০২. জনাব মিসির আলি

জনাব মিসির আলি

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

আমার স্ত্রী লিলি নিশ্চয়ই অনেক নাটকীয়তা করে এই চিঠি আপনার হাতে দিয়েছে। সে এমন এক মেয়ে যে কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়া কিছু করতে পারে না। খুব সহজ কথাও সে সহজে বলবে না। দু’তিন জায়গায় প্যাচ দিয়ে বলবে। সহজ কথাটাকেই তখন মনে হবে ভয়ঙ্কর জটিল। আপনি খুব বড় সাইকিয়াট্রিস্ট, আপনার কাছে হয়তো এর ব্যাখ্যা আছে, আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। আমি এবং আমার স্ত্রী আমরা দু জনই আপনার মহাভক্ত। আপনার বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থ আমার স্ত্রী কয়েকবার করে পড়েছে, এবং আমাকেও পড়তে বাধ্য করেছে। আমি আপনার সঙ্গে নিরিবিলিতে কিছু কথা বলার জন্যে অত্যন্ত আগ্রহী। সবচেয়ে ভালো হত আমি যদি লিলির সঙ্গে ঢাকায় চলে আসতে পারতাম। তা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ আমি বন্দি জীবনযাপন করছি। গত সাত বছর ধরেই আমি হুইল চেয়ারে আছি। রোড এ্যাকসিডেন্টে স্পাইনাল কর্ড জখম হয়েছিল। আপনি তো জানেন স্পাইনাল কর্ডের জীবকোষ কখনো রিজেনারেট করে না। আমাকে আমার ভাগ্য মেনে নিতে হয়েছে। চাকার জীবনে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছি। অভ্যস্ত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কখনো হবে তাও মনে হয় না। নিজেকে এখন আর আমার মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় আমি একটা দু’চাকার রিকশা।

আপনাকে ভুলিয়েভালিয়ে এখানে আনার একটি পরিকল্পনা আমি এবং আমার স্ত্রী দু জনে মিলে করেছি। জানি না আপনাকে কনভিন্স করতে পারব কি না। চেষ্টা করে দেখা যাক। আমার এখানে আসার জন্যে তিনটি টোপ আমি ফেলছি। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে প্রথম দুটি টোপ কাজ না করলেও শেষটি করবে। টোপ দিয়ে মাছের মতো মানুষও ধরা যায়।

টোপ নাম্বার এক

আমাদের বসতবাড়িটা মেঘনার পাড়ে। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দোতলা পাকা দালান। দোতলায় প্রশস্ত টানা বারান্দা। বারান্দা থেকে মেঘনা দেখা যায়। না দেখা গেলেই ভালো হত। কারণ এই মেঘনা জমি গ্রাস করতে করতে দ্রুত এগিয়ে আসছে। যে কোনো সময় (হয়তো এ বছরই) আমাদের এই অতি চমৎকার বাগানবাড়িটা গ্রাস করবে। আমাদের বাড়িটা চমৎকার। বাড়ির সামনের বাগান চমৎকার। আমি নিশ্চিত একবার আপনি এসে উপস্থিত হলে অবাক বিস্ময়ে বলবেন-বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে দিতে পারলে কী ভালোই না হত! আমাদের বাড়ির পেছনে কিছু অদ্ভুত গাছ বাড়ির আদি মালিক বাবু অশ্বিনী রায় (আমার দাদাজান এই বাড়ি পরে তাঁর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন।) লাগিয়েছিলেন। গাছগুলির নাম এখানে কেউ জানে না। এর মধ্যে একটা গাছের গা থেকে নীল বর্ণের কষ বের হয়। দু বছর পরপর মরিচের ফুলের মতো নীল রঙের ফুল ফোটে। আমার স্ত্রী এই গাছটির নাম দিয়েছে—নীল মরিচ গাছ। আমার এখানে যে-ই আসে সে-ই এই গাছটার একটা নাম দেয়। আপনিও হয়তো একটা নাম দেবেন।

টোপ নাম্বার দুই

আপনার বিষয়ে একটা বইয়ে পড়েছি আপনার সারা জীবনের শখের বস্তু হল ভালো একটা টেলিস্কোপ। যে টেলিস্কোপে আপনি বৃহস্পতির চাঁদ দেখতে পারবেন, শনির বলয় দেখতে পারবেন। আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, টেলিস্কোপ চোখে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা বর্তমানে আমার একমাত্র শখ। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ দেখা বা শনির বলয় দেখার চেয়েও বিস্ময়কর দৃশ্য এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ দেখা। নক্ষত্রপুঞ্জের স্পাইরালে শত শত নক্ষত্র ঝলমল করছে। এই দৃশ্য একবার দেখলে সারা জীবনের জন্যে আকাশের গায়ে আটকে থাকতে হবে। আমি সর্বশেষ যে টেলিস্কোপটি এনেছি তার সঙ্গে ট্রেকার যুক্ত। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে টেলিস্কোপও ঘুরবে, কাজেই আকাশে যে বস্তুটিকে ফোকাস করা হয়েছে সেই বস্তু কখনো দৃষ্টির আড়াল হবে না। আপনি যদি আসেন দু জনে মিলে আকাশের তারা দেখব। দু জনে মিলে দেখব কারণ লিলির তারা দেখার বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। আমি ঠিক করে রেখেছি আমার চারটা টেলিস্কোপের একটা আমি আপনাকে উপহার দেব। চারটা টেলিস্কোপই আমার অত্যন্ত প্রিয়। সেখান থেকে আপনাকে একটা উপহার হিসেবে দিতে আমার কষ্ট যে হবে না তা না। কষ্ট হবে তবে আপনি এই টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে গাঢ় আনন্দ পাবেন এটা ভেবেই সেই কষ্ট দূর করব।

টোপ নাম্বার তিন

এইটিই শেষ টোপ। আমি নিশ্চিত এই টোপে আপনি কাবু হবেন। ইএসপি ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে আপনার প্রবল কৌতূহল। সালমা নামের একটি ১৪/১৫ বছরের মেয়ে আমাদের সন্ধানে আছে। গ্রামেরই মেয়ে।

মেয়েটি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন। আমি নানাভাবে পরীক্ষা করেছি। এবং নিশ্চিত হয়েছি। একটি পরীক্ষা হল বিখ্যাত জেনার টেস্ট। তার ক্ষমতা কোন পর্যায়ের সেটা এখন আর ব্যাখ্যা করলাম না। কিছুটা রহস্য রেখে দিলাম।

টোপ নাম্বার চার

যদিও তিনটা টোপ ব্যবহার করার কথা ছিল, তারপরেও আমি চতুর্থ টোপটি ব্যবহার করছি। অনেকের ব্যাপারে এই টোপ কাজ করলেও আপনার ব্যাপারে করবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা হল লিলির রান্না। রান্নার উপর নোবেল পুরস্কার দেবার ব্যাপার থাকলে প্রতি বছরই সে একটা করে নোবেল পুরস্কার পেত। সামান্য আলু ভাজাও যে অমৃতসম খাদ্য হতে পারে লিলির আলু ভাজা না খেলে বুঝতে পারবেন না।

টোপ নাম্বার পাঁচ

ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক আরো একটি টোপ। এটি আপনাকে কাবু করে ফেলবে বলে আমার ধারণা। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির কথা বলছি। বইয়ের মোট সংখ্যা আঠার হাজারের বেশি। আপনার পছন্দের বিষয়ে (সাইকোলজি, বিহেভিয়ারেল সায়েন্স) প্রচুর বই আছে। শুধু একটি নাম উল্লেখ করছি Asmond-এর The Other Mind.

মিসির আলি সাহেব, কয়েকটা দিনের জন্যে আপনি কি আসতে পারেন না? আমার শরীর পঙ্গু কিন্তু মনটা পঙ্গু না। আপনি নিজে একজন সতেজ মনের মানুষ। আপনার সঙ্গে মানসিক যোগাযোগের জন্যে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।

বিনীত
এস. সুলতান হক

পুনশ্চ : আকাশ দেখার জন্যে এই সময়টা খুব ভালো। কুয়াশা থাকে না। এবং চারদিন পরই অমাবস্যা। আকাশ ভর্তি হয়ে যাবে তারায়। শুক্লপক্ষ তারা দেখার জন্যে ভালো না। চাঁদের আলোয় তারাদের ঔজ্জ্বল্য কমে যায়। কাজেই এখনি সময়।

মিসির আলি যে কোনো চিঠি তিনবার পড়েন। চিঠির ভেতরে কিছু কথা থাকে যা একবার পড়ে ধরা যায় না। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বারে ধরা পড়ে। এটিও তিনবার পড়লেন। সুন্দর চিঠি। সুন্দর হাতের লেখা। প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট। কাটাকুটি যে নেই তা না। তবে কাটা অংশগুলি হোয়াইট ইঙ্ক দিয়ে মুছে দেওয়া। ভদ্রলোকের বাগানবাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সম্ভব না। মিসির আলি তাঁর ছাত্রকে কুরিয়ারে চিঠি দিয়েছেন। সে সব কাজ ফেলে টেকনাফে এসে বসে থাকবে। তিনি না পৌঁছলে খুব অস্থির বোধ করবে। দুশ্চিন্তা করবে। তিনি কাউকে অকারণ দুশ্চিন্তায় ফেলতে চান না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *