০৮. স্যারদের নামের আগে শ্ৰদ্ধেয়

শ্রদ্ধেয় স্যার,

স্যারদের নামের আগে শ্রদ্ধেয় ব্যবহার করা আমাদের প্রাচীন রীতি। যদিও এই সমাজের বেশিরভাগ শিক্ষকরাই শ্রদ্ধেয় বিশেষণ দাবি করেন না। স্কুলে আমাদের একজন অঙ্ক স্যার ছিলেন। তিনি খুব ভালো অঙ্ক জানতেন। ছাত্রদের বুঝাতেনও খুব সুন্দর করে। তিনি আমাকে ডাকতেন—। সর্প—শিশু! মাঝে মাঝেই মজা করার জন্যে আমাকে বলতেন, এই কর তো। হাঁ করে তোর কুচকুচে কালো জিহ্বাটা নড়াচড়া কর। দেখি কেমন লাগে।

আমি তাই করতাম। তিনি মজা পেয়ে হো হো করে হাসতেন। এই শিক্ষককে কি শ্রদ্ধেয় বলা ঠিক হবে?

আমি আপনার নামের আগে বহুল ব্যবহৃত বিশেষণ ব্যবহার করেছি। এর চেয়ে সুন্দর কিছু ব্যবহার করতে পারলে আমার ভালো লাগত। আপনি অল্প কিছুদিন আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। পড়াতেন এবনরমাল বিহেভিয়ার। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আমি তোমাদের এবনরমাল বিহেভিয়ার পড়াতে এসেছি। পড়ানোর সময় কী করলে আমার আচরণকে তোমরা এবনরমাল বলবে?

আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। ছাত্র হিসেবে আমরা আপনাকে যাচাই করে নিতে চাচ্ছিলাম। আপনি বললেন, আচ্ছা, আমি যদি এই টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেই—তা হলে কি তোমরা আমার আচরণকে এবনরমাল বলবে?

একজন ছাত্র বলল, হ্যাঁ।

আপনি বললেন, প্রাচীন গ্রিসে কিন্তু ক্লাসরুমে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার প্রচলন ছিল। তাঁরা মনে করত শিক্ষক সবচেয়ে সম্মানিত। তাঁকে দিতে হবে সবচেয়ে সম্মানের স্থান। তাদের কাছে টেবিলে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়াটাকে অস্বাভাবিক আচরণ মনে হত না। কোনো শিক্ষক যদি মেঝেতে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন সেইটা হতো অস্বাভাবিক। কাজেই অস্বাভাবিকের সংজ্ঞা কী? সংজ্ঞা হল—–আমরা যা দেখে অভ্যস্ত তার বাইরে কিছু করাটাই অস্বাভাবিক।

মজার ব্যাপার হল মানুষ খুব অস্বাভাবিক একটি প্রাণী, অথচ আমরা মানুষের কাছে স্বাভাবিক আচরণ আশা করি। আচ্ছা, তোমরা একজন কেউ বল তো, মানুষ অস্বাভাবিক প্রাণী কেন?

ক্লাসের কেউ কথা বলল না। আপনি হাসিমুখে বললেন, মানুষ অস্বাভাবিক তার কারণ মানুষের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক একই সঙ্গে লজিক এবং এন্টি-লজিক নিয়ে কাজ করে। প্রতিটি প্রশ্নের দুটি উত্তর সে সমান গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে—একটি হ্যাঁ, অন্যটি না। সে মনে করে দুটি উত্তরই সত্য। তা হয় না।

প্রশ্ন :ঈশ্বর বলে কি কিছু আছেন? উদাহরণ দেই।

উত্তর : হ্যাঁ এবং না।

প্রশ্ন : আমরা কি শূন্য থেকে এসেছি?

উত্তর : হ্যাঁ এবং না।

প্ৰশ্ন : আমরা কি শূন্যতে মিশে যাব?

উত্তর : হ্যাঁ এবং না।

স্যার, আপনি ঝড়ের গতিতে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন এবং নিজেই উত্তর দিচ্ছেন—’হ্যাঁ এবং না।’ আমরা মুগ্ধ ও বিস্মিত। ক্লাসের শেষে আপনার নাম হয়ে গেল ‘হ্যাঁ-না’ স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার, এই নাম আমরা কখনো ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করি নি। এই নাম উচ্চারণ করেছি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়।

লজিক ব্যবহার করার আপনার অস্বাভাবিক ক্ষমতার সঙ্গে আমাদের অল্প সময়ের ভেতর পরিচয় হল। শার্লক হোমস-এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে কোনান ডায়ালের উপন্যাসের মাধ্যমে। শার্লক হোমস কল্পনার চরিত্র। আমরা বাস্তবের একজন সাধারণ মানুষকে দেখলাম যার চিন্তাশক্তি এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা অতিমানব পর্যায়ের।

আপনার নিশ্চয়ই মনে নেই ক্লাসে আপনি একটি এ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। আমরা সবাই এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলাম। আপনি আমার খাতা দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, তুমি ক্লাসের পরে আমার সঙ্গে দেখা করো। আমি দেখা করতে গেলাম। আপনি বললেন, এত সুন্দর হাতের লেখা কেন? আপনার প্রশ্নের ভঙ্গি এমন যেন সুন্দর হাতের লেখা হওয়া দূষণীয়। আমি বললাম, স্যার, সুন্দর হাতের লেখা কি অপরাধ?

আপনি হাসতে হাসতে বললেন, না, অপরাধ হবে কেন? তবে হাতের লেখার দিকে তুমি অস্বাভাবিক নজর দিচ্ছ। এটাই আমাকে বিস্মিত করছে। যাদের মনের ভেতরের অবস্থাটা থাকে বিশৃঙ্খল, এবং হয়তো বা অসুন্দর তারা বাইরের পৃথিবীটাকে সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল দেখতে চায়, যে কারণে হাতের লেখার মতো তুচ্ছ একটি বিষয়েও তাদের অপরিসীম মনোযোগী হাতে দেখা যায়। তোমার কি কোনো সমস্যা আছে?’

আমি বললাম, না।

আমি যে মিথ্যা বলছি আপনি তা সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললেন। সেটা আমি আপনার হাসি দেখেই বুঝলাম। তবে আপনি আমাকে মিথ্যা বলার জন্যে অভিযুক্ত করলেন না। শান্ত গলায় বললেন, তোমার রিপোর্টটি পড়ে আমি আনন্দ পেয়েছি। সবাই বইপত্র ঘেঁটে রিপোর্ট তৈরি করার চেষ্টা করেছে। একমাত্র তুমিই—নিজে যা ভেবেছ তাই লিখেছ।

রিপোর্টের বিষয়বস্তু ছিল – ‘ Strange dreams’ বা অদ্ভুত স্বপ্ন। আমি আমার নিজের দেখা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন লিখে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।

আমি বললাম, স্যার, আমার ব্যাখ্যা কেমন হয়েছে?

আপনি বললেন, বায়াড্ ব্যাখ্যা হয়েছে। যেহেতু তুমি স্বপ্নটি দেখেছ সেহেতু তুমি তা ব্যাখ্যা করেছ নিজের দিকে পক্ষপাতিত্ব করে। আমি অন্য ব্যাখ্যা করব।

‘আপনার ব্যাখ্যা কী স্যার?’

আপনি বললেন, আমার ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে আমাকে জানতে হবে তুমি আসলেই এ জাতীয় স্বপ্ন দেখেছ কি না। মানুষ কখনো তার অভিজ্ঞতার বাইরে স্বপ্ন দেখে না, মানুষের কল্পনা অভিজ্ঞতার ভেতর সীমাবদ্ধ। একজন শিল্পীকে তুমি যদি দৈত্যের ছবি আঁকতে দাও—সে এক চোখ এক দৈত্যের ছবি আঁকবে—যার দুটি শিং আছে। তুমি খুব মন দিয়ে লক্ষ করলে দেখবে—দৈত্যের হাত-পা দেখাচ্ছে মানুষের মতো। কপালে চোখটা বিড়ালের মতো, মাথার শিং দুটি গরুর মতো। অর্থাৎ শিল্পী তাঁর অভিজ্ঞতাই কল্পনায় ব্যবহার করেছেন। দৈত্যের ছবিতে তুমি এক শিঙের দৈত্য পাবে কিন্তু তিন শিঙের দৈত্য সচরাচর পাবে না। কারণ মানুষ একশিঙের প্রাণী দেখেছে—যেমন গণ্ডার, দু শিঙের প্রাণী দেখেছ গরু, ছাগল কিন্তু তিন শিঙের প্রাণী দেখে নি। বুঝতে পারছ কী বলছি?

‘পারছি স্যার।’

‘কিন্তু তুমি যে স্বপ্ন দেখেছ বলে লিখেছ এই স্বপ্ন তুমি দেখতে পার না। এই স্বপ্ন মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।’

আমি বললাম, আমি এই স্বপ্ন দেখেছি স্যার।

আপনি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। যদি কখনো বড় ধরনের সমস্যায় পড় আমার কাছে এস।

আপনার কি মনে পড়ে আপনি এ জাতীয় একটি আশ্বাসবাণী আপনার একজন ছাত্রকে দিয়েছিলেন? হয়তো আপনার মনে নেই। আমি কিন্তু মনে করে রেখেছি। এবং সব সময় আপনার খোঁজ রেখেছি। গত সাত বছরে আপনি কোন কোন বাসায় ছিলেন, কতদিন ছিলেন—সব আমি একের পর এক বলে দিতে পারব। এর পরেও আমাকে আপনার অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।

স্যার, সমস্যায় আমি এখন পড়ি নি। সমস্যায় পড়েছিলাম ছেলেবেলাতেই। সেই সমস্যা আমি আমার নিজের মতো করে সমাধান করার চেষ্টা করেছি। আমাকে সাহায্য করেছেন আমার একজন গৃহশিক্ষক। যিনি জীবিত নন। মৃত। মৃত মানুষটি এখনো আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। আপনার মতো যুক্তিবাদী মানুষের কাছে নিতান্তই অযৌক্তিক একটি বিষয় উত্থাপন করলাম। করলাম, কারণ, আপনি বলেছেন মানুষ যে কোনো প্রশ্নের উত্তর হিসেবে হ্যাঁ এবং না দুটিই গ্রহণ করে। আমি আমার গৃহশিক্ষকের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তার আগে আমার কিছু কথা জেনে নিতে হবে।

আমি নিজে আমার কথা ছাড়া ছাড়া ভাবে আপনাকে কিছু বলেছি। আপনি নিজেও অনুসন্ধান করে কিছু কিছু বের করার চেষ্টা করেছেন। এতে লাভ তেমন হয় নি। আপনি বিভ্রান্ত হয়েছেন। আপনি আমার মার সঙ্গে কথা বলেছেন—তাঁকে আপনার নিশ্চয়ই সরল সাদাসিধে মহিলা মনে হয়েছে। তিনি মোটেই সে রকম নন। আমার বাবা মাকে পরিত্যাগ করেছিলেন, কারণ তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন—আমার মা গলাটিপে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছেন। এতে আমার শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে রেখে আমার চিকিৎসা করাতে হয়। ঘটনাটা যখন ঘটে তখন আমার বয়স চার। চার বছরের স্মৃতি শিশুর মনে থাকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

স্যার, আপনি অনেকক্ষণ একনাগাড়ে আমার লেখা পড়লেন। এখন আপনি বিশ্রাম করুন। বাকিটা কাল পড়বেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *