১০. তৃতীয় চ্যাপ্টার

১০

মিসির আলি তৃতীয় চ্যাপ্টার পড়ছেন। এই অংশটি নতুন লেখা হয়েছে। তারিখ দেখে মিসির আলি বুঝতে পারছেন—পার্কে তাঁর সঙ্গে দেখা হবার পর—এই লেখা শেষ করা হয়েছে। পুরা লেখাটা ইংরেজিতে লেখা। শিরোনাম—I and We. বাংলা করলে হয়তো হবে—আমি এবং আমরা।

আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয়েছে আমি ভীতু? একজন মানুষকে দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব না—সে সাহসী না ভীতু। তা ছাড়া একজন ভীতু মানুষকেও ক্ষেত্রবিশেষে খুব সাহসী হতে দেখা যায়

আমি ভীতু না। কখনোই ছিলাম না। বাবাকে ভয় করতাম, বাবার কুকুরগুলোকে ভয় করতাম। বাবা যে বন্দুক নিয়ে মাঝে মাঝে দোতলায় বের হতেন সেই বন্দুকটাকে ভয় করতাম। আমার ভয় এই তিনটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ও না, আরেকটি ভয়ের ব্যাপার আমার মধ্যে ছিল। আমাদের পুরো বাড়ি মাঝে মধ্যে এক ধরনের বিচিত্র শব্দ করে নড়ে উঠত। সর্দার চাচা বলতেন, বাড়ি মাঝে মধ্যে কাঁদে, হাসে। এতে ভয়ের কিছু নাই।

অন্ধকারকে ভয় পাওয়া আমার মধ্যে ছিল না। পুরোনো ঢাকায় প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। হয়তো রাতে একা ঘরে বসে আছি—হঠাৎ পুরো অঞ্চলের কারেন্ট চলে গেল। গাঢ় অন্ধকারে আমি একা বসে আছি। নিজের হাতও দেখা যাচ্ছে না—এই অবস্থাতেও আমি কখনো ভয় পাই নি।

ভূতপ্রেতে ভয় পাওয়ার ব্যাপারও আমার মধ্যে ছিল না। কারণ ভয়ের গল্প আমাকে কেউ শোনায় নি। কেউ আমাকে বলে নি ঘরের কোনায় বাস করে কোণী ভূত। খাটের নিচে উবু হয়ে বসে থাকে কন্দকাটা। গভীর রাতে সে তার সরু বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত খাটের নিচ থেকে বের করে শুয়ে থাকা মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করে। শিশুরা সচরাচর যেসব কারণে ভয়ে কাতর হয়ে থাকে সেসব আমার ছিল না। তা ছাড়া অল্পবয়সেই যুক্তি ব্যবহার করতে শিখি। ভয়কে পরাজিত করতে যুক্তির মতো বড় অস্ত্র আর কী হতে পারে? ধরুন—গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল।

আমি শুনলাম, বাথরুমে খটখট শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হাঁটছে। আতঙ্কে অস্থির না হয়ে আমি যুক্তি দাঁড় করলাম নিশ্চয় নিশ্চয়ই ইঁদুর। কিছুক্ষণ কান পেতে রইলাম। ইঁদুরের কিচকিচ শব্দ শোনা গেল। যুক্তির ওপর নির্ভর করার ফল হাতে হাতে পেলাম। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে গেলাম। ভয়ে অস্থির হয়ে চেঁচামেচি করলাম না। চেঁচামেচি করে অবিশ্যি কোনো লাভও হত না। দশ বছর বয়স হবার পরই আমি থাকতাম একা। সর্দার চাচা থাকতেন গেটের কাছে। দারোয়ান এবং মালিদের জন্যে যে ঘরগুলো আছে—তার একটিতে।

মাস্টার সাহেবের মৃত্যুর প্রায় মাস দুই পরের ঘটনা। খাওয়াদাওয়া করে ঘুমুতে গেছি। সর্দার চাচা বললেন, ছিটকিনি লাগাও।

আমি ছিটকিনি লাগালাম। সর্দার চাচা তাঁর অভ্যাসমতো বললেন, ভালো কইরা দেখ ঠিকমতো লাগছে কি না।

আমি আরেকবার দেখলাম। ঠিকমতোই লেগেছে।

‘এখন বাতি নিভাও। বাতি নিভাইয়া ঘুমাও।’

আমি বাতি নিভিয়ে চারদিক অন্ধকার করে ঘুমুতে গেলাম। আপনাকে বলা হয় নি, আমার বাবা শব্দ যেমন সহ্য করতে পারতেন না, তেমনি আলোও সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর ধারণা, আলোতে কুকুর ভালো দেখতে পায় না। অন্ধকারে ভালো দেখে কাজেই রাত এগারোটার পর এ বাড়ির সব বাতি নেভানো থাকতে হবে। একটি বাতিও জ্বলবে না।

রাত এগারোটা হয়েছে। সব বাতি নিভে গেছে। আমি মশারির ভেতর শুয়ে আছি। আমার বালিশের কাছে দু ব্যাটারির একটা টর্চ লাইট। অন্য সময় বিছানায় যাওয়ামাত্র ঘুম এসে যায়। আজ ঘুম আসছে না। জেগে আছি। হঠাৎ পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল। বিচিত্র শব্দ হল। বাড়ি কেঁদে উঠল কিংবা হেসে উঠল। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। আর তখন লক্ষ করলাম কুকুরগুলো একে একে আমার ঘরের দরজার বাইরে জড়ো হচ্ছে। এরা চাপা গর্জন করছে। দরজা আঁচড়াচ্ছে। এরা এরকম করছে কেন?

আমার মনে হল খাটের নিচে কী যেন নড়ে উঠল। কেউ যেন নিশ্বাস ফেলল। আমি টর্চ লাইট জ্বালিয়ে খাট থেকে নেমে এলাম। বসলাম খাটের পাশে—টর্চ লাইট ধরলাম। প্রথমে দেখলাম দুটা চকচকে চোখ। পশুদের চোখে হঠাৎ আলো ফেললে যেমন চকচক করতে থাকে। এই চোখ দুটিও ঠিক সেরকমই চকচক করছে। তারপর মানুষটাকে দেখলাম। নগ্ন একজন মানুষ। খাটের নিচে কুঁজো হয়ে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। যেন টর্চ ফেলে তাকে দেখায় সে আনন্দিত।

আমি হতভম্ব গলায় বললাম, কে?

লোকটা জবাব দিল না। নিঃশ্বব্দে হাসল। তখনই আমি তাকে চিনলাম। আমার প্রাইভেট স্যার।

তখনো আমার এই বোধ হয় নি যে আমি ভয়ংকর একটি দৃশ্য দেখছি। যাকে দেখছি সে মানুষটি জীবিত নয়—মৃত। একজন মৃত মানুষ খাটের নিচে কুঁজো হয়ে বসে থাকতে পারে না। আমি একটি ভয়াবহ অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখছি।

আমি শান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে পড়লাম। যেন কিছুই হয় নি। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। টর্চের আলো নিভিয়ে দিলাম। আর তখনই সীমাহীন ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করল। এই ভয়ের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। এ ভয়ের জন্ম পৃথিবীতে নয়— অন্য কোথাও।

তীব্র ভয়ের পরপরই একধরনের অবসাদ আছে। ভয়ংকর সত্যকে সহজভাবে নিতে ইচ্ছা করে। ফাঁসির আসামি মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর আতঙ্কে অস্থির হয়। সেই আতঙ্ক দ্রুত কমে যায়। মৃত্যুর ক্ষণ যখন উপস্থিত হয় তখন সে সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে যায় ফাঁসির মঞ্চের দিকে। এমন কোনো ফাঁসির আসামির কথা জানা নেই— যাকে কোলে করে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে হয়েছে।

আমি মাস্টার সাহেবকে গ্রহণ করলাম সহজ সত্য হিসেবে। এ ছাড়া আমার উপায়ও ছিল না। মাস্টার সাহেব বাস করতে শুরু করলেন আমার খাটের নিচে। দিনের বেলা কখনো তাঁকে দেখা যায় না। সন্ধ্যাবেলা না। রাতে শোবার সময় খাটের নিচে তাকাই। তখনো কেউ নেই। শুধু গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলেই তীব্র তামাকের গন্ধ পাই। বুঝতে পারি খাটের নিচে তিনি আছেন। কুকুরগুলো দরজা আঁচড়াতে থাকে। তিনি কিছু কিছু কথাও বলেন। এবং আশ্চর্যের কথা—আমি জবাব দেই। যেমন —

‘তুমি জেগেছ?’

‘হুঁ।’

‘কটা বাজে?’

‘জানি না।’

‘ভয় লাগছে?’

‘না।’

‘পড়াশোনা হচ্ছে ঠিকমতো?’

‘হচ্ছে।’

‘তোমার সর্দার চাচাকে আমার কথা বলেছ?’

‘না।’

‘কাউকেই বল নি?’

‘না।’

‘ইচ্ছে করলে বলতে পার। অসুবিধা নেই।

‘ইচ্ছে করে না।’

‘আমি কেন তোমার খাটের নিচে থাকি জান?’

‘না।’

‘জানতে চাও?’

‘না।’

‘জানতে না চাইলে জানতে হবে না। সবকিছু জানতে চাওয়া ভালো না। না জানার মধ্যেও আনন্দ আছে। আছে না?’

‘জি আছে।’

‘ইংরেজি একটা প্রবাদ আছে। তোমাকে একবার পড়িয়েছিলাম। মনে আছে?’

‘আছে।’

‘বল তো দেখি।’

‘মনে পড়ছে না।’

‘মনে করার চেষ্টা কর। ইংরেজি বেশি বেশি করে পড়বে। অর্থের মানে বুঝতে না পারলে ডিকশনারি দেখবে।’

‘আচ্ছা।’

‘তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়েছ—কাজেই আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আমি তোমাকে সাহায্য করব। পরামর্শ দেব।’

‘আচ্ছা।’

‘আমার সম্বন্ধে তোমার কি কিছু জানতে ইচ্ছে করে?’

‘না।’

‘জানতে ইচ্ছে করলে জিজ্ঞেস কর। আমি বলব। আমি এমন সব বিষয় জানি যা জীবিত মানুষ জানে না।’

‘আমি কিছু জানতে চাই না।

‘ঘুম পাচ্ছে?’

‘হুঁ।’

‘ঘুমিয়ে পড়। মশারি ঠিকমতো গোঁজা হয়েছে?’

‘হুঁ।’

‘বড্ড মশা। তুমি ঘুমাও। টর্চ লাইটটা কি হাতের কাছে আছে?’

‘আছে।’

‘একবার জ্বালিয়ে দেখে নাও ব্যাটারি ঠিক আছে কিনা।

‘ঠিক আছে।’

‘তোমার সর্দার চাচাকে বলে আরেক জোড়া ব্যাটারি এনে রাখবে।’

‘জি আচ্ছা।’

‘ঘুমিয়ে পড়।’

‘জি আচ্ছা।’

‘গায়ে চাদর দিয়েছ কেন? চাদর সরিয়ে ফেল। গরমে চাদর-গায়ে ঘুমুলে গায়ে ঘামাচি হবে।’

আমি চাদর সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার ঘুম ভাঙে। তীব্র তামাকের গন্ধ পাই। আমার ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারেন। ভরাট গলায় বলেন, ঘুম ভেঙেছে?

‘হুঁ।’

‘অসহ্য গরম পড়েছে। ঘন ঘন ঘুম ভাঙারই কথা। পানির পিপাসা হয়েছে?’

‘না।’

‘বাথরুমে যাবে?’

‘না।

‘গল্প শুনতে চাও?’

‘না।’

‘আমি তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তা করছি। এই সংসারে তুমি খুব শিগগিরই একা হয়ে যাবে। তোমার বাবা বেশিদিন বাঁচবেন না। সর্দার চাচাও থাকবেন না। তুমি হবে একা। বুঝতে পারছ??

‘পারছি।’

‘তোমরা বাবা যে মারা যাবেন এতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’

‘হচ্ছে।’

‘কষ্ট হওয়ারই কথা। তবে মৃত্যু তাঁর জন্যে মঙ্গলজনক হবে। কিছু মানুষের জন্যে মৃত্যু মঙ্গলময়। উনি অসুস্থ। অসুস্থতা ক্রমেই বাড়ছে। উনার যে অসুখ সেটা আরো বেড়ে গেলে—চারদিকে বিকট সব জিনিস দেখতে পান। সেই সব ভয়ংকর জিনিস দেখার কষ্ট মৃত্যু-যন্ত্রণার চেয়েও শতগুণে বেশি। মৃত্যু-যন্ত্রণা একবার হয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা হতেই থাকে। শেষ হয় না। ধাপে ধাপে বাড়ে। তোমার মনে হয় না মৃত্যু তাঁর জন্যে ভালো?’

‘জি মনে হয়।’

‘তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের সামান্য হলেও সাহায্য করা উচিত বলে আমি মনে করি। সাহায্য করা উচিত না?’

‘জি উচিত।’

‘কীভাবে সাহায্য করা যায় তুমি বল তো?’

‘আমি জানি না।’

‘আমার তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। আমি ছায়া মাত্র। আমি শুধু বুদ্ধি দিতে পারি। কিছু করতে পারি না। তবে আমার ক্ষমতা বাড়ছে। ছায়া জগতের ছায়াদের ক্ষমতা বাড়ে এবং কমে। যতই তুমি আমার ওপর বিশ্বাস করবে ততই আমার ক্ষমতা বাড়বে। তোমার সর্দার চাচা যদি আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে তা হলে আমার ক্ষমতা অনেকগুণে বেড়ে যাবে। তখন আমি ছোটখাটো কাজ করতে পারব। তুমি কি মনে কর না আমার ক্ষমতা বাড়া উচিত?’

‘মনে করি।

‘বুঝেছ তন্ময়, আমি তোমাকে সাহায্য করব। তোমার ক্ষতির চেষ্টা কখনো করব না। প্রচুর ক্ষমতা হবার পরও করব না। এখন ঘুমাও।’

‘আচ্ছা।’

‘ঘুম কি আসছে না?’

‘না।’

‘তা হলে এস আরো কিছুক্ষণ গল্প করি। তোমার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবি।’

‘ভাবতে ইচ্ছা করছে না।’

‘ভাবলে কোনো দোষ নেই। ভাবলেই যে করতে হবে তা তো না। আমরা কত কিছু ভাবি। ভাবলেই যে করতে হবে তা তো না। আমরা সব সময় যা ভাবি তা কি করি?’

‘না।’

‘বেশ এস, তা হলে ভাবি। তুমি কি কলা খাও তন্ময়?’

‘খাই।’

‘রাতে শোবার আগে এই কলার খোসাগুলো তুমি নিশ্চয়ই দোতলার সিঁড়ির মাথায় রেখে আসতে পার। পার না?’

‘হুঁ।’

‘এটা তো তেমন কোনো অন্যায় না। ঝুড়িতে না ফেলে সিঁড়ির মাথায় ফেলেছ। মনের ভুলেও তো ফেলতে পারতে। পারতে না?’

‘হুঁ।’

‘তোমার বাবা তো রাতে বারান্দায় হাঁটেন। অন্ধকার বারান্দা। মনের ভুলে তিনি কলার খোসায় পা ফেলতে পারেন। পারেন না?’

‘হুঁ, পারেন।’

‘কলার খোসায় পা পড়লে অনেক কিছুই হতে পারে। তিনি সামান্য হোঁচট খেতে পারেন। বারান্দায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে পারেন। আবার সিঁড়ির একেবারে নিচে পড়ে যেতে পারেন। পারেন না?’

‘হুঁ, পারেন।’

‘কোনটা ঘটবে আমরা জানি না। কবে ঘটবে তাও জানি না। প্রথম দিনেই যে ঘটবে তা তো না। প্রথম দিনে কিছু নাও ঘটতে পারে। দিনের পর দিন হয়তো আমাদের কলার খোসা রাখতে হবে। পারবে না? কথা বলছ না কেন? পারবে না?’

‘পারব।’

‘বাহ্ ভালো। ভেরি গুড। এখন ঘুমাও। আরাম করে ঘুমাও। ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। ঘুম ভালো হবে।’

আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

আমার বাবা মারা গেলেন কলার খোসায় পা হড়কে। তিনি সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যান। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পান। দুদিন হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় থেকে তৃতীয় দিনের দিন তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর জ্ঞান ফেরে। তিনি ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন—আমার ছোট্ট বাচ্চাটাকে কে দেখবে?

বাবার মৃত্যুর পর অনেকদিন আমার খাটের নিচে কেউ ছিল না। কতদিন তা বলতে পারব না। আমি এক ধরনের আচ্ছন্ন অবস্থার ভেতর ছিলাম। সময়ের হিসাব ছিল না। সারা দিন কুয়াতলায় ছবি আঁকতাম। সর্দার চাচা কুয়ার উপর বসে বিষণ্ন চোখে আমার ছবি আঁকা দেখতেন। একসময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলতেন, সৌন্দর্য হইছে। এখন ধুইয়া ফেলি।

আমার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য দীর্ঘদিন পর আমার মা উপস্থিত হলেন। সর্দার চাচা কঠিন গলায় তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি শুনলাম তিনি আমার মাকে বলছেন- খবরদার, এই দিকে পাও বাড়াইবেন না। পাও বাড়াইলে কুত্তা দিয়া খাওয়াইয়া দিমু।

বাবা কাগজপত্রে আমার জন্যে অভিভাবক নিযুক্ত করে রেখে গিয়েছিলেন। তিনি হলেন বাবার ম্যানেজার—ইসমাইল চাচা। পৃথিবীতে কঠিন মানুষ যে কজনকে আমি চিনি তিনি তাঁর একজন। তিনি কাজ ছাড়া অন্য কিছু কখনো ভালবেসেছেন বলে আমি জানি না। বাবার মৃত্যুর পর একদিন আমাদের এ বাড়িতে তিনি এলেন। আমাকে একটিও সান্ত্বনার কথা বললেন না। যন্ত্রের মতো গলায় বললেন, তুমি কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবে না। স্কুলে যাওয়া শুরু কর। পড়াশোনা কর। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। সেই চিন্তা আমি করব। তোমার মা, তোমার অভিভাবকত্বের জন্যে কোর্টে মামলা করেছেন। মামলায় লাভ হবে না। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে ছোটবেলায় তিনি তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। তার পরেও আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করি—তুমি কি চাও তোমার মা তোমার অভিভাবক হোক?

আমি বললাম, না।

‘বেশ। আমি তা হলে যাই। কোর্টে তোমাকে যেতে হতে পারে। তবে আমার ধারণা, তোমার মা মামলা তুলে নিবেন। উনাকে মোটা টাকার লোভ দেখানো হয়েছে। সেই লোভ তিনি সামলাতে পারবেন না। তুমি কি টাকার পরিমাণ জানতে চাও?’

আমি বললাম, না।

‘সেই ভালো। টাকাপয়সা থেকে দূরে থাকাই ভালো। তোমার বাবা আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব আমি পালন করব। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।’

যখন সব মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, যখন আমি ভাবতে শুরু করেছি খাটের নিচে আর কখনোই কাউকে দেখব না। আমার ভেতর এক ধরনের অসুখ তৈরি হয়েছিল, অসুখ সেরে গেছে তখনই এক রাতে খাটের নিচ থেকে তীব্র তামাকের গন্ধ পেলাম। আমি ফিসফিস করে বললাম, কে?

মাস্টার সাহেবের শ্লেষ্মাজড়িত ভারী গলার আওয়াজ পাওয়া গেল—আমি তন্ময়, আমি। তুমি কেমন আছ?

‘ভালো।’

‘আমি বুঝতে পারছি—ভালো আছ। ভালো আছ বলেই তোমাকে বিরক্ত করছি না। আমি কেমন আছি তা তো জিজ্ঞেস করলে না। জিজ্ঞেস কর।’

‘আপনি কেমন আছেন?’

‘আনন্দে আছি। আমার ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ছায়াজগতের এই এক মজা। ক্ষমতা যখন বাড়ে দ্রুত বাড়ে। আমি এখন তোমার বাবার দোতলার ঘরটায় থাকি। আরামে থাকি। নির্জনতা ভালো লাগে। একা থাকার মজাই অন্য রকম। মাঝে মাঝে তোমার বাবার টেলিফোন বেজে ওঠে। টেলিফোন রিসিভার তুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে। বলতে পারি না। এত ক্ষমতা আমার এখনো হয় নি। তবে দেরি নেই, হবে। খুব শিগগিরই হবে। তন্ময়!’

‘জি।’

‘তুমি একবার আমাকে সাহায্য করেছ—আরেকবার একটু সাহায্য করবে না? সামান্য সাহায্য। তা হলে তোমার সঙ্গে আমি একটা চুক্তিতে যাব। আমি তোমাকে বিরক্ত করব না। তুমি তোমার মতো থাকবে। আমি থাকব আমার মতো। আর সাহায্য যদি না কর তা হলে বাধ্য হয়ে তোমাকে বিরক্ত করতে হবে। তুমি কি চাও আমি তোমাকে বিরক্ত করি?’

‘না।’

‘তা হলে তুমি সাহায্য কর। কাজটা খুব সহজ। তুমি যখন কুয়োতলায় ছবি আঁক, তখন তোমার সর্দার চাচা কুয়ার পাড়ে বসে থাকেন। থাকেন না?’

‘হুঁ।’

‘বসে বসে ঝিমাতে থাকেন। মাঝে মাঝে তাঁর চোখও বন্ধ হয়ে যায়। যায় না?’

‘হ্যাঁ যায়।’

‘এই সময় সামান্য ধাক্কা দিলেই কিন্তু উনি কুয়ার ভেতর পড়ে যাবেন। অনেক দিনের পুরোনো কুয়া। বিষাক্ত গ্যাস জমে আছে—একবার কুয়ার ভেতর পড়ে গেলে বাঁচার কোনো উপায় নেই। পারবে না?’

‘না।’

‘দেখ তন্ময়, এটা না পারলে কী করে হবে? না পারলে আমি তোমাকে ক্রমাগত বিরক্ত করতে থাকব। রাতে ঘুম ভাঙলে দেখবে আমি তোমার পাশেই নগ্ন হয়ে শুয়ে আছি। সেটা কি তোমার ভালো লাগবে?’

‘না।’

‘তা হলে আমি যা বলছি তাই তুমি করবে। ঠিক না তন্ময়?’

‘হ্যাঁ।’

‘গুড বয়। ভেরি গুড বয়।’

তার দুদিন পরই কুয়ার ভেতর পড়ে সর্দার চাচা মারা যান। বাবার ম্যানেজার ইসমাইল চাচা তখন থাকতে আসেন আমার সঙ্গে। তিনি তাঁর মেয়েটিকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসেন।

.

ইসমাইল চাচা বিপত্নীক ছিলেন। তাঁর একটি মাত্র মেয়ে—মেয়েটির নাম রানু। তিনি রানুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠে এলেন। দুটা ঠেলাগাড়িতে করে তাঁদের মালপত্র চলে এল। বাড়ির এক অংশের পরপর তিনটি ঘর তিনি বেছে নিলেন। একটি তাঁর শোবার ঘর। একটি বসার। একটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। যে ব্যবস্থাগুলো তিনি করছেন সে সম্পর্কে আমাকে কিছুই বললেন না। তিনি বাড়িতে এসে উঠলেন, সকাল দশটার দিকে, দুপুরের মধ্যে বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন হল। যেমন তিনি সব কটি কুকুর বিদেয় করে দিলেন। তিনি বললেন, কুকুরের দরকার নেই। কুকুর দেখলে ভয় লাগে। বাড়ির পেছনের কুয়া বন্ধ করে দিলেন। কয়েক ট্রাক মাটি চলে এল। সন্ধ্যার মধ্যে কুয়া বুজিয়ে দেওয়া হল। সন্ধ্যার পর এই বাড়ির বাইরের বাতিগুলো আবার জ্বলল। তিনি অনেকক্ষণ একা একা মোড়া পেতে বাগানে রইলেন।

আমার সঙ্গে কথা হল রাতে ভাত খাবার সময়। আমাকে বললেন, তোমার নাবালক অবস্থায় আমি তোমার অভিভাবক। কাজেই তোমার আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি তোমার জন্যে যা ভালো মনে করি তা করব। তোমার যেদিন আঠারো বছর বয়স হবে সেদিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। নারায়ণগঞ্জে আমার একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। ঐ বাড়িতে গিয়ে উঠব। আমি বললাম, জি আচ্ছা।

তিনি বললেন, রানুকে আমি নিয়ে এসেছি, তোমার একজন কথা বলার লোক হল। তোমার কোনো কথা যদি আমাকে সরাসরি বলতে ইচ্ছা না করে—রানুকে বললেই আমি শুনব।

আমি বললাম, জি আচ্ছা

‘শীত এসে যাচ্ছে-বাড়ির চারদিকে এত খালি জায়গা আমি চাই তুমি ফুলের বাগান কর। কীভাবে মাটি তৈরি করতে হয়। কীভাবে বীজ পুঁততে হয়—রানু তোমাকে দেখিয়ে দেবে। ও জানে। নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে আমাদের খুব সুন্দর ফুলের বাগান ছিল।’

আমি বললাম, জি আচ্ছা।

রানু হেসে ফেলে বলল, বাবা এই ছেলেটা জি আচ্ছা ছাড়া আর কিছু বলতে পারে না। তুমি যাই বলবে, সে বলবে—জি আচ্ছা। তুমি যদি তাকে বল, তুমি সকালে উঠে তোমার মাথাটা কামিয়ে ফেলবে, তা হলে সে বলবে, জি আচ্ছা। ইসমাইল সাহেব বললেন, মা রানু এই ছেলে এখন থেকে তোমার ভাই। বোনরা ভাইকে যেভাবে আগলে রাখে তুমি তাকে সেইভাবে আগলে রাখবে।

রানু অবিকল আমার গলার স্বর নকল করে বলল, ‘জি আচ্ছা।’ ইসমাইল চাচা হাসতে গিয়েও হাসলেন না। কিন্তু আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। এমন প্রাণ খুলে আমি অনেকদিন হাসি নি।

.

আমার নতুন জীবন শুরু হল। আনন্দময় জীবন। সেই শীতে আমি এবং রানু মিলে সুন্দর বাগান করলাম। কসমস, ডালিয়া, গাঁদা ফুলের গাছ। ইসমাইল চাচা নিজে শুরু করলেন গোলাপের চাষ। তিনি একজন মালি রাখলেন। খুব নাকি এক্সপার্ট মালি, নাম রওশন মিয়া। সেই এক্সপার্ট মালিকে দেখা গেল খুরপি হাতে ঘুরে বেড়ায়। কাছে গেলেই ফুল বিষয়ে একটি গল্প বলে—বুঝলেন ভাইডি আল্লাহতালা তো বেহেশত বানাইলেন- সেই বেহেশতে কিন্তু কোনো ফুল গাছ নাই। তিনি বললেন, আমার বেহেশতে আমি ফুল দেব না। ফুল দিলে ফুল হবে মানুষের চেয়ে সুন্দর। এটা ঠিক না। মানুষের চেয়ে সুন্দর কিছু আমি বেহেশতে রাখব না। বুঝলেন ভাইডি এই জন্যে বেহেশতে ফুল গাছ নাই, ফুল নাই।

রানু বলল, চুপ কর মিথ্যুক।

রওশন কিছু বলতে গেলেই রানু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলত, চুপ কর মিথ্যুক। আমি হো হো করে হাসতাম।

আমি হাসি ভুলে গিয়েছিলাম। হাসি পেলেও কখনো হাসতাম না। সব সময় মনের ভেতর থাকত হাসলেই ওরা আমার কালো জিব দেখে ফেলবে।

রানু নামের এই অদ্ভুত মেয়েটি কখনো আমাকে আমার কালো জিব নিয়ে কিছু বলে নি। ভালবাসা কী আমি আমার জীবনে কখনো বুঝি না। এই কিশোরী ভালবাসার গভীর সমুদ্রে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল। রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার সময় আমি কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে বলতাম-আমি এত সুখী কেন? জীবনের প্রথম অংশ দুঃখে-দুঃখে কেটেছে বলেই কি এই অংশে এত সুখ?

মাস্টার সাহেব নামে একটি বিভীষিকা আমার জীবনে আছে, তা মনে রইল না। শুধু মাঝে মাঝে বাবার দোতলা ঘরের দিকে তাকালে গা কাঁটা দিয়ে উঠত। কখনো ঐ ঘরের কাছে যেতাম না। আমি একা না, অন্য কেউও যেত না। কারণ ইসমাইল চাচা কী জন্যে যেন একবার দোতলায় উঠেছিলেন —–ফিরে এসে আমাকে এবং রানুকে বললেন, তোমরা কেউ ওদিকে যাবে না। কখনো না, ভুলেও না।

রানু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বাবা?

তিনি কঠিন গলায় বললেন-আমি নিষেধ করেছি এই জন্যে। তিনি কাঠের মিস্ত্রি ডাকিয়ে দোতলা ঘরের দুটি দরজাতেই আড়াআড়ি পাল্লা লাগিয়ে দিলেন। দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে কাঁটাতারের গেট করে দিলেন। আমার জীবনের একটি অন্ধকার অংশকে তিনি পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। পুরোপুরি বোধহয় পারলেন না। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো খাট থেকে নেমে আসি। খাটের নিচে টর্চের আলো ফেলি। না কেউ সেখানে নেই। তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে আবার ঘুমুতে যাই।

.

আমি মেট্রিক পাস করলাম।

খুব ভালোভাবে পাস করলাম। পত্রিকায় আমার নাম ছাপা হল। আইএসসি পরীক্ষায় আরো ভালো ফল করলাম। এবার পত্রিকায় ছবি ছাপা হল। আমার কৌতূহল ছিল মনোবিজ্ঞানে, সায়েন্স ছেড়ে আর্টস নিলাম। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

রানুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সহজ। এই সম্পর্কে কোনো রকম জটিলতা ছিল না। মেয়েদের সঙ্গে মেশার আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। কারো সঙ্গেই আমি কখনো মিশি নি। কাছ থেকে দেখিও নি। এই প্রথম একজনকে দেখলাম। অন্য মেয়েরা কেমন জানি না—এই মেয়েটিকেই জানি। সহজ একটা মেয়ে কিন্তু রহস্যময়।

.

আমি রাত জেগে পড়ি সে রাত জাগতে পারে না। ঘুম ঘুম চোখে পাশে বসে থাকে। আমি বলি তুমি ঘুমিয়ে পড়। তুমি জেগে আছ কেন?

সে বিস্মিত হয়ে বলে, তাই তো আমি কেন জেগে আছি। আমি ঘুমাতে গেলাম। তুমি কতক্ষণ পড়বে?

‘অনেকক্ষণ।’

‘রাত একটা, না রাত দুটা?’

‘দুটা।’

‘আজ একটা, পর্যন্ত পড়লে কেমন হয়?’

‘একটা পর্যন্ত পড়লে তোমার কী লাভ?’

‘তুমি রাত জেগে পড়। আমার দেখতে কষ্ট হয়।’

‘কষ্ট হয় কেন?’

‘জানি না কেন হয়। তবে হয়।’

আমি রানুর ভেতর অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করতে লাগলাম। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকার প্রবণতা। যতক্ষণ বাড়িতে থাকব ততক্ষণই সে আমার পাশে থাকবে।

বাড়ির রান্নাবান্না তাকে করতে হয়। রান্না করতে যাবে, কিছুক্ষণ পরপর উঠে আসবে। আমি যদি বলি—কী? সে তৎক্ষণাৎ বলবে, কিছু না।

মাঝে মাঝে সে ভয়াবহ অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যায়। দেখেই মনে হয় তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে ঝড়ের কারণ সে জানে না। আমিও জানি না।

ইসমাইল চাচা তাঁর নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে চলে যাওয়া ঠিক করলেন। রানু বলল, অসম্ভব, আমি যাব না। ও বেচারা একা থাকবে? এত বড় বাড়িতে একা থাকলে ভয় পাবে না? এমনিতেই সে ঘুমের মধ্যে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে কাঁদে। যদি যেতে হয় তাকে নিয়ে যেতে হবে। বাবার সঙ্গে সে চাপা গলায় ঝগড়া করে এবং একসময় আমাকে এসে বলে, তুমি কি চাও আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?

আমি বলি, না না। কখনো চাই না।

‘তুমি চাইলেও আমি যাব না। তুমি কখনো, কোনোভাবেই এ বাড়ি থেকে আমাকে তাড়াতে পারবে না।’

‘কী আশ্চর্য! তাড়ানোর প্রশ্ন আসছে কেন?’

‘আমি জানি না কেন আসছে। মাঝে মাঝে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কী করি না করি নিজেই বুঝি না। সরি। কী সব অদ্ভুত ব্যাপার যে আমার হচ্ছে। তুমি যখন রাত জেগে পড়, আমিও রাত জাগতে চেষ্টা করি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বাধ্য হয়ে ঘুমুতে যাই। তখন আর ঘুম আসে না। রাতের পর রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটাই। তুমি কি সেটা জান?’

‘না। এখন জানলাম।’

‘আমার কী করা উচিত?’

‘ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত।’

‘ঘুমের ওষুধ আমার আছে। কিন্তু আমি খাই না। রাত জেগে আমি নানান কথা ভাবি। আমার ভালোই লাগে।’

.

আমাদের দিনগুলো এই ভাবেই কাটছিল। তারপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল।

তখন আমি এম.এ. ক্লাসের ছাত্র। বর্ষাকাল। কদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। ক্লাস থেকে ফিরেছি বিকেলে। গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি, রানু এই বৃষ্টির মধ্যে বাগানে দাঁড়িয়ে ভিজছে। কী যে সুন্দর তাকে লাগছে! আমি চেঁচিয়ে বললাম—এই রানু এই!

রানু ছুটে এল। হাসতে হাসতে বলল, এই যে ভাই ভালো ছাত্র—তুমি কি আমার সঙ্গে একটু বৃষ্টিতে ভিজবে? নাকি খারাপ ছাত্রীর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা নিষেধ

আমি বললাম, না নিষেধ না—চল বৃষ্টিতে ভিজি।

‘অসুখে পড়লে আমাকে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না।’

‘না, দোষ দেব না। দাঁড়াও খাতাটা রেখে আসি।’

রানু বলল, না না। খাতা রাখতে যেতে পারবে না। খাতা ছুড়ে ফেলে দাও।

আমি খাতা ছুড়ে ফেললাম। রানু চেঁচিয়ে বলল, স্যান্ডেল খুলে ফেল। আজ আমরা গায়ে কাঁদা মাখব। পানিতে গড়াগড়ি খাব। দেখো বাগানে পানি জমেছে।

আমি স্যান্ডেল ছুড়ে ফেললাম। রানু বলল—আজ বাসায় কেউ নেই। পুরো বাড়িতে শুধু আমরা দু জন।

রানু কথাগুলো কি অন্যভাবে বলল? কেমন যেন শোনাল। যেন সে প্রবল জ্বরের ঘোরে কথা বলছে। কী বলছে সে নিজেও জানে না।

আমি বললাম, তোমার কী হয়েছে রানু?

রানু থেমে থেমে বলল, আমার কী হয়েছে আমি জানি না। আমার খুব অস্থির অস্থির লাগছে। আমি আজ ভয়ংকর একটা অন্যায় করব। তুমি রাগ করতে পারবে না। আমাকে খারাপ মেয়ে ভাবতে পারবে না।

রানু ঘোর লাগা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে অদ্ভুত গলায় বলল, তুমি আমাকে খারাপ মেয়ে ভাব আর যাই ভাব—আমি এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা অন্যায় করব। প্লিজ চোখ বন্ধ কর। তুমি তাকিয়ে থাকলে অন্যায়টা আমি করতে পারব না।

চোখ বন্ধ করতে গিয়েও চোখ বন্ধ করতে পারলাম না। আমি বুঝতে পারছি রানু কী করতে যাচ্ছে। আমি কেন যে কোনো মানুষই তা বুঝবে। আমার নিজেরও যেন কেমন লাগছে। হঠাৎ দোতলার দিকে তাকালাম, আমার সমস্ত শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি দেখলাম আমার উলঙ্গ মাস্টার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তিনি কী চান আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম। তিনি আমার সব প্রিয়জনদের একে একে সরিয়ে দিচ্ছেন—প্রথমে বাবা, তারপর সর্দার চাচা। এখন রানু। তা সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না।

আমি রানুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। সে মাটিতে পড়ে গেল।

সে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমাকে এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে। যেভাবে আছ সেইভাবে।

রানু কোনো প্রশ্ন করল না। উঠে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। ইসমাইল চাচা ঢুকলেন তার কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনি বললেন-কী ব্যাপার?

আমি কঠিন গলায় বললাম, চাচা আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?

আমি তার জবাব দিলাম না। রানু মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে গেল। তার এক ঘণ্টার ভেতরই বাবা মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন।

.

অনেক অনেক দিন পর আমি আবার একা হয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন হয়ে বৃষ্টি নামল। রীতিমতো ঝড় শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমি অন্ধকার বারান্দায় বসে রইলাম। আমার দৃষ্টি দোতলার বারান্দার দিকে। জায়গাটা গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে—সেই আলোয় আমি উলঙ্গ মাস্টার সাহেবকে রেলিঙে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বাতাসের এক একটা ঝাপটা আসছে। সেই ঝাপটায় ভেসে আসছে সিগারেটের কড়া গন্ধ। আবারো সেই গন্ধ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হাসনাহেনার গন্ধে। সেবার আমাদের হাসনাহেনা গাছে প্রথমবারের মতো ফুল ফুটেছিল। মানুষের সঙ্গে গাছের হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। নয়তো কখনো যে গাছে ফুল ফোটে না—হঠাৎ সেখানে কেন ফুল ফুটল?

রাত বাড়তে লাগল। বৃষ্টি বাড়তে লাগল। কামরাঙা গাছের ডাল বাতাসে নড়তে লাগল। আমি এগিয়ে গেলাম দোতলার দিকে। সিঁড়ির মুখ কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ। মাস্টার সাহেব বললেন, কাঁটাতারের বেড়া খুলে রেখেছি, তুমি উঠে এস।

আমি উঠে গেলাম। কঠিন গলায় বললাম, আপনি কী চান?

তিনি বললেন, আমি কিছু চাই না তন্ময়। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।

‘আপনার সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই।’

‘তুমি তো ভুল কথা বলছ তন্ময়। এখনই আমার সাহায্যের তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সাহায্য করব। আমি আমার কথা রাখি।’

‘আপনি কেউ না। আপনি আমার অসুস্থ মনের কল্পনা।’

‘কে বলল তোমাকে?

‘আমি মনোবিদ্যার ছাত্র। আমি জানি। আমি সিজোফ্রেনিয়ার রুগি। সিজোফ্রেনিয়ার রুগিদের হেলুসিনেশন হয়। তারা চোখের সামনে অনেক কিছু দেখতে পায়। আমি তাই দেখছি।

‘তোমাদের ইসমাইল সাহেব কি সিজোফ্রেনিয়ার রুগি?’

‘না।’

‘তিনি কিন্তু আমাকে দেখেছেন। কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছেন। এ ঘরে তোমাদের আসতে নিষেধ করেছেন। নিষেধ করেন নি?’

‘হ্যাঁ করেছেন।’

‘তোমার বান্ধবী। রানু মেয়েটিও কিন্তু আমাকে দেখেছে। ঘটনাটা তোমাকে বলি। এক দুপুর বেলায় সে হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরের দিকে চলে এল। তাকাল বারান্দার দিকে। আমি তখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নগ্ন অবস্থায় দাঁড়ালাম বলাই বাহুল্য। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে গেল। আমি তখন তাকে কুৎসিত একটা কথা বললাম…বললাম…

‘চুপ করুন।’

‘রেগে যাচ্ছ কেন? রেগে যাবার কী আছে—তোমার কথা যদি ঠিক হয় তা হলে আমার অস্তিত্ব নেই। আমি তোমার মনের কল্পনা। কাজেই আমি মেয়েটিকে কী বলেছি তা শুনতে তোমার আপত্তি হবে কেন? আমি মেয়েটিকে,…

‘Stop’.

‘হা হা হা। মেয়েটি এতই ভয় পেয়েছিল যে নড়তে-চড়তে পারছিল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এই ফাঁকে আমি কিছু কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করলাম। কে জানে এগুলো হয়তো তার পছন্দ হয়েছে।

‘আমি আপনার পায়ে পড়ছি থামুন।’

‘বেশ থামলাম। রানু তোমাকে এই ঘটনার কিছু বলে নি?’

‘না।’

‘আমার কথায় তোমার যদি সন্দেহ থাকে তুমি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।’

‘জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করলাম।’

‘ভেরি গুড। এখন মনোবিজ্ঞানীর ছাত্র; তুমি আমাকে বল, তোমার ইসমাইল চাচা কিংবা তোমার বান্ধবী ওরা সিজোফ্রেনিয়ার রুগি না হয়েও আমাকে দেখছে কী করে? এর ব্যাখ্যা কী?’

‘আমি এর ব্যাখ্যা জানি না।’

‘শুধু তুমি কেন। কেউই জানি না। এই পৃথিবীতে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন জিনিসের সংখ্যাই বেশি।’

‘আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না। কিন্তু একজন পারবেন।’

‘তাই নাকি! সেই একজনটা কে?’

‘তিনি আমার স্যার। তাঁর নাম মিসির আলি।’

‘নিয়ে এস তোমার স্যারকে।’

‘তাঁকে আনার আমি কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার সমস্যা আমিই সমাধান করব।’

‘এবং যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।’

‘হ্যাঁ।’

‘ভালো খুব ভালো। আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি।’

‘আপনাকে একটা কথা দিতে হবে। আপনি রানুর কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।’

‘তুমি অদ্ভুত কথা বলছ তন্ময়। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না আবার তুমি বলছ- আমি রানুর কোনো ক্ষতি করতে পারব না। এরকম করছ কেন?’

‘এরকম করছি কারণ মানুষ একই সঙ্গে বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাস করে না।’

‘কে বলেছে, তোমার স্যার?’

‘হ্যাঁ।’

‘ইন্টারেস্টিং মানুষ। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। উনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবেন আমার অস্তিত্ব নেই। আমি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করব উনার অস্তিত্ব নেই। হা হা হা। কবে তুমি তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসবে?’

‘আনব। তাঁকে আমি আনব। আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি রানুর কোনো ক্ষতি করবেন না।’

‘দেখ তন্ময় আমি তোমার স্বার্থ দেখব। তোমার ভালো দেখব। যদি আমার কখনো মনে হয় এই মেয়ের কারণে তোমার ক্ষতি হচ্ছে তখনই আমি তাকে সরিয়ে দেব। এখন আমার অনেক ক্ষমতা। তবে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত যখন নেব, তোমাকে জানিয়েই নেব।

‘আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘যাও ঘুমুতে যাও। সমস্ত দিনে তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। তোমার ঘুম দরকার। রানুর টেবিলের ড্রয়ার ভরতি ঘুমের ওষুধ। তুমি দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। শুভ্র রাত্রি। ভালো কথা ঘুমুতে যাবার আগে ভেজা কাপড় বদলে নিও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *