১১. ডাক্তার মুসফেকুর রহমান

১১

ডাক্তার মুসফেকুর রহমান, (এম.আর. সি. পি., প্রফেসর, পিজি হাসপাতাল) ওসি সাহেবের মতোই বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তারদের সময়ের দাম আছে। সেই দামী সময়ের অংশ নিতান্ত অকারণে কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না। মুসফেকুর রহমান সাহেবের ধারণা, মিসির আলি নামের মানুষটি নিতান্ত অকারণে তাঁর সময় নিচ্ছে। তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া উচিত, কিন্তু দেওয়া যাচ্ছে না। সভ্যসমাজের অনেক অভিশাপের মধ্যে একটা অভিশাপ হচ্ছে—যা করতে ইচ্ছা করে, তা করা যায় না।

ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘আপনাকে যা বলার তা তো বলেছি, তার পরেও বসে আছেন কেন?’

‘এক্ষুণি চলে যাব। শুধু একটা জিনিস জানার বাকি, ওসমান গনি সাহেব কি কখনো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছিলেন?’

‘আমি জানি না। আর জানলেও আপনাকে বলতাম না। ডাক্তারদের কিছু এথিকেল কোড মানতে হয়। রুগীর রোগ সম্পর্কে অন্যকে কোনো তথ্য না-দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে একটি। কার কি অসুখ তা আমি অন্যদের বলব না।

কেন বলবেন না? ব্যাধি তো গোপন রাখার বিষয় নয়।’

‘দেখুন মিসির আলি সাহেব, আমি বুঝতে পারছি আপনি মানুষটি তর্কে পটু। আমি আপনার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে যেতে চাচ্ছি না। ওসমান গনি সাহেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সম্পর্কে আমি যা জানি তা আপনাকে বলেছি। এর বেশি কিছু জানি না।’

‘শেষের দিকে তিনি কোনো ধরনের হেলুসিনেশনে ভুগছিলেন কি?’

‘আমার জানা নেই।’

‘একটু মনে করে দেখুন তো তিনি কি কখনো কথা প্রসঙ্গে আপনাকে বলেছেন যে তিনি তীব্র ভয় পাচ্ছেন বা এই জাতীয় কিছু?’

‘হ্যাঁ, তা বলেছেন। বাথরুমে ঢুকলে তিনি ফিসফিস করে কথা শুনতে পান – যেন কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে। বাচ্চা ছেলের গলা। ছেলেটা তাঁর নাম ধরে ডাকত। দুঃস্বপ্ন দেখতেন। তিনি একবার জানতে চাইলেন কেন এ-রকম হচ্ছে।’

‘উত্তরে আপনি তাঁকে কী বলেন?’

‘আমি বলি যে অতিরিক্ত টেনশানে এ-রকম হতে পারে। আমি তাঁকে টেনশান কমাতে বলি। তাঁকে ঘুমের অষুধ দিই!’

‘কী অষুধ দেন?’

‘এটাও কি আপনার জানতে হবে?’

‘হ্যাঁ, জানতে হবে।

ডাক্তার সাহেব খসখস করে কাগজে অষুধের নাম লিখে মিসির আলির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। শুকনো গলায় বললেন, ‘এই অষুধটা দিই। আরো কিছু জানতে চান? এই অষুধ কীভাবে কাজ করে। কীভাবে নার্ভ শান্ত করে—এ-জাতীয় কিছু?’

‘না, আর কিছু জানতে চাই না। আপনাকে যথেষ্ট বিরক্ত করা হয়েছে। ধন্যবাদ।’

মিসির আলি ঘর থেকে বেরুতে গিয়েও বেরুলেন না। আবার ফিরে এসে আগের জায়গায় বসলেন। ডাক্তার সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন, ‘কি হল?’

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। ওসমান গনি সাহেবের মেয়ে নাদিয়া গনি, সে কি কখনো তার বাবার মতো সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিল?’

‘না, আসে নি। আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?’

‘জ্বি, শেষ হয়েছে।’

‘শেষ হয়ে থাকলে দয়া করে যান। দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে আসবেন না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *