০৮. আমার নাম সুলতান

আমার নাম সুলতান

সাধারণত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের এ জাতীয় নাম থাকে। সুলতান, সম্রাট, বাদশাহ্। বাবা মা ভাবেন বড় হয়ে ছেলে রাজা বাদশাহ্ হবে। আমি কোনো গরিব ঘরের সন্তান ছিলাম না। বিত্তশালী পরিবারর সন্তান ছিলাম। আমার বাবা মার সন্তানদের নামকরণের মতো তুচ্ছ বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। আমরা অনেকগুলি ভাই-বোন ছিলাম। মা প্রতিবছর একটি করে সন্তান প্রসব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকেই মাকে বিছানায় শোয়া পেয়েছি। নিজের সন্তানদের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। তাঁর মন এবং শরীর দুইই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে তিনি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা শুরু করলেন।

আমরা থাকতাম পুরোনো ঢাকার একটা বাড়িতে। সেই বাড়িটিও বিশাল। সেই বাড়িও উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। আমাদের পড়াশোনার জন্যে ঢাকায় এনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই দিকে কারো নজর ছিল বলে মনে হয় না। বাবা ব্যস্ত তাঁর ব্যবসা নিয়ে। আজ ঢাকা, কাল নারায়ণগঞ্জ, পরশু খুলনা এই অবস্থা। মা বিছানায়। বাড়ি ভর্তি কাজের লোক। এরা পান খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা ছাড়া কিছু করে না। সন্ধ্যার পর দুজন প্রাইভেট টিউটর আসেন। তাঁরা চা পানি খান। বেত নিয়ে হাম্বিতাম্বি করেন। সপ্তাহে তিন দিন আসেন একজন মওলানা। তাঁর বিরাট দাড়ি, চোখে সুরমা। তিনি আমাদের কোরান শরীফ পাঠ করা শেখান। বিরাট বিশৃঙ্খলার ভেতরে আমরা বড় হচ্ছি। তবে বিশৃঙ্খলারও নিজস্ব ছন্দ আছে। কোথাও ছন্দ পতন হচ্ছে না। একদিন হল—আমার বড় বোন মারা গেল, ভালো মানুষ—সারাদিন কাজকর্ম করেছে। মওলানা সাহেবের কাছে সিপারা পড়েছে। রাতে এশার নামাজ পড়ে ঘুমুতে গিয়েছে, সেই ঘুম আর ভাঙল না।

বাবা তখন চিটগাং-এ। তিনি খবর পেয়ে কাজকর্ম ফেলে চলে এলেন। তাঁকে কন্যা শোকে অধীর বলে মনে হল না, তিনি শুধু বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলেন আর বারবার বলতে লাগলেন—সমস্যাটা কী? ঘটনাটা কী?

বড় বোনের মৃত্যুর পেছনে কোনো সমস্যা বা ঘটনা হয়তো ছিল, আমি নিতান্তই শিশু বলে বুঝতে পারি নি। আমার বড় বোনের নাম মীরু। তার তখন আঠার উনিশ বছর। সমস্যারই সময়। আমার ধারণা ভালো কোনো সমস্যাই ছিল।

বড় বোনের মৃত্যুর ঠিক ছমাসের মাথায় মারা গেল আমার মেজো ভাই। তার নাম ইজাজত। স্কুল থেকে ফেরার পথে রিকশার ধাক্কা খেয়ে নর্দমায় পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেল। বাসায় এসে কয়েকবার বমি করে চোখ উল্টে দিল। বাবা শোকে যে অভিভূত হলেন তা না, চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, সমস্যাটা কী? ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যায় এটা ঠিক আছে। কিন্তু রিকশার নিচে পড়ে মৃত্যু এটা কেমন কথা? আর কিছু না অভিশাপ লেগে গেছে। মহাঅভিশাপ লেগে গেছে। এই বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না।

সেই বছরের শেষ দিকে আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি মারা গেল। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলা চলে। ডিপথেরিয়ায় মৃত্যু। ছোটবোনের মৃত্যুর পর বাবা সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ঠিক হল ঢাকায় নতুন কোনো বড় বাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকব। অভিশাপ লাগা বাড়িতে ফিরে যাব না। গ্রামের বাড়িতে আমাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দেবার জন্যে সার্বক্ষণিক একজন শিক্ষক রাখা হল তার নাম ইদরিশ। মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টার। বাবা তাঁকে ডেকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে দিলেন—শিশুদের শাসনে রাখতে হবে। কঠিন শাসন। পড়াশোনা না করলে, বেয়াদবি করলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। কোনো অসুবিধা নেই। শিশুদের দুইটাই অষুধ। একটা কৃমির অষুধ, আরেকটা মার।

মুহম্মদ ইদরিশ অত্যন্ত উৎসাহে তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। প্রতিদিনই তিনি নির্যাতনের নানান কৌশল বের করতে লাগলেন। দুই হাতে ইট নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা দিয়ে শুরুটা করলেন। হাতের ইট তাঁর পায়ে ফেলে দিয়ে তাঁকে প্ৰায় খোঁড়া করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম বলেই হয়তো আমার শাস্তির ব্যাপারে তিনি বিশেষ যত্নবান হলেন। এমন সব শাস্তি যা অনেক চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা করে বের করতে হয়। চট করে মাথায় আসে না।

আমাকে তিনি এক বিকালে বিশেষ এক ধরনের শাস্তি দেবার জন্যে মন্দিরে নিয়ে ঢুকলেন। গা থেকে শার্ট খুলে খালি গা করলেন। দড়ি দিয়ে দুই হাত পেছনমোড়া করে বাঁধলেন। তারপর দুটা প্রকাণ্ড বড় মাকড়সা সুতা দিয়ে বেঁধে আমার গলায় মালার মতো পরিয়ে দিয়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।

আমার মাকড়সা ভীতি আছে। এই নিরীহ প্রাণী মানুষের কোনোই ক্ষতি করে না কিন্তু যারা একে ভয় পায় তাদের কাছে এরা রাজ্যের বিভীষিকা নিয়ে উপস্থিত হয়। যে কারণে মাকড়সা ভীতির আলাদা নাম পর্যন্ত আছে।

প্রথম কিছুক্ষণ আমার মনে হল আমি বোধহয় এক্ষুনি মারা যাব। সুতা দিয়ে বাঁধা মাকড়সা দুটা সারা গায়ে কিলবিল করছে। গলা বেয়ে মুখের দিকে উঠতে চেষ্টা করছে। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি, গলা দিয়ে সামান্যতম শব্দও বের হচ্ছে না। আমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে দরজায় আছড়ে পড়ি। সেটা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ আমার হাত-পা জমে গিয়েছিল। ঘর অন্ধকার। আমি চোখে কিছুই দেখছি না, কিন্তু অদ্ভুত কারণে মাকসড়া দুটাকে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তাদের গা থেকে হালকা সবুজ আলো বের হচ্ছে। এই সময় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল—চোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি—যুবতী মেয়ে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই, তার জন্যে কোনো লজ্জাও নেই। তার মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা চুল। সেই চুল মুখের উপর পড়ে আছে বলে মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা বলল, মাকড়সা তো সামান্য পোকা। তুই ভয়ে দেখি মরে যাচ্ছিস?

আমি বললাম, আপনি মাকড়সা দুটা ফেলে দিন। আপনার পায়ে পড়ি।

নারীমূর্তি বলল, পায়ে পড়ে লাভ হবে না। আমি মাকড়সা হাত দিয়ে ছোঁব না। স্নান করে এসেছি। হাত নোংরা হবে। তুই মাকড়সার দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল। তাহলে ভয় কমবে।

আমি বললাম, আপনি কে?

নারীমূর্তি চাপা গলায় বলল, আমি গৌর কালী। কী আশ্চর্য তুই তো দেখি মাকড়সার ভয়ে মরেই যাচ্ছিস! পেচ্ছাব করে মন্দিরও অপবিত্র করে ফেলেছিস। তুই কেমন ছেলে বল দেখি। মাকড়সার ভয়ে কেউ পেচ্ছাব করে? ছিঃ!

আমি বললাম, আপনি একটা কাঠি দিয়ে মাকড়সা দুটা ফেলে দিন।

নারীমূর্তি চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল—পাগলের মতো কথা বলবি না। আমি এখন কাঠি পাব কোথায়? কাঠি খুঁজতে হলে মন্দিরের বাইরে যেতে হবে। কুয়ার পাড়ে তোর মাস্টার বসে আছে। আমি নেংটো হয়ে তার সামনে যাব নাকি? তোকে একটা বুদ্ধি দেই শোন—এই মাস্টার তোকে আরো অনেক যন্ত্রণা দেবে। যন্ত্রণা দেবার আগেই ব্যবস্থা করে ফেল।

কী ব্যবস্থা?

মাস্টারকে প্রায়ই দেখি কুয়ার ওপর বসে থাকে। আচমকা ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে কুয়ার ভেতর ফেলে দিবি। পারবি না?

না।

না পারার কী আছে? এক ধাক্কায় সব সমস্যার সমাধান। খুবই গহিন কুয়া। নিচে বিষাক্ত গ্যাস। একবার পড়লে আর দেখতে হবে না। কাজটা যে তুই করেছিস সেটাও কেউ বুঝবে না। ভাববে নিজে নিজে পড়ে গেছে। আমার অবিশ্যি ধারণা কেউ কোনোদিন জানবেও না যে এইখানে একজন মানুষ পড়ে আছে।

মন্দিরের ভেতরের স্মৃতি এরপর আমার কিছু মনে নেই। হয়তো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। এই ঘটনার তৃতীয় দিনের দিন আমি মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারকে ধাক্কা দিয়ে কুয়ায় ফেলে দেই। কুয়াটা খুব গভীর তো বটেই, ধাক্কা দেওয়ার অনেক পরে ঝপাং শব্দটা কানে আসে। ও আল্লাগো ও আল্লাগো শব্দটি দুবার শোনা যায়। তারপর সব নিস্তব্ধ। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে কুয়ার পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। তারপর ঘরে চলে আসি।

মাস্টার সাহেব বাড়িতে নেই এটা নিয়ে বাড়ির কাউকেই উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না—কারণ তখন আমার মায়ের শরীর খুবই খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখন মারা যান তখন মারা যান অবস্থা। মওলানা ডাকা হয়েছে। মওলানা তওবা করিয়েছেন। খবর পেয়ে বাবা চলে এসেছেন ঢাকা থেকে। মা সেই যাত্রা রক্ষা পেয়ে যান। বাবা উৎফুল্ল মনে ঢাকায় ফিরে যান। যাবার আগে আরেকজন নতুন মাস্টার ঠিক করে যান। মুহম্মদ ইদরিশের বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সে ভালো কোনো সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। নিমকহারাম টিমকহারাম বলে তাকে অনেক গালাগালিও করেন।

মার শরীর আরেকটু ভালো হলে আমরা আবার ঢাকা শহরে চলে আসি। মুহম্মদ ইদরিশ কুয়ার ভেতরে থেকে যায়। তার বিষয়ে কেউ কিছুই জানে না। আমি নিজেও ব্যাপারটা ভুলে যাই। একবার শুধু রাতে মন্দিরে দেখা নারীমূর্তিকে স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নটা এ রকম—আমি মন্দিরের বারান্দায় বসে পেয়ারা খাচ্ছি। নারীমূর্তি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। পরিচিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, এই বাঁদর! আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি বললাম চিনতে পারছি।

অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন? নাকি আমার গায়ে কাপড় নেই বলে তাকাতে লজ্জা লাগছে?

আমি বললাম, লজ্জা লাগছে।

চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল তাহলে লজ্জা লাগবে না। এখন বল দেখি ইদরিশ মাস্টারের উচিত শিক্ষা হয়েছে না?

আমি বললাম, হয়েছে।

দেখলি কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে নি।

হুঁ।

মানুষের শরীর পচে গেলে খুবই দুর্গন্ধ হয়। কুয়াটা তো অনেক গভীর এই জন্যে পচা গন্ধ নিচে জমে আছে উপরে আসতে পারছে না। বুঝতে পারছিস?

হুঁ।

আমি তোকে একটা বিষয়ে সাবধান করতে এসেছি।

কোন বিষয়ে?

তুই কুয়ার ধারে একা একা যাবি না।

গেলে কী হবে?

ইদরিশ মাস্টার তোকে ডাকবে। তুই বাচ্চা মানুষ তো। ডাক শুনে ভয়টয় পেতে পারিস।

আচ্ছা কুয়ার ধারে যাব না।

কখনো কোনোদিনও কুয়ার ভেতরে কী আছে উঁকি দিয়ে দেখতে যাবি না। দেখতে গেলেই মহাবিপদ।

আচ্ছা দেখতে যাব না।

ইদরিশ মাস্টারের প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ। অনেক বছর পর ইদরিশ মাস্টারর প্রসঙ্গটা আমার আবার মনে আসে। তখন আমি বিলেতে পড়াশোনা করছি। কোনো এক উইক এন্ডে হঠাৎ একটা বই হাতে এল—বইটার নাম The crystal door. বইটার লেখক কিংস কলেজের একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট — James Hauler. তিনি এই বইটিতে বললেন—মানুষের মনের কিছু দরজা আছে যা সহজে খোলে না। মানুষ যদি কোনো কারণে ভয়ঙ্কর কোনো চাপের মুখোমুখি হয় তখনি দরজা খুলে যায়। তিনি এই দরজার নাম দিয়েছেন crystal door.

জেমস হাউলার বলছেন—এই স্ফটিক দরজার সন্ধান বেশির ভাগ মানুষ সমগ্র জীবনে কখনো পায় না। কারণ বেশির ভাগ মানুষকে তীব্র ভয়াবহ মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় না। জেমস হাউলার মনে করেন মানুষের কাছে দুধরনের বাস্তব আছে। একটি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা, আরেকটি অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা। স্বপ্ন হচ্ছে সে রকম একটি অদৃশ্য জগত এবং সেই জগতও দৃশ্যমান জগতের মতোই বাস্তব। স্ফটিক দরজা বা crystal door হল অদৃশ্য বাস্তবতার জগতে যাবার একমাত্র দরজা। এই সাইকিয়াট্রিস্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খোলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেন। তার উপর গবেষণা করছেন।

মনের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টির জন্যে তিনি উৎসাহী ভলেন্টিয়ারকে একটি সাত ফুট বাই সাত ফুট এয়ার টাইট ধাতব বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে দেন। বাক্সের ভেতরটা ভয়ংকর অন্ধকার। বাইরের কোনো শব্দও সেখানে যাবার কোনো উপায় নেই। পরীক্ষাটা কী, কেমন ভাবে হবে তার কিছুই ভলেন্টিয়ারকে জানানো হয় না। সে কোনো রকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই বাক্সের ভেতর ঢোকে। তারপর হঠাৎ লক্ষ করে বাক্সের ভেতর পানি জমতে শুরু করছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। ভলেন্টিয়ার বাক্সের ভেতর দাঁড়ায়। ডাকাডাকি করতে শুরু করে। বাক্সের ডালায় ধাক্কা দিতে থাকে। কোনো উত্তর পায় না। এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে তার গলা পর্যন্ত চলে আসে। সে প্রাণে বাঁচার জন্যে পায়ের আঙুলে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। পানি বাড়তেই থাকে। পানি নাক পর্যন্ত যাবার পর পরীক্ষাটা বন্ধ হয়। তীব্র ভয়ে ভলেন্টিয়ার দিশাহারা হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ত্রিশভাগ ভলেন্টিয়ার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ নিজেকে বাক্সের বাইরে আলো ঝলমল একটা জগতে দেখতে পায়। যে জগতের আলো পৃথিবীর আলোর মতো না। সেই আলোর বর্ণ সোনালি। সেই জগতের বৃক্ষরাজি পৃথিবীর বৃক্ষরাজির মতো না। সেই জগত অদ্ভুত অবাস্তব এক জগত। যেখানে অস্পষ্ট কিন্তু মধুর সঙ্গীত শোনা যায়। শতকরা দশভাগ ভলেন্টিয়ার নিজেদের আবিষ্কার করেন অন্ধকারে ধূম্রময় এক জগতে। সেই জগত আতঙ্ক এবং কোলাহলের জগত। বাকি ষাট ভাগ কিছুই দেখে না। তারা আতঙ্কময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে আসে।

আমি জেমস সাহেবের বইটি পড়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে শৈশবে মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টার না জেনেই এ ধরনের একটি পরীক্ষা আমার উপর করেছিল। ভয়াবহ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে স্ফটিক দরজা খোলার ব্যবস্থা করেছিল। আমি আমার পাঠ্য বিষয় গণিতশাস্ত্রের চেয়ে প্যারাসাইকোলজির বিষয়ে বেশি আগ্রহ বোধ করতে থাকি। এ ধরনের বইপত্র যেখানে যা পাই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। এটা করতে গিয়ে অনেক ভালো বই যেমন পড়েছি—অনেক মন্দ বইও পড়েছি। ভালো বই পড়ার উদাহরণ হিসেবে বলি—মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মানসিক জগত নিয়ে লেখা পেরিনের অসাধারণ বই Death call. পেরিন দেখিয়েছেন মৃত্যুর দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষদের মানসিক রূপান্তর একই ধারায় হয়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে আসার পর হঠাৎ মনে হয় মানুষগুলি আর এ জগতে বাস করছে না। তারা অন্য কোনো জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। যে জগতটির সঙ্গে পৃথিবীর জগতের কোনোই মিল নেই। তাদের সেই জগতটি সত্য বলে মনে হয়।

পেরিনের লেখা আরেকটি বইও আমাকে আলোড়িত করেছিল। এই বইটি ক্যানসারে আক্রান্ত রুগীদের নিয়ে লেখা। রুগীরা জানেন তাদের মারণ ব্যাধিতে ধরেছে। বাঁচার কোনো আশা নেই। তারপরেও মনের গভীর গোপনে বেঁচে থাকার আশা পোষণ করেন। তাঁরা ভাবেন একটা কিছু অলৌকিক ব্যাপার তাঁদের জীবনে ঘটবে। ঈশ্বর প্রার্থনা শুনবেন, তাঁদের আরোগ্য করবেন। ক্যানসারের কোনো অষুধ বের হয়ে যাবে। সেই অষুধে রোগমুক্তি ঘটবে। আশায় আশায় বাঁচতে থাকেন। এক সময় হঠাৎ করেই বুঝতে পারেন—কোনো আশা নেই। নিশ্চিত মৃত্যু সামনেই অপেক্ষা করছে। তখন তাঁরা অন্য রকম হয়ে যান। আত্মা তাঁদের ত্যাগ করে। আশা ত্যাগ করার পরও দুএক দিন তাঁরা বাঁচেন। সেই বাঁচা ভয়াবহ বাঁচা। মানুষটা বেঁচে আছে, কথা বলছে, খাচ্ছে ঘুমুচ্ছে কিন্তু মানুষটার আত্মা নেই।

আমার মায়ের বেলায় ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল। আত্মা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার!

বিলেতে পড়াশোনার সময়ই আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলি সুযোগ এবং সুবিধামতো আমি প্যারাসাইকোলজির উপর কিছু কাজ করব। সেই সুযোগের জন্যে আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়।

.

মিসির আলি খাতার উপর থেকে চোখ তুললেন। সুলতান এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সে এসেছে নিঃশব্দে। মিসির আলি সুলতানের ঘরে ঢোকার শব্দ পান নি। সে যখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই বুঝতে পেরেছেন।

সুলতান খাটে বসতে বসতে বলল, সন্ধ্যাবেলা পড়াশোনার জন্যে ভালো না। মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়ছেন দেখে ভালো লাগল। ঘটনাগুলি আমি মোটামুটি ভালোই গুছিয়ে লিখেছি।

মিসির আলি বললেন, আমি যখন কিছু পড়ি মন দিয়েই পড়ি। তুমি গুছিয়ে না লিখলেও আমি মন দিয়েই পড়তাম।

সুলতান বলল, এইখানে আপনার সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। আমি যখন যা করি মন দিয়েই করি। যখন আকাশের তারা দেখি, খুব মন দিয়ে দেখি। যখন মনে করি কারো উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করব তখন সেই কাজটাও খুব মন দিয়ে করি।

ভালো।

সুলতান বলল, ভালোমন্দ বিবেচনা করে আমি কিছু করি না। আমাকে যা করতে হবে সেটা আমি করি। যাই হোক এটা নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে। আপনি একটা কাজ করুন। পুরো খাতাটা এখন পড়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে পড়বেন। আমার ধারণা আপনি পড়ার অনেক সময় পাবেন। এখন শুধু সালমার অংশটা পড়ুন। এই মেয়েটি হচ্ছে আমার বর্তমান গবেষণা সাবজেক্ট। মেয়েটার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তার বিষয়ে আগে জানা থাকা ভালো।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করতে করতে বললেন, তোমাদের ঐ কুয়াতে কি শুধু মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারই আছে? নাকি আরো অনেকে আছে?

সুলতান হাসি মুখে তাকিয়ে রইল—জবাব দিল না। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব মজার কোনো কথা শুনল।

মিসির আলি বললেন, তোমার স্ত্রী কোথায়? লিলি?

সুলতান হাই তুলতে তুলতে বলল, ও অসুস্থ।

মিসির আলি বললেন, তোমার পরীক্ষা নিরীক্ষায় লিলি সাহায্য করে না?

সুলতান বলল, ওর সাহায্যের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। ও ভলেন্টিয়ার যোগাড় করে আনে। আপনাকে যেমন আনল। অবিশ্যি আপনাকে ভলেন্টিয়ার বলা ঠিক হচ্ছে না। বিপজ্জনক কাজে ভলেন্টিয়ার পাওয়া যায় না—জোর করে বানাতে হয়। আপনি অকারণে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। সালমার বিষয়ে কী লিখেছি তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলুন। এক শ ছয় পৃষ্ঠায় পাবেন। আমি বরকতকে দিয়ে হারিকেন পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভালো কথা চা খাবেন? আপনাকে আজ মনে হয় বৈকালিক চা দেওয়া হয় নি। লিলি অসুস্থ হওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে। খাবারদাবারের ব্যবস্থাটা খানিকটা এলোমেলো হয়েছে।

সুলতান উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি হারিকেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সালমার বিষয়ে কী লেখা আছে মন দিয়ে পড়তে হবে। মিসির আলি খাতা খুললেন। এক শ ছয় পৃষ্ঠা বের করলেন। এখনো ঘরে কিছু আলো আছে, পড়া শুরু করা যেতে পারে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই হারিকেন চলে আসবে।

স্যাম্পল নাম্বার ৭
নাম : সালমা
বয়স : পনের থেকে ষোল
পড়াশোনা : নবম শ্রেণীর ছাত্রী
বুদ্ধি : ভালো। বেশ ভালো।

জীব হিসেবে মানুষকে যতটা ভঙ্গুর মনে করা হয় সে তত ভঙ্গুর না। মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করা কঠিন কাজ। মস্তিষ্কের ডিফেন্স ম্যাকানিজম প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রবল। মানসিক চাপ প্রতিরোধে সে তার সমগ্র শক্তি নিয়োগ করে। আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষের এই ক্ষমতা অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। সালমার বিষয়েও একই ব্যাপার ঘটেছে। তার উপর সৃষ্টি করা মানসিক চাপ সে নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজমের মাধ্যমে প্রতিহত করছে। আমি প্রতিদিনের পর্যবেক্ষণ লিখে যাচ্ছি।

১৮.৪.৮০

সালমাকে প্রথম সংগ্রহ করা হল। সংগ্রহ পদ্ধতি অবান্তর বলে উল্লেখ করছি না। বাবা-মা-ভাই-বোন ছেড়ে হঠাৎ এই নতুন জায়গায় উপস্থিত হয়ে সে প্রথমে খুবই ঘাবড়ে গেল। আমি অতি দ্রুত তার ভয় দূর করলাম। তাকে বলা হল আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাবা মাকে খুঁজে বের করে তাকে তাদের কাছে পাঠাব। মেয়েটি মিশুক প্রকৃতির। প্রাথমিক শঙ্কা ও ভয় সে দ্রুত কাটিয়ে উঠল। রাতে অনেকক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করলাম। পড়াশোনার খোঁজ নিলাম। সে জানাল যে তার ভীতির বিষয় একটাই তা হল অংক। তার ধারণা সে এস.এস.সি.তে সব বিষয়ে পাস করলেও অংকে ফেল করবে। আমি তার অংক ভীতি কাটানোর জন্যে অংক নিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। নয় সংখ্যাটির অদ্ভুত গুণ ব্যাখ্যা করলাম। যেমন ৯ এমন একটা সংখ্যা যাকে যে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে এবং গুণফলের সাথে সংখ্যাগুলিকে যোগ করলে আবার ৯ হয়।

৯ × ৬ = ৫৪; ৫ + ৪ = ৯

৯ × ১৬ = ১৪৪; ১ + ৪ + 8 = ৯

সালমা এতে খুবই মজা পেল। নিজেই ব্যাপারটা পরীক্ষা করল। এবং জানতে চাইল—৯-এর বেলায় এরকম কেন হচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে মেয়েটির বুদ্ধি ভালো। অল্প বুদ্ধির মেয়ে অংকের এই ব্যাপারটা ধরতে পারত না।

১৯-৪-৮০

আজ সালমার উপর প্রথম মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হল। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম সে কুমারী কি না। প্রথম কিছুক্ষণ প্রশ্নটা সে ধরতেই পারল না। তাকে কুমারী বলতে কী বোঝাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার পর সে হতভম্ব হয়ে গেল। সে কল্পনাও করে নি এ ধরনের কোনো প্রশ্ন আমি তাকে করতে পারি। সে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি কঠিন ধমক দিয়ে তার কান্না থামিয়ে খুবই শান্ত গলায় বললাম যে তাকে এখানে আনা হয়েছে গৌর কালীর মন্দিরে দেবীর উদ্দেশে বলি দেওয়ার জন্যে। বলিদানের জন্যে কুমারী মেয়ে প্রয়োজন বলেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।

তাকে দেবীমূর্তি দেখিয়েও আনলাম। সে জানতে চাইল কবে বলি দেওয়া হবে। আমি বললাম অমাবস্যায়। মেয়েটি সারারাত অচেতনের মতো পড়ে রইল। তার শরীরের উত্তাপ বাড়ল। রাতে ভুল বকতে থাকল।

২০-৪-৮০

সকালবেলা মেয়েটা আমার সঙ্গে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করল এবং ভীত গলায় বলল—গত রাতে সে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। দুঃস্বপ্নে একজন কেউ তাকে এসে বলেছে যে তাকে মা কালীর কাছে বলি দেওয়া হবে। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, চাচা এমন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কেন দেখলাম?

মেয়েটির নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজম কাজ করতে শুরু করেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়েছে কাল রাতের ঘটনাটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না।

দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়া যেতে পারে, তবে দুঃস্বপ্ন কেটে গেলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তার সময়টা স্বপ্ন এবং জাগরণ—এই দুইয়ের ভেতর ভাগ করে নিল। যখনই সে ভয় পাচ্ছে তখনি ভাবছে এটা স্বপ্ন, কিছুক্ষণের মধ্যে স্বপ্ন কেটে যাবে এবং সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

২১-৪-৮০

আজ সালমাকে রাতে থাকতে দেওয়া হল মন্দিরে। মন্দিরে সামান্য আলোর ব্যবস্থা রাখা হল। গাঢ় অন্ধকারে মানুষ ভয় পায় না। ভয় পাবার জন্যে আলো-আঁধার প্রয়োজন। কুকুর তিনটা মন্দিরের চারপাশে যেন ঘুরপাক খায় সেই ব্যবস্থা করা হল। মন্দিরের মূল দরজা খোলা। আমার দেখার ইচ্ছা মেয়েটি কী করে। সে তেমন কিছু করল না। সারারাত মূর্তির গা ঘেঁষে বসে রইল। মাঝে মাঝে দেখছি তার ঠোঁট নড়ছে। সে হয়তো কথা বলছে মূর্তির সঙ্গে। আমার ধারণা মূর্তিটাকে সে ভয়ঙ্কর হিসেবে না নিয়ে বন্ধু হিসেবে নিয়েছে। কারণ মূর্তিটা দেখতে লিলির মতো। সালমা লিলিকে চেনে। মূর্তির গা ঘেঁষে বসে থাকার এই একটিই যুক্তি। তাকে অবিশ্যি অমাবস্যা কবে তা জানানো হয়েছে। অমাবস্যার মধ্যরাতে ঘটনা ঘটানো হবে তাও বলা হয়েছে। জেমস হাউলারের বিখ্যাত পরীক্ষার মতো পরীক্ষা। তাঁর পরীক্ষার বাক্সে পানি জমতে শুরু করেছে। আমার পরীক্ষায় অমাবস্যা এগিয়ে আসছে। হা হা হা।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। তাঁর মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন সালমা নামের মেয়েটি আজ রাতেই মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে। সুলতান তার বিখ্যাত পরীক্ষা সালমাকে নিয়ে করছে না। সে পরীক্ষাটি করছে মিসির আলি নামের একজনকে নিয়ে যাকে সে মানসিকভাবে নিজের কাছাকাছি ভাবছে। মিসির আলি মোটামুটি নিশ্চিত যে সুলতান মধ্যরাতে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটাবে তাঁকে ভয় দেখানোর জন্যে। বাচ্চা একটি মেয়ের মানসিক পরিবর্তন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সালমা মেয়েটি তার সাবজেক্ট না। তার সাবজেক্ট মিসির আলি। মেয়েটির মৃত্যুতে তার কিছু যায় আসে না। তার আগ্রহ কৌতূহল মিসির আলিকে নিয়ে। যে কারণে সালমা মেয়েটিকে যোগাড় করার পরই মিসির আলি নামের মানুষটাকে এখানে আনার জন্যে ব্যবস্থা করেছে। সুলতানের মতো মানুষেরা একটা পর্যায়ে বুদ্ধির খেলা খেলতে চায়। আমিই শ্রেষ্ঠ এটা প্রমাণ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এটা তাদের একটা খেলা। শিশুদের সঙ্গে সিরিয়াল কিলারদের কোথায় যেন সামান্য মিল আছে। শিশুদের কাছে যেমন সবই খেলা এদের কাছেও তাই।

সালমা মেয়েটিকে রক্ষা করার কোনো উপায় কি আছে? খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে এবং অতি দ্রুত ভাবতে হবে। হাতে সময় খুব বেশি নেই। সুলতানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি নামতে পারছেন না। মানসিক যুদ্ধ অবশ্যই করা যাবে কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্র কি তাঁর কাছে আছে?

সুলতানের বিষয় অংক। কাজেই যুক্তি ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা। যুক্তির ক্ষমতার প্রতি তার আস্থা অবশ্যই থাকবে। সুলতানের মানসিক দুর্গে তাঁকে পৌঁছতে হবে যুক্তির সিঁড়িতে পা রেখে। এমন যুক্তি যা সুলতানকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি কি পারবেন? মিসির আলি চোখ বন্ধ করে আছেন। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। তিনি অনুভব করলেন তাঁর শরীর কাঁপছে। এটা ভালো লক্ষণ না। এটা বয়সের লক্ষণ। জরার লক্ষণ।

‘দিধ্বং নো অত জরসে নিনেষজ্
জরা মৃত্যুবে পরি নো দদাত্যথ
পক্কেন সহ সংভবেম’

আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে জরায়, জরা নিয়ে যাবে সেই মৃত্যুতে যা আমাকে অসীমের সঙ্গে যুক্ত করবে।

মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। তিনি বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। তাঁর শীত লাগছে। শীতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তিনি গায়ের উপর চাদর টেনে দিলেন। তিনি কিছুক্ষণ ঘুমুবেন। মধ্যরাতের আগেই সুলতান নিশ্চয়ই তাঁকে ডেকে নিয়ে যাবে। হয়তো তখনি সালমার সঙ্গে দেখা হবে। হত্যাকাণ্ডটা যে খুব সহজ হবে তাও মনে হয় না। সুলতানের মতো মানুষেরা ড্রামা পছন্দ করে। হয়তো মেয়েটাকে স্নান করানো হবে। নতুন কাপড় পরানো হবে। গলায় দেওয়া হবে জবা ফুলের মালা। এই ফুল প্রাচীন ভারতের অনেক নররক্তের সাক্ষী। ঘুমের মধ্যে মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, সালমা মাগো, ভয় পেও না। আমি আছি তোমার পাশে। আমি সাধারণ কেউ না মা, আমি মিসির আলি।

.

সুলতান মরিচ ফুল গাছের বেদিতে বসে আছে। তার সামনে হারিকেন। হারিকেনের আলোয় সুলতানের মুখ দেখা যাচ্ছে। আনন্দময় মানুষের মুখ। সে হাত দিয়ে মাথার চুল টানছে। কিন্তু তাতে কোনো অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে না। সুলতানের সামনে দুটা পিরিচে ঢাকা কফির মগ। মিসির আলি এসে বেদিতে বসলেন। সুলতান কফির মগ মিসির আলির হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি এর মধ্যে দুবার খোঁজ নিয়েছিলাম। দেখলাম আপনি ঘুমাচ্ছেন। স্যার আপনার ঘুম কি ভালো হয়েছে?

হ্যাঁ ভালো হয়েছে।

সুলতান হাসিমুখে বলল, এমন পরিস্থিতিতে কেউ ঘুমুতে পারে আমার ধারণা ছিল না।

মিসির আলি বললেন, পরিস্থিতি কি খুব খারাপ?

খারাপ তো বটেই, আজ অমাবস্যা না? আমি সালমা মেয়েটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ও আসলে আমার পরীক্ষায় কোনো কাজে আসছে না। তাকে তো আর ফেরতও পাঠাতে পারি না। এই রিস্ক আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। কাজেই অন্য ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। কফি খেতে কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

সালমা মেয়েটির সঙ্গে কি কথা বলবেন?

না।

না কেন?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। কফির মগে চুমুক দিতে লাগলেন। একবার তাকালেন মরিচ ফুল গাছটার দিকে। গাছ ভর্তি জোনাকি। জ্বলছে, নিভছে। এত সুন্দর লাগছে দেখতে যে তিনি চোখ ফেরাতে পারছেন না।

স্যার কী দেখছেন?

জোনাকি। অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। অপূর্ব দৃশ্য! মনে হচ্ছে আকাশের

সব তারা গাছে নেমে এসেছে।

সুলতান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি জোনাকি দেখে অভিভূত হচ্ছেন, মেয়েটিকে রক্ষা কীভাবে করা যায় এই বিষয়ে ভাবছেন না?

ভাবছি। কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য কিছু ভাবা সহজ।

ভেবে কিছু পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

কী পেয়েছেন? আচ্ছা আমিই বলি আপনি কী পেয়েছেন—আপনি ঠিক করেছেন যুক্তি দিয়ে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবেন। আপনার ঝুলিতে যেসব ধারালো যুক্তি আছে তার সব একের পর এক করবেন। সক্রেটিসের বিখ্যাত যুক্তিটা দিতে পারেন। সক্রেটিস বলেছেন, ‘কোনো মানুষই জেনেশুনে মন্দ কাজ করে না।’

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, এইসব যুক্তি তোমার বেলায় খাটবে না। তোমাকে যা করতে হবে তা হল—তোমার মনের ভেতরে, চেতনার গভীরে যে ভয় বাস করছে তাকে বের করে আনা

সুলতান শীতল গলায় বলল, আমার ভেতরে ভয় বাস করছে? কীসের ভয়?

মিসির আলি বললেন, কুয়ার ভয়। গৌর কালীমূর্তি এসে স্বপ্নে তোমাকে বলে গেল কখনো যেন কুয়ার পাশে না যাও। কুয়াতে ভয়ঙ্কর কিছু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। গৌর কালী বলে তো কিছু নেই। তোমার অবচেতন মন গৌর কালীকে সৃষ্টি করেছিল। সেই অবচেতন মনই ভয়টাকেও সৃষ্টি করেছে। সেই ভয় বাস করছে কুয়ার ভেতরে। আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলছি তুমি কি যুক্তিগুলি বুঝতে পারছ?

পারছি।

কুয়ার পাশে যেই মুহূর্তে তুমি দাঁড়াবে প্রবল ভয় তোমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করবে। অবচেতন মন তোমাকে ভয়ঙ্কর কিছু দেখাবে। কী দেখবে আমি জানি—হয়তো দেখবে কুয়ার গা বেয়ে ইদরিশ মাস্টার উঠে আসছে। তাকে দেখাচ্ছে একটা কুৎসিত মাকড়সার মতো। কিংবা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু দেখাবে।

সুলতান হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি যা বলছেন ঠিক আছে। আমি সেটা জানি। জানি বলেই কখনো কুয়ার পাশে যাই না। কারো পক্ষেই আমাকে কুয়ার পাশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, তোমাকে কুয়ার কাছে যেতে হবে কেন? কুয়া তোমার কাছে চলে আসবে। তুমি বসে আছ বেদিতে, তুমি দেখবে কুয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তোমার দিকে।

সুলতান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তার মানে?

মিসির আলি বললেন, তুমি আকাশের তারা দেখ—এই ব্যাপারটি তুমি সবচেয়ে ভালো বুঝবে। আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় না আকাশের তারা নিচে নেমে আসছে। অনেকটা সে রকম। দৃষ্টি বিভ্রম। কুয়া থাকবে কুয়ার জায়গায় অথচ তোমার মনে হবে কুয়া জীবন্ত প্রাণীর মতো এগিয়ে আসছে।

সুলতান চাপা গলায় বলল, আপনি আমার সঙ্গে একটা ট্রিকস করার চেষ্টা করছেন। মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ করছি। তোমার মনের গভীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ভয়টাকে বের করে এনেছি। ভয়ে তোমার চেতনা যখন অসাড় হয়ে এসেছে তখন বলেছি কুয়া এগিয়ে আসছে। তোমার অবচেতন মন তা গ্রহণ করেছে। একে সাইকোলজির ভাষায় বলে induced hallucination. তোমার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ কুয়া তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। তোমার মনও আমাকে খানিকটা সাহায্য করেছে। এই কুয়াটার প্রতি তোমার তীব্র আকর্ষণ। তুমি সব সময় তার কাছে যেতে চেয়েছ। কিছুক্ষণের ভেতর কুয়াটাকে তুমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখবে। তোমার ইচ্ছা করবে না, তরপরেও তুমি উঁকি দেবে—এবং যে ভয় তুমি পাবে সেই ভয়ের জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনো জগতে।

সুলতান চিৎকার করে উঠল, স্টপ, প্লিজ স্টপ। স্টপ ইট প্লিজ।

সুলতান বিকৃত গলায় চেঁচাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করেছে। ছুটে এসেছে লিলি। কিছুদূর এসেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সুলতান চিৎকার করেই যাচ্ছে। সে থরথর করে কাঁপছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মরিচ ফুলের গাছের বেদির দিকে। ভয়ঙ্কর কিছু সে অবশ্যই দেখতে পাচ্ছে।

মিসির আলি শান্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। সালমা মেয়েটি নিশ্চয়ই মন্দিরে আছে। বেচারি হয়তো ভয়েই মরে যাচ্ছে! তার ভয়টা কাটানো দরকার।

.

সালমা মূর্তির আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। মিসির আলিকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে তাকাল। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ গো মা? মেয়েটা জবাব দিল না। তার চোখ ভর্তি হয়ে গেল পানিতে।

মিসির আলি বললেন, আমার ছোট্ট মায়ের চোখে পানি কেন? কাছে এস চোখ মুছিয়ে দেই। এস জোনাকি পোকা দেখি। আমি আমার জীবনে এক সঙ্গে এত জোনাকি দেখি নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *