড লোভ ছিল সাইকেলের ওই ক্যারিয়ারটার প্রতি। একবার কি ওখানে বসা যায় না! কিন্তু না, একটি দিনের জন্যও কেউ আমরা ভাগ বসাতে পারিনি ভানুর সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে।

সাইকেলটা ছিল রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানকারী মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ দীনেশ গুপ্তের। কী অপরিসীম স্নেহই না তিনি করতেন প্রাণচঞ্চল ছেলে ভানুকে! দীনেশ গুপ্ত সাইকেলে যাচ্ছেন, অথচ তাঁর ক্যারিয়ারে ভানু বসে নেই, এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কষ্টকর ছিল তখনকার সময়ে।

১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশ গুপ্ত প্রাণ দিলেন ফাঁসিমঞ্চে। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন কোনও সন্ধান পেলাম না ভানুর। কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! দেশ ভাগ হল ১৯৪৭ সালে।

ভাসতে ভাসতে দুজনেই চলে এলাম কলকাতায়। আনন্দের কথা, এত বড় বিপর্যয়ও আমাদের বন্ধুত্বে কোনও ফাটল ধরাতে পারেনি। সে সুযোগও অবশ্য ছিল না। কারণ, ঘটনাচক্রে একই পথের পথিক হতে হয়েছে দুজনকে। একজন লেখক, অন্যজন অভিনেতা। তাই দূরত্বের ব্যবধান গড়ে উঠতে পারেনি আমাদের মধ্যে।

সাহিত্য জীবনে আমার প্রথম হাতেঘড়ি—জয় মাকালী বোর্ডিং। ভানু সে ছবির নায়ক। তারপর মুক্তমঞ্চের প্রযোজনায়—যাত্রা। সেখানেও ভানু নায়ক, পরিচালক সব কিছুই। তারপর রঙ্গনা মঞ্চে।

পরবর্তী জীবনে ভানুকে বহু জায়গায় বহুভাবে দেখেছি। কখনও স্টুডিয়োর সেটে, কখনও বিচিত্রানুষ্ঠানে, কখনও বা যাত্রাপালায়। তাছাড়া প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমার কাছেও ভানু এসেছে অনেকবার। আমিও কম যাইনি ওর চারু অ্যাভিনিউয়ের আস্তানায়।

যদিও মুখ ফুটে কোনও দিন জানতে চাইনি, তবু ভানুকে দেখলেই একটা চঞ্চল জিজ্ঞাসা আমার মনে জেগে উঠত সর্বক্ষণ। আজকের খ্যাতনামা শিল্পী ভানু কি অতীতের সেই ভানুকে ভুলে গেছে? ফেলে আসা ঢাকার কথা কি তার একবারও মনে পড়ে না? মনে পড়ে না তার একান্ত প্রিয় দীনেশদাকে?

উত্তর পেয়েছিলাম কিছুদিন বাদেই। তারিখটা ছিল ৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৮।

গোটা রাইটার্স বিল্ডিং জুড়ে সেদিন বিরাট ব্যস্ততা। অনেক টালবাহানার পরে সেদিন মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ বিনয়-বাদল-দীনেশের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হবে রাইটার্সের সেই ঐতিহাসিক অলিন্দে। পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই এসেছেন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এসেছে অসংখ্য সংস্থা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

কিন্তু চিত্র বা নাট্যজগৎ! না, তাদের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি। এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। হয়তো বা ওদের নামটাও কেউ শোনেনি ইতিপূর্বে।

চমকে উঠলাম একেবারে শেষ প্রান্তে তাকিয়ে। এক কোণে চুপচুপ বসে আছে ও কে! ভানু! আমার বাল্যবন্ধু ভানু!

তুই এসেছিস! আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম ভানুকে।

আসব না! নিমেষে আজকের ভানুর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল অতীতের সেই পুরোনো ভানু—আজ আমার দীনেশদার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হচ্ছে। এমন দিনে আমি কি কখনও দূরে থাকতে পারি! তাই তো শুটিং ক্যানসেল করে চলে এলাম আজকের এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল ভানু। নিমেষে দৃষ্টি তার চলে গেল অলিন্দ ছাড়িয়ে দূরে—অনেক দূরে, বাইরের চলমান জনতার দিকে। দেখে মনে হল, ভানুও যেন সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে অনেক দূরে। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত কেটে গেল। ভানু নি:শব্দ, নিশ্চুপ।

প্রশ্ন করলাম, কী দেখছিস বাইরের দিকে তাকিয়ে?

উত্তর এল—একটা সাইকেল। কিন্তু ক্যারিয়ারটা একদম ফাঁকা। কেউ আজ আর বসে নেই ওখানে।

সর্বজনপ্রশংসিত বিরল অভিনেতা – সত্যজিৎ রায়

 বাংলা ছবিতে ক্ষমতাবান জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতাদের দিয়ে সামান্য ভূমিকায় অভিনয় করিয়ে নেবার একটা রেওয়াজ অনেক দিন থেকে চালু আছে। তুলসী চক্রবর্তীর মতো অসামান্য শিল্পীকেও তাঁর অধিকাংশ জীবন এই করেই কাটাতে হয়েছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন, এবং যেখানে বিশেষ কিছু করার নেই সেখানেও করেছেন। আশ্চর্য এই যে, যা-ই করেছেন—তা বহরে ছোটই হোক বা বড়ই হোক—তারই মধ্যে তাঁর সাবলীলতার পরিচয় রেখে গেছেন। সর্বজনপ্রশংসিত বিরল অভিনেতাদের মধ্যে ভানুবাবু একজন। আমার কোনও ছবিতে যে তিনি আজ পর্যন্ত অভিনয় করেননি তার মানে এই নয় যে আমি তাঁর অভিনয়ের কদর করি না। প্রথমে মঞ্চে ‘নতুন ইহুদী’ এবং পরে চলচ্চিত্রে সেই ‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর সময় থেকেই ভানুবাবুর সহজ ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করে এসেছে। তাঁর শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এই সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত।

স্বয়ংসম্পূর্ণ অভিনেতা – তপন সিংহ

 ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। ১৯৫৪ সালে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি ‘টনসিল’ ছবিতে প্রথম ভানুবাবু আমার সঙ্গে কাজ করেন। তারপর আরও বহু ছবি। সাম্প্রতিক কালে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবিতেও তিনি ছিলেন। ভূমিকাটি অবশ্য ছোট। পুরোহিতের চরিত্র চিত্রণ।

আমার মনে হয় ভানুবাবু কমেডিতে নতুন একটা ধারার প্রবর্তন করেছেন। ভাঁড়ামো না করে হাস্যরসের সারবস্তুটিকে সঠিক ও সপ্রতিভভাবে প্রযুক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক নতুন স্কুলিং সৃষ্টি করেছেন।

ভানুবাবুকে সাধারণত কমেডি ও সিরিও-কমেডি চরিত্রে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি গুরুত্বপূর্ণ (সিরিয়াস) ভূমিকাতেও সাবলীল ভঙ্গিতে কাজ করতে পারেন।

এককথায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এক স্বয়ংসম্পূর্ণ অভিনেতা (কমপ্লিট অ্যাক্টর)। যে-কোনও ধরণের চরিত্রই হোক না কেন, ভানুবাবুকে দিয়ে সেই চরিত্র-চিত্রণ সম্পূর্ণভাবে ফুটে ওঠে। বহুবার বহু ছবিতে তা প্রমাণিতও হয়েছে।

মুক্তোর অপর নাম অশ্রু – সুচিত্রা সেন

 শুরু হয়েছিল সেই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দিয়ে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিক সেটা। তাঁর সেই বিখ্যাত সংলাপ তখন—এমনকী এখনও মানুষের মুখে মুখে ফিরে চলেছে—’মাসিমা মালপো খামু’।

এরপর দিন, মাস, বছর কাটছে, ভানুবাবু মানুষকে হাসিয়েই চলেছেন—অনাবিল মুক্ত হাসি। দু:খে যারা বিহ্বল, বেদনায় যারা বিধুর, ভানুবাবু তাদের মুখেও হাসি জুগিয়ে চলেছেন।

শুনুন, আপনাদের হাসিয়ে উনি যখন ঘরে ফেরেন, বাস্তবের মুখোমুখি হন, তখন তাঁর চোখে অনেক মুক্তো ঝরে পড়ে—সেই মুক্তোর অপর নাম—অশ্রু!

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী – সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়

 এমনই এক নামের দাবিদার আর ভাগ্যের ভাগীদার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে শুধু নামটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষটি ভেসে ওঠেন মনের পর্দায়। তাঁর অভিনয়ে আছে এমনই এক মায়া যা ভাবনা-ভারাক্রান্ত মুখের গম্ভীর ছায়া আর গোমড়া মুখের গুমোট আবহাওয়া পালটে দেয় এক লহমায়।

সুদীর্ঘ অভিনয়জীবনে কত মানুষকে হাসিয়েছেন গোনা-গাঁথা না থাকলেও বলতে পারি—লক্ষ কোটির সীমানা ছাড়িয়ে তার পরিসংখ্যান। শুধু যে হাসিয়েছেন, ভাসিয়েছেন, মাতিয়েছেন আনন্দের জোয়ারে তাই নয়, হাসির মধ্যে মানুষকে ভাবিয়েছেনও—এটাই বড় কৃতিত্ব, বড় সার্থকতা। আপন প্রতিভায় সমুজ্জ্বল যে মানুষটির অবস্থান অভিনয়জগতের এক শীর্ষবিন্দুতে, সে মানুষটি কিন্তু ছোট-বড় সকলেরই অত্যন্ত কাছের মানুষ। সবার প্রিয়, সবার আপন, আমাদের সকলের ভানুদা।

সম্পর্কটা আমার সঙ্গে শুধু ফিল্মি নয়, ফ্যামিলি-গত। প্রথম কবে দেখা হয়েছিল আমাদের, এ-কথা বললে সঠিক বলা হবে না। সঠিক বলা হবে, প্রথম কবে দেখেছিলেন আমাকে। ছ’দিন মাত্র বয়স যখন—সেই ছয় ষষ্ঠীর অনুষ্ঠানে। একটু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খুব দুষ্টু হয়ে উঠেছিলাম নাকি, কথা বলতাম কটকটিয়ে; তাই ভানুদা নাম দিয়েছিলেন কটকটি।

দেশ বিভাগের পর সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে আসা এখানে। স্কুলে ভর্তি হওয়া, পড়াশোনার মধ্যে কেটে গেল তিন-চার বছর। সঠিক আর মনে নেই ভানুদাকে।

ফ্রক পরা কিশোরী মেয়ে তখন। স্কুল ছুটির পর গল্প করতে করতে বান্ধবীদের সঙ্গে চলে আসি রাসবিহারী অ্যাভিন্যুর মোড়ে। পান খাওয়ার খুব শখ ছিল ওই বয়সেই, মাঝে মধ্যে কিনে খাই তবক জড়ানো মিঠে পান। হঠাৎ দেখি, কেমন যেন তাকায় আমার দিকে একটা রোগাপটকা লোক। বিরক্ত হয়ে উঠি মনে মনে, এ আবার কেমনতর লোক রে বাবা! এমন করে তাকায় মেয়েদের দিকে! ভাবতে ভাবতে উঠে পড়ি ট্রামে, ঘরমুখো হওয়ার জন্য। এমন হয় মাঝে মাঝেই।…ওই রোগা-পটকা লোকটাই হঠাৎ একদিন বাড়িতে এসে উপস্থিত। চমকে উঠি দেখেই, অবশ্য চমক ভেঙে খুশি হয়ে উঠতেও সময় লাগে না। জানতে পারি ও আমার পিসতুতো দাদা—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাবার অনুমতি নিয়েই উনি আমায় নিয়ে যান ‘উত্তর সারথী’ নাট্য সংস্থায়। ‘নতুন ইহুদী’ নাটকের নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য। এখনকার অনেক বাঘা বাঘা শিল্পী ছিলেন তখন সেই সংস্থায়। পরীক্ষা দিতে হল তাদের সামনে—পাশ করলাম অভাবনীয় সাফল্যে—শুরু হয়ে গেল আমার অভিনয়জগতে পদযাত্রা—।

অভিনয়ের যতগুলি মাধ্যম আছে, সবগুলিতেই ভানুদা দাপটে করেছেন অভিনয়, রেখেছেন দক্ষতার স্বাক্ষর। খুব কম অভিনয় শিল্পীর ভাগ্যেই এ সৌভাগ্য ঘটে—মঞ্চ, চলচ্চিত্র, বেতার, গ্রামোফোন রেকর্ড, দূরদর্শন, যাত্রা—সবটাই তাঁর অভিনয়ের ক্ষেত্র। সবটাতেই অনন্যসাধারণ শিল্পী। লোকশিল্প যাত্রা। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ জনসংযোগ—সেখানেও তাঁর জয়যাত্রা।

এই উচ্চকোটি অভিনয়শিল্পী ব্যক্তি-মানুষটি কেমন? জীবনে সবচেয়ে কঠিন সোজা হওয়া। সেই কাঠিন্যকেই জয় করেছেন তিনি। তাই সহজ, সরল, সবুজ, রসিক। আচার-আচরণে, অশনে-বসনে, পোশাকে-আশাকে নির্ভেজাল বাঙালি। বাংলার জলবায়ু তাঁর প্রাণবায়ুর মতো, বাংলার কলাকৃষ্টি তাঁর রক্তে মিশে আছে। নানা বিষয়ে গভীর জ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মনীষার সন্ধান তাঁরাই রাখেন যাঁরা মিশেছেন গভীরভাবে।

তাহলে দোষ কি কিছু নেই? হ্যাঁ আছে, নিশ্চয়ই আছে। লোকটি ভীষণ একরোখা, ভয়ংকর ঠোঁট কাটা, মুখের লাগাম নেই একটুও, অপ্রিয় সত্য কথা বলতে ছাড়েন না, তা সে যত তিক্ত কটুই হোক। আবার স্নেহপ্রবণও। যাদের স্নেহ করেন তাদের অন্যায় দেখলে এমন ভর্ৎসনার কড়া চাবুক মারেন যে তিষ্ঠানো দায়। চরিত্রের সবচেয়ে মহৎ গুণ, কোনও ভণিতা নেই ভানুদার।

এমনই একটি মানুষ, যাঁর সান্নিধ্যে মুহূর্তে ভুলে যাই সংসারের দু:খ-কষ্ট, চিন্তা-ভাবনা। হাসির জোয়ারে ভাসিয়ে দেন সব, শিশুসুলভ সরল সবুজতায়। এমন সরল সবুজ মনের অধিকারী বলেই হতে পেরেছেন এত বড় অভিনয়শিল্পী, এত উঁচুদরের হাস্যরসিক।

কৌতুকাভিনেতা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করলেও এটাই তাঁর সর্বোপরি পরিচয়। অভিনয়জীবনের সূত্রপাত অত্যন্ত সিরিয়াস অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। সিরিয়াস অভিনয়েও তিনি যে কত বড় প্রতিভাধর তারও পরিচয় পেয়েছি আমরা। অভিনয়শিল্পী হিসেবে সার্থকতা স্বতন্ত্রতা ছাড়াও সবচেয়ে বড়ত্বটা তার কীসে?

মাত্রাজ্ঞানে, পরিমিতিবোধে, সংযততায়, সাবলীলতায়।

রসনাগর, রসসাগর, রসিক চূড়ামণি, হাস্যার্ণব, কৌতুকাভিনেতা বা কমেডি কিং—যে-বিশেষণেই ভূষিত করা হোক না কেন এই শিল্পীকে, কোনও বিশেষ্য বিশেষণের সীমার গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে কিন্তু রাজি নই আমি। আমার উপলব্ধিতে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী।

দরদী দাদা – গীতা দে

 আমার জীবনে কমেডি চরিত্র সৃষ্টির শিক্ষা ভানুদার কাছে। অভিনয়জীবন শুরু ছ-বছর বয়সে। তারপর ছেদ পড়ে প্রায় তেরো বছর। আবার অভিনয় আঙিনায় এলাম। এবার শ্রীরঙ্গমে। ‘তক্ততাউস’ নাটকে প্রথমে ডুপ্লিকেট। ঝর্ণাদেবী ছেড়ে যাওয়ায় পাকাপাকি শিল্পী হলাম। তখন আমি ‘ইমতিয়াজ’। কমেডি চরিত্র করার কথা কোনওদিন ভাবিওনি।

এই শ্রীরঙ্গমেই প্রথম দেখলাম ভানুদাকে। অভিনেত্রী সংঘের সহ-সম্পাদক। আসতেন শিল্পীদের সঙ্গে আলাপ করতেন। শিশিরবাবু ছিলেন ভানুদার বাবার ছাত্র। শিশিরবাবুর কাছে ভানুদা ছিলেন খুবই প্রিয়।

ভানুদাই আমাকে অভিনেত্রী সংঘের সদস্যা তালিকাভুক্ত করলেন।

‘৫৬ সালে স্টারে এলাম। ‘শ্রীকান্ত’ নাটক শুরু হল। এখানেও শুরু সেই ডুপ্লিকেট দিয়ে। অভয়ার ভূমিকায় সাবিত্রী চ্যাটার্জী। ৮০ রাত্রির পর সাবিত্রী চলে যাওয়ায় আমি হলাম অভয়া। ভানুদা তখন স্টারে। ওই নাটকে করছেন ‘নন্দ মিস্ত্রী’।

সিনেমা হল ‘অভয়া-শ্রীকান্ত’। ভানুদা হলেন নন্দ মিস্ত্রী, আর আমি টগর। তাঁর সঙ্গে পরিচয় আরও বাড়ল।

১৯৫৯ সালে স্টারে হল ‘ডাকবাংলো’। ছবিবাবু এলেন। সন্ধ্যা রায়ও সেই প্রথম মঞ্চে এলেন। এই নাটকে দেবুদা (দেবনারায়ণ গুপ্ত) আমায় ও ভানুদাকে স্ত্রী-স্বামীর ভূমিকা দিলেন। সেই শুরু হল কমেডি চরিত্র রূপায়ণ। ভানুদার পাশে থেকে তা শিখলুম। অভিনয় আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সেই থেকে সিরিয়াস কমেডিতে দুজনের নামে সাড়া পড়ে যেত। বাইরেও আমরা কৌতুকী নকশা পরিবেশন করেছি। ‘রাজযোটক’ তেমনি এক নকশা। রেকর্ডও হয়েছে। কমেডিতে সময়ের মাত্রাজ্ঞান একান্ত প্রয়োজন। ভানুদা আমায় দিনের পর দিন সেই বিষয়ে বুঝিয়েছেন। শুধু আমার ক্ষেত্রে কেন, আরও অনেককে তিনি অভিনয়জগতের বহুমুখী চর্চায় উদ্দীপ্ত করে তোলেন। এমন সময় গেছে, ভানুদা আর আমি ছাড়াও অনুপকুমার ও সুখেন দাস সিরিয়াস কমেডির অংশীদার। চারজনকে একদৃশ্যে পেলে দর্শকরা ফেটে পড়ত। কিন্তু সবেরই মূলাধার ভানুদা।

এ তো গেল অভিনয়ের কথা। অভিনয়ের বাইরে সহশিল্পীদের জন্যে ভানুদার মমত্ববোধ কোনওদিন ভোলার নয়। আজও আমার মনে আছে—ঘটনা একটা নয়, অনেক, অসংখ্য। আমিই ভানুদার নজরে এনেছি শিল্পীদের অসহায় হওয়ার ঘটনা। কেউ বা বাড়িভাড়া দিতে পারেনি, কেউ পরীক্ষা দেবে—অর্থাভাব। কারো আবার অসুখ, চিকিৎসার টাকা নেই—এমনি কত কী। ভানুদাকে বলেছি। সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগ ভানুদার—সেই সহযোগী সহায়তা কোনওদিন ভোলার নয়। নিজের টাকা দিয়েই শেষ নয়, প্রয়োজনে থিয়েটার থেকে আগাম মাইনে নিয়েও এই কাজে তিনি তা ব্যয় করতেন। কারোকে জানাতেন না। এক শিল্পী বিএ পরীক্ষা দেবে, ভানুদাকে বলেছি। সঙ্গে সঙ্গে ভানুদা তার শুধু পরীক্ষার ফি নয়, বইপত্তর, এমনকী ছ-মাসের মতো কলেজ করার জন্য পোশাক-পরিচ্ছদেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

সম্প্রতি বিনোদিনী নাট্য গোষ্ঠীর উদ্যোগে দু:স্থ শিল্পীদের সাহায্যার্থে বিচিত্রানুষ্ঠান হল। ভানুদা এলেন। কোনও পয়সা-কড়ির কথাই নয়। বরং এই সংস্থার উদ্যোগপর্বে টিকিট পর্যন্ত বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

বাংলার মঞ্চ ও চিত্রজগত কেন বলি, যাত্রার আসরেও ভানুদার জনপ্রিয়তার মূলে আছে তাঁর নিজস্ব শিক্ষা, জ্ঞান এবং নিবিড় চর্চার একাগ্রতা। তাঁর মমত্ববোধ, সহশিল্পীদের প্রতি তাঁর সদা-সম্প্রসারিত সহযোগিতা কোনওদিন ভোলার নয়। এটা আমাদের সকলের কাছে আদর্শ।

আমার আমি – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

 এই বয়সে আমার নামে ‘প্রসাদ’-এর একটা সংখ্যা বেরুচ্ছে এ-বিষয়ে বিনয় করার কিছুই নেই। আমি মনে করি আমি ধন্য। সেই সঙ্গে প্রসাদের কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে কর্মী-সাংবাদিক সকলকেই অভিনন্দন জানাই।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে নিজের কথাটা বলা দরকার—

আসলে আমি কত বড় অভিনেতা সেটা আমিই বলতে চাই।

আধুনিককালে সারা পৃথিবীতে যত শিল্পী জীবিত আছেন অর্থাৎ কাজ করছেন তার মধ্যে আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ—এর লজিক্যাল কারণ—সেই চেহারা অর্থাৎ ২৮ ইঞ্চি বুকের মাপ, তৎকালীন মুখশ্রী এবং সেই গলার আওয়াজ লইয়া ২৮ বছর টিকিয়া আছি—পৃথিবীতে কোনও শিল্পী এতগুলান ড্র-ব্যাক লইয়া টিকিয়া থাকে না—

ভানু + কমেডি = সিরিয়াস – বিকাশ রায়

 ভানু আমার ভাই, বন্ধু, আবার গার্জেনও। ওর সঙ্গে যখনই দেখা হয়, তখনই ও প্রথমেই আমাকে এক রাউন্ড যা-ইচ্ছে তাই বকা-ঝকা করে নেয়, তা কারণ থাকুক বা না-ই থাকুক। বলে, তোমার মতো একগুয়ে জেদি বিচ্ছিরি মানুষকে সামলাতে হলে অফেন্স নেওয়াটাই নিজেকে ডিফেন্স করার সেরা উপায়। আর আমাদের এই সম্পর্কটা আজকের নয়—অনেক, অনেক দিনের। যখন আমরা কেউ-ই ফিল্ম-এ আসিনি, তখনকারের।

রেডিয়োতে চাকরি করতাম, প্রভাত মুখুজ্জে হঠাৎ একদিন একটি ছেলেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিলে। বললে, একে দেখো। ভালো আর্টিস্ট, ঢাকা রেডিয়োয় সুন্দর অভিনয় করত।

রোগা ডিগডিগে চেহারা আর মুখশ্রী তো অপূর্ব। ভানু বলে, ওর মুখশ্রী নাকি আমার চেয়ে ভালো! আমি বলি, আমি কত ছবির হিরো, কত ছবির ভিলেন আর তুই তো কমিক করিস। ওর গলা চড়ে, ও বলে—! যাকগে, সেসব কথা বলে লাভ নেই, কতকগুলো গালাগালিই তো! এই যা বলছি এর জন্যেও আমার কী পাওনা হচ্ছে সে আমিই জানি।

সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু সেই প্রথম দিন থেকেই আমার বন্ধু, আমার ছোট ভাই, আমরা পরস্পর সুখ-দু:খের সঙ্গী। ওর সম্বন্ধে আমার পক্ষে বিশেষ করে কিছু বলা প্রায় অসম্ভব।

তবে একটা কথা বলি, ভানু হাস্যরসিক, ভানুর একার জোরে একটা যাত্রার দল চলে, একটা থিয়েটারে হাউস-ফুল-এর পর হাউস-ফুল হয়, এটা তো সবাই জানেন, সবাই বলবেন। কিন্তু ভানু যে কত বড় সিরিয়াস অভিনেতা তা হয়তো অনেকেই মনে করতে পারবেন না। এই সুযোগে আজ আমি সে-সম্বন্ধে কিছু বলি—

অনেক দিন আগে বিপ্লবী অনন্ত সিং-এর প্রযোজনায় একটা ছবি পরিচালনা করেছিলাম—’নতুন প্রভাত’। ভানু অনন্তবাবুর খুব স্নেহের পাত্র ছিল, ও-ই যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল।

সেই ছবিতে একটা চরিত্র ছিল—এক মাস্টারমশাই টিবি রোগী, দিনরাত ক্রসওয়ার্ড পাজল করে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা পাওয়ার লোভ তাঁর, সকলে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করে, এমনকী দর্শকও। কিন্তু শেষ দৃশ্যে সে ভদ্রলোক যখন তাঁর ক্রসওয়ার্ড পাজল নিয়ে পাগল হওয়ার কারণটুকু বলেন তখন কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না।

গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত এই চরিত্রটিতে অতি-পরিমিত অভিনয়ের প্রয়োজন ছিল। ভানু এই চরিত্রে, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে যা অভিনয় করেছিল, তা আমি আজও ভুলতে পারি না।

ভানু আর একটা ছবিতেও সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করেছিল, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতি’তে, নির্মল দে-র পরিচালনায়। এ ছবির অভিনয় আমি আজও ভুলতে পারিনি।

তাহলে, দাঁড়াল কী? ভানু ইজ ইকোয়াল টু কমেডি প্লাস সিরিয়াস। আর আমি ইজ ইকোয়াল টু শুধু সিরিয়াস। লজিকের হিসেবে ভানু আমার চেয়ে বড় অভিনেতা। ওকে বলি না বটে, কিন্তু আপনাদের কাছে এই শেষ বয়সে কথাটা স্বীকার করে গেলাম।

পাগল ভানুদা – সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে কিছু লেখবার জন্যে আমাকে ‘প্রসাদ’ পত্রিকা থেকে বলা হয়েছে, কিছু লিখতেই হবে। কিন্তু কী লিখি?

যাই হোক, যেটা সত্যি সেটাই বলা উচিৎ—ভানুদা হল একের নম্বরের বদমাইস লোক, খারাপ লোক—এই অভিনয়জগতে তার সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে লেখকের মান-সম্মান দুটোরই যাওয়ার সম্ভাবনা। কারণ ভানুদাই লেখাটা পড়ে গলাটা টিপে ধরে বলবে, ‘এটা তুই কী লিখছস?’ তবু আমি সত্যি কথা বলব মশাই, ভানুদা একের নম্বরের বদমাইস—ফিল্মের অনেক ডাইরেক্টরই ওর সামনে আসতে রীতিমতো ভয় পায়। না, না, ভানুদা কাজ চায় না, বলে, ‘তোমরা নিজেরাই কাজ জানো না, কোনওরকমে কাজ পাচ্ছ, তা আমাকে কাজ দেবে কী!’

আচ্ছা দেখুন, ভানুদার এটা কি বলা উচিৎ? সেদিন এক প্রাোডিউসারকে বলে বসল, ‘আপনি অনেক বড় বড় ছবি তৈরি করতে পারেন কিন্তু একটা ভানু ব্যানার্জি তৈরি করতে পারবেন না।’

কথা শুনুন, এটা কি ভদ্রলোকের কথা! ভানুদা সবসময় একটা চ্যালেঞ্জের মনোভাব নিয়ে বসে থাকে—চ্যালেঞ্জ সবার বিরুদ্ধে, এমনকী নিজের বাড়ির বিরুদ্ধেও। চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল এই জঘন্য লাইনে থেকেও ছেলেমেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। ঠিক করেছে ও, ভানুদার ছেলেমেয়ের মতো ছেলেমেয়ে আর কার আছে!

ভানুদা ছিল প্রথমে ফিল্ম পাগল, তারপর হল থিয়েটার পাগল। এখন? সে-ও এক চ্যালেঞ্জ—কোনও এক থিয়েটারে বেশ ক-বছর থিয়েটার করল, হঠাৎ একদিন থিয়েটার-মালিকের সঙ্গে কী হল। ব্যস, মালিককে গিয়ে মুখের ওপর বলে এল, ‘আমি থিয়েটার করুম না, যাত্রা করুম এবং নিজে যাত্রা-দল করুম।’ বলাও যা করাও তা—সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাদল তৈরি করে ফেলল ভানুদা। ফিল্ম লাইন, থিয়েটার লাইনের ওপর ঘেন্নাটা সোচ্চার হয়ে উঠল।

সবাই এই কথা শুনে হাসাহাসি, বিদ্রুপ, ঠাট্টা করেছিল। আমিও করেছিলাম, বলেছিলাম, ভানুদাটা এবার পাগল হয়ে গেছে। সেই পাগলের সঙ্গে এখন যখন দেখা হয়, আগে প্রণাম করি, প্রণাম করি পাগলের দূরদর্শিতাকে, মনের জোরকে—প্রণাম করি পাগলের চ্যালেঞ্জকে আর মনে মনে ভগবানকে বলি, এই পাগলটাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রেখো, তাহলে অনেক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখতে পাব। যা করার সাহস আর কারোর আছে বলে মনে হয় না…

অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় : একটি মূল্যায়ন – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 অভিনয় বা অভিনেতাকে নিয়ে আমাদের দেশে যতটুকু আগ্রহ বা কৌতূহল তা দর্শক সাধারণের। সমালোচক বা বোদ্ধারা এ নিয়ে বিশেষ একটা মাথা ঘামান না। এত সব ফিল্ম সোসাইটি হয়েছে, তার কল্যাণে চলচ্চিত্র উৎসাহীর, চলচ্চিত্র-পণ্ডিতের সংখ্যাও বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু চলচ্চিত্র সংক্রান্ত ‘মননশীল’ পত্র-পত্রিকায় ভূ-ভারতের ফিল্ম নিয়ে এত দাঁত-ভাঙা সব আলোচনা বেরোয়, কই, কোথাও তো অভিনয় বা অভিনেতা নিয়ে আলোচনা দেখতে পাই না। তবে কি অভিনয়কর্মটা মননের বিষয় হতে পারে না? না কি অভিনেতারা দর্শকের কাছে নগদ পাওনা তো পেয়েই যাচ্ছে, এই বিবেচনায় ঈর্ষামিশ্রিত আভিজাত্যাভিমান থেকে পণ্ডিতরা অভিনয়কে ব্রাত্য করে রাখছেন! আমার অবশ্য সন্দেহ হয়, এই পণ্ডিতরা আসলে কিছুই বোঝে না—অভিনয় নিয়ে আলোচনার যোগ্যতা তাদের নেই বলেই ও-বিষয়টা অছ্যুত—এই ভান করে দূরে থাকে।

ফ্যান ম্যাগাজিন বা পত্র-পত্রিকার জন-মনোরঞ্জক চলচ্চিত্র বিভাগগুলোতে আবার অভিনয় বা অভিনেতা নিয়ে যা সব ছাপা হয়, অভিনয়ের সম্পর্কে কোনও সত্যিকারের বা সুস্থ বোধ তৈরি হওয়ার পক্ষে সেগুলো মারাত্মক। নির্বোধ, বালখিল্য এমনকী অশ্লীল স্তুতি-নিন্দার মধ্যে থেকে অভিনয়কে একটা গুরুতর কাজ যা অভিনেতাকে শিল্পকর্মী বলে ভেবে নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই অভিনেতারা বেশির ভাগ সময়েই তাঁদের কাজের মূল্যায়নের জন্যে সাধারণ দর্শকের ওপরই নির্ভর করেন। দর্শকের কাছে তাঁরা শ্রদ্ধেয় যদি না-ও হন অন্তত প্রিয় তো বটে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও এমনি একটি অতি-প্রিয় নাম বাঙালি দর্শকের কাছে। শুধু যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতেই দেখতে হয় তাহলে সেখানেও গত তিরিশ বছরে তাঁর তুলনায় জনপ্রিয় অভিনেতা কমই হয়েছে। উত্তমকুমার যেমন একটা কিংবদন্তী, একটা প্রতীক, একটা ভাবমূর্তি—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই। বাঙালি মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত তাড়িত-পীড়িত ব্যস্ত-বিব্রত জীবনের কৌতূহলদীপ্ত ভাবমূর্তি ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়ের অভিনয় যেমন উজ্জ্বল তেমন খুব কম অভিনেতার অভিনয়ই দেখেছি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললে তাই শুধুই একটা হাসাবার যন্ত্র মনে পড়ে না—একটা জীবন ধারণা, জীবন সম্পর্কে একটা মন্তব্য যেন মনকে ছুঁয়ে যায়।

আর সব থেকে তৃপ্তিদায়ক হল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে অভিনয়শৈলী দিয়ে এই জীবনভাবনাকে প্রকাশ করেছেন সেটা ঘোর বাঙালি। অনেক শক্তিমান কৌতুকাভিনেতার মধ্যেও দেখেছি আদি হলিউডের অসামান্য ক্লাউনদের প্রবল প্রভাব। তুলসী চক্রবর্তীর, ফণী রায়ের বা নবদ্বীপ হালদারের মধ্যে এইসব প্রভাব একেবারেই ছিল না। ভানু-জহরের অভিনয়ে যদি তা কখনও উপস্থিত থেকেও থাকে তা কখনওই দৃশ্যমান হয়নি। বলা ভালো, স্বকীয়তার মধ্যে বাঙালিয়ানার জারকে তা পরিপাক হয়ে গেছে। এই জন্যেই হয়তো এঁদের তুলনারহিত জনপ্রিয়তা, এই কারণেই হয়তো প্রায় দুই দশক ধরে উত্তম-সুচিত্রার মতো কিংবা হিসেব করলে দেখা যাবে তার থেকেও বেশি করে ভানু-জহরও ছিল বাংলা ছবির একটা অত্যাবশ্যক Instiution, অবর্জনীয় অনিবার্য অঙ্গ। একটা ভূমিকার মধ্যে যে পরিমাণ energy—উন্মাদনার এঁরা জন্ম দিতে পারেন তার সমকক্ষতা বিরল।

কিন্তু সিনেমার অভিনয়ের বিচারে জহর রায়ের থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি সব সময়েই ওপরে জায়গা দিতে চাই। কারণ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এত মাপের সঙ্গে স্বাভাবিক অভিনয় করার ক্ষমতা (হাসির হট্টগোলের ভূমিকার মধ্যে থেকেও) আমার সময়ের খুবই কম সিনেমার অভিনেতার মধ্যে আমি দেখেছি। জহর রায়ের অসামান্য ক্ষমতা সত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে তাঁর মধ্যে অতি-অভিনয়ের প্রবণতা ছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়শৈলীর মধ্যে অতি অভিনয়ের কোনও প্রবণতা নেই। কোনও সময়ে তিনি চরিত্রের সীমা ছাড়িয়ে বাইরে পা বাড়ান না। আর একটা দুর্লভ গুণ এঁর অভিনয়ে চিরকাল লক্ষ করেছি—এঁর কোনও প্যাঁচ নেই, আগে থেকে ভেবে নেওয়া চাল নেই, কোনও মুদ্রাদোষ নেই। অভিনয়টা সোজা সরল রাস্তায় চরিত্রটিকে এবং তার বাস্তবতাকে আশ্রয় করে চলতে থাকে। কিন্তু বৈচিত্রের ঐশ্বর্য আছে বলেই, তূণে অনেকরকমের বাণ আছে বলেই সবসময়েই অভিনয়টা প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় থাকে।

তিরিশ বছর ধরে অভিনয় করেছেন—তিনশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে ক’টা আর সত্যিকারের চরিত্র? সবই তো ছাঁচে ঢালা। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও রসবোধ এই অভিনেতার এত অপর্যাপ্ত যে, আজও মানুষকে আপ্লুত করার ক্ষমতা রাখেন। আমার সময়কার অভিনেতাদের মধ্যে, বিশেষত, কৌতুকাভিনেতাদের মধ্যে এত বৈচিত্রের ঐশ্বর্য কারোরই নেই। সিরিয়াস ও কমিক—এই দুই-এর মধ্যে অনায়াস বিচরণের ক্ষমতাও তাঁর মতো কমই দেখেছি।

বাংলা ছবির অভিনেতারা অনেকেই খুব শক্তিমান—কিন্তু অনেকেই graceful নন। কৌতুকাভিনেতারাই এর খানিকটা ব্যতিক্রম। এই জাতের অভিনেতাদের মধ্যেও আবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্য। অত্যন্ত sensitive ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেতা বলেই কি তাঁর অভিনয়ে এত রমণীয়তা, এত লাবণ্য?

তিনশো ছবিতে অভিনয় করার একটা খেসারত আছে। তার ওপর সেইসব ছবি করিয়েদের অনেকেরই রসবোধ দূরস্থান, আদৌ কোনও বোধ ছিল কি না সন্দেহ হয়। বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকার ন্যাকামির দৃশ্যের, কিংবা মা ও হাম্বাজাতীয় জীবদের কান্না-সিক্ত দৃশ্যগুলির ভিড়ের মধ্যে অধিকাংশ সময়ে শুধুমাত্র একঘেয়েমি কাটাতে কিংবা নাকের ও চোখের জল মোছবার অবকাশ দেবার জন্য comic relief হিসেবে ভানু-জহর, বা কমেডিয়ানদের আমদানি করা হয়ে থাকে। চিত্রনাট্যে হাসি নেই, অথচ হাসানোর দাবিতেই পয়সা দিয়ে এঁদের নিযুক্ত করা হয়। সেরকম অজস্র ছবিতে অভিনয় করার একটা খেসারত আছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সেই খেসারত দিতে হয়েছে। অভিনয়রীতিতে যান্ত্রিকতার, প্রাণশূন্যতার দোষ কখনও কখনও তাঁকেও লেগেছে বইকি। কিন্তু কত দুর্মর প্রাণশক্তি থাকলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিন দশক ধরে বাংলা ছবিকে অভিনয়ের সহজ লাবণ্য দিয়ে সমৃদ্ধ রাখা যায়—আবালবৃদ্ধের মুখে দিনযাপনের গ্লানি ভুলিয়ে হাসি ফোটানো যায়—সেই কথা ভেবে আমার আশ্চর্য লাগে।

আর ভেবে আশ্চর্য লাগে যে এমন অভিনেতাকে নিয়ে আমাদের দেশে কত কম আলোচনা হয়েছে, তাঁর কাজের সম্বন্ধে কতটুকু আগ্রহ বা কতটুকু স্বীকৃতি দেখতে পেয়েছি! তবে কি আমাদের দেশের আরও বহু সুন্দর জিনিসের মতো তাঁর অভিনয়ও অমনোযোগী বিস্মৃতির অমোঘ ভাটায় পড়ে ভেসে যাবে?

আসলে আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতির অভিভাবক যে শ্রেণি তারা অত্যন্ত অন্তসারশূন্য এবং সত্যিকার অর্থে শিল্পরসিকও নয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ের যে জীবনবোধ যে বাঙালিয়ানা সাধারণ মানুষকে এত তৃপ্তি দেয়, তাকে উপভোগ করার বা স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা এদের নেই। আজ যদি সাহেবদের দেওয়া কোনও পুরস্কারে তিনি চর্চিত হতেন, কিংবা সাহেবদের দেশে যেসব ছবি ফেসটিভাল উপলক্ষ্যে যায় সেসব ছবিতে ঘন ঘন তাঁকে দেখা যেত তাহলে হয়তো তাঁর সত্যিকারের মূল্যায়ন না হোক অন্তত কফির পেয়ালার ওপর আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি বিবেচিত হতেন। ঘটনা এই যে, তিনি তেমনভাবে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত আজও নন। সুখের কথা, সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, তাঁর অভিনয়ের সেইটেই সবচেয়ে বড় স্বকৃতি। এই দেউলিয়া সমাজের সব শিল্পকর্মের মতো তাঁর অভিনয়েও যদি কোনও গুণ থাকে তবে সেটা সাধারণ মানুষই উপভোগ করবে, মনে করে রাখবে—এইটে ভেবেই সান্ত্বনা পাই।

(‘আনন্দলোকে’র সৌজন্যে)

হিতৈষী ও পরোপকারী – দীপঙ্কর দে

 ভানুদা, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানুদার বয়স কত?

 ভানুদার বয়স—বাড়তে পারে না। হতে পারে না। যিনি আজীবন নিজে না হেসে অপরকে হাসিয়েছেন, তিনি শিশুর সারল্য নিয়েই বেঁচে আছেন। থাকবেনও আমাদের মধ্যে বহুদিন, এই আমাদের আবেদন।

শিশু মাত্রেই অমলিন, তাই ভানুদা আমাদের কাছে চিরদিনের উজ্জ্বল বর্তিকা। ব্যক্তিগত-ভাবে যতটুকু জানি, ভানুদার মতো হিতৈষী, পরোপকারী ব্যক্তিত্ব বাংলার চলচ্চিত্র জগতে বিরল।

সামনে সাদাসিধে হলেও প্রজ্ঞা ও প্রতিভায় তিনি অনেক গভীরে মানুষ। অভিনয়জগতের চূড়ান্ত পর্যায়ের শিল্পী। নির্দিষ্ট চরিত্র চিত্রণে তাঁর জুড়ি মেলানো অসম্ভব। আর চরিত্র সৃষ্টিতে কোন চরিত্র তিনি পারেন না, সেটা ভাববার কথা।

কমেডির রাজা – বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

 ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একটা নাম যেটা শুনলেই সবাই হেসে ফেলে।

 এর কারণ কী? কারণ একটাই। সেটা হল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা চিত্রজগতের কমেডির রাজা। আজ পর্যন্ত ভানুদা অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে বহু হিট বহু সুপারহিট আছে। ভানুদার অগুনতি চরিত্র-সৃষ্টির মধ্যে আজও সমানভাবে এবং সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় হল পূর্ববঙ্গের মানে বাঙাল ভাষায় কথা বলা চরিত্র। এই ধরনের চরিত্র তো আরও অনেকে করেন বা চেষ্টা করেন তবে ভানুদার ধারে-কাছেও সেইসব শিল্পী পৌঁছাতে পারেন না। বাঙাল চরিত্রে ভানুদা আনপ্যারালাল নি:সন্দেহে। চিত্রজগতের প্রথম দিক থেকে নিয়ে আজও এই ধরনের চরিত্রে ভানুদা চিরনতুন। যার জন্য আমার পরিচালিত ছবি ‘সোরগোল’-এও ভানুদা এই একই ধরনের একটি চরিত্র করেছেন বম্বের টুনটুনের বিপরীতে। এই চরিত্র ভানু বন্দ্যোপাধায়কে ভেবেই আমায় তৈরি করতে হয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন ভানুদার পাশে আর একটা নাম যুক্ত হলে মনে হত সোনায় সোহাগা। সেই নামটি হল জহর রায়। কমেডির ক্ষেত্রে জহরও জহর ছিল। এই মানিকজোড় থাকলে দর্শক মনে মনে ভেবেই নিত, হাসতে হাসতে তাদের পেট ব্যথা হয়ে যাবে। আজ সেই জহর ভানুদার পাশে নেই, তাই কখনও কখনও ভানুদাকে একটু একা একা মনে হত।

ভানুদার সঙ্গে কাজ করেছি অনেক ছবিতে। ভানুদা আমার সিনিয়ার আর্টিস্ট, কিন্তু যখন আমি পরিচালক তখন দেখেছি ভানুদা মেকআপ থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেক শর্টের আগে ডেকে জিগ্যেস করেছেন—বিশু, এইখানটায় একজ্যাক্টলি কী করব? বা তুমি কী চাও বলো?’ অনেক সিনের আগে আলোচনা করে অনেক ভালো সাজেসান দিয়েছেন। এত নিষ্ঠা আজও ভানুদার মধ্যে আছে। ভানুদার ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’—যে-কোনও দর্শক বলবেন ভানুদা ছাড়া সেই নাটকের কোনও অস্তিত্বই নেই। আজ তাঁর শরীর ভালো নয়। তবুও যে দাপটের সঙ্গে তিনি অভিনয় করে চলেছেন সেটা প্রশংসার যোগ্য।

অনেকে আবার ভানুদাকে খুব পছন্দ করেন না। তার কারণ একটাই, সেটা হল, ভানুদা কারুর মন রেখে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। যা বলেন সামনে বলেন। সেটা শুনতে নিশ্চয়ই সকলের ভালো লাগে না। যাকে প্রশংসা করার শতমুখে প্রশংসা করবেন, যাকে গালাগাল দেবেন সামনে দেবেন। যেটা পছন্দ করেন না সেটা সবার সামনে উঁচু গলায় জানিয়ে দেবেন—এটা আমি পছন্দ করছি না।

ভানুদা অভিনীত বহু ছবি—সেটা লেখা সম্ভব নয় এইটুকু জায়গার ভিতর, তাই লেখা যাচ্ছে না, তবু তারই ভিতর যমালয়ের জীবন্তমানুষ, টাকা আনা পাই, ভানু পেল লটারি, পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, পাশের বাড়ি, বসু পরিবার, ওরা থাকে ওধারে, ইত্যাদি ছবিগুলির নাম করতে হয়।

এই শিল্পী স্টেজ, ফিল্ম ও যাত্রা—সবেতেই অভিনয় করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে সব ক্ষেত্রেই তিনি সাকসেসফুল। এটা কম বড় কথা নয়। কারণ তিন জায়গায় টেকনিক এবং অভিনয়ের ধারা ভিন্ন।

আমি কমেডির এই বিরাট প্রতিভার দীর্ঘায়ু কামনা করি। তিনি যেন এখনও বহু বছর আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে যেতে পারেন।

অতি আপনজন – সমিত ভঞ্জ

 ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়—ভানুদা। দুর্ধর্ষ কৌতুক অভিনেতা বলে দর্শকরা জানেন। তিনি সবাইকে হাসিয়ে বেড়ান। কিন্তু ভানুদা শুধু অভিনেতা নন, তিনি একজন মানবতায় ভরা মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমনই যে, যে-কোনও মানুষকেই অজান্তে জয় করে নেন, আপন করে নেন।

এখনও পর্যন্ত এমন একটি সুন্দর মমতাময় মানুষ ও দাদার সান্নিধ্যে কম এসেছি। ছবির জগতে আমি এসেছি ‘হাটে বাজারে’ ছবি থেকে। সেই ছবিটির আউটডোর হয়েছিল ভুটানে। রেড ব্যাঙ্ক টি এস্টেটে। আমার জীবনের প্রথম ছবি। ভানুদা ছিলেন রুম মেট। নবাগত আমি, বিশিষ্টজনদের শ্রদ্ধা করতাম, সিগারেট খেতাম লুকিয়ে। ভানুদার দৃষ্টি বড় গভীরে। নিজে থেকে বললেন, শুটিং-এর সিনে সকলের সামনে সিগারেট খাস তো? এখানে লজ্জা হল কেন—বয়স হলে ওটায় বাধা নেই!

আউটডোর থেকে ফিরে কলকাতায় আমি নিরাশ্রয়। থাকব কোথায়? ভানুদাই ব্যবস্থা করে দিলেন। নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। চারু অ্যাভেন্যুতে। তাঁর বাড়ির ম্যাজাইন ফ্লোরে প্রায় দেড় বছর ছিলাম।

একবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ভানুদা চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। নিজে হাতে শুশ্রূষা করতে লাগলেন শয্যাশায়ী রোগীকে। বউদি ও ভাইপো-ভাইঝিরাও আমাকে নিজের বাড়ির মানুষের মতোই দেখতেন। এমনকী নিজে রান্না করে খাওয়ার পাটও তুলে দিলেন।

কাজের জন্য স্টুডিয়োতে ঘুরেছি, ভানুদাই নিজে গাড়ি করে নিয়ে গেছেন। চতুর্দিকে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। কাজের সুরাহার পথে প্রধান অবলম্বন আমার ভানুদা।

ভগবানের কাছে প্রার্থনা : আমার এই দাদাটি যেন দীর্ঘজীবী হন। এতে আমরা, চলচ্চিত্র জগতের বহুজনই তাঁর সহৃদয় ভালোবাসা আরও পাব। বাংলার দর্শকরাও অনাবিল আনন্দ ও তাঁর অনবদ্য অভিনয় প্রতিভার আস্বাদন পাবেন।

এক কথা ও অনেক কাজের – শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

 পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়, আমি তখন স্কুলের ছাত্র, একটা নাটক এবং প্রায় সঙ্গে

সঙ্গেই তার চিত্ররূপ পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং সচেতন দর্শকদের বেশ নাড়া দিয়েছিল।

পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জীবনযুদ্ধের কাহিনি ‘নতুন ইহুদী’। ছিন্নমূল নিরপরাধ অসহায় এক পরিবারের জীবনের যন্ত্রণার কথা। রাজনীতির রুপোর খুরপি যাদের মাটি থেকে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল কলকাতার নিষ্ঠুর ইট-কাঠের মধ্যে। তাদের ঘরের আধপাগল একটা ছেলে স্বার্থান্ধ সভ্যতার কামড়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। ভেবেই পাচ্ছিল না কেন দেশ ভাগ হল। কেন তাদের সর্বস্ব গেল? কী তাদের অপরাধ? মার খেয়ে খেয়ে শেষ হওয়ার মুহূর্তে শেষ সম্বলটুকু আঁকড়ে ধরেছিল বুক দিয়ে। পাগলা চোখে তখন তার মরিয়া আগুন ফুঁসছে, শুকিয়ে দিয়েছে শেষ অশ্রুর ফোঁটাটুকু—সভ্যতার হাইকোর্ট দরবারে তার প্রথম ও শেষ বিদ্রোহ জানিয়েছিল একটি সংলাপে—’না দিমু না। জান থাকতে দিমু না।’

ভানুদা – দীনেন গুপ্ত

 এমন একজন মানুষের কথা লেখার সুযোগ পেলাম যার সঙ্গে কাজ করার দিনগুলো আজও স্বরণীয় হয়ে আছে। মানুষটি সবার প্রিয় ভানুদা, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এবারে বুঝতে পাচ্ছেন নিশ্চয় সবাই কার কত কাছের মানুষ। ছোটবেলা থেকেই আমি ওঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ পাই, তারই কয়েকটা ঘটনা।

তখন আমি ছিলাম ক্যামেরাম্যান। বেশ মনে পড়ে, ভানুদার যখন শুটিং হত অন্য ফ্লোর থেকে অনেকে চলে আসতেন আমাদের ফ্লোরে, আর সঙ্গে যদি জহরদা থাকতেন সেদিনের কাজের মাত্রাটাই অন্যরকম হয়ে যেত। তখন ছবিতে ডাইরেক্ট সাউন্ড থাকত। যাঁরা শুটিং দেখতে আসতেন কীভাবে হাসিকে বন্ধ করতেন না দেখলে বিশ্বাসই করানো যাবে না। এই ছবি যখন সিনেমা-হলে পৌঁছোত দর্শকের উল্লাস ভাবা যায় না। ছবি যখন হত, যেমন, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, এত সুন্দরভাবে সাজানো হত, দর্শক বিশ্বাস করতেন। এতে ভানুদার অভিনয় এখনও দর্শকের কাছে স্মরণীয়।

আমি একটা ছবি করেছিলাম ‘আশিতে আসিও না’। ভানুদা নায়ক ছবিতে। এত সুন্দর চিত্রনাট্য করেছিলেন গৌর শী! নায়িকা রুমা গুহঠাকুরতা। ভানুদার মুখে একটা গান ছিল, গেয়েছিলেন মান্নাদা, সুর গোপেন মল্লিক। খুব হিট করেছিল। এরপর অনেক ছবি করেছি একসঙ্গে। একটা ছবি আজও সবার মন জয় করে আছে, শংকরের চৌরঙ্গীর ন্যাটাহরি প্রথম থেকে দর্শকের যা চাহিদা ভানুদা পূরণ করে ন্যাটাহরি যখন করবী আত্মহত্যা করে মারা যায় সিনটা শেষ হয় ন্যাটাহরি অর্থাৎ ভানুদার ওপর এত সুন্দর সংলাপ। দর্শকের দু-চোখ জলে ভরে যেত। পিনাকী মুখার্জীর সুন্দর চিন্তাধারা, তার সঙ্গে ভানুদার অভিনয়, দুটোই অসাধারণ। এই ধরনের অভিনেতাদের যদি ছবির যে-কোনও চরিত্রে পাওয়া যেত চিত্রনাট্যকার পরিচালকরা সুন্দর ব্যবহার করতেন, সেটা এখন আর তেমন সাড়া পাওয়া যায় না কমেডির ছোঁয়া এখন যে ছবি হয় একটা কথা পরিষ্কার মনে আছে ভানুদার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় সলিল সেন নেপাল নাগ ওরা একটা নাটক করেছিলেন ‘নতুন ইহুদী’ তাতে সুশীল মজুমদার সাবিত্রী চ্যাটার্জী প্রথম নাটক বাঙলা দেশ থেকে আসা উদবাস্তুদের ওপর কাহিনি লিখেছিল তুলসী লাহিড়ী সবাইকার অভিনয়ে একবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তাতে ভানুদার অভিনয় একেবারে অসাধারণ।

তারপর যতদিন যায় ভানুদার প্রতিটি ছবি একবারে সবার মনে দাগ রেখে যায়। একদিনের একটা ঘটনা বেশ মনে আছে, চৌরঙ্গীর শুটিং হচ্ছিল গ্রান্ড হোটেলে। সারাদিন কাজ চলছে। পরিচালক বললেন আমাকে, সিঁড়িতে ভানুর নেমে আসার একটা শট নিতে হবে। লাইট করে কেলো, আমি লাইট করা শেষ করছি হঠাৎ দেখি ভানুদা পুরো মেকআপ তুলে ওপর থেকে নামছে। আমি তো অবাক। আমি তাকিয়ে আছি, ভানুদা বললে, কী রে দেখছিস কী? আমি বলি তোমার তো শট আছে। লাইট করে ফেলেছি। তুমি মেকআপ তুলে ফেললে! একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে আরে অ্যাসিস্ট্যান্টরা বলে দিল আমার প্যাকআপ। একটু ভেবেই বললে, আমি এখুনি আসছি। মেকআপ করে প্রায় ছুটে ওপরে চলে যায়। আজকের দিনে ওর মতো অভিনেতার এই ব্যবহার আর ভাবা যায় না—সবই স্মরণীয় হয়েই রইল।

ভানুদাকে খোলা চিঠি – সলিল দত্ত

 শ্রদ্ধেয় ভানুদা,

আপনি যেখানেই থাকুন, এই চিঠি ঠিক আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। এখনকার বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিছু খবর আপনাকে দেওয়ার আছে, কেননা আপনিই তো চলচ্চিত্রজগৎ, মঞ্চজগৎ, যাত্রাজগৎ—সব জগতেরই একজন আদরণীয় পুরুষ ছিলেন। এককথায় সত্যিকারের সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন। আপনি ভালোভাবেই জানেন, হাসির রাজা আর আমাদের মধ্যে নেই। তাই এখানে নির্ভেজাল হাসির বড় আকাল চলছে।

রাজা নেই, কিন্তু ভাঁড়েরা আছেন। পর্দার বুকে তারা বলাৎকার করে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে রক্তস্রোতের ওপর দাঁড়িয়ে হা: হা: করে অট্টহাসি হাসছে—তা দেখে দর্শকের মুখের হাসি শুকিয়ে যাচ্ছে, ভয়ের রেখা ফুটে উঠছে। আপনি যেখানে আছেন, সেখানে মরজগৎ ছেড়ে চলে যাওয়া মায়াচ্ছন্ন বিষণ্ণ কিছু কিছু মুখে নিশ্চয় হাসি ফুটিয়ে তুলছেন। এখানে প্রধান বিচক্ষণ কিছু অভিনেতা সঠিক সংলাপ না পেয়েও শুধুমাত্র বাচনভঙ্গি আর মুখাভাবে কিছু হাস্যমুহূর্ত রচনার চেষ্টা করেন কিন্তু বেশিরভাগই দুর্বল চিত্রনাট্যর জন্য তা-ও বিফলে যায়।

ছোটবেলা থেকে আমি ছবি দেখছি। আপনার অভিনীত সব ছবির নাম আজ আর মনেই নেই। তবু মনে পড়ে ‘মাসিমা মালপো খামু’ কিংবা কোর্টে সাক্ষী দিতে গিয়ে ‘আমরা হলাম গিয়া রাজারামপালের বংশ। অতি উচ্চ বংশ! রাজবংশ! আমি মিথ্যা কমু?’

চিত্রনাট্যের সূত্র ধরে আসা এমন কত শত আপনার মুখের সংলাপ দর্শকদের মধ্যে নির্ভেজাল হাসির ফোয়ারা ছুটিয়েছে। সেই ‘পাশের বাড়ি’ থেকে যমালয় ফেরত জীবন্ত মানুষটি আমার পরিচালনায় ‘স্ত্রী’ ছবিতে সংসারবাবু সেজে সপারিষদ জহর রায়কে নিয়ে সংসার করেছেন। রতনে রতন চেনে, যেমন আপনি চিনেছিলেন জহর রায়কে। জহর রায় চিনেছিলেন আপনাকে। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট।’ আজকের দিনে কেউ কি কল্পনা বা সাহস করবেন দুজন কমেডিয়ানের ওপর নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ছবি তৈরি করতে আর তা থেকে সাফল্য অর্জন করতে?

সেটা ১৯৬৫ সাল। আমার ছবি ‘প্রস্তরস্বাক্ষর’-এ আপনি, শ্রীভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনয় করলেন। তারপর ‘স্ত্রী’ ১৯৭১ সালে। ‘অপরিচিত’ ‘কলঙ্কিত নায়ক’ ‘খুঁজে বেড়াই’ হয়ে গেছে। এই ছ’বছর হাসির রাজা আমার ছবিতে অনুপস্থিত। কারণ হয়তো চিত্রনাট্যে তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু সুযোগ যখন এল ‘স্ত্রী’ ছবির সময়, তখন অন্য এক জটিলতার সৃষ্টি হয়ে গেছে। আপনি এখন সবকিছু বিস্মৃত, আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন মানুষের অবশ্যই কিছু রাজনৈতিক সচেতনা থাকা উচিত, কিন্তু তারজন্য এমন কোনও চিন্তা মনে না আসে, যাতে দুধ কেটে গিয়ে জল আর ছানা আলাদা না হয়ে যায়। দু:খের বিষয় তাই ঘটে গেল। ১৯৬৮ সালে ‘চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতি’র আন্দোলন শিল্পী কলাকুশলীদের এমনই পরিস্থিতির শিকার করে ফেলল। আমার ‘অপরিচিত’ ছবির মুক্তি দু’বছরের জন্য আটকে গেল, আর ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ যথা সময়ে মুক্তি পেল। প্রাচীন সংস্থা ‘অভিনেত্রী সঙ্ঘ’ দুভাগ হয়ে গেল। ‘শিল্পী সংসদ’-এর জন্ম হল। ফতোয়া জারি হল, দুটো সঙ্ঘের মেম্বার কোনও শিল্পী অন্য সঙ্ঘের শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে পারবে না। আন্দোলনের সময় কুৎসিত মন্তব্যসহ শিল্পীদের নামে নামে পোস্টারে স্টুডিয়ো, সিনেমা হলের দেওয়াল ছেয়ে গেল।

বিশ্বাস করুন, বড় ব্যথিত হয়েছিলাম। একজন শিল্পী বা কলাকুশালী যে-কোনও মতবাদেই বিশ্বাসী হোন না কেন, তাঁর সহকর্মী সহঅভিনেতার গুণের প্রতি সম্মান ও স্বীকৃতি জানাবার একটা ন্যূনতম মানসিকতাও তো তাঁর থাকবে। জানি, সেদিন আপনারা প্রায় সকলেই আমার মতো এধরনের চিন্তায় অন্তরে ব্যথা অনুভব করতেন, কিন্তু বড় বড় কিছু পরিবেশক প্রযোজকের চাপের কাছে সমবেতভাবে কিছু করে উঠতে পারেননি। ফলে এইভাবেই বেশ কিছুদিন ছবি হতে থাকল। তখন আমার সময়টা বেশ ভালো ছিল। ‘কলঙ্কিত নায়ক’ ছবি করতে গিয়ে আমিই প্রথম মনের প্রশ্নটা তুললাম। কাজ হল। শিল্পী সংসদের উত্তমকুমার আর অভিনেত্রী সঙ্ঘের অনুপকুমার আবার একসঙ্গে কাজ করলেন। পুরোনো প্রীতির সম্পর্ক আবার ফিরে এল। ঠিক অনুরূপভাবেই ‘স্ত্রী’ ছবিতে আপনি, সৌমিত্র আর উত্তমকুমার, জহর রায় আবার একত্র হলেন। ‘ভ্রান্তি-বিলাস’-এর অবসান ঘটল।

উত্তমকুমারের মন সাধারণ মধ্যবিত্তের সরল মন। আর স্বভাবে আপনি ভানুদা ভীষণ মিশুকে রসিক মানুষ। শুটিং-এর ফাঁকে ফাঁকে আপনার হিউমারের ছোঁয়ায় জমে থাকা সমস্ত কাদা পরিষ্কার করে দিলেন।

শুটিং-এর সময় পরিচালকরা সাধারণত চিন্তাভাবনায় একটু টেনসড হয়ে থাকেন। হয়তো কখনও সখনও আমিও একটু গম্ভীর চিন্তিত থাকতাম, আর সেটা লক্ষ করে তখনি আপনি সামনে এসে বলতেন : ‘একটা কথা বলব?’ নিশ্চয় কাজের কথা মনে করে আমিও শশব্যস্তে বলতাম : ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না ভানুদা।’ ছোটবড় সবাইকে আপনি সম্মান করতেন, কিন্তু মুখের ভাবে আপনারই বিশিষ্টতা ফুটিয়ে তখন বলতেন : ‘Disturb feel করবেন না তো?’

আমি অমন কাঁচুমাচু মুখ দেখে শশব্যস্তে বলতাম : ‘না-না-বলুন না—’

সঙ্গে সঙ্গে আপনি দু-চার কথায় এমন একটা হিউমারাস ঘটনার কথা বলতেন যে, কার সাধ্য গম্ভীর মুখে কোনও চিন্তায় থাকতে পারে! আশেপাশের সকলেই তখন আমার সঙ্গে নির্ভেজাল হাসি হাসতে থাকে। এমন কত গল্পই যে আপনার স্টকে ছিল, তার কোনও হিসাব নেই। আপনাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে কোনওদিন শরীরে ক্লান্তি অনুভব করিনি।

আপনারা বেশ খানিকটা জায়গা আমাদের মধ্যে থেকে খালি করে চলে গেছেন। এই পত্র মারফত আপনাকে জানাই, সেই খালি জায়গাটা এখনও ভরাট হয়নি।

বিনীত

সলিল দত্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *