০৩. বিশিষ্ট বেহালাবাদক শিল্পপতি ওসমান গনি

বিশিষ্ট বেহালাবাদক শিল্পপতি ওসমান গনির
মর্মান্তিক মৃত্যু
[স্টাফ রিপোর্টার]

বিশিষ্ট বেহালাবাদক শিল্পপতি জনাব ওসমান গনি গত বারই জুন রাত তিনটায় গুলশানস্থ বাসভবনে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ—জনাব ওসমান গনি ঐ রাতে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নাদিয়া গনিকে কিছুক্ষণ বেহালা বাজিয়ে শোনান অতঃপর তাঁকে বলেন বড় ধরনের দুঃসংবাদের জন্যে সবাইকে সবসময় মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়। কন্যা এই পর্যায়ে জানতে চান, তিনি এ-জাতীয় কথা কেন বলছেন। ওসমান গনি তার উত্তরে নানান ধরনের রসিকতা করতে থাকেন, এবং এক সময় তাঁকে এক পট গরম কফি এনে দিতে বলেন। নাদিয়া গনি কফির পট নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবাকে দেখতে পান না। বাবা স্নান করছেন। বেরুতে দেরি হবে ভেবে তিনি আবার রান্নাঘরে ফিরে যান। নতুন এক পট কফি বানিয়ে ফিরে আসেন। এই সময় তিনি বাথরুম থেকে আর্তস্বর শুনে চমকে ওঠেন। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সেখান থেকে শব্দ ভেসে আসছে। নাদিয়া গনি বাথরুমের দরজা খুলতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাঁর হৈচৈ শুনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছুটে আসেন। বাথরুমের দরজা ভেঙে ফেললে দেখা যায়, ওসমান গনির নিষ্প্রাণ দেহ বাথটাবের পানিতে ডুবে আছে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল তিনি আত্মহত্যা করেছেন, পরবর্তী সময়ে সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়—বাথটাবে স্নানরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দশ বছর আগে তাঁর স্ত্রীও দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আর দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করেন নি। নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে দেন। প্রচারবিমুখ এই নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর মৃত্যুতে নগরীতে শোকের ছায়া নেমে আসে! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্ববিশ্রুত বেহালাবাদক ইহুদি মেনহুইনের সঙ্গে তাঁর দু’টি অ্যালবাম আছে, যা প্রকাশ করেছে কলম্বিয়া রেকর্ডস। এই বরেণ্য শিল্পী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠান করলেও নিজ দেশের বেতার টেলিভিশন বা কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে কখনোই বেহালা বাজাতে দেখা যায় নি।

মিসির আলি খবরটি মন দিয়ে পড়লেন। খবরের সঙ্গে ওসমান গনির একটি ছবি ছাপা হয়েছে। যুবক বয়সের ছবি। অত্যন্ত সুপুরুষ একজন মানুষ। বড়-বড় চোখ। সেই চোখে একধরনের বিষণ্নতা আছে। পরক্ষণেই মনে হল, ভদ্রলোকের চোখ দু’টি বিষণ্ণ—এটা তাঁর মনগড়া অনুমান। মানুষটি একজন বেহালাবাদক এবং মৃত। সেই কারণেই ছবিটি তিনি দেখছেন মমতা এবং বিষাদ নিয়ে। নিজের মমতা এবং বিষাদের কারণে ছবির চোখ দু’টি বিষাদমাখা বলে মনে হচ্ছে।

তিনি খবরটা আবার পড়লেন। তাঁর কাছে মনে হল, রিপোর্টার ওসমান গনির চরিত্রে একধরনের মহত্ত্ব আরোপের চেষ্টা করেছেন। এই শিল্পী নিজের দেশের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন নি—এটি তাঁর চরিত্রের কোনো বড় দিক নয়। তিনি যা করেছেন, তা হচ্ছে দেশের মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন। বড় মাপের শিল্পীরা এ-কাজ কখনো করবেন না। তা ছাড়া ভদ্রলোক শুধু শিল্পী নন, শিল্পপতি। অর্থাৎ তিনি শিল্পকে যেমন চিনেছেন, অর্থকেও তেমনি চিনেছেন।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন নি—এই বাক্যটিতেও তাঁর চরিত্রের মহত্ত্ব প্রকাশ পায় না। বরং এটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যজীবন অসহনীয় ছিল। যে-কারণে স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বার বিবাহের যন্ত্রণায় যেতে চান নি।

মিসির আলি তৃতীয় বারের মতো রিপোর্টটি পড়লেন। তাঁর কাছে মনে হল রিপোর্টটি অসম্পূর্ণ। কত বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু, তা দেওয়া নেই। জন্ম-তারিখ নেই। পুত্র-কন্যাদের কথা নেই। কার কাছে বেহালা বাজানো শিখেছেন, কতদিন ধরে বাজাচ্ছেন তাও নেই। বরং রিপোর্টটি অপ্রয়োজনীয় খবরে ঠাসা। তিনি কফি খেতে চাইলেন। মেয়ে তাঁর জন্যে কফি নিয়ে এল। পটভর্তি কফি। এটা না-লিখে রিপোর্টার ভদ্রলোক কন্যার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতেন—তিনি তাঁর কন্যাকে কী বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে কোন রাগটি বাজানো হয়েছিল? নিশিরাতের কোনো রাগ, নাকি ভোরবেলার রাগ ভৈরবী?

রাত এগারটা বাজল। মিসির আলি যন্ত্রের মতো ঘুমুতে গেলেন। মনস্থির করলেন অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাথা ভারাক্রান্ত করবেন না। মাথা থেকে ওসমান গনিকে ঝেড়ে ফেলে ঘুমুতে যাবেন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একটি মানুষ মারা গেছে, যাক না! কত লোক তো মারা যায়! আচ্ছা ভালো কথা, আমরা সবসময় বলি হৃদযন্ত্র। ফুসফুসকে ফুসফুসযন্ত্র বলি না। কিডনিকে কিডনিযন্ত্র বলি না। পত্রিকায় কখনো লেখা হয় নি ‘অমুক কিডনিযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।’ আবেগ এবং অনুভূতির সঙ্গে যাকে এক করে দেখা হয়, সেই হৃৎপিণ্ডকে আমরা বলছি যন্ত্ৰ। কোনো মানে হয় না।

রাত একটা বেজে গেল। মিসির আলির ঘুম এল না। মাথা ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকল। তাঁর ঘুমুনো প্রয়োজন। রাতজাগা তাঁর জন্যে একেবারেই নিষিদ্ধ। তিনি বিছানা থেকে নামলেন। দশ মিলিগ্রামের দু’টি ফ্রিজিয়াম খেলেন। মশারির ভেতর ঢুকতে গিয়ে ঢুকলেন না। ঘরের দরজা খোলা রেখেই বাড়িওয়ালার সদর দরজায় কলিংবেল টিপলেন।

বেশিক্ষণ টিপতে হল না। বাড়িওয়ালা ওয়াদুদ সাহেব নিজেই উঠে এসে দরজা খুললেন। বিস্মিত গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার?

একটা টেলিফোন করব।’

‘অবশ্যই অবশ্যই করবেন। কী হয়েছে বলুন তো? কারো অসুখবিসুখ?’

‘জ্বি-না, অসুখবিসুখ না। একটা ব্যাপার নিয়ে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। টেলিফোন না-করা পর্যন্ত মনে স্বস্তি পাব না। রাতে ঘুমুতে পারব না।’

‘আসুন, ভেতরে আসুন। একটা কেন, এক শ’টা টেলিফোন করুন। নাম্বার কী বলুন, আমি ডায়াল করে দিচ্ছি।’

‘নাম্বার জানি না। বের করতে হবে। ওসমান গনির কন্যা নাদিয়া গনির সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘কারা এরা?’

‘আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?’

‘না।’

‘তাহলে চিনবেন না। চেনার দরকার নেই। আমি কি আপনাকে ঘুম থেকে তুলেছি?’

‘তা তুলেছেন। আমি দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। এটা কোনো ব্যাপার না। আপনি তো আসেনই না। আপনার সঙ্গে কথা বললে ভালো লাগে। চা-টা কিছু খাবেন?

‘খাব।’

.

রাত দুটোর সময় টেলিফোন পেয়ে কোনো তরুণী মধুর গলায় কথা বলবেন এটা আশা করা যায় না। কিন্তু মিসির আলিকে অবাক করে দিয়ে নাদিয়া গনি মিষ্টি গলায় বললেন, ‘আপনি কে?

‘আমার নাম মিসির আলি।

‘কিছু মনে করবেন না। আপনি এমনভাবে নাম বললেন, যেন নাম শুনলেই আমি আপনাকে চিনে ফেলব। আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছি না।’

‘পরিচয় দিলেও চিনতে পারবেন না। আমি কি কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?

‘অবশ্যই পারেন। রাত দু’টার সময় যখন টেলিফোন করেছেন, নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কারণে করেছেন। কী বলতে চান বলুন।’

মিসির আলি চট করে কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। আসলে টেলিফোনটি করা হয়েছে ঝোঁকের মাথায়। কী বলা হবে কিছুই ভাবা হয় নি।

নীরবতায় নাদিয়া গনি অধৈর্য হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, ‘টেলিফোনে কথা বলতে কি আপনার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে? আমি আপনাকে চিনি না। কখনো নাম শুনি নি। আপনার সঙ্গে আমার এমন কোনো কথা থাকতে পারে না যার জন্যে আপনি অস্বস্তি বোধ করবেন।

‘অস্বস্তি বোধ করছি না। কী বলব গুছিয়ে উঠতে পারছি না।’

‘তাহলে এক কাজ করুন—ভালোমতো গুছিয়ে একদিন টেলিফোন করুন। এবং দয়া করে রাত দু’টো-তিনটায় নয়। এই সময় টেলিফোনের জন্যে প্রশস্ত নয়।’

‘আপনি কি টেলিফোন রেখে দিচ্ছেন?

‘হ্যাঁ, এতক্ষণ যে ধরে রেখেছি তাই কি যথেষ্ট নয়? এই ভদ্রতাটুকু কি সবাই দেখায়?’

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, ‘না, দেখায় না। আর আপনি শুধু যে ভদ্রতার জন্যে টেলিফোন রিসিভার হাতে নিয়ে বসে আছেন তাও না। আমার ধারণা আপনি যথেষ্ট কৌতূহল নিয়েই অপেক্ষা করছেন।’

‘আপনার এ-রকম মনে করার কারণ কী?

‘মনে করার অনেকগুলি কারণ আছে। আপনি যে বললেন, আপনি আমাকে চেনেন না, কখনো আমার নাম শোনেন নি—তা ঠিক নয়। আপনার বাবার লেখার টেবিলে আমার একটা নোট পাওয়া গেছে। সেখানে তাঁকে সাবধান করা হয়েছে, যেন পানি থেকে দূরে থাকেন। শুধু এই কারণেই আপনার কাছে আমার নাম মনে থাকার কথা। তার ওপর পুলিশের কাছে আপনি অবশ্যই শুনেছেন যে, ওসমান গনি নাম নিয়ে একজন আমার কাছে গিয়েছিল। ঘটনাটা অদ্ভুত। গত চারদিন ধরে দিনরাত পুলিশ আমার বাসার দিকে লক্ষ রাখছে। এ-তথ্যও অবশ্যই আপনার জানা থাকার কথা। তার পরেও আপনি মিথ্যা করে বললেন, আপনি কখনো আমার নাম শোনেন নি।

মিসির আলি দম নেবার জন্যে থামলেন। নাদিয়া গনি শীতল গলায় বললেন, ‘আপনি এত দ্রুত কথা বলছেন কেন? আপনার সব কথা বুঝতে পারছি না। স্লোলি বলুন।’

মিসির আলি বললেন, ‘গভীর রাতে টেলিফোনে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।’

নাদিয়া গনি হালকা গলায় বললেন, ‘আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। আপনি আসুন, কথা বলব।’

‘এখনই পাঠাচ্ছেন?

‘হ্যাঁ, এখনই। আপনি তো জেগেই আছেন। আসতে অসুবিধা আছে?’

‘না, অসুবিধা নেই।’

.

নাদিয়া গনি হাসিমুখে বললেন, ‘আসুন।’ তাঁর কথা বলার ভঙ্গি সহজ ও স্বাভাবিক। গভীর রাতে বাড়িতে অতিথি আসা যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায়ই আসে। মেয়েটির পরনের শাড়ি খুব পরিপাটি। কিছুক্ষণ আগেই মুখ ধুয়ে হালকা ক্রীম গালে লাগানো হয়েছে। এত রাতেও চোখে-মুখে স্নিগ্ধ আভা। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি কোথাও নেই। চুল বেণী করা নয়, ছেড়ে দেওয়া। এত চুল মিসির আলি এর আগে কোনো মেয়ের মাথায় দেখেন নি। সবুজ রঙ সম্ভবত মেয়েটির প্রিয় রঙ। আজও সবুজ শাড়ি পরা। বয়স কত হবে? ২৫-এর মতো? হতে পারে। আবার বেশিও হতে পারে। গান গাওয়া ছাড়া সে আর কী করে? পড়াশোনা কোন পর্যন্ত? মেয়েটি কি বিবাহিতা? অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছা করছে।

নাদিয়া তাঁকে দোতলায় নিয়ে গেলেন। দোতলার বারান্দা সুন্দর করে সাজানো। মুখোমুখি গদিআঁটা বেতের চেয়ার বসানো। চেয়ার দু’টির মাঝখানে সাদা টেবিল ক্লথে ঢাকা বেতের টেবিল। টেবিলে টী-কোজি ঢাকা টী—পট। একটা অ্যাশট্রে আছে। অ্যাশট্রের পাশে এক প্যাকেট সিগারেট, একটা দেয়াশলাই। কাচের ছোট্ট বাটিতে নানান ধরনের বাদামের মিশ্রণ। বারান্দা অন্ধকার। ঘরের ভেতর বাতি জ্বলছে। তার আলো এসে পড়েছে বারান্দায়।

‘মিসির আলি সাহেব?’

‘জ্বি।’

‘ইচ্ছা করে বারান্দা অন্ধকার করে রেখেছি। অন্ধকারের আড়াল থাকলে কথা বলতে সুবিধা হয়।’

মিসির আলি বললেন, ‘আপনার কি এমন কথা আছে, যা বলার জন্যে অন্ধকারের আড়াল প্রয়োজন হবে?’

‘না।’

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। মেয়েটিও মিসির আলিকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে সিগারেট নিল। সিগারেট ধরাল আনাড়ি ভঙ্গিতে নয়, অভ্যস্ত ভঙ্গিতে।

‘আপনি কি আমার সিগারেট খাওয়া দেখে আবাক হচ্ছেন?’

‘খানিকটা হয়েছি।’

‘চা নিন। খুব ভালো চা। কীভাবে বানিয়েছি জানেন? সিক্সটি পারসেন্ট বাংলাদেশি চা, ফোর্টি পারসেন্ট দার্জিলিং টী। খুব সামান্য জাফরানও দেওয়া হয়েছে।’

মিসির আলি চা নিলেন। তাঁর কাছে আহামরি কিছু মনে হল না। চিনি কম হয়েছে। আরেকটু বেশি হলে ভালো হত। চিনি চাইতে ইচ্ছা করছে না। আশেপাশে কোনো কাজের লোক দেখা যাচ্ছে না। চিনি চাইলে হয়তো এ-মেয়েটিকেই উঠে যেতে হবে।

‘মিসির আলি সাহেব?

‘জ্বি।’

‘প্রথমেই আপনার কিছু ভুল ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার। আপনার ধারণা হয়েছে, বাবার কাছে লেখা আপনার নোট আমি পড়েছি। এই ধারণা সত্যি নয়। বাবার মৃত্যু আমার জন্যে এত আপসেটিং ছিল যে আমাকে পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িযে রাখা হয়েছিল। পুলিশ এসে তাঁর টেবিলের সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে। সেখানে কী লেখা বা কী লেখা না, আমি কিছুই জানি না। আপনার কাছে এক লোক গিয়ে বলেছে, সে ওসমান গনি। এই তথ্যও আমাকে বলা হয় নি। আমি পুলিশকে বলে দিয়েছি বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত কোনো কিছু নিয়েই যেন আমাকে বিরক্ত না-করা হয়। তারা তা করছে না। বাবার সম্পর্কে আমি কারো সঙ্গেই কথা বলতে চাই না।’

‘আপনি কিন্তু কথা বলেছেন। পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন।’

‘তা বলেছি। এই লোক আপনার মতোই গভীর রাতে আমাকে টেলিফোন করেছিল। গভীর রাতে কেউ টেলিফোন করলে আমি সাধারণত কথা বলি।’

‘কেন?’

যাক।’

‘আপনি অনুমান করুন, আপনার ধারণা, আপনার অনুমানশক্তি প্রবল। পরীক্ষা হয়ে

মিসির আলি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে-রাখতে বললেন, ‘আপনি কী করে জানলেন যে আমার ধারণা, আমার অনুমানশক্তি প্রবল? আপনার কাছে এই দাবি আমি করি নি।’

‘পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিনের সঙ্গে করেছেন। রাত দু’টায় আপনার টেলিফোন পাওয়ার পরপর আমি ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন সাহেবকে টেলিফোন করে আপনার সম্পর্কে সব তথ্য জানতে চাই। তিনি আমাকে বলেছেন।’

‘আমার সম্পর্কে কী তথ্য জানেন?’

‘অনেক কিছুই জানি। আপনি যে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি তাও জানি। অসম্ভব জটিল কিছু সমস্যার আপনি সমাধান দিয়েছেন। আপনার আগ্রহের বিষয় হচ্ছে সাইকোলজি। অনেকের ধারণা, আপনি প্যারাসাইকোলজি বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ। এখন আপনি বলুন দেখি, কেন আমি রাতের টেলিফোন অ্যাটেন্ড করি? কেনই-বা গভীর রাতে আপনাকে আসতে বললাম?’

‘সত্যি জানতে চান?’

‘হ্যাঁ, জানতে চাই।’

‘আপনার ভয়াবহ ধরনের ইনসমনিয়া আছে। রাতের পর রাত আপনি জেগে থাকেন। এই সময় আপনি নিঃসঙ্গ বোধ করেন এবং আমার ধারণা খানিকটা ভয়ও পান। রাতে কেউ টেলিফোন করলে আপনার এ-কারণেই ভালো লাগে। কারো সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো লাগে। আপনার শুচিবাইর মতো আছে। রাতে কয়েকবার আপনি গোসল করেন। কিছুক্ষণ আগে গোসল সেরেছেন। এখনো চুল শুকায় নি। আপনার বাবার মৃত্যুর পর আপনি আরো নিঃসঙ্গ হয়েছেন। কারণ তাঁরও ইনসমনিয়া ছিল। তিনিও রাত জাগতেন। দু’ জন সঙ্গ দিতেন দু’ জনকে।’

‘কী করে বুঝলেন, বাবার ইনসমনিয়া ছিল?’

‘পত্রিকার রির্পোট অনুযায়ী। বেহালা বাজানো শোনার পর আপনি বাবার জন্যে কফি আনতে গেলেন। অর্থাৎ আপনারা আরো রাত জাগবেন। নয়তো পট— ভর্তি করে কফি আনতেন না। আপনার বাবারও গভীর রাতে স্নানের অভ্যাস ছিল। কারণ আপনি কফি নিয়ে এসে দেখেন—বাথরুমের দরজা বন্ধ। শাওয়ার দিয়ে পানি পড়ছে। আপনি ধরে নেন আপনার বাবার বেরুতে দেরি হবে। কাজেই কফির পট নিয়ে ফিরে যান, এবং আবারো নতুন করে কফি বানান। বাবার গভীর রাতে স্নান আপনার কাছে মোটেই অস্বাভাবিক মনে হয় নি। কারণ আপনার বাবার এই অভ্যাসের সঙ্গে আপনি পরিচিত।’

নাদিয়া আরেকটি সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চান? বলতে চাইলে বলতে পারেন।’

‘কী জানতে চান?’

‘আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব। তবে সবার আগে জানতে চাই—আপনার কি ধারণা, আপনার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে?

‘ডাক্তাররা তাই বলছেন।’

‘আপনার কী ধারণা?’

নাদিয়া আধ-খাওয়া সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘আমার ধারণা বাবা আত্মহত্যা করেছেন। কেন করেছেন তা-ও আমি জানি। আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁর মৃতদেহও বাথরুমের বাথটাবে পাওয়া যায়। মা বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পত্রিকায় আসে নি।’

‘তিনি কত বছর আগে মারা যান?’

‘জুন মাসের ২১ তারিখে ন’ বছর আগে।’

‘আপনার বাবার ইনসমনিয়া কি আপনার মা’র মৃত্যুর পর থেকে শুরু হয়েছে?’

‘না, আগেও ছিল। তবে মা’র মৃত্যুর পর বেড়েছে।’

‘আপনি কি চান আমি আপনার বাবার মৃত্যুসংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে চিন্তা—ভাবনা করি?’

‘আমি চাই না। কী ঘটছে আমি জানি। আমি খুব ভালো করে জানি। আমার বুদ্ধি অন্যের চেয়ে কম বা আপনার চেয়ে কম, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

‘আমি তা মনে করছি না।’

নাদিয়া হাতঘড়িতে সময় দেখলেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘চারটা কুড়ি বাজে। এই সময় আমি ঘুমুতে যাই। গাড়ি তৈরি আছে, আপনাকে পৌঁছে দেবে। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। তবে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। কোনোদিনই না। দয়া করে আর কখনো আসবেন না এবং কখনো আমাকে বিরক্ত করবেন না।’

মিসির আলি উঠতে-উঠতে বললেন, ‘আপনার এমন কোনো আত্মীয়স্বজন কি আছে, যার তিনটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো?

নাদিয়া গলার স্বর একটু তীক্ষ্ণ করে বললেন, ‘সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধানো কেউ কি এসে আপনাকে বলেছিল—আমি ওসমান গনি?’

‘জ্বি।’

‘সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধানো এমন কাউকে আমি চিনি না। আমার ধারণা, বাবা কাউকে পাঠিয়েছিলেন। বাবার মধ্যে একধরনের অভিনয় প্রবণতা ছিল। আমি যখন খুব ছোট, তখন একবার তিনি রাক্ষস সেজে আমাদের ভয় দেখিয়ে— ছিলেন। এই রকম কিছু হবে। সব মানুষের মধ্যেই কিছু পরিমাণ ইনসেনিটি থাকে।’

‘আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি।’

‘পুলিশের লোক কি এখনো আপনার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে?’

‘থাকে।’

‘আর যেন না থাকে আমি সেই ব্যবস্থা করব। আসুন, আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’

গাড়িতে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে মিসির আলি বললেন, ‘শেষবার বেহালায় আপনার বাবা কী বাজিয়েছিলেন—অর্থাৎ কোন রাগ?

‘উনি একটা ঘুমপাড়ানি গানের সুর বাজিয়েছিলেন—ওঁর নিজের খুব প্রিয় সুর, আমারো প্রিয়-একটি চেক লোকগীতির সুরে লালাবাই। লাইনগুলি হচ্ছে—

‘Precious baby, Sweetly sleep
Sleep in peace
Sleep in comfort, slumber deep.
I will rock you, rock you, rock you
I will rock you, rock you, rock you.’

বলতে-বলতে নাদিয়ার চোখ ভিজে উঠল। মিসির আলি বললেন, আপনার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আপনি পড়াশোনা কতদূর করেছেন?’ নাদিয়া বললেন ‘আমি আপনার আর কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেব না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *