০৫. ভদ্রলোক আবার এলেন

এক সপ্তাহ পর ভদ্রলোক আবার এলেন।

আমিই দরজা খুললাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’

আমি বললাম, ‘পারছি। আপনার নাম মিসির আলি। আপনি অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির একজন অধ্যাপক। গত সপ্তাহে আমার এখানে এসে একটা পাউরুটি এবং দুটো কলা ফেলে গেছেন।’

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। হাসিটি সুন্দর। শিশুর সারল্যমাখা। আজকাল মাপা হাসি ছাড়া আমরা হাসতে পারি না।

মিসির আলি বললেন, ‘আপনার মেয়েটাকে একটু ডাকবেন? তার জন্যে এক প্যাকেট চকলেট এনেছি।’

আমি খানিকটা বিরক্ত হলাম। অপরিচিত লোক দামী চকলেটের প্যাকেট নিয়ে এলে বুঝতে হবে কিছু ব্যাপার আছে।

‘আবার চকলেট কেন?’

‘আপনার জন্যে তো আনি নি, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন? আপনার মেয়েটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। পছন্দের মানুষকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। আপনি কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করবেন না। এই উপহারে কোনো রকম স্বার্থ জড়িত নেই। আমি আপনার কাছে কিছু চাইতে আসি নি।’

আমি খানিকটা লজ্জিত বোধ করলাম। ভদ্রলোককে ঘরে বসিয়ে চকলেটের প্যাকেট ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কী করতে পারি আপনার জন্যে?’

মিসির আলি বললেন, ‘আপনার কাছে আমার এক কাপ চা পাওনা আছে। ঐ পাওনা চা খাওয়াতে পারেন।’

‘চা আসবে। এখন আসল ব্যাপারটা বলুন।’

‘আপনার কি কোনো তাড়া আছে?’

‘না, তাড়া নেই।’

‘আমি আপনার কাছে সুধাময়বাবু সম্পর্কে কিছু জানতে এসেছি। আপনি যদি কষ্ট করে বলেন…’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সুধাময়বাবু কে?’

‘আপনি এই নামে কাউকে চেনেন না?’

‘জ্বি-না।’

‘সুধাময়বাবুর বাড়িতে আপনি কি এক রাত কাটান নি, যেখানে আপনার একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়।’

‘আপনি কি সুধাকান্তবাবুর কথা বলছেন?’

‘নাম সুধাকান্ত হতে পারে। গল্পটা আমাকে যে বলেছে, সে সম্ভবত নামে গণ্ডগোল করেছে।’

আমি বললাম, ‘আপনি কি আমাকে দয়া করে গুছিয়ে বলবেন, ব্যাপারটা কী? সুধাকান্তবাবুকে আমি ঠিকই চিনি। একটা অসাধারণ গল্প তাঁর মুখ থেকে শুনেছি। আপনার সঙ্গে সেই গল্পের কী সম্পর্ক বুঝতে পারছি না।’

মিসির আলি বললেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে রহস্যময় ব্যাপারগুলোর প্রতি আমার একটা আগ্রহ আছে। পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় ব্যাপার ঠিকই ঘটে। আবার অনেক কিছু ঘটে—যেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে খুব রহস্যময় মনে হলেও আসলে রহস্যময় নয়। আমি ব্যাপারটা বুঝতে চাই। সুধাকান্তবাবুর চরিত্র আমাকে খানিকটা কৌতূহলী করেছে, কারণ ওর চরিত্রে কিছু অস্বাভাবিক দিক আছে। ঐ সম্পর্কে আমি ভালোভাবে জানতে চাই। তা ছাড়া আপনার গল্পটাও বেশ মজার। এর মধ্যে এমন কিছু এলিমেন্ট আছে, যা প্রচলিত ভূতের গল্পে থাকে না।’

‘আপনি কি ভূতের গল্প নিয়ে গবেষণা করছেন নাকি?’

‘জ্বি-না। কিছু-কিছু গল্পের প্রতি একধরনের ফ্যাসিনেশন জন্মে যায়। ব্যাপারটা কী, ভালোমতো জানতে ইচ্ছে করে।’

‘আমার গল্প আপনি কার কাছ থেকে শুনেছেন?’

‘আমার এক ছাত্রের মুখে শুনেছি। সে শুনেছে আপনার কাছে। নাম হচ্ছে রুস্তম। তার কাছ থেকেই আমি আপনার ঠিকানা নিয়েছি।’

‘আপনি বলছিলেন গল্পটাতে মজার কিছু এলিমেন্ট আছে, সেগুলো কী?’

‘যেমন ধরুন কুকুরের ব্যাপারটা। একদল কুকুর সুধাকান্তবাবুকে ঘিরে ধরল। তারপর তাকে ঘিরে চক্রাকারে হাঁটতে লাগল এবং একটি বিশেষ দিকে নিয়ে যেতে লাগল। যেখানে নিয়ে গেল সেখানে একটা যুবতীর নগ্ন মৃতদেহ, যাকে কিছুক্ষণ আগেই হত্যা করা হয়েছে।’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘এ-রকম কিছুই কিন্তু গল্পে নেই। কোনো নগ্ন যুবতীর মৃতদেহ পড়ে ছিল না। একটি বালিকার ডেডবডি ছিল। তার পরনে শাড়ি ছিল।’

মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘আমিও তাই ভাবছিলাম। গল্প যখন এক জনের মুখ থেকে অন্য জনের মুখে যায়, তখন ডালপালা ছড়ায়। অনেক সময় মূল গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। এই জন্যেই আমি এসেছি আপনার মুখ থেকে গল্পটা শোনার জন্যে। যদি আপনার কষ্ট না হয়।’

‘আমার কোনো কষ্ট হবে না। আমি আগ্রহ করে গল্পটা বলব।’

মিসির আলি কোটের পকেট থেকে নোট বই এবং কলম বের করলেন। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘আপনি কি নোট করছেন নাকি।’

‘দু’-একটা পয়েন্ট লিখে রাখব। আমার স্মৃতিশক্তি ভালো, তবু মাঝে-মাঝে কিছু নোট রাখি। স্মৃতি মানুষকে প্রতারণা করে, লেখা করে না।’

চা চলে এল। চা খেতে-খেতে ভদ্রলোক গল্প শুনলেন। তবে গল্প বলে আমি কোনো আরাম পেলাম না। ভদ্রলোক গল্পের মাঝখানে একবারও বললেন না—অদ্ভুত তো! তারপর কী হল? কী আশ্চর্য!

তিনি পাথরের মতো মুখ করে গল্প শুনলেন এবং গল্প শেষ হওয়ামাত্র বললেন, ‘আচ্ছা তাহলে যাই। আপনাকে কষ্ট দিলাম, কিছু মনে করবেন না।’

আমি বললাম, ‘আপনার কাজ হয়ে গেল?’

‘জ্বি।’

‘গল্পটা কি আপনার কাছে অদ্ভুত মনে হয় নি?’

‘জ্বি-না, ভূতের গল্প সাধরণত এ-রকমই হয়। নতুনত্ব কিছু নেই। আমার শুধু একটা প্রশ্ন, মেয়েটার ডেডবডি কি শেষ পর্যন্ত ছিল?’

‘তার মানে?’

‘এ-জাতীয় গল্পে ডেডবডি শেষ পর্যন্ত থাকে না। বাতাসে মিলিয়ে যায় কিংবা কুকুর খেয়ে ফেলে। আপনি জানেন, কী হয়েছিল?’

‘আমি জানি না, আমি জিজ্ঞেস করি নি। আপনি গল্পটার কিছুই বিশ্বাস করেন নি, তাই না?’

‘জ্বি-না।’

‘কেন, দয়া করে বলবেন কি?’

‘এই জাতীয় ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যখন হয়, তখন মানুষ খুব কনফিউজড্ অবস্থায় থাকে। কোনো ঘটনাই সে পরিষ্কার দেখে না। যা দেখে তাও সে গুছিয়ে বলতে পারে না। অথচ আপনার সুধাকান্তবাবু চমৎকারভাবে সব বর্ণনা করলেন। অতি সূক্ষ্ম ডিটেলও বাদ দিলেন না। এই জিনিস পাওয়া যায় তৈরি-করা গল্পে।

আমি বললাম,’সব মানুষ তো এক রকম নয়। কিছু-কিছু মানুষ বিপর্যয়ের সময়ও মাথা ঠাণ্ডা রাখে।’

‘তা রাখে। যেমন আমি নিজেই রাখি।’

‘তার পরেও আপনি বললেন এটা একটা গল্প?’

‘জ্বি।‘

‘কেন বলুন তো?’

‘সুধাকান্তবাবু আপনার কথামতো একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ, সাধু-প্রকৃতির লোক। এই ধরনের একজন মানুষ বিপদে ঈশ্বরের নাম নেবে, গায়ত্রী মন্ত্র পড়বে। একজন নাস্তিক পর্যন্ত যে-কাজটা করবে, তিনি করেন নি। ঘটনা সত্যি-সত্যি ঘটলে তিনি তা অবশ্যই করতেন। যেহেতু ঘটনাটা বানান, কাজেই এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা বাদ পড়েছে।’

আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার ওপর খানিকটা রাগ হচ্ছে। এককথায় সে বলে দিল গল্প বানান?

মিসির আলি বললেন, ‘আপনার সঙ্গে যখন গল্প করছিলেন, তখন ভয় পেয়ে ভদ্রলোক মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, অথচ ঐ রাতে করলেন না। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?’

আমি বললাম, ‘সুধাকান্তবাবু শুধু-শুধু এ-রকম একটা গল্প বানাবেন কেন? এই রকম একটা গল্প তৈরির পিছনে কোনো একটা কারণ থাকবে নিশ্চয়ই।’

‘তা তো থাকবেই। তাঁরও আছে।’

‘কী কারণ?’

‘অনেক কারণ হতে পারে। তবে আমার যা মনে হয, তা হচ্ছে উনি নিঃসঙ্গ ধরনের মানুষ, এই জাতীয় একটা গল্প তৈরি করে নিজে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। এটা এক জন নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে কম কথা নয়।

মিসির আলি লোকটির প্রতি আমার ভক্তি হল। লজিক বা ‘যুক্তি’ নামক ব্যাপারটা যে কত শক্তিশালী হতে পারে, মিসির আলি তা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

আমি বললাম, ‘এই গল্পটা যে সত্যি, এটা আপনি কখন স্বীকার করবেন? অর্থাৎ কোন প্রমাণ উপস্থিত করলে আপনি গল্পটা মেনে নেবেন?

মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘ঐ মেয়েটির ডেডবডি যদি অন্যরা দেখে থাকে এবং কবর দেওয়া হয় বা দাহ করা হয়, তবেই আমি ঘটনাটা মেনে নেব।’

‘আমি আপনাকে খবরটা এনে দেব। আমি চিঠি লিখে খবরটা জোগাড় করব। আপনি আপনার ঠিকানা লিখে রেখে যান।’

মিসির আলি তাঁর ঠিকানা লিখে রেখে চলে গেলেন। আশ্চর্য কাণ্ড, আজও তাঁর পলিথিনের ব্যাগ ফেলে গেলেন। ব্যাগের ভেতর ছোট্ট একটা পাউরুটি, একটা কলা এবং এক টুকরো মাখন। গরমে সেই মাখন গলে ব্যাগময় ছড়িয়ে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *