০৩. পাখিবিষয়ক গবেষণা

তাঁর পাখিবিষয়ক গবেষণা বেশিদূর এগুচ্ছে না। চড়ুই পাখি দুটি খাঁচায় ঢুকছে না। মিসির আলি খাঁচাটা জানালার পাশে রেখেছেন। খাঁচার ভেতরে পিরিচ ভর্তি চাল। পাখি দুটি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাল দেখছে তবে সাহস করে এগুচ্ছে না। তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাদের সাবধান করে দিচ্ছে। বলে দিচ্ছে এই খাঁচার ভেতর না ঢুকতে। একটি চড়ুই পাখির মস্তিষ্কের পরিমাণ কত? খুব বেশি হলে পঞ্চাশ মিলিগ্রাম। মাত্র পঞ্চাশ মিলিগ্রাম মস্তিষ্ক নিয়েও সে বিপদ আঁচ করতে পারে। মানুষ কিন্তু পারে না। সিক্সথ সেন্স মানুষের ক্ষেত্রে তেমন প্রবল নয়।

সারাটা দিন মিসির আলি পাখির পেছনেই কাটালেন। পাখি দুটির আজ হয়তো কোনো কাজকর্ম নেই। এরা খাঁচার আশপাশেই রইল, অন্যদিনের মতো চলে গেল না। মিসির আলিও সময় কাটাতে লাগলেন বিছানায় আধশোয়া হয়ে। তিনি এমনভাবে শুয়েছেন যেন প্রয়োজনে চট করে উঠে খাঁচার দরজা বন্ধ করতে পারেন। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার ভানও করলেন। পাখি দুটি তাতে প্রতারিত হল না।

সন্ধ্যাবেলা তিনি গেলেন পার্কে। শীতের সময় সন্ধ্যাবেলা পার্কে লোকজন হাওয়া খেতে যায় না। পার্ক থাকে খালি। এই সময় হাঁটতে ভালো লাগে। সন্দেহজনক কিছু লোকজনকে অবিশ্যি দেখা যায়। তারা কুটিল চোখে বারবার তাকায়। একবার চাদর গায়ে একজন মধ্যবয়স্ক লোক তাঁর খুব কাছাকাছি এসে গম্ভীর গলায় বলেছিল—সব খবর ভালো? তিনি তৎক্ষণাৎ বলেছেন, জি ভালো। লোকটি এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। মিসির আলি পার্কে সেজেগুজে থাকা কিছু মেয়েকেও দেখেন। সাজ খুবই সামান্য—কড়া লিপস্টিক, গালে পাউডার এবং রোজ, চোখে কাজল। তারা ঘোরাফেরা করে অন্ধকারে। অন্ধকারে তাদের সাজসজ্জা কারোর চোখে পড়ার কথা না। এরা কখনো মিসির আলির কাছে আসে না। তবে তিনি এদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে এক ধরনের আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি ঠিক করে রেখেছেন এদের কেউ যদি কখনো তাঁর কাছে আসে তিনি তাকে নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসবেন, তার তীব্র দুঃখ ও বেদনার কথা মন দিয়ে শুনবেন। তাঁর খুব জানতে ইচ্ছা করে—এই মেয়েগুলো জীবনের চরমতম গ্লানির মুহূর্তগুলো কীভাবে গ্রহণ করেছে? এ সুযোগ এখনো তাঁর হয় নি।

পার্কে তিনি ঘণ্টাখানেক হাঁটলেন। কুড়ি মিনিটের মতো তাঁর পরিচিত প্ৰিয় জায়গায় পা তুলে বসে রইলেন। পার্কটার একটা বড় সমস্যা হল—গাছগাছালি খুব বেশি, আকাশ দেখা যায় না। তাঁর আজকাল খুব ঘন ঘন আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর সবারই বোধহয় এরকম হয়—বারবার আকাশের দিকে দৃষ্টি যায়।

প্রকৃতি মানুষের জিনে অনেক তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে না, কিংবা চায় না। তার যা বলার তা সে বলে দিয়েছে, লিখিতভাবেই বলেছে। সেই লেখা আছে ‘জিনে’–ডিএনএ এবং আরএনএ অণুতে। মানুষ সেই লেখার রহস্যময়তা জানে কিন্তু লেখাটা পড়তে পারছে না। একদিন অবশ্যই পারবে।

ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মিসির আলির উঠতে ইচ্ছা করছে না। তিনি অপেক্ষা করছেন মুশফেকুর রহমান নামের লোকটির জন্যে। যদিও তিনি জানেন সে আজ আসবে না। কারণ মুশফেকুর রহমান জানে, মিসির আলি গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। রহস্যপ্রিয় মানুষ, নিজের রহস্য কখনো ভাঙবে না। আরো রহস্য তৈরি করবে। এই লোকটি তখনই তার কাছে আসবে—যখন মিসির আলি তার জন্যে অপেক্ষা করা বন্ধ করে দেবেন।

লোকটিকে খুঁজে বের করা কি কঠিন? মিসির আলির কাছে এই মুহূর্তে কাজটা কঠিন বলে মনে হচ্ছে না। বিত্তবান লোক হলে তার একটা টেলিফোন থাকার কথা। . গাড়ি থাকার কথা। গাড়ি রেজিস্ট্রেশন কী নামে হয়েছে তা বের করা কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। গাড়ি না থাকলেও তার টিভি কিংবা রেডিও আছে। এদের জন্যেও লাইসেন্স করতে হয়। ঠিকানা আছে এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। বের করা যায় না শুধু ঠিকানাহীন মানুষদের।

‘স্লামালিকুম স্যার।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

‘স্যার, আমি মুশফেকুর রহমান। আপনি আজ পার্কে আসবেন ভাবি নি। আমি ভেবেছিলাম আজ আপনি পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।’

মিসির আলি স্বাভাবিক গলায় বললেন, পাখি দুটা ধরা পড়ে নি।

‘ধরা না পড়ারই কথা। খাঁচায় কাঁচা পেইন্টের গন্ধ। এই গন্ধ পাখি সহ্য করতে পারে না। আপনি কয়েকদিন খাঁচাটাকে বাইরে ফেলে রাখুন। রঙের গন্ধ দূর হোক।’

মুশফেকুর রহমান মিসির আলির পাশে বসল। মিসির আলি তাকালেন কিন্তু কিছু দেখতে পেলেন না। জায়গাটা ঘন অন্ধকার। মিসির আলি বললেন, আমি আপনার কথা শোনার জন্যে মানসিকভাবে তৈরি হয়ে এসেছি। শুরু করুন।

‘গল্প শোনার সময় আপনি কি আমার মুখ দেখতে চান না? অনেকে আবার মুখের দিকে না তাকিয়ে গল্প শুনতে পারে না, আবার বলতেও পারে না।

‘আপনি কি বলতে পারেন?’

‘তা পারি। আমি আমার গল্প অন্ধকারেই বলতে চাই। আমার গল্প অন্ধকারের গল্প। কিন্তু স্যার, আপনার কি ঠাণ্ডা লাগছে না?’

‘লাগছে।’

‘আমি একটা চাদর নিয়ে এসেছি। চাদর গাড়িতে রাখা আছে। আমার চাদর ব্যবহার করতে আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?’

‘না, আপত্তি নেই।’

মুশফেকুর রহমান বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গেল। মিসির আলি লক্ষ করলেন সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তার গায়ে চাদর। গায়ে চাদর থাকতেও সে আরেকটি চাদর নিয়ে এল কী জন্যে? তাঁর জন্যে কি এনেছে? সে কি নিশ্চিত ছিল, মিসির আলি এসে বসে থাকবেন? গল্প শুনতে চাইবেন, এবং সে গল্প শুনাবে শীতের রাতে?

তাই যদি হয় তা হলে সে শুধু চাদর আনে নি, ফ্লাস্কে করে চা এনেছে। কিছু খাবার এনেছে। মিসির আলি ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট খান। সেই সিগারেটও এক প্যাকেট এনেছে। চাদর যদি তাঁর জন্যে আনা হয় তা হলে চাদরটি হবে অব্যবহৃত, নতুন।

মুশফেকুর রহমান ফিরে এল। তার সঙ্গে ফ্লাস্ক। একটা প্যাকেটে পূর্বাণী কনফেকশনারির কিছু স্যান্ডউইচ। সে বসতে বসতে বলল, চাদরটা আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গায়ে দিন। এটি যদিও অনেক আগে কেনা, কখনো ব্যবহার করা হয় নি। দু বছর আগে জয়পুর গিয়েছিলাম, তখন কেনা। রাত বলেই দেখতে পাচ্ছেন না, চাদরের গায়ে রেশমি সুতার কাজ করা আছে। এরা বলে জয়পুরী কাজ। চাদরটা আপনার জন্যে আমার সামান্য উপহার

‘থ্যাংক ইউ। আমার ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট কোথায়?’

মুশফেকুর রহমান হাসল। হাসতে হাসতে বলল, সিগারেটও এনেছি। দেব?

‘দিন এবং গল্প শুরু করুন।’

‘কোত্থেকে শুরু করব? প্রথম খুন কীভাবে করলাম সেখান থেকে?’

‘না, নিজের কথা বলুন। আপনার ছেলেবেলার কথা।’

মুশফেকুর রহমান ফ্লাস্কে চা ঢালতে ঢালতে গল্প শুরু করল-

আমার ছেলেবেলা মোটেই মজার নয়। গল্প করে বেড়াবার কিছু নেই। সব মনেও নেই—তবু বলছি।

আমি বড় হয়েছি পুরোনো ঢাকায়। অনেকের ধারণা নেই যে, পুরোনো ঢাকায় অসম্ভব বিত্তবান বেশকিছু মানুষ থাকেন। বাইরে থেকে তাঁদের অর্থ ও বিত্তের পরিমাণ বোঝা যায় না। আমাদের একেবারেই বোঝা যেত না। জেলখানার মতো উঁচু দেয়াল দেওয়া বাড়ি। গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকলে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। ফুলের বাগানটাগান নেই। এলোমেলোভাবে কয়েকটা বড় বড় দেশী ফুলের গাছ। চাঁপা গাছ, শিউলি গাছ, বাড়ির দক্ষিণ দিকে হাসনাহেনার প্রায় জঙ্গলের মতো ঝাড়। এই গাছগুলোতে কখনো ফুল ফোটে না। মাঝে মাঝে কেটে দেওয়া হয়। আবার আপনাতেই গজায়। বাড়ির পেছনে বেশকিছু ফলের গাছ। একটা আছে কামরাঙা গাছ। এই গাছে কিছু কামরাঙা হয়। অন্যগুলোতে ফল হয় না।। একটা পাতকুয়া আছে। মেঝে বাঁধানো। কুয়ার পানি খুব পরিষ্কার তবে বিশ্রী গন্ধ বলে সেই পানি ব্যবহার করা হয় না। বাড়িটা একতলা অনেক বড়। মূল বাড়ির উত্তরে কামরাঙা গাছের কাছে চার কামরার আলাদা একটা দোতলা বাড়ি। নিচে তিন কামরা, উপরে এক কামরা। দোতলাটাকে আমরা বলতাম—উত্তর বাড়ি। দোতলার পুরোটাই বলতে গেলে বারান্দা। ছেলেবেলায় আমার উত্তর বাড়িতে যাওয়া পুরোপুরি নিষেধ ছিল। কারণ উত্তর বাড়িতে থাকতেন বাবা। তিনি বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করতেন না। আমার বাবা পৃথিবীর বেশিরভাগ জিনিসই অপছন্দ করতেন। হইচই অপছন্দ করতেন, বাচ্চাকাচ্চা অপছন্দ করতেন, গান অপছন্দ করতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল গাড়ি অপছন্দ করতেন। কারণ গাড়ি স্টার্ট করলে ভটভট শব্দ হয়। যে কারণে আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না। আমি স্কুলে যেতাম রিকশায়। আমাকে মাথা কামানো গাট্টাগোট্টা একটা লোক স্কুলে নিয়ে যেত। তার নাম ছিল সর্দার। আমি ডাকতাম সর্দার চাচা। তিনি কথায় কথায় বলতেন—এক টান দিয়া কইলজা ছিঁড়া বাইর কইরা ফেলামু। এমনভাবে বলতেন যেন তিনি কাজটা এক্ষুনি করবেন।

ধরুন, আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। অন্য একটা রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। আমার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। তিনি চলন্ত রিকশায় উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন—এক টান দিয়া কইলজা ছিঁড়া ফেলামু

সর্দার চাচাকে আমি খুবই পছন্দ করতাম। কিন্তু উনি আমাকে পছন্দ করতেন কি করতেন না কোনোদিন জানতে পারি নি। সর্দার চাচাকে আমার অপছন্দ করার কোনো কারণ ছিল না। পছন্দ করতাম, কারণ আমার আর কেউ ছিল না। বাবার সঙ্গে আমার কোনো রকম যোগাযোগ নেই। মা’র সঙ্গেও নেই। বাবা মাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। মা’র এই বাড়িতে আসা নিষেধ ছিল।

আমাকে লালনপালন, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে আনা সবই সর্দার চাচা করতেন। আমার জগৎ ছিল স্কুল এবং স্কুলের চার দেয়ালঘেরা আমাদের বাড়ি। স্কুল আমার ভালো লাগত না। বাড়িও ভালো লাগত না। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন স্কুলে যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল। কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। শুধু শুনলাম বাবা বলে দিয়েছেন, স্কুলে যেতে হবে না। মাস্টার এসে আমাকে বাড়িতে পড়াবে। আমার স্কুলে যেতে না দেওয়ার কারণ আমি তখন যা অনুমান করেছি তা হচ্ছে—কোনো একদিন হয়তো স্কুল থেকে আমার মা আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

মিসির আলি বললেন, এখন আপনার অনুমান কী?

‘আমি স্যার আমার অনুমানের কথা আপনাকে বলব না। আমি আমার অনুমানের কথা বলে আপনাকে প্রভাবিত করব না।’

‘বেশ, আপনি বলতে থাকুন।’

আমার জীবন কাটতে লাগল বাড়ির পেছনে কুয়োতলায়। বাঁধানো কুয়োতলা আমি চক দিয়ে ছবি এঁকে ভরিয়ে ফেলতাম। সন্ধ্যাবেলা সর্দার চাচা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলতেন—’ভালো হইছে। সৌন্দর্য হইছে।’ তারপর কুয়ো থেকে বালতি বালতি পানি তুলে কুয়োতলা ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখতেন, যাতে পরদিন আমি ছবি আঁকতে পারি।

যে মাস্টার সাহেব আমাকে পড়াতে এলেন তাঁকে আমার পছন্দ হল। খুবই পছন্দ হল। হাসিখুশি। পড়াতেন খুব ভালো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতেন।

মানুষটা খুব রোগা। অনেকখানি লম্বা। অতিরিক্ত লম্বার কারণেই বোধহয় কুঁজো হয়ে থাকতেন। চাইনিজদের মতো তাঁর থুতনিতে দাড়ি ছিল। প্রচুর সিগারেট খেতেন। সস্তা দামের সিগারেট। সিগারেটের কড়া গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যেত। বমি আসত। যখন গল্প শুরু করতেন তখন আর কিছু মনে থাকত না। তামাকের গন্ধও পেতাম না।

‘কী গল্প করতেন?’

‘নানান ধরনের গল্প। চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের পুরো গল্পটা তিনি আমাকে বলেন, কাঁদতে কাঁদতে আমি এই গল্প শুনি। আজ পর্যন্ত আমি কাউকে এত সুন্দর গল্প বলতে শুনি নি।’

‘অল্প কিছুদিন স্যার আমাকে পড়ালেন। তারপর তাঁর চাকরি চলে গেল।’

‘কেন?’

‘আপনাকে পরে বলব। ব্যাখ্যা করে বলব। স্যারের প্রসঙ্গ এখন থাক। যে কথা বলছিলাম—উনার চাকরি চলে গেলেও উনি কিন্তু প্রায়ই আসতেন। চুপিচুপি আসতেন, বেছে বেছে এমন সময় আসতেন যখন বাবা থাকতেন না। গলা নিচু করে বলতেন, তোমাকে দেখতে আসলাম। ভালো আছ? তোমার বাবা বাসায় নাই তো? আমি যদি বলতাম, না। তিনি অসম্ভব আনন্দিত হয়ে তৎক্ষণাৎ সিগারেট ধরাতেন।

একদিন ঠিক দুপুর বেলায় এসে গলা নিচু করে বললেন, তন্ময়, বাবা একটা কথা শোন—তোমার মা তোমাকে একটু দেখতে চায়। শুধু একপলক দেখবে। তোমার মা’র খুব শরীর খারাপ। হয়তো বাঁচবে না। তোমাকে খুব দেখার ইচ্ছা। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? দুপুর বেলা তো তোমার বাবা বাসায় বেশিক্ষণ থাকেন না। তখন নিয়ে যাব। দেখা করিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। যাবে? এই দেখ, তোমার মা একটা চিঠিও দিয়ে দিয়েছেন। চিঠিটা পড়।

আমি চিঠিটা না পড়েই তৎক্ষণাৎ বললাম, হ্যাঁ।

তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, কাউকে কিছু বলবে না। কাউকে কিছু বললে তোমাকে নিতে দেবে না।

‘আমি কাউকে কিছু বলব না।’

‘আমি তোমাকে নিতে আসব না—বুঝলে? তুমি করবে কি—দুপুর বেলায় সুযোগ বুঝে গেট দিয়ে বাইরে চলে আসবে। এক দৌড়ে সদর রাস্তায় চলে আসবে। একটা বেবিট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে না—ঐখানে আমি থাকব। তুমি আসামাত্র তোমাকে নিয়ে চলে যাব। আসতে পারবে না?’

‘পারব।’

‘দেখো, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। জানতে পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোমার বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন না। উনি সেই মানুষই না। আমি একজন দরিদ্র মানুষ…।’

‘আমি যাব।’

‘কবে আসবে?’

‘আপনি বলুন।’

‘আগামীকাল পারবে?’

‘হুঁ পারব।’

উনাকে খুব চিন্তিত মনে হলেও আমি মোটেই চিন্তিত হলাম না। আমার মনে হল- কেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই আমি চলে আসব। তা ছাড়া শীতের দুপুরে সর্দার চাচা পাকা বারান্দায় পাটি পেতে রোদে ঘুমায়। বাবা বাসায় থাকেন না। তিনি ফেরেন সন্ধ্যায়। গেটে যে থাকে সেও ঝিমুতে থাকে। এক ফাঁকে ঘর থেকে চলে গেলেই হল।

তাই করলাম। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি বেবিট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে মাস্টার সাহেব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে সিগারেট। তাঁকে দেখে দারুণ চিন্তিত মনে হল। ভীত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন। আমাকে দেখে তাঁর উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল। তিনি বললেন, কেউ দেখে নি তো?

আমি বললাম, না।

তিনি বললেন, চল একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে নি।

উনি যখন বেবিট্যাক্সি দরদাম করছেন তখনই সর্দার চাচা উপস্থিত হলেন। আমাদের দুজনকেই বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাবা আসলেন সন্ধ্যাবেলা। তিনি আমাকে কিছুই বললেন না, কিন্তু স্যারের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। সেই শাস্তি ভয়াবহ শাস্তি। একতলার দারোয়ানের ঘরে দরজা বন্ধ করে মার। সেই ঘরের ভেতর আমিও আছি। বাবা চাচ্ছিলেন যেন শাস্তির ব্যাপারটা আমিও দেখি।

স্যারকে মারছিল সর্দার চাচা। আমি একটা খাটের উপর দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর দৃশ্য থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দেখছি। স্যার একসময় রক্তবমি করতে লাগলেন এবং একসময় কাতর গলায় বললেন, আমারে জানে মারবেন না। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে।

সর্দার চাচা হিসহিস করে বললেন,—চুপ। শব্দ করলে কইলজা টান দিয়া বাইর কইরা ফেলামু। চুপ।

এরপর কী হল আমার মনে নেই। কারণ, আমার জ্ঞান ছিল না। আমি অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে যাই। জ্ঞান হলে দেখি আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। সর্দার চাচা আমার মাথায় পানি ঢালছেন।

আমি বললাম, উনি কি মারা গেছেন?

সর্দার চাচা বললেন, আরে দূর বোকা! মানুষ অত সহজে মরে না। মানুষ মারা বড়ই কঠিন। তারে রিকশায় তুল্যা বাসায় পাঠায়ে দিছি।

‘রক্তবমি করছিল?’

‘পেটে আলসার থাকলে অল্প মাইর দিলেই নাকে-মুখে রক্ত ছোটে। ও কিছু না।’

‘উনি তা হলে মরেন নাই?’

‘না না। আইচ্ছা ঠিক আছে—তোমারে একদিন তাঁর বাসায় নিয়া যাব নে।’

‘আমি উনার বাসায় যাব না।’

‘এইটাই ভালো। কী দরকার?’

সর্দার চাচা আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। স্যারকে ঐরাতে ভয়ংকরভাবে মারা হয়েছিল। অচেতন অবস্থায় তাঁকে গভীর রাতে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়। সেখান থেকে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর আগে তাঁর জ্ঞান ফেরে নি। কাজেই তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু বলে যেতে পারেন নি।

মুশফেকুর রহমান চুপ করল। হাই তুলতে তুলতে বলল, আজ এই পর্যন্ত থাক। ঠাণ্ডা বেশি লাগছে। মিসির আলি বললেন, আপনার স্যারের নাম কী?

‘উনার নাম জানি না। খুব অল্পদিন পড়িয়েছিলেন। নাম জানা হয় নি। উনি ছিলেন একজন পেশাদার প্রাইভেট টিউটর। ছাত্র পড়ানো ছাড়া আর কিছু করতেন না।’

‘উনি আপনাকে কতদিন পড়িয়েছিলেন?’

‘সপ্তাহ দুই। কিংবা তার চেয়েও কম। আমার শৈশবের ঘটনা আপনার কাছে কেমন লাগল?’

‘মোটামুটি লেগেছে। সাজানো গল্প। যত সুন্দরই হোক সাজানো গল্প ভালো লাগে না।’

মুশফেকুর রহমান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, সাজানো বলছেন কেন?

‘গল্পটা সাজানো মনে করার পেছনে আমার অনেকগুলো কারণ মনে আসছে। যে ভদ্রলোক মাত্র দু সপ্তাহ আপনাকে পড়িয়েছেন তিনি এই সময়ের ভেতর আপনাকে গোপনে নিয়ে আপনার মা’র সঙ্গে দেখা করিয়ে আনার মতো দুঃসাহসিক পরিকল্পনা হাতে নেবেন তা বিশ্বাস্য নয়। আমার মনে হয়, ঘটনাটা এরকম—আপনি বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলেন। যখন আপনার সর্দার চাচা আপনাকে ধরল তখন শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যে মাস্টার সাহেবকে জড়িয়ে গল্পটা তৈরি করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় হয়তো মাস্টার সাহেব সামনে পড়ে গেছেন। যে কারণে আপনাকে আপনার বাবা কোনো শাস্তি দেন নি। আপনার সর্দার চাচা ঐ নিরীহ মানুষটিকে এমন ভয়ংকর শাস্তি কেন দিল তাও পরিষ্কার হচ্ছে না। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত একটি শিশুকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। আর অপরাধ ধরা হলেও মৃত্যুদণ্ড তার শাস্তি হতে পারে না।

মুশফেকুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমার গল্প আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না?

‘না। কারণ গল্পে ফাঁক আছে।’

‘সুদূর শৈশবের গল্প বলছি। ফাঁক থাকাই তো স্বাভাবিক।’

‘ফাঁকগুলো অনেক বড়।’

মুশফেকুর রহমান বলল, ‘স্যার, শুরুতেই আপনি আমাকে একজন ভয়ংকর মানুষ ধরে নিয়েছেন। আমার কারণেই তা করেছেন। আমি নিজেকে ভয়ংকর মানুষ হিসেবেই আপনার সামনে উপস্থিত করেছি। যে কারণে অতি সামান্য অসামঞ্জস্যও আপনার কাছে অনেক বড় লাগছে। গল্পে ফাঁক আছে বলে যে দাবি আপনি করছেন, আমি সেই ফাঁক ঠিক ধরতে পারছি না। আমি শুধু বলছি যে-যা ঘটেছে তা আপনাকে আমি বলার চেষ্টা করেছি। স্যার, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন। আপনাকে মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন আমার নেই।’

মিসির আলি বললেন, ‘আমাকে সত্য বলারও তো প্রয়োজন নেই।

‘প্রয়োজন আছে। সব ঘটনা আপনাকে ঠিকঠাকমতো জানানো দরকার।’

‘আপনি ঠিকঠাকমতো বলছেন না। কী করে আপনি জানলেন যে মাস্টার সাহেবকে মেরে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়? যদি ফেলেও আসে আপনাকে কেউ সেই তথ্য দেবে না। ক্লাস ফোরে যে ছেলেটি উঠেছে সে পরদিন খবরের কাগজ পড়ে এই তথ্য উদ্ধার করবে তা বিশ্বাস্য নয়। মাস্টার যে মারা গেছে এটিও আপনার জানার কথা না। আপনার সর্দার চাচা কি আপনার কাছে স্বীকার করেছিলেন?’

‘না স্বীকার করেন নি। তবে পরদিন খুব ভীত ভঙ্গিতে আমাকে বলেছিলেন— বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে। পুলিশ এলে আমি যেন বলি—আমি এই মাস্টারকে চিনি না।’

‘পুলিশ কি এসেছিল?’

‘জি এসেছিল, তবে আমার সঙ্গে পুলিশের কোনো কথা হয় নি। বাবার সঙ্গে কথা বলে তারা খুব খুশি মনে চলে যায়।

‘মাস্টার সাহেব যে বাহাদুর শাহ পার্কে পড়েছিলেন এই তথ্য কোথায় পেলেন?’ মুশফেকুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হল কথাটা বলবেন কি বলবেন না তা ঠিক করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেন—

‘এই তথ্য আমি মাস্টার সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছি।’

‘তার মানে?’

‘যে মাস্টার সাহেবের কথা আপনাকে বললাম, উনি তাঁর মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে বাস করছেন।’

‘কী বললেন?’

‘ঐ মৃত ব্যক্তি গত একুশ বছর ধরে আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের বাড়িতে বাস করেন। আমি জানি ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য। হাস্যকর। এটা যে বিংশ শতাব্দী তাও আমি জানি। মানুষ চাঁদে নেমেছে, চাঁদের মাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ আছে এটি যেমন সত্যি- আমার স্যার আমাদের বাড়িতে বাস করছেন এটিও তেমনি সত্য। আমি চাই আমার ঐ স্যারের সঙ্গে আপনার দেখা হোক, কথা হোক। তিনি আপনার মতোই বুদ্ধিমান। কিংবা কে জানে আপনার চেয়েও হয়তো বুদ্ধিমান। তাঁকে আপনার পছন্দ হবে।’

‘উনি আমাকে চেনেন?’

‘হ্যাঁ চেনেন। আমি যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি তা তিনি জানেন। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী।’

‘যে দুজন খুন হয়েছে, তারা কারা?’

‘একজন সর্দার চাচা। অন্যজন আমার বাবা।’

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। মুশফেকুর রহমান বলল, আপনি কি আমার স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন?

‘না।’

‘না কেন?’

একজন এসে আমাকে বলবে—তার বাড়িতে একটি প্রেতাত্মা বাস করছে, সেই প্রেতাত্মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়-আর ওমনি আমি কথা বলার জন্যে রওনা হব—তা হয় না। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, মানসিকভাবে অসুস্থ নই।’

‘আপনি কি কোনো কৌতূহল বোধ করছেন না?’

‘প্রেতাত্মা বিষয়ে কোনো কৌতূহল বোধ করছি না। তবে আপনার ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে আপনি খুবই অসুস্থ একজন মানুষ। আপনার মার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। উনি কি জীবিত আছেন?’

‘জি, জীবিত আছেন। আমি জানতাম আপনি আমার মার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। আমি উনার ঠিকানা লিখে এনেছি। এই কাগজে লেখা আছে। ‘ মিসির আলি যন্ত্রের মতো ঠিকানা লেখা কাগজ হাতে নিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *