০২. পুলিশের লোকদের বিব্রত

পুলিশের লোকদের বিব্রত করে সবাই বোধহয় এক ধরনের আনন্দ পায়। এক ঘন্টার জায়গায় মিসির আলি দু’ ঘন্টা দেরি করে ফেললেন। ভ্রমণ শেষ করে হোটেল রহমানিয়ায় নাশতা করলেন।ম খুটিয়ে খুঁটিয়ে সব ক’টা পত্রিকা পড়লেন। গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যুর কথা খবরের কাগজে থাকবেই। ওসমান গনি সম্পর্কিত কোনো খবর কোনো পত্রিকাতেই নেই। হোম মিনিস্টারের কাছে মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও খবরের কাগজের লোকদের কাছে হয়তো নয়। হোটেল রহমানিয়া থেকে বের হয়ে তিনি নিতান্তই অকারণে নিউমার্কেট কাঁচা-বাজারে গেলেন। ভোরবেলা এখানে মাছের পাইকারি কেনা—বেচা হয়। গাদাগাদি করে রাখা মাছের স্তূপ হাঁকডাক হয়ে বিক্রি হয়। যারা কেনে, তারা মুখ কালো করে কেনে, যারা বিক্রি করে তারাও মুখ কালো করে বিক্রি করে। দেখতে মজা লাগে।

মিসির আলি ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে বললেন, ‘এক ঘন্টার কথা বলেছিলাম, একটু দেরি হল।’

ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আপনি এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট দেরি করেছেন।’

বোঝাই যাচ্ছে মানুষটি বিরক্ত। পুলিশের লোকদের বিরক্তি প্রকাশের ভঙ্গি অন্যদের মতো নয়। রকিবউদ্দিন তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করছেন ঘন-ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। রকিবউদ্দিনের সঙ্গে আরো একজনকে দেখা যাচ্ছে। সে মনে হচ্ছে পদমর্যাদায় ছোট। ঘরে আরো চেয়ার থাকতেও বসেছে মোড়ায়। তার হাতে কাগজ এবং কলম।

মিসির আলি বললেন, ‘আপনারা কি চা খাবেন? চা করি?’

‘চা খাব না। আপনি আমার সামনে বসুন। কথার জবাব দিন।’

‘আপনি এমন ভঙ্গিতে কথা বলছেন যেন আমি একজন আসামী। আমি কি আসামী?’

‘খুন যখন হয়, তখন খুনীর পরিচিত সবাইকেই আসামী ভেবে নিয়ে পুলিশ এগোয়।’

‘ওসমান গনি খুন হয়েছেন?’

‘আপনি প্রশ্ন করবেন না। প্রশ্ন করার কাজটা আমি করব। আপনি উত্তর দেবেন।’

‘বেশ, প্রশ্ন করুন।’

‘আপনি দাঁড়িয়ে না-থেকে আমার সামনের চেয়ারটায় বসুন।’

‘চেয়ারে না-বসে আমি বরং খাটে বসি। পা তুলে বসা আমার অভ্যাস। আপনারা শোবার ঘরে চলে আসুন। আমি খাটে পা তুলে বসব, আপনারা চেয়ারে বসবেন।’

রকিবউদ্দিন কঠিন মুখে বললেন, ‘আমি অন্যের শোবার ঘরে ঢুকি না। কথাবার্তা যা হবার এখানেই হবে।’

‘বেশ, প্রশ্ন করুন।’

রকিবউদ্দিনের সঙ্গের লোকটি খাতা এবং পেন্সিল হাতে তৈরি। মনে হচ্ছে শর্টহ্যাণ্ড-জানা কেউ। আজকালকার পুলিশদের সঙ্গে শর্টহ্যাণ্ড-জানা লোকজন হয়তো থাকে, মিসির আলি জানেন না। পুলিশের সঙ্গে তাঁর সে-রকম যোগাযোগ কখনো ছিল না। প্রশ্নোত্তর শুরু হল। প্রশ্নের ধারা দেখে মনে হচ্ছে রকিবউদ্দিন দীর্ঘ দেড় ঘন্টা বসে—বসে সব প্রশ্ন সাজিয়ে রেখেছেন। কোনটির পর কোনটি করবেন তা-ও ঠিক করে রাখা। তবে প্রশ্নগুলির মধ্যে প্রাণ নেই। প্রতিটি প্রশ্ন একই ভঙ্গিতে করা হচ্ছে। স্বরের ওঠানামা নেই, রোবট—গন্ধী প্রশ্ন।

ইন্সপেক্টর : মিসির আলি সাহেব।

মিসির : জ্বি?

ইন্সপেক্টর : আপনি কী করেন?

মিসির : এক সময় অধ্যাপনা করতাম। এখন কিছু করি না।

ইন্সপেক্টর : কিছু না-করলে আপনার সংসার চলে কী করে?

মিসির : আমার সংসার নেই। একা মানুষ। কোনো-না-কোনোভাবে চলে যায়।

ইন্সপেক্টর : একা মানুষদেরও বেঁচে থাকার জন্যে টাকা লাগে। সেই টাকাটা আসে কোত্থেকে?

মিসির : ওসমান গনির মৃত্যুর সঙ্গে আপনার এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক ধরতে পারছি না।

ইন্সপেক্টর : আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আপনাকে সম্পর্ক খুঁজতে হবে না।

মিসির : বাজারে আমার লেখা কিছু বই আছে, পাঠ্য বই। বইগুলি থেকে রয়েলটি পাই।

ইন্সপেক্টর : বাড়ি ভাড়া কত দেন?

মিসির : আগে দিতাম পনের শ’ টাকা। ইলেকট্রিসিটি এবং পানিসহ। এখন কিছু দিতে হয় না।

ইন্সপেক্টর : দিতে হয় না কেন?

মিসির : বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের একটা সামান্য সমস্যার আমি সমাধান করেছিলাম। তারপর থেকে উনি ভাড়া নেন না।

ইন্সপেক্টর : কী সমস্যা?

মিসির : ভৌতিক সমস্যা।

ইন্সপেক্টর : ওঁর বাড়িতে ভূতের উপদ্রব ছিল। সেই উপদ্রব দূর করেছি।

মিসির : আপনি কি ভূতের ওঝা নাকি?

মিসির : আমি ভূতের ওঝা নই। অবশ্যি এক অর্থে ভূতের ওঝা বলতেও পারেন। কিছু মনে করবেন না। আপনার প্রশ্নের ধারা আমি বুঝতে পারছি না।

ইন্সপেক্টর : ওসমান গনি সাহেব কি মাঝে-মাঝে আপনাকে অর্থসাহায্য করতেন?

মিসির : না। গতকালই আমি তাঁকে প্রথম দেখি।

ইন্সপেক্টর : আপনি বলতে চাচ্ছেন যে উনি আপনার কাছে এসেছিলেন?

মিসির : জ্বি।

ইন্সপেক্টর : উনি কখন এসেছিলেন আপনার কাছে?

মিসির : উনি রাত আটটার সময় এসেছিলেন, সাড়ে ন’টায় চলে যান।

ইন্সপেক্টর : ওঁর সম্পর্কে আপনি কী জানেন?

মিসির : আমি কিছুই জানি না।

ইন্সপেক্টর : আপনি মিথ্যা কথা বললেন, কারণ উনি যে ব্যবসায়ী তা আপনি জানতেন। আপনার শোবার ঘরের বালিশের কাছে রাখা একটা খাতায় আপনি তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন।

মিসির : জেনে লিখি নি, অনুমান করে লিখেছি। আরেকটি কথা, খানিকক্ষণ আগে যে বললেন আপনি কারোর শোবার ঘরে ঢোকেন না, তা ঠিক নয়। আপনি আমার অনুপস্থিতিতে আমার শোবার ঘরে ঢুকেছেন।

ইন্সপেক্টর : সন্দেহজনক জায়গায় অনুসন্ধান চালানোর অধিকার পুলিশের আছে।

মিসির : তার জন্যে সার্চ ওয়ারেন্ট লাগে। আপনার কি সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?

ইন্সপেক্টর : মিসির আলি সাহেব, আমার সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। আমি কাঁচা কাজ কখনো করি না। দেখতে চান?

মিসির : দেখতে চাই না। বুঝতে পারছি আপনি সত্যি কথা বলছেন। আর কী জানতে চান বলুন।

ইন্সপেক্টর : ওসমান গনি সাহেব ঠিক কী কারণে এসেছিলেন?

মিসির : ঠিক কী কারণে এসেছিলেন তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। দুটো ছোট সাইজের ভূতের কথা বললেন, আমার কাছে মনে হল তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।

ইন্সপেক্টর : আপনার ধারণা উনি মানসিক রুগী?

মিসির : আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই, তবে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে।

ইন্সপেক্টর : তাঁর হত্যাকারীর নাম তিনি আপনাকে বলে গেছেন? সেই নাম বলুন।

মিসির : আপনার কথায় আমি বিস্মিত বোধ করছি। এ-ধরনের কোনো কথাই হয় নি। তা ছাড়া শুধু-শুধু তিনি আমাকে হত্যাকারীর নাম বলতে যাবেন কেন?

ইন্সপেক্টর : এটা আমাদেরও প্রশ্ন। আচ্ছা, উনি যখন কথা বলছিলেন, তখন কোনো  বিশেষ কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?

মিসির : আমি খুব খুঁটিয়ে ওকে লক্ষ করি নি। তাঁর সোনাবাঁধানো তিনটা দাঁত দেখে বিস্মিত হয়েছি। এ-যুগে সোনা দিয়ে কেউ দাঁত বাঁধায় না।

ইন্সপেক্টর : উনি কি আপনাকে বললেন যে ওর দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো? নাকি এও আপনার অনুমান?

মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অনুমান নয়, দেখলাম।’

ইন্সপেক্টর সাহেব মুখ বিকৃত করলেন। মনে হচ্ছে মিসির আলির কোনো কথাই তিনি বিশ্বাস করছেন না। মিসির আলির কাছে মনে হল পুরো ব্যাপারটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একবার জট পাকাতে শুরু করলে জট পাকানোর প্রক্রিয়া দ্রুত ঘটতে থাকে। মিসির আলি বললেন, ‘ওসমান গনি যে আমার কাছে এসেছিলেন, এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?’

ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন যন্ত্রের মতো বললেন, ‘ওঁর লেখার টেবিলে আপনার লেখা একটা চিরকুট ছিল। আপনার ঠিকানাও সেই চিরকুটে লেখা। দেখুন তো এই হাতের লেখাটি আপনার?’

‘জ্বি, আমার।’

‘চিরকুটে এই জাতীয় কথা আপনি কেন লিখলেন।’

‘উনি লিখতে বললেন বলেই লিখলাম।’

‘কেউ কিছু লিখতে বললেই আপনি লিখে দেন?’

‘না, তা দিই না। তবে মানুষটা যদি উন্মাদ হয় এবং কিছু লিখে না-দিলে যদি তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় না থাকে, তখন লিখে দিতে হয়। আমার পরিস্থিতিতে আপনি যদি পড়তেন তাহলে বুঝতেন।’

‘আপনি বলতে চাচ্ছেন ওসমান গনি একজন উন্মাদ?’

‘মানসিকভাবে সুস্থ না তো বটেই।

‘ঠিক আছে। আপনি যা বলছেন লিখে নিচ্ছি এবং ধরে নিচ্ছি যা বলছেন সবই সত্য।’

‘মিথ্যা বলার আমার কোনো কারণ নেই।’

‘দেখুন মিসির আলি সাহেব, আমি সতের বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছি। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কারণে মিথ্যা বলার চেয়ে অকারণে মিথ্যা বলতে মানুষ বেশি পছন্দ করে।’

‘আপনার অবজারভেশন ঠিক আছে।’

রকিবউদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘এখন আপনি আমার সঙ্গে চলুন।’

‘কোথায়?’

‘ওসমান গনি সাহেবের ডেড বডি দেখবেন।’

‘তার কি প্রয়োজন আছে? মৃত মানুষ দেখতে ভালো লাগে না।’

‘মৃত মানুষ দেখতে কারোরই ভালো লাগে না। আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে বলছি—আপনি আসুন।’

‘চলুন।’

.

কিছুই মিলছে না। গুলশানের অভিজাত এলাকায় তেতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল লন। ফোয়ারা আছে, মার্বেল পাথরের একটি শিশু ফোয়ারার মধ্যমণি। চারদিক থেকে তার গায়ে পানি এসে পড়ছে। বাড়ির সামনে কোনো ফুলের বাগান নেই। ঘাসে ঢাকা লন, ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু করা। মনে হয়, বাড়ির সামনে ঢেউ খেলছে। বাড়ির প্যাটার্নও জাহাজের মতো। ফুলের বাগান বাড়ির দু’পাশে। দেশিফুলের প্রচুর গাছ।

মিসির আলিকে গেটের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কড়া পুলিশ পাহারা। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। রকিবউদ্দিন ভেতরে গেলেন। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ফিরে এসে মিসির আলিকে নিয়ে গেলেন। দোতলার ঘরে নিচু খাটের ওপর মৃতদেহ শোয়ানো। সাধারণত মরা-বাড়িতে হৈচৈ কান্নাকাটি হতে থাকে। এখানে তার কিছুই নেই। ঘরের এক কোণায় রাখা গদিআটা চেয়ারে একটি অল্পবয়সী মেয়ে পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। মেয়েটি একদৃষ্টিতে মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির মাথার চুল খুব লম্বা। গায়ে উজ্জ্বল সবুজ রঙের শাড়ি। খাটের এক কোণায় যিনি বসে আছেন, তিনি সম্ভবত ডাক্তার। সাফারির পকেট থেকে স্টেথেসকোপের মাথা বের হয়ে আছে। মৃত মানুষদের জন্যে কোনো ডাক্তার প্রয়োজন হয় না। উনি কেন আছেন কে জানে। ঘরের ভেতর একজন পুলিশ অফিসার আছেন। তাঁকে একইসঙ্গে নার্ভাস এবং বিরক্ত মনে হচ্ছে। তিনি স্থির হয়ে এক সেকেন্ড ও দাঁড়াচ্ছেন না।

সাধারণত মৃতদেহ চাদরে ঢাকা থাকে। এ-ক্ষেত্রে তা করা হয় নি। মৃতদেহের মুখের ওপর কোনো চাদর নেই। মিসির আলি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর বিস্মিত হবার সঙ্গত কারণ ছিল।

রকিবউদ্দিন বললেন, ‘মিসির আলি সাহেব, ভালো করে দেখুন। উনিই কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?’

‘না, উনি যান নি।’

‘দাঁত দেখার প্রয়োজন আছে?’

‘না, দাঁত দেখার প্রয়োজন নেই। যিনি আমার কাছে গিয়েছিলেন, তিনি মোটাসোটা ধরনের খাটো মানুষ। গায়ের রঙ শ্যামলা।’

‘যিনি আপনার কাছে গিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন যে তাঁর নাম ওসমান গনি?’

‘জ্বি।’

গদিতে বসে থাকা মেয়েটি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘এখানে এত কথা বলছেন কেন? কথা বলার জায়গার তো অভাব নেই।’

রকিবউদ্দিন মিসির আলিকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে এলেন। মিসির আলি বললেন, ‘আমি কি চলে যাব?’

‘হ্যাঁ, চলে যাবেন। দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।’

‘দরকার হবে বলে মনে করছেন?’

রকিবউদ্দিন ভাবলেশহীন গলায় বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। এটা একটা সিম্পল কেইস অব স্যুইসাইড। বাথরুমের ভেতর তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল। পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভাঙা হয়।’

‘ও।’

‘আত্মহত্যা সম্পর্কে একটা নোট রেখে গেলে আর কোনো সমস্যা ছিল না। নোটটোট নেই—উল্টো আপনার সম্পর্কে আজগুবি কিছু কথা লেখা।’

‘আপনার তাহলে ধারণা হচ্ছে কথাগুলি আজগুবি?’

‘হ্যাঁ, তাই ধারণা হচ্ছে। পয়সা বেশি হলে মানুষ কিছু-কিছু পাগলামি করে। এইসব কিছু করেছেন। একজন কাউকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। সে গিয়ে বলেছে তার নাম ওসমান গনি। হতে পারে না?’

‘হ্যাঁ, হতে পারে।’

‘আচ্ছা, আপনি চলে যান। প্রয়োজন হলে আবার যোগাযোগ করব। তবে প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। এটা একটা আত্মহত্যা। এ-ব্যাপারে সবাই স্যাটিসফায়েড। ফ্যামিলির তরফ থেকে তা-ই বলা হয়েছে।’

‘পোস্ট মর্টেম হবে না?’

‘হওয়া তো উচিত। অপঘাতে মৃত্যুর সুরতহাল হতে হয়। তবে এরা হচ্ছে সমাজের মাথা। এদের জন্যে নিয়ম-কানুন ভিন্ন।’

রকিবউদ্দিন গেট পর্যন্ত মিসির আলিকে এগিয়ে দিলেন। মিসির আলি বললেন, ‘এদের আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে কি আমি কথা বলতে পারি? যে—বাথরুমে উনি মারা গেলেন সেই বাথরুমটা দেখতে পারি?’

রকিবউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কেন?’

‘এম্নি। কারণ নেই কোনো। কৌতূহল বলতে পারেন।’

‘এইসব বিষয়ে কৌতূহল যত কম দেখাবেন ততই ভালো। বাড়িতে যান। আরাম করে ঘুমান।’

‘জ্বি আচ্ছা। সবুজ শাড়িপরা মেয়েটি কি ওঁর আত্মীয়?’

‘হ্যাঁ, আত্মীয়। নাদিয়া গনি। রবীন্দ্রসংগীত করেন, নাম জানেন না?’

‘না। ওঁর সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারলে…..’

‘বাড়ি যান তো—যন্ত্রণা করবেন না।’

মিসির আলি বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। অসময়ে দীর্ঘ ঘুম। ঘুম ভাঙলো দুপুর দুটোর দিকে। খিদেয় প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে। খেতে হবে হোটেলে। বাইরে বেরুবার উপায় নেই—ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। তিনি হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা খাতাটা নিলেন—ওসমান গনি প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হয়েছে। কথাটা লিখে রাখা দরকার। পাতা ওল্টাতে লাগলেন—ওসমান গনি সম্পর্কে যে-পাতায় লিখেছিলেন, ঐ পাতাটা ছেঁড়া। ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছেন।

সন্ধ্যার মধ্যে মিসির আলি আরো একটি তথ্য আবিষ্কার করলেন। তাঁর বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে একজন কেউ তাঁর ওপর লক্ষ রাখছে। পুলিশের লোক বলেই মনে হল। সন্ধ্যার পর ডিউটি বদল হল। অন্য একজন এল। বৃষ্টি সমানে পড়ছে। বেচারাকে ছাতামাথায় হাঁটাহাটি করতে হচ্ছে। কে জানে তাকে সারা রাতই এভাবে কাটাতে হবে কি-না।

রাত ন’টার দিকে বৃষ্টি একটু ধরে এলে মিসির আলি রাতের খাবার খেতে বের হলেন। ছাতামাথায় লোকটি নিরীহ ভঙ্গিতে চট করে গলিতে ঢুকে পড়ল। মিসির আলিও সেই গলিতে ঢুকলেন। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আমার ওপর লক্ষ রাখছেন?

সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘জ্বি-না স্যার।’

‘আপনি পুলিশের লোক তো?’

‘জ্বি স্যার, আমি পুলিশের লোক। তবে আমি আপনার ওপর লক্ষ রাখছি না। বিশ্বাস করুন স্যার।’

‘বিশ্বাস করছি, আমি হোটেল রহমানিয়ায় ভাত খেতে যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে আসতে পারেন।’

‘আমি স্যার খেয়ে এসেছি।’

মিসির আলি লম্বা-লম্বা পা ফেলে হোটেলের দিকে রওনা হলেন। তাঁকে তেমন চিন্তিত মনে হল না। যদিও চিন্তিত হবার কথা। পুলিশের একজন লোক সারাক্ষণ তাঁর ঘরের দিকে লক্ষ রাখবে, এটা স্বস্তিবোধ করার মতো কোনো ঘটনা নয়। নিতান্ত সম্পর্কহীন একটা লোক তাঁর সম্পর্কে ডাইরিতে কেন লিখবে? ওসমান গনি সেজে কেনই বা একজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবে? একটা সময় ছিল, যখন এ—জাতীয় সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগত। এখন লাগে না। ক্লান্তিবোধ হয়। তিনি সারা জীবন বিশ্বাস করে এসেছেন, পৃথিবীতে জটিল সমস্যা বলে কিছু নেই। পৃথিবীর নিজস্ব একধরনের সারল্য আছে। সে—কারণেই পৃথিবীর সব সমস্যাই সরল সমস্যা। কিন্তু আসলেই কি তাই? তাঁর ভাবতেও ভালো লাগছে না। ওসমান গনির বিষয়টা নিয়ে তেমন কৌতূহলও কেন জানি বোধ করছেন না। ওসমান গনি ধনবান এবং সম্ভবত ক্ষমতাবান একজন মানুষ ছিলেন। জীবনে যা পাওয়ার সব পেয়ে যাবার পর আত্মহনন করলেন। ঘটনাটা ঘটাবার আগে ছোট্ট একটা রসিকতা করলেন। এর বেশি কি? মৃত্যু কীভাবে হল আগামীকালের খবরের কাগজ পড়ে জানা যাবে। কিংবা কে জানে খবরের কাগজে হয়তো কিছু থাকবে না। ক্ষমতাবান মানুষদের কোন খবরটি পত্রিকায় যাবে, কোনটি যাবে না—তাও তাঁরা ঠিক করে দেন।

মিসির আলি ভাত ডাল এবং এক পিস ইলিশ মাছ দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলেন। ইলিশ মাছ খাওয়াটা ঠিক হয় নি। গলায় কাঁটা বিঁধে গেছে। ঢোক গিললেই কাঁটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এম্নিতে কিছু বোঝা যায় না। মুশকিল হচ্ছে গলায় কাঁটা বিধলেই অকারণে কিছুক্ষণ পরপর ঢোক গিলতে ইচ্ছা করে।

বাসায় ঢোকবার মুখে বাড়িয়ালার ছেলের বউ দিলরুবার সঙ্গে দেখা। দিলরুবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। মিসির আলি লক্ষ করেছেন, এই মেয়েটি বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করে। বৃষ্টি হলেই মেয়েটাকে তিনি বারান্দায় দেখেন। দিলরুবা খুশি-খুশি গলায় ডাকল, ‘মিসির চাচা। আপনার কী হয়েছে বলুন তো?’

‘কিছু হয় নি, কী হবে?’

‘আজ সকালে বাবার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল। আপনি বাবাকে চিনতে পারেন নি। হড়বড় করে একগাদা কথা বলেছেন। ঘন্টা বাজছে—ঢং ঢং ঢং…..’

দিলরুবা খিলখিল করে হাসছে। মেয়েটির হাসিমুখ দেখতে ভালো লাগছে।’

‘আপনার শরীর ভালো আছে তো মিসির চাচা?’

‘হ্যাঁ মা, শরীর ভালো।’

তিনি সহজে কোনো মেয়েকে মা ডাকতে পারেন না। এই মেয়েটিকে মা ডেকে ভালো লাগছে। খানিকক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে গেছেন যে তাঁর গলায় কাঁটা ফুটে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *