০৪. ছোট মা

ছোট মাকে আমি দেখতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম দু দিন, তিন দিন পরপর হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্যে দেখা যেত। তারপর রোজ-ই দেখতে পেতাম।

শুরুতে তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ শুনতেন। তারপর কথা বলা শুরু করলেন। কথা বলতেন ফিসফিস করে। কোথাও কোনো শব্দ হলে দারুণ চমকে উঠতেন।

হয়তো বাতাসে দরজা নড়ে উঠল—সেই শব্দে মা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে চলে গেলেন পর্দার আড়ালে। ছোট মার দেখা পাওয়াটা ঠিক স্বাভাবিক ব্যাপার না এটা আমার বোধের ভেতর ছিল। আমি এর বাইরেও কিছু কিছু ব্যাপার লক্ষ করলাম। যেমন ছোট মা কখনো কিছু খান না। আমি কমলা সেধেছি। প্লেট থেকে কেক তুলে দিয়েছি। তিনি কখনো কিছু মুখে দেন নি। তিনি যখন আশপাশে থাকতেন তখন আমি এক ধরনের গন্ধ পেতাম। মিষ্টি গন্ধ, তবে ফুলের গন্ধ না। ওষুধ ওষুধ গন্ধ।

আসল ছোট মার সঙ্গে এই মায়ের কিছু অমিলও ছিল। যেমন ছোট মা আমাকে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডাকতেন। ইনি ডাকতেন না। একদিন আমি নিজেই বললাম, তুমি ওই নামগুলি বল না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন নাম? তা থেকে বুঝলাম নামগুলি তিনি জানেন না।

ছোটরাও নিজেদের মতো করে কিছু পরীক্ষাটরীক্ষা করে। আমিও ছোট মাকে নিয়ে কিছু পরীক্ষা করলাম—যেমন একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?

ছোট মা বললেন, জানি না তো।

আমি বললাম, সত্যি জান না?

তিনি বললেন, না। আমার কী নাম?

আমি বললাম, তোমার নাম চাঁপা।

তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? আমার সামান্য খটকা লাগলেও আমি নির্বিকার ছিলাম। একজন খেলার সাথী পেয়েছি, এই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল।

ছোট মা খেলার সঙ্গী হিসেবে চমৎকার ছিলেন। যা বলা হত তাই রোবটের মতো করতেন। কোনো প্রশ্ন করতেন না। মা’দের ভেতর খবরদারির একটা ব্যাপার থাকে। ওনার ভেতর তা ছিল না।

পায়ে মোজা নেই কেন?

ঘর নোংরা করছ কেন?

ঘুমাতে যাচ্ছ না কেন?

এ জাতীয় প্রশ্ন করে তিনি আমাকে কখনো বিব্রত করতেন না। আমার বেশ কজন টিচার ছিলেন। পড়ার টিচার, গানের টিচার, নাচের টিচার। তাঁরা যখন আসতেন—নিচ থেকে ইন্টারকমে আমাকে বলা হত। আমি নিচে যাবার জন্যে তৈরি হতাম। মাকে সেই সময় খুব বিব্রত মনে হত। তিনি যেন ঠিক বুঝতে পারছেন না কী করবেন। তাঁকে খুব কাঁদতেও দেখতাম। দু হাতে মুখ ঢেকে খুনখুন করে কাঁদতেন। চোখ দিয়ে তখন অবিশ্যি পানি পড়ত না। তাঁর কান্না সব সময় ছিল অশ্রুবিহীন।

মিসির আলি সাহেব আপনি আমার সামনে নেই বলে আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে। হয়তো আপনার মনে অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে, কিন্তু আপনি প্রশ্নগুলি করতে পারছেন না। সামনাসামনি থাকলে প্রশ্ন করতে পারতেন। আর আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না—কোনো ডিটেল বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না। গুরুত্বহীন মনে করে আমি হয়তো অনেক কিছু লিখছি না—যা আপনার কাছে মোটেই গুরুত্বহীন না। তবু আপনার মনে সম্ভাব্য যেসব প্রশ্ন আসছে বলে আমার ধারণা—আমি তার জবাব দিচ্ছি।

প্রশ্ন : উনার গায়ে কী পোশাক থাকত?

উত্তর : সাধারণ পোশাক শাড়ি। যেসব শাড়ি আগে পরতেন সেইসব শাড়ি। প্রশ্ন : উনি কি হঠাৎ উপস্থিত হতেন এবং পরে বাতাসে মিলিয়ে যেতেন?

উত্তর : না। কখনো হঠাৎ উদয় হতেন না। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেন। বের হয়ে যাবার সময়ও দরজা খুলে বের হয়ে যেতেন। তাঁর পুরো ব্যাপারটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। তাঁকে আমি কখনো শূন্যে ভাসতে দেখি নি—কিংবা লম্বা একটা হাত বের করে দূর থেকে কিছু আনতে দেখি নি।

প্রশ্ন : তুমি নিশ্চিত যে উনি তোমার ছোট মা?

উত্তর : জি নিশ্চিত। তবে আগেই তো বলেছি—আমার চেনা ছোট মার সঙ্গে তাঁর কিছু অমিল ছিল—যেমন তিনি পড়তে পারতেন না। অথচ ছোট মা আমাকে রোজ রাতে গল্পের বই পড়ে শুনাতেন। কাজেই আমি একদিন উনাকে গল্পের বই পড়ে শুনাতে বললাম। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন যে তিনি বই পড়তে জানেন না। তিনি আমাকে বই পড়া শেখাতে বললেন।

প্রশ্ন : তুমি তাঁকে বই পড়া শেখালে?

উত্তর : জি। উনি খুব দ্রুত শিখে গেলেন।

প্রশ্ন : উনি কি তোমার জন্যে কখনো কোনো উপহার নিয়ে এসেছেন?

উত্তর : জি এনেছেন।

প্রশ্ন : কী উপহার?

উত্তর : সেটা আমি আপনাকে বলব না।

প্রশ্ন : তুমি ছাড়া আর কেউ কি উনাকে দেখেছে?

উত্তর : জি না।

প্রশ্ন : তাঁকে দিনে বেশি দেখা যেত, না রাতে?

উত্তর : দিন রাত কোনো ব্যাপার ছিল না।

প্রশ্ন : সব সময়ই কি একই কাপড় পরা থাকতেন?

উত্তর : জি না। একেক সময় একেক কাপড় পরা থাকত।

প্রশ্ন : তিনি তোমার গায়ে হাত দিয়ে আদর করতেন?

উত্তর : জি করতেন। মাঝে মাঝে আমি তাঁর কোলে উঠে বসে থাকতাম।

যেসব প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছে তার উত্তর দিলাম। অনেক চিন্তা করেও আর কোনো প্রশ্ন পাচ্ছি না। আপনারা যারা সাইকিয়াট্রিস্ট তাঁরা তো রাজ্যের প্রশ্ন করেন। উদ্ভট সব প্রশ্ন। আপনার মাথাতেও নিশ্চয়ই উদ্ভট সব প্রশ্ন আসছে। ও না ভুল করলাম- আপনি তো আবার অন্যদের মতো না। আপনি প্রশ্ন করেন না। শুধু শুনে যান। একই গল্প বারবার শোনেন। শুনতে শুনতে হঠাৎ এক জায়গায় খটকা লাগে। সেখান থেকে আপনার যাত্রা শুরু হয়। আমার গল্পে কোথাও কি কোনো খটকা লেগেছে? নাকি পুরো গল্পই ‘খটকাময়’? পুরো গল্প খটকাময় হলে তো আপনি কাগজগুলি ছুড়ে ফেলে বলবেন—আরে দূর দূর।

প্লিজ তা করবেন না। আমার অনেক কিছু বলার আছে। Please Help Me. আপনি নিশ্চয়ই এখন বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। ভাবছেন মেয়েটার কী কনট্রাডিকশান— সাহায্য চাচ্ছে, আবার কোনো ঠিকানা দিচ্ছে না। যোগাযোগ করছে না। নিজের পরিচয় গোপন করছে। আসল নাম না বলে, বলছে নাম চিত্রা। তা হলে সাহায্যটা করা হবে কীভাবে? আসলে আমি সাহায্য চাই না। কারণ আমি ভালোই আছি। আমার বিচিত্র জীবন সম্পর্কে আমি আপনাকে বলব। আপনি শুনবেন। আমার সমস্যার সমাধান করবেন। তার উপর একটা বই লেখা হবে। সেই বই কিনে আমি পড়ব। আমার এতেই হবে। এর বেশি সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই।

আরেকটা কথা—আপনি আবার ভাবছেন না তো আমার এই গল্প বানোয়াট গল্প? আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্যে উদ্ভট একটা গল্প ফেঁদেছি? একবার আপনার মাথায় এই ব্যাপারটা ঢুকে গেলে আপনি মনোযোগ দিয়ে আমার লেখা পড়বেন না। এমনও হতে পারে যে কাগজগুলি ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন। আমার প্রধান দায়িত্ব আপনাকে বিশ্বাস করানো—আমি যা বলছি, সত্যি বলছি। আমার কাছে যা ‘সত্যি’ অন্যের কাছে হয়তো নয়। সত্য একেক জনের কাছে একেক রকম। Truth has many faces. তাই না?

আমি যে সত্যি বলছি সেটা কী করে প্রমাণ করব? আমি জানি না। আমি আপনার হৃদয়ের মহত্ত্বের কাছে সমর্পণ করছি এবং আশা করছি আমাকে বিশ্বাস করবেন। আজ এই পর্যন্তই লিখলাম। মাথা ধরেছে—এখন আর লিখতে পারছি না। আপনার ঠোঁটে কি এখন মৃদু একটা হাসির রেখা? সাইকিয়াট্রিস্টরা ‘মাথা ধরেছে’ বাক্যটা শুনলেই নড়েচড়ে বসেন। তাদের ভাবটা হচ্ছে—’এইবার পাওয়া গেছে’ মাথায় সমস্যা বলেই মাথা ধরা।

আমেরিকার একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। আমি যাই নি—আমার বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ কথা বলার পরই গম্ভীর গলায় বললেন, ইয়াং লেডি, তোমার কি প্রায়ই মাথা ধরে?

আমি বললাম—হ্যাঁ।

ভদ্রমহিলার ঠোটে আনন্দের হাসি দেখা গেল। ভাবটা হচ্ছে—I got you at last.

তারপর অসংখ্য প্রশ্ন, সবই মাথা ধরা নিয়ে।

কখন মাথা ধরে? রাতে বেশি, না দিনে?

মাথা ধরার সময় কি চোখ জ্বালা করে? কান লাল হয়ে যায়?

মাথা ধরার তীব্রতা কেমন?

কতক্ষণ থাকে?

তখন কি পানির পিপাসা হয়?

আমি যখন বললাম, ম্যাডাম আমার মাথা ধরাটা খুবই স্বাভাবিক ধরনের। মাঝে মধ্যে মাথা ধরে—প্যারাসিটামল খাই, কিংবা গরম চা খাই। মাথা ধরা সেরে যায়। ভদ্রমহিলা তাতে খুব হতাশ হলেন।

আপনিও কি হতাশ হচ্ছেন?

এমনিতে আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিক মানুষ। আমি আমার মৃতা মাকে দেখতে পেতাম এই অস্বাভাবিকতাটা ছোটবেলায় ছিল—বেশি দিনের জন্যে কিন্তু না। খুব বেশি হলে সাত কিংবা আট মাস। হঠাৎ একদিন সব আগের মতো হয়ে গেল। ছোট মার আসা বন্ধ হল। আমি কিছুদিন প্রবল হতাশায় কাটালাম। ছোটদের হতাশা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। তবে তার স্থায়িত্বও কম হয়। শিশুদের প্রবল শোক এবং প্রবল হতাশা কাটিয়ে ওঠার সহজাত ক্ষমতা থাকে। আমিও হতাশা কাটিয়ে উঠলাম। ধীরে ধীরে সব আগের মতো হয়ে গেল। অবিশ্যি ছোট মা আসা পুরোপুরি বন্ধ করলেন তাও না। তিন- চার মাস পরপর হঠাৎ চলে আসতেন। আমি তখন বলতাম, এতদিন আস নি কেন? তিনি বলতেন—আসার পথ ভুলে যাই। মনে থাকে না। আমার জীবন যাপন স্বাভাবিক হলেও আমি বড় হচ্ছিলাম নিঃসঙ্গতায়। আমার চারপাশে কেউ ছিল না। আমার নিঃসঙ্গতা দূর করলেন নীতু আন্টি। তিনি আমাদের বাড়িতে থাকতে এলেন। আরো পরিষ্কার করে বলি—বাবা তাঁকে বিয়ে করলেন। আচ্ছা আপনি কি বাবার ওপর বিরক্ত হচ্ছেন? কেমন মানুষ, একের পর এক বিয়ে করে যাচ্ছে। দয়া করে বিরক্ত হবেন না। আমার বাবা অসাধারণ একজন মানুষ।

এই যা মাথা ধরা নিয়ে অনেকক্ষণ লিখে ফেললাম। আচ্ছা আপনার কি এখন মাথা ধরেছে? কেন জিজ্ঞেস করলাম জানেন। ধরুন আপনি একজনের সঙ্গে কথা বলছেন। যার সঙ্গে কথা বলছেন তার প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই দেখবেন আপনারও মাথা ধরেছে। কোনো কারণ ছাড়াই ধরেছে। এটা বহুল পরীক্ষিত একটা ব্যাপার। আমি অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছি। আপনিও করে দেখতে পারেন। এবার আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। বলুন তো কোন প্রাণীর দুটা লেজ? খুব সহজ! একটু চিন্তা করলেই পেয়ে যাবেন।

মিসির আলি পড়া বন্ধ করলেন। তিনি অনেক ভেবেও বের করতে পারলেন না কোন প্রাণীর দুটা লেজ। একবার টিকটিকির কথা মনে হয়েছিল। টিকটিকির একটা লেজ খসে গেলে আরেকটা গজায় সেই অর্থে টিকটিকিকে দুই লেজের প্রাণী কি বলা যায়? না—টিকটিকি হবে না।

উত্তরও কোথাও দেয়া নেই। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলেই উত্তরটা জানা যাবে। দেখা হবার সম্ভাবনা কতটুকু? এখনো তেমন কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। কারণ মেয়েটিকে খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা তিনি করছেন না। বয়সের কারণে তাঁর ভেতর এক ধরনের আলস্য কাজ করা শুরু করেছে। আশপাশের জগৎ সম্পর্কে উৎসাহ কমে যাচ্ছে। লক্ষণ খুব খারাপ।

আত্মার মৃত্যু হলেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটে। কোনো কিছুই মনকে আকৃষ্ট করে না। আত্মার মৃত্যু হয়েছে কি হয় নি তা বের করার একটা সহজ পদ্ধতির কথা তিনি জানেন। বৃষ্টি কেটে যাবার পর আকাশে যখন রঙধনু ওঠে সেই রঙধনুর দিকে তাকিয়ে যে চোখ নামিয়ে নেয় এবং দ্বিতীয়বার তাকায় না, তার আত্মার মৃত্যু হয়েছে। আকাশে রঙধনু না উঠলে তিনি তার আত্মার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না।

মৃত আত্মাকে জীবনদান করারও কিছু পদ্ধতি আছে। সবচে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে শিশুদের সঙ্গে মেশা। শিশুরা সব সময় তাদের আশপাশের মানুষদের তাদের আত্মা থেকে খানিকটা ধার দেয়।

সমস্যা হচ্ছে শিশুদের মিসির আলি তেমন পছন্দ করেন না। এদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে। শিশুরা সুন্দর—অসম্ভব সুন্দর। যে কোনো বড় সৌন্দর্যকে দেখতে হয় দূর থেকে। যত দূর থেকে দেখা যায় ততই ভালো। ‘কুৎসিত জিনিস দেখতে হয় কাছ থেকে, সুন্দর জিনিস দূর থেকে।’ এটা যেন কার কথা? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি কি দুর্বল হতে শুরু করেছে?

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মস্তিষ্ক তার মেমোরি সেলে জমিয়ে রাখা স্মৃতি ফেলে দিয়ে সেলগুলি খালি করছে। মৃত্যুর ঠিক আগে আগে মেমোরি সেলে কোনো মেমোরি থাকে না। মস্তিষ্ক সব ফেলে দিয়ে ঘর খালি করে দেয়।

মিসির আলি ঘুমাতে গেলেন রাত দশটায়। ইদানীং তিনি খুব নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করছেন। যেমন রাত দশটা বাজতেই ঘুমাতে যাওয়া। সকালবেলা মর্নিং ওয়াক। ঘড়ি ধরে কাজ করার চেষ্টা। রাত দশটায় ঘুমাতে গেলেও লাভ হচ্ছে না—ঘুম আসতে আসতে তিনটা বেজে যাচ্ছে। দশটা থেকে রাত তিনটা এই পাঁচ ঘণ্টা মস্তিষ্ককে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় রাখা সম্ভব না। মিসির আলি সেই চেষ্টা করেনও না। তিনি শুয়ে শুয়ে ফারজানা মেয়েটিকে নিয়েই ভাবেন।

মেয়েটি স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী। সে তা জানে না। অধিকাংশ স্কিজোফ্রেনিয়াকই তা জানে না। তারা ভেবে নেয়—তাদের দেখা জগৎই সত্যি জগৎ। অন্যদের জগৎ ভ্রান্তিময়। তাদের একটা যুক্তি অবশ্যই আছে। কালার ব্লাইন্ড একজন মানুষ সবুজ রঙ দেখতে পায় না। তার জগতে সবুজের অস্তিত্ব নেই। সে বলবে পৃথিবীতে সবুজ রঙ নেই। তার কাছে এটাই সত্যি। তার সেই জগৎ মিথ্যা নয়।

মিসির আলি জেগে আছেন—তাঁর মাথায় ফারজানা মেয়েটি নেই। তাঁর মাথায় ঘুরছে কোন প্রাণীর লেজের সংখ্যা দুই। তাঁর হঠাৎ মনে হল ফারজানা মেয়েটি ইচ্ছে করে তাঁর মাথায় এই ধাঁধাটি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ধাঁধার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। মেয়েটি এই ব্যাপার জানে। স্কিজোফ্রেনিয়াকরা খুব বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। তারা নিজেরা বিভ্রান্তির জগতে বাস করে বলেই হয়তো অন্যদের বিভ্রান্তিতে ফেলে আনন্দ পায়। মিসির আলির মাথা দপদপ করছে। রেলগাড়িতে চড়লে যেমন কিছুক্ষণ পরপর শব্দ হয়—তাঁর মাথার ভিতর ঠিক সেরকম খানিকক্ষণ পরপর প্রশ্ন উঠছে—

কোন প্রাণীর দুটা লেজ?

কোন প্রাণীর দুটা লেজ??

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *