০৯. মুশফেকুর রহমানের খাতা

মিসির আলি মুশফেকুর রহমানের খাতা নিয়ে বসেছেন। এখন পড়ছেন শৈশব স্মৃতি। খুবই গোছানো লেখা। একটিও বানান ভুল নেই। কাটাকুটি নেই। বোঝাই যাচ্ছে এই অংশ অনেকদিন আগে লেখা। কাগজ পুরোনো হয়ে গেছে। লেখার কালি বিবর্ণ। তবে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লেখা।

কিছু কিছু জায়গা নতুন লেখা হয়েছে। সেগুলো পেনসিলে লেখা এবং তারিখ দেওয়া।

.

‘মানুষের অনেক বৈচিত্র্যময় ছেলেবেলা থাকে। ম্যাক্সিম গোর্কির ছেলেবেলা কেটেছে তাঁর দাদিমার সঙ্গে পথে পথে ভিক্ষা করে। আমার ছেলেবেলার শুরুটা ছিল সরল ঘটনাবিহীন।

আমি ছিলাম সঙ্গীহীন, বন্ধুহীন। বিরাট কম্পাউন্ডের বাড়ি। জেলখানার দেয়ালের মতো উঁচু দেয়াল। খেলার জন্যে অনেক জায়গা, তবুও আমাকে বন্দি থাকতে হত আমার নিজের ঘরে। বারান্দায় বা উঠোনে কিংবা বাড়ির পেছনে খেলতে গেলেই দোতলা থেকে আমার বাবা দেখে ফেলতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, ভেতরে যাও, ভেতরে যাও। আমি দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যেতাম।

নিঃসঙ্গ শিশু নিজের খেলার সঙ্গী নিজেই তৈরি করে নেয়। আমার অনেক কাল্পনিক সঙ্গী-সাথী ছিল। এদের সঙ্গেই খেলতাম। গল্প করতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল খাটের নিচের অন্ধকার কোণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি খাটের নিচে বসে কাটিয়েছি। মাঝে মাঝে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম।

আমাকে দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল সর্দার চাচার। আপনাকে আগেই তাঁর কথা বলেছি। তিনি সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। বাড়িতে সর্দার চাচা ছাড়াও আরো কিছু মানুষজন ছিল, মালি ছিল। দারোয়ান ছিল। রান্নার লোক ছিল। তাদের কেউ আমার কাছে আসতে পারত না। সর্দার চাচা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠতেন।

বাবা সর্দার চাচাকে খানিকটা সমীহ করতেন। মাঝে মাঝে সর্দার চাচা আমাকে বাগানে খেলার জন্যে নিয়ে যেতেন। কুয়োতলায় নিয়ে যেতেন ছবি আঁকার জন্যে। দোতলা থেকে বাবা আমাকে দেখতে পেতেন, কিন্তু ভেতরে যাও ভেতরে যাও বলে চেঁচাতেন না।

যে জন্ম থেকেই নিঃসঙ্গ সে নিঃসঙ্গতার কষ্ট জানে না। আমিও জানতাম না। মার জন্যে আমার কোনো আকর্ষণ ছিল না। তিনি আমার ভেতর কোনো সুখস্মৃতি তৈরি করে যেতে পারেন নি। মার কথা মনে হলেই ভয়ংকর এক স্মৃতি ধক করে মনে হত। পরিষ্কার দেখতে পেতাম মা আমার গলা চেপে ধরে আছেন। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ছোট্ট বুক ধক করে ফেটে যাবে। এই অবস্থা থেকে আমার বাবা উদ্ধার করেন। তিনিই আমাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যান।

আমি যে কদিন হাসপাতালে ছিলাম, সে কদিন আমার বাবা আমার পাশেই ছিলেন। যতবার আমি চোখ মেলেছি ততবারই আমি দেখেছি বাবা ব্যথিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাসপাতালের ঐ কটি দিনই ছিল আমার শৈশবের শ্রেষ্ঠতম সময়।

পারিবারিক অবস্থার কথা বলি—আমরা কয়েক পুরুষের বনেদি ধনী। মুসলমানরা তিন পুরুষের বেশি তাঁদের ধন ধরে রাখতে পারে না। আমার বাবা হলেন তৃতীয় পুরুষ। যৌবনে তিনি ব্যবসাপাতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। বেশিরভাগ ব্যবসাই বিক্রি করে নগদ টাকা করলেন। টাকা ব্যাংকে জমা করলেন। কয়েকটা বড় বড় বাড়ি কিনলেন। শহরে জমি কিনলেন। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল—তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এইসব জমি হীরের দামে বিক্রি হবে।

আমার বাবাও আমার মতোই নিঃসঙ্গ ছিলেন। তিনি কারো সঙ্গে মিশতেন না। আমি আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজনকে এ বাড়িতে আসতে দেখি নি। আত্মীয়দের বাড়িতে বাবার যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাবা খানিকটা অসুস্থও ছিলেন। আপনাকে হয়তো ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে—উনি শব্দ সহ্য করতে পারতেন না। শব্দ শুনলেই তাঁর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হত। তা ছাড়া তাঁর ধারণা হয়ে গিয়েছিল সবাই তাকে খুন করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছে। চার দেয়ালের বাইরে বের হলেই তাঁকে খুন করা হবে। তিনি ঘরের বাইরে বের হওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিলেন। কাউকে তিনি বিশ্বাস করতেন না। দুদিন পরপর দারোয়ান বদলাতেন, মালি বদলাতেন। একসময় কুকুর পুষতে শুরু করলেন। প্রথমে এল সরাইলের দুটি কুকুর। গ্রে হাউন্ড জাতীয় কুকুর— ভয়ংকর রাগী। মালি এবং দারোয়ানের সংখ্যা কমতে লাগল, কুকুরের সংখ্যা বাড়তে লাগল।

বাবার সঙ্গে আমার কোনো রকম যোগাযোগ ছিল না তবে কালেভদ্রে তিনি আমাকে তাঁর দোতলার ঘরে ডেকে নিয়ে যেতেন। সর্দার চাচা আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। বাবা আমার সঙ্গে কথা বলতেন নিচু গলায় এবং কিছুটা আদুরে স্বরে; তবে কখনো আমার দিকে তাকাতেন না। কথাবার্তার একটা নমুনা দিচ্ছি :

বাবা বললেন, কেমন আছিস?

আমি বললাম, ভালো।

‘বোস।’

আমি কোথায় বসব বুঝতে পারছি না। ঘরে একটা মাত্র খাট। সেখানে বসার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ বাবা বসে আছেন। তা ছাড়া খাটের এক মাথায় দোনলা বন্দুক। বাবা সব সময় গুলিভরা বন্দুক মাথার কাছে রাখতেন। আমি ইতস্তত করছি—বাবা খাটের এক অংশ দেখিয়ে বসার জন্যে ইশারা করলেন। আমি বসলাম।

‘পড়াশোনা হচ্ছে?’

‘জি।’

‘বাড়িতে মাস্টার আসে?’

‘জি।’

(সেই সময় আমার জন্যে প্রাইভেট মাস্টার রাখা হয়েছে। তিনি বাসায় এসে আমাকে পড়িয়ে যান। তাঁর কথা আপনাকে বলেছি। এবং টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে।)

‘মাস্টারটা কেমন?’

‘ভালো।’

‘মোটেই ভালো না। অতি বদলোক। সাবধানে থাকবি। বদ মতলবে ঢুকেছে। খুনখারাবি করবে।

এটা হচ্ছে বাবার সাধারণ কথার একটি। পৃথিবীর সব মানুষই তাঁর কাছে বদমানুষ পৃথিবীর সবাই খুনখারাবির মতলব নিয়ে ঘুরছে। আমি বাবার কথার কোনো জবাব দিলাম না। মাথা নিচু করে শুনে গেলাম।

বাবা বললেন, তোকে সাবধান করার জন্যেই ডেকেছি। খুব সাবধান থাকবি। খুব সাবধান।

‘জি আচ্ছা।’

‘তোর মাস্টারের দরকারই বা কী? নিজে নিজে পড়তে পারবি না?’

‘আপনি বললে পারব।’

‘এই ভালো। নিজে নিজে পড়। আর তোর যদি পড়াশোনা না হয় তা হলেও ক্ষতি নেই। টাকাপয়সা আমি যা রেখে যাব দুহাতে খরচ করেও শেষ করতে পারবি না। আমার মৃত্যুর পর দুহাতে খরচ করবি। জায়গাজমি সব বিক্রি করে দিবি। তোর কোনো টাকাপয়সা জমিয়ে রাখার দরকার নাই। বুঝতে পারছিস?’

‘পারছি।

‘আচ্ছা যা। আমি সর্দারকে বলে দেব সে যেন মাস্টারকে আসতে নিষেধ করে।’

‘আচ্ছা।’

‘আরেকটা কথা—রাতে-বিরাতে দরজা খুলে বের হবি না। কুকুরগুলো ভয়ংকর এরা তোকে খেয়ে ফেলবে।

কুকুরগুলো ছিল সত্যি ভয়ংকর। রাতে যতবার ঘুম ভাঙত, শুনতাম, এরা চাপা গর্জন করছে। একটা কুকুর রোজ রাতে আমার দরজা আঁচড়াত। রাতে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুমুতে পারতাম না।

‘আমি কি এখন চলে যাব?’

‘আচ্ছা যা।’

বাবা বালিশ উঁচু করে বালিশের নিচ থেকে চকচকে একটা দশ টাকার নোট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—বাদাম কিনে খাস

যতবার বাবার কাছে গিয়েছি ততবারই বাদাম কিনে খাবার জন্যে একটা করে চকচকে দশ টাকার নোট পেয়েছি। বাদাম অবিশ্যি খাওয়া হয় নি। আমাকে দোকানে নিয়ে যাওয়া নিষেধ ছিল। টাকাগুলো আমি একটা কৌটায় জমা করে রেখেছি। যতবার টাকাগুলো দেখি ততবারই ভালো লাগে।

বাবার হুকুমে সর্দার চাচা মাস্টার সাহেবকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দেন। তারপরও তিনি মাঝে মধ্যে আসতেন। অনেকক্ষণ থাকতেন। এর মধ্যে একদিন এসে আমার হাতে একটি চিঠি দিলেন। সেই চিঠি আমার মার লেখা। মা আমার সঙ্গে দুটা কথা বলতে চান। আমি কি তাঁর কাছে যেতে পারব?

আমি মাস্টার সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে পরদিন বাড়ি থেকে বের হলাম। ধরা পড়লাম সর্দার চাচার হাতে। বাকি ঘটনা আপনি জানেন। ঐ অংশটি দ্বিতীয়বার বলতে চাই না। যে কথাটা আপনাকে আগে বলা হয় নি তা হচ্ছে—ঐ চিঠি আমার মার লেখা ছিল না। ঐ চিঠি মাস্টার সাহেবের লেখা।

মিসির আলি লক্ষ করলেন শেষ পাতাটি দুদিন আগে লেখা হয়েছে। এবং প্রচুর কাটাকুটি করা হয়েছে। যেন মুশফেকুর রহমান বুঝতে পারছে না—কী লিখবে। বাংলা ভাষাটাও মনে হচ্ছে ভাব প্রকাশের জন্যে সে উপযুক্ত মনে করছে না। কারণ শেষ পাতাটা ইংরেজিতে লেখা। শেষ পাতার বক্তব্য হল—আমি ভয় পাচ্ছি, বাবা সম্পর্কে আমি আমার মনের ভাব ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারি নি। আমি তাঁকে অসম্ভব ভালবাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *