০৪. গা ছমছম করছে

মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন তার গা ছমছম করছে। যেন অশুভ কিছু তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে। ভয়ঙ্কর কিছু। লৌকিক কিছু না, অলৌকিক কিছু। অনেককাল আগে তার একবার এ রকম অনুভূতি হয়েছিল। শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছেন। গভীর রাত। তিনি এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেসে ভৈরব যাবেন। ট্রেন আসবে ভোররাতে। পৌষ মাসের মাঝামাঝি। প্রচণ্ড শীত। ওয়েটিং রুমে বসে সময় কাটানোর জন্যে ঢুকতে যাবেন হঠাৎ তার পা জমে গেল। বুক ধকধক করতে লাগল। মনে হল ওয়েটিং রুমে অশুভ কিছু আছে। ভয়ঙ্কর কিছু। যে ভয়ঙ্করের কোনো ব্যাখ্যা নেই। তার উচিত কিছুতেই ওয়েটিং রুমে না ঢোকা। একবার ঢুকলে আর বের হতে পারবেন না।

কৌতূহল সব সময় ভয়কে অতিক্রম করে। তাঁর বেলাতেও তাই হল। তিনি কৌতূহলী হয়েই উঁকি দিলেন। ওয়েটিং রুমের ইজি চেয়ারে একজন বৃদ্ধ হলুদ কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বৃদ্ধের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। মিসির আলি ঘরে ঢুকলেন। বৃদ্ধ চোখ মেলল না, তবে তার ঠোটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। শরীর জমিয়ে দেওয়া তীব্র ভয় মিসির আলিকে আবারো আচ্ছন্ন করল। তিনি প্রায় ছিটকে বের হয়ে এলেন। বাকি রাতটা কাটালেন প্ল্যাটফরমে পায়চারি করে। এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস ভোর চারটা চল্লিশে প্ল্যাটফরমে ইন করল। মিসির আলি ট্রেনে ওঠার আগে আরেকবার ওয়েটিং রুমে উকি দিলেন। বৃদ্ধ যাত্রী ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। মাথা নিচু এবং চোখ বন্ধ করে আগের মতোই সিগারেট টানছে। ঠোটের কোনায় আগের মতোই অস্পষ্ট হাসি।

মিসির আলি তাঁর জীবনের এই ভয় পাওয়া ঘটনাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে কাছাকাছি ব্যাখ্যা যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন সেটা হল কিশোর বয়সে তিনি নিশ্চয়ই নির্জন স্টেশনের ওয়েটিং রুমের কোনো ভূতের গল্প পড়ে ভয় পেয়েছিলেন। ভয়টা এতই তীব্র ছিল যে, মস্তিষ্কের নিউরোন সেই স্মৃতি মূল্যবান কোনো স্মৃতি মনে করে যত্ন করে মেমোরি-সেলে ঢুকিয়ে রেখেছে। নষ্ট হতে দেয় নি। অনেককাল পরে আরেকটি নির্জন স্টেশন দেখামাত্র মস্তিষ্ক মনে করল এ রকম একটা স্মৃতি তো আছে। স্মৃতিটা বের করে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক। যেহেতু অনেকদিনের স্মৃতি, বের করতে গিয়ে সমস্যা হল। স্মৃতির কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেল। কিছু অন্য রকম হয়ে গেল। মস্তিষ্ক শুধু যে স্মৃতি বের করে আনল তা না, স্মৃতির মনে জড়িত ভয়ঙ্কর ভীতিও বের করে আনল। এ রকম কাণ্ডকারখানা মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে করে। এর যেমন মন্দ দিক আছে, ভালো দিক ও আছে। মস্তিষ্কের ভেতর হঠাৎ নিউরোনের প্রবল ঝড় সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষতিকারক স্মৃতি উড়ে চলে যায়। স্মৃতি জমা করে রাখা মেমরি-সেল খালি হয়।

.

আজ যে ভয়টা পাচ্ছেন তার পেছনের কারণটা কী? তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পাঁচিল-ঘেরা প্রকাণ্ড একটা বাড়ির গেটের কাছে। অন্ধকারে পাঁচিল-ঘেরা বাড়িটাকে জেলখানার মতো লাগছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একা। এতক্ষণ লিলি তার সঙ্গে ছিল। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে সে দারোয়ান শ্রেণীর কাউকে দিয়ে গেট খুলিয়েছে।

তাও পুরো গেট না। গেটের অংশ যার ভেতর ছোটখাটো মানুষ হয়তো বা কষ্ট করে ঢুকতে পারে। গেট খুলতেই লিলি তাঁর দিকে ফিরে বলল, স্যার আপনি দাঁড়ান। পাঁচ- ছয় মিনিট লাগবে। আমি কুকুর বেঁধে আসি। আমাদের তিনটা কুকুর আছে। খুবই উগ্র স্বভাব, অপরিচিত কাউকে দেখলে কী করবে কে জানে? আমাকেই একবার কামড়ে দিয়েছিল।

মিসির আলি তারপর থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ঘড়ি দেখেন নি কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছে পাঁচ-ছ মিনিটের অনেক বেশি সময় পার হয়েছে। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশাল বাড়ি কিন্তু পুরোপুরি নিঃশব্দ। তিনটা ভয়ঙ্কর কুকুর অথচ তারা একবারও শব্দ করবে না এটা কেমন কথা? তাছাড়া বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। বিশাল এই বাড়ির একটি ঘরেও বাতি জ্বলবে না, এটাইবা কেমন কথা! এমন তো না যে, এই বাড়িতে মানুষজন থাকে না। রাত তো বেশি হয় নি। খুব বেশি হলে দশটা। যে দারোয়ান গেট খুলেছে তার হাতে কি একটা টর্চ থাকবে না?

এমন গাঢ় অন্ধকার মিসির আলি অনেকদিন দেখেন নি। নক্ষত্রের আলো পর্যন্ত নেই। আকাশ মেঘে ঢাকা। প্রবল অন্ধকারে জোনাকি বের হয়। জোনাকিও নেই। অনেকদিন তিনি জোনাকি দেখেন নি। জোনাকি দেখতে পেলে ভালো লাগত।

নদীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। স্রোতের শব্দ। হঠাৎ করেই কি নদী সাড়াশব্দ শুরু করল? এতক্ষণ এই নদী ছিল কোথায়? বকুল ফুলের গন্ধ আসছে। এটা কি বকুল ফুলের সময়? শহরবাসী হয়ে ছোটখাটো ব্যাপারগুলি ভুলতে বসেছেন। গন্ধটা হয়তো বকুল ফুলের না। অন্য কোনো বুনো ফুলের। জায়গাটা বন তো বটেই। আশপাশে লোকালয় নেই।

ঘড়ঘড় শব্দ হল। মিসির আলির চোখ হঠাৎ ধাঁধিয়ে গেল। গেট খুলেছে। গেটের ওপাশে জাহাজি লণ্ঠন হাতে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দারোয়ান। দারোয়ানের হাতে লম্বা টর্চ। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিশ্চয়ই। এই টর্চে আলো ফেলে দেখতে ইচ্ছা করছে—আলো কেমন হয়।

লিলি বলল, স্যার আসুন। ওর শরীরটা খারাপ বলে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর আমি খুঁজে পাচ্ছি না হারিকেন। বরকতকে দেখুন এত লম্বা টর্চ নিয়ে ঘুরছে। টর্চে নেই ব্যাটারি। ব্যাটারি ছাড়া টর্চ হাতে নিয়ে ঘোরার দরকারটা কী স্যার আপনিই বলুন। আপনাকে ব্যাগ হাতে নিতে হবে না। বরকত নেবে।

মিসির আলি বললেন, তোমার কুকুর কি বাঁধা হয়েছে?

হ্যাঁ বাঁধা হয়েছে। সকালে কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব তখন আর আপনাকে কিছু বলবে না। আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি দোতলার সবচেয়ে দক্ষিণের ঘরে। ঘরটা তেমন ভালো না, তবে খুব বড় ঘর। এই ঘরের খাটটা সুন্দর। অন্য ঘরগুলিতে এত সুন্দর রেলিং দেওয়া খাট নেই।

লণ্ঠনের আলোয় বাড়িঘর কিছু দেখা যাচ্ছে না। লণ্ঠন তার চারপাশ আলো করছে। দূরে আলো ফেলতে পারছে না। লণ্ঠন এবং টর্চের এই হল তফাত—লণ্ঠন নিজেকে আলোকিত করে। নিজেকে দেখায়। টর্চ অন্যকে আলোকিত করে।

সিঁড়িটা সাবধানে উঠবেন স্যার। শ্যাওলা জমে কেমন পিছল হয়ে গেছে। রেলিং ধরে উঠুন। আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে লেগেছে। ক্ষিধে লেগেছে না স্যার?

হুঁ লেগেছে।

আপনি হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন। আমি খাবার রেডি করে ফেলব। এর মধ্যে কোনো কিছুর দরকার হলে দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়াবেন। মাথা নিচু করে বরকত বরকত করে ডাক দেবেন। আমাদের একটাই কাজের লোক বরকত। একের ভেতর চার। সে-ই দারোয়ান, সে-ই কেয়ারটেকার, সে-ই মালি, সে-ই কুকুর-পালক। ভাত খাবার আগে চা-কফি কিছু খাবেন?

খেতে পারি।

আমি এক্ষুনি বরকতকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তোমার হাজবেন্ডের সঙ্গে কি রাতে দেখা হবে?

অবশ্যই হবে।

অসুস্থ বলছিলে।

অসুস্থ হোক যাই হোক গেস্টের সঙ্গে দেখা করবে না?

.

মিসির আলির ঘর পছন্দ হল। পুরোনো বাড়ির একটা সুন্দর ব্যাপার হল—ঘরগুলি প্রকাণ্ড। ছোটখাটো ফুটবল খেলার মাঠ। কড়ি বর্গার ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদ থেকে লম্বা লম্বা লোহার রড নেমে এসেছে। রডের মাথায় ফ্যান। এক শোবার ঘরেই চারটা ফ্যান। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া এই ফ্যান চলার কথা না। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এদের জেনারেটর আছে। ফ্যানগুলি পুরোনো আমলের ডিসি ফ্যান না। আধুনিক কালের ফ্যান। ফ্যানের পাখায় জমে থাকা ময়লা থেকে বোঝা যায় যে ফ্যানগুলি ব্যবহার করা হয়।

ঘরে শোবার খাট দুটা। চারপাশে রেলিং দেওয়া প্রকাণ্ড খাটটা ঘরের মাঝামাঝি রাখা। এই খাটে ওঠার জন্যে দুই ধাপ সিঁড়ি আছে। জানালার পাশে খাটের সাইজেরই একটা টেবিল। বিশাল টেবিলের সঙ্গে বেমানান ছোট একটা চেয়ার। চেয়ার টেবিলের উল্টোদিকে দুটা আলমিরা। কাঠের আলমিরা তালাবন্ধ। চারটা সোফার চেয়ার। চেয়ারে সবুজ মখমলের গদি। চেয়ারের পাশে পুরোনো ডিজাইনের দুটা আলনা। তারপরেও মনে হচ্ছে ঘরটা ফাঁকা। দুটা খাটেই বিছানা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। একটায় বিছানো হয়েছে ধবধবে সাদা চাদর। সাদা বালিশের ওয়ার। রেলিং দেওয়া খাটে সবকিছুই রঙিন। তবে দুটো খাটেই কোলবালিশ আছে। মিসির আলি বাথরুমে উঁকি দিলেন। বাথরুমও প্রায় শোবার ঘরের মতোই বড়। খুবই আধুনিক বাথরুম। এই বাথরুম অবশ্যই পরে বানানো হয়েছে। যে সময়ের বাড়ি সে সময়ে টাইলস নামক বস্তু বাজারে আসে নি।

বাথরুমটা শুধু যে ঝকঝক করছে তা না, বড় বড় হোটেলের মতো করে গোছানো। বেসিনের উপর সাবান, টুথপেস্ট এবং একটা মোড়ক-না-খোলা টুথব্রাশ। তোয়ালে রাখার জায়গায় তোয়ালে ঝুলছে। ময়লা নয়—মনে হচ্ছে এইমাত্র ধোপাখানা থেকে নিয়ে আসা।

মিসির আলি বেসিনের কলে পানি আশা করেন নি। দোতলায় পানি আসতে হলে ছাদে পানির ট্যাংক থাকতে হবে। সেই ট্যাংকে পানি তোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্যাপ খুলতেই পানি পাওয়া গেল। অনেকদিন অব্যবহারের পর হঠাৎ কল খুললে লাল পানি বের হয়—সে রকম পানি না। পরিষ্কার পানি। মিসির আলি মুখে পানি ছিটালেন।

সিঁড়িতে থপথপ শব্দ করতে করতে কেউ-একজন আসছে। বাড়ির মালিক নিশ্চয় নন। তিনি হুইল চেয়ারে থাকেন। তাহলে কে আসছে—দারোয়ান? একেকটা সিঁড়ি ভাঙতে এত সময় নিচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই ভারী কিছু নিয়ে আসছে। সেই ভারী বস্তুটা কী হতে পারে? চেয়ার-টেবিল কাঁধে করে আনবে না। তাঁর ঘরে চেয়ার-টেবিল আছে। বালতিতে করে গরম পানি কি আনছে? রাতের বেলার অতিথিদের গরম পানি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। অতিথি গরম পানিতে গোসল করবেন, কিংবা হাত-মুখ ধোবেন। তাঁর প্রতি যে বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে তাতে সেটা প্রকাশ পাবে।

না বালতি নিয়ে কেউ আসছে না। বালতি হলে মাঝে মাঝে সিঁড়িতে নামিয়ে রাখত। তার শব্দ পাওয়া যেত। সেই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মিসির আলি ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে এলেন।

দারোয়ান বরকত আসছে। তার কোমরে মাটির কলসি। কলসির মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, তার মানে কলসিতে করে গরম পানিই আনা হচ্ছে। মিসির আলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। যাক লজিক শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে। সিদ্ধান্তে আসার পরই টেনশান বোধ করা শুরু করছেন। লজিকের যে সিঁড়িগুলি গাঁথা হয়েছে সেই সিঁড়িগুলি কি ঠিক আছে? সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যাবে তো?

মিসির আলি জানেন এই সবই হচ্ছে বয়সের লক্ষণ। বয়স মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা করে—তা হল আস্থা কমিয়ে দেয়। যা-ই করা হয় মনে হয় ঠিকমতো বুঝি করা হল না। ভুল থেকে গেল।

স্যার গরম জল।

বুঝতে পারছি।

সিনান করলে করেন।

গোসল করব না।

বড় সাব সিনান করতে বলেছেন।

তোমার বড় সাহেব বললে তো হবে না। আমার গোসল করতে ইচ্ছে করছে না। আর কিছু লাগবে?

না আর কিছু লাগবে না। ভালো কথা—তুমি গরম পানি না বলে গরম জল বলছ কেন? তোমাদের এদিকে কি পানিকে জল বলা হয়? এটা কি হিন্দুপ্রধান অঞ্চল?

বরকত জবাব দিল না। সরু চোখে তাকিয়ে রইল। মিসির আলি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।

যাও বলার পরেও সে যাচ্ছে না। আগের মতোই সরু চোখে তাকিয়ে আছে। বলশালী একজন মানুষ। বয়স কত হবে ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ। বেশিও হতে পারে। চুলে পাক ধরেছে। মানুষটার বুদ্ধি কেমন? চট করে মানুষের বুদ্ধি বের করার কোনো উপায় এখনো বের করা যায় নি। সাইকোলজিস্টরা নানান ধরনের পরীক্ষা অবিশ্যি বের করেছেন। কোনো পরীক্ষাই মিসির আলির কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। আসলে বুদ্ধি পরীক্ষার ব্যবস্থা না থেকে থাকা উচিত ছিল বোকামি পরীক্ষার ব্যবস্থা। প্রথম শ্রেণীর বোকাদের জন্যে এক রকম পরীক্ষা। দ্বিতীয় শ্রেণীর বোকাদের জন্যে আরেক রকম পরীক্ষা।

বরকত চলে যাচ্ছে। যেতে যেতেও দু বার ফিরে তাকাল। সিঁড়ির কাছে অন্ধকার। কাজেই তার চোখের দৃষ্টিতে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। নয়তো এতবার করে তাকাত না।

মিসির আলি নিজের ঘরে ঢুকলেন। ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া দরকার। নিজের গায়ের গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে দিতে হবে। গন্ধ যত ছড়াবে ঘর হবে তত আপন। নিম্নশ্রেণীর পশুরা তাই করে। নিজের গায়ের গন্ধ দিয়ে সীমানা ঠিক করে দেয়। অদৃশ্য সাইনবোর্ড গন্ধ দিয়ে বলে—এই আমার সীমানা। এর ভেতর আর কেউ আসবে না। যদি ভুলে চলেও আস, বেশিক্ষণ থাকবে না। থাকলে সমূহ বিপদ

মিসির আলি সুটকেস খুলে বই বের করলেন। চারটা বইয়ের মধ্যে একটা হল ক্লোজআপ ম্যাজিকের বই। দড়িকাটার খেলা, পিংপং বল অদৃশ্য করে দেবার খেলার মতো ছোট ছোট ম্যাজিকের কৌশল দেওয়া আছে। পড়তে ভালো লাগে। তিনি বইগুলি টেবিলে সাজিয়ে রাখলেন। এত বড় টেবিলে চারটা মাত্র বই দেখতে হাস্যকর লাগছে। মিসির আলি ঠিক করে রাখলেন—এ বাড়ির লাইব্রেরি থেকে বেশ কিছু বই এনে টেবিল ভর্তি করে রাখবেন। চোখের সামনে প্রচুর বই থাকলে ভালো লাগে।

আবারো সিঁড়িতে থপথপ শব্দ হচ্ছে। বরকত কি আবারো ভারী কিছু নিয়ে উঠছে? ব্যাপারটা কী? এবার সে কী আনছে? মিসির আলি দ্রুত বারান্দায় চলে এলেন। বরকত ভারী কিছু তুলছে না। তার হাতে ছোট্ট তেলের শিশির মতো শিশি। অথচ এমনভাবে সে উঠছে যেন তার উঠতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে বিশ্রামও করে নিচ্ছে বলে মনে হয়। এমন স্বাস্থ্যবান একজন মানুষের সিঁড়ি ভাঙতে কোনো কষ্ট হবার কথা না। অথচ তার যে কষ্ট হচ্ছে এটা পরিষ্কার। হার্টের কোনো অসুখ কি আছে? কিংবা আর্থরাইটিস? ওঠার সময় হাঁটুতে ব্যথা করে?

বরকত মিসির আলির সামনে এসে বলল, ওষুধ নিয়া আসছি।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কীসের অষুধ?

সাপের অষুধ। আপনের ঘরের চারদিকে দিয়া দিব।

ঘরের চারদিকে সাপের অষুধ দেবে মানে কী? দোতলায় সাপ আসবে কীভাবে?

বরকত প্রশ্নের জবাব দিল না। ঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলি বারান্দায় দাঁড়িয়েই তীব্র কার্বলিক এসিডের গন্ধ পেলেন। তাঁর গন্ধ বিষয়ক সমস্যা আছে। কিছু কিছু গন্ধ মনে হয় তাঁর স্নায়ুতে সরাসরি আক্রমণ করে। চট করে মাথা ধরে যায়। কার্বলিক এসিডেও তাই হয়েছে। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, শুধু সাপ না, আমি নিজেও আর এই ঘরে ঢুকতে পারব না। এই গন্ধ নিয়ে বাস করার চাইতে ঘরে দু তিনটা সাপ নিয়ে বাস করা অনেক সহজ। মশারি ভালোমতো গুঁজে দিয়ে রাখলে সাপ ঢুকতে পারবে না। সাপকে খাটে উঠতে হলে খাটের পা বেয়ে উঠতে হবে। সাপের জন্যে এই প্রক্রিয়া খুবই কষ্টকর হবার কথা। সাপ শুধু শুধু এত কষ্ট করবে না।

বরকত নেমে যাচ্ছে। শিশিটা নিশ্চয়ই ঘরে কোথাও রেখে এসেছে। বোতল থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। আচ্ছা বোতলটা সে কোথায় রেখেছে? খাটের নিচে রেখেছে নিশ্চয়ই। মশার কয়েল জ্বালিয়ে আমরা বেশির ভাগ সময় জ্বলন্ত কয়েলটা খাটের নিচে রেখে দেই।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে বরকতের তেমন কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হলো না। বেশ দ্রুতই নামছে। বরকতের আর্থরাইটিস নেই, এটা নিশ্চিত।

সিঁড়ির শেষ মাথায় ছোট একটা শব্দ হল। জায়গাটা গাঢ় অন্ধকার। তারপরেও মিসির আলির মনে হল কে যেন সেখানে বসে আছে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁকে দেখছে। মিসির আলির মনে হল তাঁর হাতে একটা টর্চ থাকলে ভালো হত। টর্চের আলো ফেলে দেখা যেত কে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে দু ধাপ নামলেন। উঁচু গলায় বললেন, কে? কে ওখানে?

কেউ জবাব দিল না। মিসির আলি আরো কয়েকটা সিঁড়ি টপকালেন আর তখনি শান্ত গম্ভীর পুরুষ গলায় কেউ একজন বলল, স্যার রেলিং ধরে ধরে নামুন। খুব খেয়াল রাখবেন যতবার ওঠানামা করবেন। রেলিং ধরে ধরে করবেন। আমার নাম সুলতান। ওয়েলকাম টু মাই ‘ধ্বংসস্তূপ’। ধ্বংসস্তূপের ইংরেজিটা মনে পড়ছে না বলে বাংলা

বললাম। স্যার কেমন আছেন?

হুইল চেয়ারে বসে যে মানুষটি হাত বাড়িয়েছে মিসির আলি কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। কাছাকাছি আসায় মানুষটাকে এখন দেখা যাচ্ছে। কেউ একজন একতলার দরজাও মনে হয় খুলেছে। আলো এসে পড়েছে মানুষটার মুখে। অত্যন্ত সুপুরুষ একজন মানুষ। অতিথিকে স্বাগতম বলার জন্যে যিনি বিশেষভাবে পোশাক পরেছেন। ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা প্যান্টের সঙ্গে, হালকা নীল ফুল হাফ শার্ট। পোশাকটায় স্কুল-ড্রেস স্কুল ড্রেস ভাব আছে। কিন্তু এই মানুষটাকে খুব মানিয়েছে। ভদ্রলোক চশমা পরেন, নাকের কাছে চশমার দাগ আছে, কিন্তু এখন চোখে চশমা নেই। তাঁর বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ, বুদ্ধিতে ঝিকমিক করছে। বয়স পঞ্চাশের বেশি। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। কাঁচা-পাকা চুলের যে আশ্চর্য সৌন্দর্য আছে, তা এই মানুষটার চুলের দিকে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়।

স্যার আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আপনি কেমন আছেন?

আমি ভালো আছি।

আছে।

ঘরটা পছন্দ হয়েছে?

কার্বলিক এসিড দেওয়ার আগ পর্যন্ত পছন্দ ছিল। আমার কিছু গন্ধবিষয়ক সমস্যা

আপনি এসেছেন আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি। খুশির প্রকাশটা অবিশ্যি করতে পারছি না। আপনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ, আপনি নিশ্চয়ই আমার খুশি ধরতে পারছেন।

মিসির আলি কিছু বললেন না। মানুষটা যে খুশি হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। আনন্দিত মানুষের ভেতর অস্থিরতা থাকে। ব্যথিত মানুষ চুপচাপ হয়ে যায়। এই মানুষটা অস্থির। হুইল চেয়ার নিয়ে এদিক-ওদিক করছে।

আমি আপনাকে খাবার ঘরে নিয়ে যাবার জন্যে অনেকক্ষণ থেকে সিঁড়ির গোড়ায় বসে আছি। আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি নিচ থেকে আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করছিলেন। দুশ্চিন্তার বিষয়টা ধরার চেষ্টা করছিলাম।

দুশ্চিন্তা করছিলাম না। আপনার স্ত্রী লিলি কোথায়?

ও রান্না শেষ করে ঘুমুতে চলে গেছে। ভুল বললাম, সে চলে যায় নি। আমি তাকে জোর করে পাঠিয়েছি। ওর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। সমস্যাগুলি হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়। আপনাকে নানান কৌশল করে এখানে আনার অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটা কারণ হল লিলির ব্যাপারটি নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করা।

ও আচ্ছা।

স্যার আসুন। খেতে আসুন। খাবার ঘরটা একতলায়। একতলায় থাকায় রক্ষা। আমি যেতে পারছি। দোতলায় হলে যেতে পারতাম না।

মিসির আলি ভেবেছিলেন বিশাল একটা খাবার ঘর দেখবেন। তা দেখলেন না। ছোট ঘর। খাবার টেবিলটাও ছোট। টেবিলের পাশে একটামাত্র চেয়ার। মনে হচ্ছে একজনের জন্যেই খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ঘরের প্রধান আকর্ষণ মোমদানি। রূপার তৈরি মোমদানিতে এক সঙ্গে একুশটা মোম জ্বলছে। ঘর আলো হয়ে আছে। মোমদানিটা খাবার টেবিলে রাখা।

মিসির আলি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আপনি খাবেন না?

জি না। সন্ধ্যার পর আমি কিছু খাই না। আগে পানি, চা-কফি খেতাম। এখন তাও না। সূর্য ডুবল মানে আমার খাওয়ার পর্ব শেষ।

মিসির আলি একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন—সূর্য ডোবার পর কেন খান না? শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করলেন না। সূর্য ডোবার পর খাদ্য গ্রহণ না করার পেছনে ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই কিছু যুক্তি আছে। সেইসব যুক্তি তিনি যদি অন্যদের জানাতে চান—প্রশ্ন না করলেও জানাবেন।

সূর্য ডোবার পর আমি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি কেন জানেন?

না জানি না।

সরি, আমি আপনাকে খুবই বোকার মতো প্রশ্নটা করলাম। সন্ধ্যার পর আমি কেন কোনো খাদ্য গ্রহণ করি না সেটা তো আপনার জানার কথা না। তবে আপনার লজিকেল ডিডাকসানের যে ক্ষমতা আপনি নিশ্চয়ই বের করে ফেলেছেন?

আমি কিছু বের করি নি।

স্যার আপনি খাওয়া শুরু করুন। সব টেবিলে দেওয়া আছে। আপনি খেতে থাকুন। আমি গল্পটা বলি। এক রাতে খেতে বসেছি; হঠাৎ মনে হল—পৃথিবীর পশুপাখি কীটপতঙ্গ কোনো কিছুই রাতে খাদ্য গ্রহণ করে না। জীব জগতের নিয়মই হল রাতে খাদ্য গ্রহণ না করা। এমনকি উদ্ভিদও সূর্যের আলো নিয়ে খাদ্য তৈরি করে দিনে, রাতে না। আর আমরা মানুষরা জীব জগতের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে রাতে খাদ্য গ্রহণ করছি। এটা তো ঠিক হচ্ছে না। তারপর থেকে সূর্য ডোবার পর ফুড ইনটেক পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। প্রথম কিছুদিন কষ্ট হয়েছে। এখন আর হচ্ছে না। এখন ভালো আছি। শরীর খুবই ফিট। যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই গল্প বলার ছলে বলতে চেষ্টা করি—সূর্য ডোবার পর খাদ্য গ্রহণ করা ঠিক না।

মিসির আলি প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন, জীব জগতের কেউই রাতে খাবার খায় না?

বাদুড় আর পেঁচা খায়। এরা নিশাচর—এদেরটা হিসেবে ধরছি না। আমি যে বকবক করছি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?

বিরক্ত হচ্ছি না।

প্রথম দফাতে অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি। আর করব না। আপনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিশ্রাম করুন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি একা খেতে পছন্দ করেন। সবকিছু দেওয়া আছে। আপনি খান। আমি পাশের ঘরেই থাকব। কোনো দরকার হলে ডাকবেন।

মিসির আলি বিব্রত গলায় বললেন, আমার একা খাওয়াটা কোনো নিয়মের কারণে না। একা থাকি বলেই একা খাই।

একা খেয়ে আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে। হঠাৎ করে এই অভ্যাস ভাঙানো ঠিক হবে না। আপনি খাওয়া শেষ করুন—তখন শুভরাত্রি জানানোর জন্য আসব। আপনাকে খুব স্পেশাল ডেজার্টও খাওয়াব।

খাবার আয়োজন বেশি না। আলু ভাজা, মুগের ডাল, করলা ভাজি, বেগুন ভাজি, সজনের ঝোল, পটোলের ঝোল এবং ডাল। সবই নিরামিষ। একটা বাটিতে ঘি, অন্য একটা বাটিতে তেঁতুলের আচার। মিসির আলি অত্যন্ত তৃপ্তি করে খেলেন। লিলি মেয়েটির রান্নার হাত যে অসাধারণ—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। এত অল্প সময়ে এতগুলি পদ সামনে দেওয়া সহজ ব্যাপার না। মেয়েটার অসুস্থতার ব্যাপারটি এখনো মিসির আলির কাছে পরিষ্কার হয় নি। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটাকে যে কোনো কারণেই হোক তার সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না, কিংবা সে নিজেই আসছে না। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না।

মিসির আলি খাওয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই সুলতান ঢুকল। তাঁর হাতে কাচের মুখ খোলা বয়াম এবং একটা চামচ। সে কি আড়াল থেকে মিসির আলির খাওয়া দেখছিল? তা না হলে খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র তার উপস্থিত হওয়াটা সম্ভব না।

স্যার আপনার ডেজার্ট। অনেক রকম ডেজার্ট খেয়েছেন, এটাও খেয়ে দেখুন। আপনাকে মেপে মেপে দু চামচ দেব। দু চামচের বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। তবে আপনার যদি আরো খেতে ইচ্ছে করে, তাহলে খাবেন। সাধারণত দু চামচের বেশি খেতে ইচ্ছা করে না।

সোনালি রঙের ঘন তরল পদার্থ। হারিকেনের আলোয় ঝিকঝিক করে জ্বলছে। সুলতান বলল, তর্জনীতে মাখিয়ে মাখিয়ে মুখে দিল। এইভাবেই খাওয়ার নিয়ম।

মিসির আলি বললেন, জিনিসটা কি মধু?

জি মধু

বিশেষ কোনো মধু?

অবশ্যই বিশেষ মধু। ‘চাকভাঙা মধু’ এই বাক্যটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। এটা হল চাকভাঙা মধু। সুন্দরবনের মধুয়ালীরা মার্চ-এপ্রিল মাসে এই মধু সংগ্রহ করে। এই সময় খলসা ফুল ফুটে। মৌমাছিরা খলসা ফুল থেকে মধু জমা করে। কেওড়া ফুলের মধুও আছে। সেটাও খারাপ না। তবে খলসা ফুলের মতো ভালো মধু পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমি মনে করি না।

মিসির আলি আঙুলে মধু মাখিয়ে মুখে দিলেন। তিনি বিশেষ কোনো পার্থক্য অনুভব করতে পারলেন না। ঘন মিষ্টি সিরাপে হালকা ফুলের গন্ধ।

অন্য মধুর সঙ্গে পার্থক্য বুঝতে পারছেন?

না। মধু আমি খাই না। যারা নিয়মিত খায় তারা হয়তো পার্থক্যটা ধরতে পারবে। আমি পারব না।

আপনিও পারবেন। আমার কাছে এই মুহূর্তে আট রকমের মধু আছে। অস্ট্রেলিয়ান মধু, কানাডার মধু, আয়ারল্যান্ডের মধু এবং পাঁচ রকমের সুন্দরবনের মধু। সব আপনাকে খাওয়াব। আপনি নিজেই পার্থক্য ধরতে পারবেন। আপনি যখন এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন তখন আপনি মোটামুটিভাবে একজন মধু বিশেষজ্ঞ।

মিসির আলি মধু শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন।

সুলতান বলল, যান শুয়ে পড়ুন। সকালবেলা নাশতা খেতে খেতে আগামী কয়েক দিনের প্রোগ্রাম সেট করে ফেলব।

আচ্ছা।

পান খাবার অভ্যাস আছে?

না।

কাঁচা সুপারি দিয়ে একটা পান খেয়ে দেখুন। কাঁচা সুপারিতে এলকালয়েড আছে। এই এলকালয়েড স্নায়ুর উপর কাজ করে। শরীরে হালকা ঝিমঝিম ভাব নিয়ে আসে। ইন্টারেস্টিং সেনসেশন।

মিসির আলি কাঁচা সুপারির একটা পান মুখে দিলেন। সুলতান বলল, আপনার ঘর পাল্টে দিয়েছি। কার্বলিক এসিডের গন্ধ আপনার কাছে বিরক্তিকর এটা জানতাম না। এই ঘরটায় কার্বলিক এসিড দেওয়া হয় নি।

দোতলায় সাপ কি সত্যি আছে?

থাকার কোনোই কারণ নেই। তবে সাপ দেখা গেছে। আমি নিজেই দেখেছি। আমি সাপ চিনি না। যেটাকে দেখেছি তার ফণা আছে। কাজেই বিষ থাকার কথা।

বলেন কী?

আপনার খাটটা ঠিক ঘরের মাঝখানে দিতে বলেছি। খাটের নিচে জ্বলন্ত হারিকেন থাকবে। সাপ কার্বলিক এসিডের চেয়েও বেশি ভয় পায় আলো। মশা নেই, তবু মশারি খাটিয়ে ঘুমাবেন। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলে ভালোমতো মেঝে দেখে তারপর নামবেন। আপনার কি ভয় লাগছে?

সামান্য লাগছে। সাপ আমার পছন্দের প্রাণী না।

আমার নিজেরও না। আমি এই পৃথিবীতে একটা জিনিসই ভয় পাই। তার নাম সাপ। মানুষ নানান রকম দুঃস্বপ্ন দেখে, আমি একটা দুঃস্বপ্নই দেখি—আমি সাপের সঙ্গে শুয়ে আছি। বেশ স্বাভাবিকভাবেই শুয়ে আছি। স্বপ্নটা দেখার সময় ভয় লাগে না। স্বপ্নটা যখন ভেঙে যায় তখন প্রচণ্ড ভয় লাগে। গা ঘিনঘিন করতে থাকে। বারবার গোসল করি, তারপরেও মনে হয় সাপের স্পর্শ শরীরে লেগে আছে। আপনার সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে পরে কথা বলব।

আচ্ছা।

আমি দোতলা পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দিতে পারছি না। ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব না। হুইল চেয়ার দোতলায় ওঠাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। বরকত আপনাকে নতুন ঘর দেখিয়ে দেবে।

এত বড় বাড়িতে আপনারা তিন জন মাত্র মানুষ!

আমরা ছয় জন ছিলাম। এখন তিন জন। জার্নি করে এসেছেন আপনি ক্লান্ত। শুয়ে পড়ুন। কাল আপনার সঙ্গে কথা হবে। আমার উচিত ছিল ঘর পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দেওয়া, সেটা সম্ভব না। বরকত এগিয়ে দেবে।

কোনো অসুবিধা নেই।

বরকতের অনিদ্রা রোগ আছে। সে কুকুরগুলির সঙ্গে সারারাত জেগে থাকে। আপনার যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়—সিঁড়ির কাছে এসে ওকে ডাকলেই হবে।

থ্যাংক য়্যু।

নতুন জায়গায় ঘুম যদি না আসে তার জন্যে আপনার ঘরে ফ্রিজিয়াম জাতীয় কিছু ট্যাবলেট দিতে বলেছি। লিলি নিশ্চয়ই দিয়েছে। রাত জেগে যদি বই পড়তে চান তার ব্যবস্থাও করেছি। The Other Mind বইটাও আপনার বিছানার কাছে আছে। বইটা কি পড়েছেন?

না।

পাঁচ জন সিরিয়াল কিলারের মানসিকতা ব্যাখ্যা করে বইটা লেখা হয়েছে। আমি নিজে খুবই আগ্রহ করে বইটা পড়েছি। আপনার অনেক বেশি ভালো লাগবে বলে আমার ধারণা।

বরকত এক গাদা জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়েছে। ফ্লাস্ক আছে, চায়ের কাপ আছে, পানির বোতল আছে। মিসির আলির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা থাকলেও তিনি যে রাত জাগবেন এবং চা খাবেন তা মনে হচ্ছে না। বরকত পাশে পাশে হাঁটছে। মনে হচ্ছে তার হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

নতুন যে ঘরে মিসির আলিকে থাকতে দেয়া হয়েছে সে ঘরটাও প্রায় আগেরটার মতোই বড়। তবে আসবাবপত্র নেই। ঘরের মাঝখানে কালো রঙের খাট। খাটের পাশেই ছোট্ট টেবিল। টেবিলে হারিকেন আছে, একটা কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প আছে, দেয়াশলাই এবং মোমবাতিও রাখা আছে। ঘুমের অষুধ রাখা হয়েছে, এক ধরনের নয়—বেশ কয়েক ধরনের। The Other Mind বইটি রাখা হয়েছে বিছানায় বালিশের উপর।

শোবার আগে বই পড়া মিসির আলির অনেক দিনের অভ্যাস। পড়ার বই তিনি সঙ্গে এনেছেন। বাইরে বেড়াতে গেলে হালকা ধরনের বইপত্র পড়তেই ভালো লাগে। সাইকোলজির কঠিন বই না। কিন্তু এ বাড়ির কর্তা যে কোনো কারণেই হোক চাচ্ছে যেন তিনি The Other Mind বইটি পড়েন। আজ পড়া যাবে না, কারণ ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

মিসির আলি দরজার ছিটকিনি লাগাতে গেলেন। জং ধরে ছিটকিনি আটকে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও ছিটকিনি লাগাতে পারলেন না। লাভের মধ্যে লাভ এই হল যে ঘুম কেটে গেল। মিসির আলি ডায়েরি বের করলেন—কয়েক পৃষ্ঠা লিখবেন। এতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হবে। তারপর বই নিয়ে বসবেন। সাইকোলজির কঠিন বই না, জেরোম কে জেরোমের এক নায়ে তিনজন।

টেবিলে যদিও দ টা বাতি তারপরেও এই আলো লেখার জন্যে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। মিসির আলি লিখে আরাম পাচ্ছেন না। এক সময় তাঁর মনে হল শুধু যে আলোর অভাবেই তিনি লিখে আরাম পাচ্ছেন না, তা না। যে বিষয় নিয়ে লিখছেন সেই বিষয়টি লিখতেও ভালো লাগছে না। মনের ভেতরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

.

‘এখন রাত একটা কুড়ি। আমার অনেকদিনের অভ্যাস ঘুমুতে যাবার আগে হয় কিছুক্ষণ লিখি, নয় বই পড়ি। লাল মলাটের এই ডায়েরিটা আমি কিনেছিলাম নির্জন সমুদ্রবাসের অভিজ্ঞতা লেখার জন্যে। সমুদ্রবাস এই মুহূর্তে করতে না পারলেও নির্জনবাস ঠিকই করছি। যাদের বাড়িতে আমি আছি তারা আমাকে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে কিন্তু আমি কেন যেন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার শুধুই মনে হচ্ছে— কোথাও একটা সমস্যা আছে। আমি সমস্যা ধরতে পারছি না। সমস্যার নিয়ম হল— সমস্যাটা যদি এমন হয় যে খুবই স্পষ্ট তাহলে সেই সমস্যা ধরা যায় না। ধরতে সময় লাগে।

এরা খুব আগ্রহ করে আমাকে এই বাড়িতে এনেছে। আগ্রহের পেছনের কারণটা কী? আমাকে আকাশের তারা দেখানোর জন্যে কিংবা ভালো ভালো খাবার রান্না করে খাওয়াবার জন্যে নিশ্চয়ই আনে নি। আমি অতি বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি না যে এ বাড়িতে কিছুদিন থেকে গেলে এদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এরা বলতে পারবে— আমাদের সঙ্গে মিসির আলি কিছুদিন ছিলেন। তিনি আমাদের অতি বন্ধু মানুষ। প্রায়ই আসেন। আগামী সামারে আবার আসবেন। এই দেখুন মিসির আলির সঙ্গে আমাদের ছবি।

সুলতান বা তার স্ত্রী আমার কাছ থেকে ঠিক কী চাচ্ছে তা এখনো ধরতে পারছি না বলে আমার অস্বস্তিটা কাটছে না। তারা কোনো বিপদে আছে বলে আমার মনে হয় না। বিপদে থাকলে প্রথম রাতেই বিপদের কথা জানতে পারতাম। এদের আচার-আচরণে সামান্য অস্বাভাবিকতা আছে এটা থাকবেই। একটা বিশাল পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে দিনের পর দিন যদি তিনটি মানুষ বাস করে তাহলে তাদের চরিত্রে পরিবেশের প্রভাব প্রবলভাবে পড়বে। পরিবারের প্রধান মানুষটি হুইল চেয়ারে জীবন যাপন করছেন। এর প্রভাবও বাকিদের উপর পড়বে। আফ্রিকার আদিবাসি এক জনগোষ্ঠীর উপর একবার একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেখা গেল এরা সবাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কারণ অনুসন্ধান করে পাওয়া গেল এদের দলপতি বাঁ পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। ব্যথার কারণে সারাজীবন তাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে। তাই সংক্রমিত হয়েছে পুরো দলের উপর

আমি এ বাড়ির তিন সদস্যকে আলাদা আলাদাভাবে দেখার চেষ্টা করছি, আবার দলবদ্ধভাবেও দেখার চেষ্টা করছি। সুলতানকে আমার মনে হয়েছে আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। আমি যা করছি ঠিক করছি, আমি যা ভাবছি ঠিক ভাবছি গোত্রের একজন। একই ব্যাপার লিলির মধ্যে এবং বরকতের মধ্যেও দেখলাম। দীর্ঘদিন কিছু মানুষ যদি একটি গণ্ডিতে বাস করে তাহলে একটা পর্যায়ে তারা তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। এদের ক্ষেত্রেও কি তাই হতে যাচ্ছে?

সুলতানের আট ধরনের মধু এবং মধু নিয়ে তার বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাসের কারণটা ধরতে পারছি না। যারা মধ্যপান করেন এবং ভালো মদের ব্যাপারে যাদের আগ্রহ আছে তাদের মধ্যে এই উচ্ছ্বাস দেখা যায়। নানান ধরনের মদ সংগ্রহ করতে এবং অতিথিদের তা দেখাতে এরা পছন্দ করেন। সুলতানের মধুর ব্যাপারটা শুরুতে আমি সে রকম কিছুই ভেবেছিলাম। পরে লক্ষ করলাম ব্যাপারটা সে রকম না। আমি নিশ্চিত যে সুলতান মধু খায় না। কারণ সে যখন আমাকে মধু দিচ্ছিল তখন তার নাক এবং ভুরু সামান্য কুঞ্চিত হল। যে শুঁটকি কখনো খায় না তার সামনে এক বাটি শুঁটকির ঝোল দিলে সে এই ভঙ্গিতেই নাক কুঁচকাবে। আমি একবার ভেবেছিলাম তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি সে মধু খায় কি না। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করি নি। আমি যে চোখ খোলা রেখে সব দেখছি তা ঠিক এই মুহূর্তে এদের জানতে দিতে চাচ্ছি না। বরকত নামের দারোয়ানের একটা বিষয় আমার চোখে লাগছে। আমি লক্ষ করেছি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে তার খুবই কষ্ট হয়। দেখে মনে হয় কষ্টটা শারীরিক। আমার ধারণা তা না। আমার ধারণা কষ্টটা মানসিক দোতলার কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি কি তার মাথায় আছে? যে কারণে দোতলায় ওঠার ব্যাপারে তার অনাগ্রহ আছে?

লিলি মেয়েটি নিজের চারদিকে এক ধরনের রহস্য তৈরি করার জন্যে ব্যস্ত। এটি অস্বাভাবিক না। মেয়ে মাত্রই নিজেকে রহস্যময়ী হিসেবে উপস্থিত করতে চায়। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। সে নানানভাবে আমার বুদ্ধির হিসেব নিতে চাচ্ছে। দাঁড়িপাল্লায় বুদ্ধি মাপতে চাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমার বুদ্ধির ব্যাপারটা তার কাছে জরুরি। কেন জরুরি? সে কি আমার বুদ্ধি ব্যবহার করতে চায়? কোথায় ব্যবহার করবে…

এই পর্যন্ত লিখে মিসির আলি হাই তুললেন। তাঁর ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমানো যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *