১২. হোম মিনিস্টার সাহেব

১২

হোম মিনিস্টার সাহেব ফাইল থেকে মুখ না-তুলেই বললেন, ‘কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?’

‘জ্বি ভালো।’

‘ভালো থাকলেই ভালো। বসুন। হাতের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে। আপনার যা বলার—এর মধ্যেই বলতে হবে। আপনি আবার ভেবে বসবেন না, এটাও আমার একধরনের ভান। বেশি-বেশি কাজ দেখাচ্ছি…’

মিসির আলি বসলেন। মিনিস্টার সাহেব ফাইলে চোখ রেখে সহজ গলায় বললেন, ‘খবরের কাগজ পড়েছেন?’

‘জ্বি-না।’

‘পড়লে একটা ইন্টারেস্টিং খবর দেখতে পেতেন। আমার মন্ত্রিত্ব চলে যাচ্ছে— অন্য একজন আসছেন।’

‘সত্যি নাকি?’

‘না, সত্যি না। কিন্তু আমাদের দেশের লোকজন খবরের কাগজে যা পড়ে তা-ই বিশ্বাস করে। সবাই ঘটনা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। যে-কারণে আজ আমার কাছে কোনো দর্শনার্থী নেই। অন্যদিন ওয়েটিং রুম মানুষে গিজগিজ করত। আজ শুধু আপনি এসেছেন। খবরের কাগজ পড়েন নি বলে এসেছেন। পড়লে হয়তো আসতেন না। এখন বলুন কি ব্যাপার।’

‘একটা পুরানো জিডি এন্ট্রি আমার দেখা দরকার। থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘কত দিনের পুরানো?

‘সতের বছর।’

‘তাহলে না-পাওয়ারই সম্ভাবনা। তবু চেষ্টা করে দেখা যাবে। এখন বলুন, আপনার তদন্ত কর্তদূর? শুনেছি রোজ ভিলায় আছেন? সত্যি নাকি?

‘হ্যাঁ।’

‘খুবই ভালো। এখন বলুন, কিছু পেয়েছেন?’

‘পেয়েছি।’

এর মধ্যে পেয়েও গিয়েছেন! কী পেয়েছেন?

‘এটা যে হত্যাকাণ্ড এ-ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি।’

‘বাহ্, ভেরি গুড! তাহলে হত্যাকারী কে বলে ফেলুন। শুনে দেখি চমকে উঠি কি না।’

‘হত্যাকারী কে, তা এখনো জানি না।’

হোম মিনিস্টার ফাইল বন্ধ করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘ছোটোবেলায় ডিটেকটিভ বই খুব পড়তাম—এখনো পড়ি। একটা খুন হয়। বাড়ির সবাইকে খুনী বলে সন্দেহ হতে থাকে। যার ওপর সন্দেহ সবচেয়ে কম হয়—দেখা যায় সে-ই খুনী। আপনি ঐ পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখুন না কেন। এই মুহূর্তে কার ওপর আপনার সবচেয়ে কম সন্দেহ হচ্ছে?’

মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘এই মুহূর্তে সবচেয়ে কম সন্দেহ হচ্ছে আপনার ওপর।’

হোম মিনিস্টার তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ‘তার মানে? আপনি কি রসিকতা করার চেষ্টা করছেন?’

‘জ্বি-না স্যার, আমি রসিকতা করার চেষ্টা করছি না। ওসমান গনির পরিবারের সঙ্গে আপনি পরোক্ষভাবে হলেও জড়িত। এই পরিবারের সঙ্গে আপনার স্বার্থ জড়িত।’

‘ওসমান গনি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। মাঝে-মাঝে ওর বাড়িতে গান শুনতে যেতাম। এর ভেতর স্বার্থ কী আছে?’

‘আপনি আপনার মেজো ছেলেকে নাদিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেবার চেষ্টা অনেকদিন থেকে করছেন। নাদিয়া রাজি হচ্ছে না বলেই বিয়েটা হচ্ছে না।

‘বন্ধুর কন্যার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবার ইচ্ছা হওয়াটা কি দোষের কিছু?

‘মোটেই দোষের কিছু নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক। আমি কিন্তু দোষের কিছু বলি নি। আমি শুধু বলেছি—এই পরিবারের সঙ্গে আপনার স্বার্থ জড়িত। পরোক্ষভাবে হলেও জড়িত। কাজেই এই পরিবারে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটলে—আপনার কথাও ভাবা হবে। আপনাকে বাইরে রাখা হবে না।’

‘আমি যে নাদিয়ার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছি, এটা আপনাকে কে বলল? নাদিয়া?’

‘জ্বি-না, সে বলে নি। নাদিয়ার সঙ্গে আমার কথাবার্তা খুব কমই হয়। সে বিব্ৰত বোধ করতে পারে বলে এই প্রশ্ন তাকে করি নি।’

‘তাহলে আপনি কার কাছ থেকে এই তথ্য জানলেন?’

‘এটা কি কোনো গোপন তথ্য যে, কেউ জানবে না? বিয়ের আলোচনা কেউ গোপনে করে না। তা ছাড়া আপনার ছেলেও তো অযোগ্য ছেলে না। খুবই যোগ্য ছেলে।’

‘কী করে জানেন?’

‘আমি আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলেছি।’

‘আই সী। আপনি দেখি চষে ফেলছেন! গুড। চা খাবেন?’

‘খেতে পারি।’

মিনিস্টার সাহেব চায়ের কথা বলে, মিসির আলির দিকে ঝুঁকে এসে নিচু গলায় বললেন, ‘আপনার কথা সত্যি। আমার স্বার্থ আছে। ভুল বললাম, স্বার্থ একসময় ছিল, এখন নেই। একসময় আমার ছেলেকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। ওসমান গনিকে অনেক অনুরোধ করেছি। সে কখনো হ্যাঁ বলে নি, আবার কখনো নাও বলে নি। আমার মধ্যে লোভ কাজ করেছে। ওসমান কোটিপতি। কিন্তু মিসির আলি সাহেব, সেই লোভ এখন আর নেই। লোভের চেয়ে বাস্তবতা এখন বেশি কাজ করছে। আমি এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, নাদিয়া নামের মেয়েটি পুরোপুরি উন্মাদ। মেয়েটা রাতে ঘুমায় না। বারান্দার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হাঁটে, আর খিলখিল করে হাসে। সিগারেট টানে। আপনি তো ঐ বাড়িতেই আছেন। আপনি লক্ষ করছেন না?’

‘খিলখিল হাসি শুনি নি, তবে উনি রাত জাগেন তা সত্যি।’

‘আমি সত্যি কথাই আপনাকে বললাম। তদন্ত করছেন, ভালোমতো করুন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপও বের হয়ে যেতে পারে।’

চা চলে এল। মিসির আলি চায়ের কাপ হাতে নিলেন। মিনিস্টার সাহেব নিলেন না। রাগী রাগী চোখে তিনি চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘মিসির আলি সাহেব।’

‘জ্বি?’

‘আপনার কি ধারণা নাদিয়া মেয়েটি কিছু করেছে?

‘এখনো বলতে পারছি না।

‘তার পক্ষে করা কি সম্ভব?’

‘অসম্ভব কিছু না। সবই সম্ভব।’

‘কেন সে এটা করবে?’

‘মানসিকভাবে অসুস্থ হলেই করবে। তার মা’র কারণে একটা ছোট্ট বাচ্চা মারা গেছে। সেই থেকে মা’র ওপর তীব্র ঘৃণা জন্মাতে পারে। ঘৃণা এক পর্যায়ে ইনসেনিটিতে রূপ নিতে পারে। বলা হয়ে থাকে, নিতান্ত অপরিচিত একজনকে হত্যার চেয়ে পরিচিত একজনকে হত্যা অনেক সহজ।’

‘কেন?’

‘ঘৃণা ব্যাপারটি অপরিচিত কারো প্রতি থাকে না, কিন্তু পরিচিত জনের প্রতি থাকে।’

মিনিস্টার সাহেব বললেন, ‘আমার ধারণা মেয়েটি কিছু করে নি, কিন্তু আমার স্ত্রীর ধারণা, করেছে। আমার স্ত্রীর ধারণা, এই মেয়ে পিশাচ ধরনের। একে বৌ করে আনলে আমরা সবাই মারা পড়ব।’

মিসির আলি বললেন, ‘স্যার, আজ উঠি।’

মিনিস্টার সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘আচ্ছা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *