১৩. মিসির আলি বিছানায় ঘুমুতে গেলেন

১৩

রাত এগারটায় নিয়মমতো মিসির আলি বিছানায় ঘুমুতে গেলেন। এ-বাড়িতে এসে খুব অনিয়ম হচ্ছে। রোজ ঘুমুতে দেরি হচ্ছে। সকালের মর্নিং-ওয়াক করা হচ্ছে না। মিসির আলির পরিকল্পনা হল, আজ থেকে আবার আগের নিয়মে ফিরে যাবেন।

বিছানায় শুয়ে হাতের কাছে রাখা টেবিল ল্যাম্প জ্বালালেন। কিছুক্ষণ কোনো—একটা বই পড়ে চোখ ক্লান্ত করবেন—এতে চট করে ঘুম চলে আসে। মিসির আলির হাতের বইটির নাম GhostGirl, লেখিকা বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ টোরি হেডেন। বইটি লেখা হয়েছে ন’ বছর বয়সী এক মেয়ে ‘জেডি’কে নিয়ে। অসম্ভব রূপবতী এই বালিকা মানসিক প্রতিবন্ধী স্কুলে তাঁর ছাত্রী ছিল। মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, কিন্তু কখনো কথা বলত না। তার শারীরিক কোনো অসুবিধা ছিল না, তবু সে থাকত কুঁজো হয়ে। যদিও সোজা হয়ে দাঁড়ানো তার জন্যে কোনো সমস্যা নয়।

মনস্তত্ত্ববিদ টোরি হেডেন এই আশ্চর্য মেয়েটির কথা ডিটেকটিভ উপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। মেয়েটির মনের ভেতরকার গোপন অন্ধকার এক-এক করে আলোতে বের করে নিয়ে এসেছেন। মিসির আলি দু’ শ’ পৃষ্ঠা পর্যন্ত একটানা পড়ে ঘড়ির দিকে তাকালেন, রাত বাজছে তিনটা। আরো তিরিশ পৃষ্ঠা বাকি আছে। এখন শুয়ে পড়া উচিত। কিন্তু বইটি শেষ না-করে ঘুমুতে যেতে তাঁর ইচ্ছা করল না।

আব্দুল মজিদ ফ্লাস্কে করে চা রেখে গেছে। তিনি এক কাপ চা এবং পরপর দু’টি সিগারেট খেলেন। সিগারেট খেতে-খেতে ‘জেডি’ নামে মেয়েটির কথা ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল, এ-জাতীয় মানসিক প্রতিবন্ধী বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্যে টোরি হেডেনের মতো প্রতিভাবান এবং নিবেদিত মনস্তাত্ত্বিক নেই।

মিসির আলি আবার বই পড়া শুরু করার আগে বাথরুমে ঢুকলেন। আব্দুল মজিদ বারবার করে বলেছে গভীর রাতে বাথরুমে গেলে যেন দরজা কখনোই বন্ধ না-করা হয়।

মিসির আলি দরজা বন্ধ করলেন। কেন জানি তাঁর একটু ভয় লাগল। সম্ভবত Ghost Girl পড়ার কারণে এটা হয়েছে। সাময়িকভাবে হলেও ভয়ের একটা বীজ মনের গভীরে ঢুকে গেছে। চোখে-মুখে পানি দেবার জন্যে ট্যাপ খুললেন—আশ্চর্য ব্যাপার, ট্যাপে এক ফোঁটা পানি নেই। চোখ-মুখ জ্বালা করছে। মুখে পানির ঝাপটা দেওয়া দরকার। তাঁর ঘরে বোতলে পানি আছে। ঐ পানি নিয়ে আসা যায়। মিসির আলি বাথরুমের দরজা খুলতে গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন। দরজা খোলা যাচ্ছে না। দরজা বন্ধ। পরপর দু’বার চেষ্টা করলেন। নব ঘোরানোই যাচ্ছে না। আশ্চর্য তো! ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হালকা গন্ধ, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি নব ছেড়ে দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। তাঁকে খানিকটা ভীত বলে মনে হল। তিনি নিঃশব্দে বাথরুমের অন্য প্রান্তে সরে গেলেন। এবং ছোট শিশুদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন। আর তখনি বাথরুমের বাতি নিভে গেল। ঘর হল নিকষ অন্ধকার। এত অন্ধকার মিসির আলি এর আগে কখনো দেখেন নি। আলোর ক্ষীণ রেখা সব অন্ধকারেই থাকে—কিন্তু বাথরুমে তাও নেই। তাঁর শরীর কাঁপছে, বুক ধড়ফড় করছে। এগুলি আর কিছুই না, সেন্স ডিপ্রাইভেশনের ফলাফল। কেউ হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেলে ভয়াবহ মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হয়। তাঁরও তাই হচ্ছে। চোখ থেকেও কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।

মিসির আলি বসে আছেন চুপচাপ। তাঁর পকেটে সিগারেটের প্যাকেট এবং দিয়াশলাই আছে। ইচ্ছা করলেই তিনি দিয়াশলাই জ্বালাতে পারেন। জ্বালালেন না, বরং উবু হয়ে একটা বড় ধরনের কোনো ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সেই ঘটনা ঘটল। তিনি পরিষ্কার শুনলেন, ঠিক তাঁর কানের কাছে শিশুদের মতো গলায় কে-একজন ডাকল, ‘মিসির আলি। এই মিসির আলি।’

জবাব দেবার ইচ্ছা প্রাণপণে দমন করে তিনি পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইলেন—একচুলও নড়লেন না। আবারো সেই অশরীরী শব্দ হল। বাথরুমের ভেতরে আবারো বালক-কণ্ঠে কে যেন বলল, ‘মিসির আলি, তুমি কোথায়? তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?’

একটু হাসির শব্দও যেন পাওয়া গেল। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ। মিসির আলি নিজেকে আরো ছোট করে বসে রইলেন আগের জায়গায়। তিনি যে—ভঙ্গিতে গুটিসুটি মেরে বসেছেন, তাকে বলে Mother’s womb position. মায়ের পেটে শিশুরা এইভাবেই থাকে। বসে থাকার এই ভঙ্গিটি ভয় কাটাতে সাহায্য করে। কারণ মায়ের জরায়ু এমন এক স্থান, যেখানে ভয়ের কোনো স্থান নেই। শিশুর জন্যে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। ভয় পেলেই এই জায়গাটার জন্যে মানুষের মনে এক ধরনের ব্যাকুলতা জাগে।

মিসির আলি ভয় কাটানোর প্রচলিত পদ্ধতিগুলি নিয়ে দ্রুত ভাবছেন। ভয় কাটানোর সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে নগ্ন হয়ে যাওয়া। বলা হয়ে থাকে— ভৌতিক কোনো কারণে ভয় পেলে নগ্ন হওয়ামাত্র ভয় অর্ধেক কমে যায়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে? মিসির আলির মাথায় আসছে না। মায়ের পেটে আমরা নগ্ন হয়ে ছিলাম, এই কি ব্যাখ্যা? এটা নিয়ে এক সময় ভাবতে হবে।

ভয় কাটানোর আরেকটি পদ্ধতি হল বড়-বড় নিঃশ্বাস নেওয়া। এই পদ্ধতির পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে—বড়-বড় নিঃশ্বাস নেবার অর্থ বেশি করে অক্সিজেন নেওয়া। শরীরে বেশি অক্সিজেন যাওয়া মানে মস্তিষ্কে বেশি অক্সিজেন যাওয়া।

তীব্র পিপাসা হচ্ছে। বুক-মুখ শুকিয়ে কাঠ। এত ভয় পাচ্ছেন কেন? বন্ধ ঘর। অশরীরী কণ্ঠ। ফুলের গন্ধ—জমাট অন্ধকার—এর বাইরেও কি কিছু আছে?

মিসির আলি নিজের নাড়ি ধরলেন। নাড়ি খুব দ্রুত চলছে। কত দ্রুত তা অবশ্যি তিনি ধরতে পারছেন না। সঙ্গে ঘড়ি নেই। মনে হচ্ছে বাথরুমের এই অন্ধকার ঘরে সময় আটকে গেছে। কখনো বোধ হয় ভোর হবে না। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি। সময় শ্লথ হয়ে গেছে। ভোর হতে কত বাকি?

এক সময় সামান্য আলোর আভা দেখা গেল। ভোর বোধহয় হচ্ছে। মিসির আলি বাথরুমের দরজায় হাত রাখলেন। দরজা খুলে গেল। তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ। দরজা খুলে তিনি বাইরে এলেন। আকাশ ফরসা হলেও চারদিক এখনো অন্ধকার। এই অন্ধকারে সবুজ শাড়ি পরে নাদিয়া ঘুরছেন। মিসির আলিকে দেখে তিনি খুশি খুশি গলায় বললেন, ‘আরে, আপনি কি রোজ এত ভোরে ওঠেন?’

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘রোজ উঠি না, আজ উঠলাম।’

‘ভেরি গুড। আসুন, একসঙ্গে খানিকক্ষণ হাঁটি। চা দিতে বলেছি। চা খেতে-খেতে হাঁটার মধ্যে অন্য এক ধরনের আনন্দ আছে।’

মিসির আলি বাগানে নেমে এসে বললেন, ‘আমি আজ চলে যাব। আপনার বাড়িতে বেশ আনন্দে সময় কেটেছে। আপনাকে ধন্যবাদ।’

নাদিয়া ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আজ চলে যাবেন মানে? আপনি কি সমস্যার সমাধান করেছেন?’

‘হ্যাঁ, করেছি। আপনি সকালে নাশতা খাবার সময় এ-বাড়িতে যারা উপস্থিত আছে সবাইকে ডাকুন, আমি সবার সামনে ব্যাখ্যা করব।’

‘সবার সামনে ব্যাখ্যা করার দরকার কী? আমাকে বলুন।’

‘আমি সবার সামনেই বলতে চাই।’

নাদিয়া কিছুক্ষণ স্থির চোখে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। মিসির আলিও হাসলেন।

মেয়েটি আজও সবুজ শাড়ি পরেছে। মেয়েটি বোধহয় কালার-ব্লাইন্ড। একমাত্র কালার-ব্লাইন্ডদেরই বিশেষ কোনো রঙের প্রতি দুর্বলতা থাকে। মিসির আলি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যে কালার-ব্লাইন্ড ছিলেন তা কি আপনি জানেন?’

‘না, জানি না। আপনার কাছে প্রথম শুনলাম।

‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কালার-ব্লাইন্ড। তিনি সবুজ রঙ দেখতে পেতেন না।’

নাদিয়া বললেন, ‘তাতে তাঁর সাহিত্যের বা গানের কোনো ক্ষতি হয় নি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি হঠাৎ করে কালার-রাইন্ডের প্রশ্ন তুললেন কেন?’

‘এম্নি তুললাম। কোনো কারণ নেই।’

‘আপনি কি সত্যি-সত্যি রহস্যের মীমাংসা করেছেন?

‘মনে হয় করেছি।’

‘মনে হয় বলছেন কেন? আপনি কি নিশ্চিত না?’

‘না। প্রকৃতি মানুষকে Truth-কে স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু Absolutetruth-কে স্পর্শ করার অনুমতি দেয় নি। ঐটি প্রকৃতির রাজত্ব। মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *