০৪. বছর তিনেক পরের কথা

বছর তিনেক পরের কথা।

সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। একটা ‘সেমিনার টক’ তৈরি করছি। বিষয়— পরিবেশ দূষণে পলিমারের ভূমিকা। চারদিকে কাগজপত্র, চার্ট, গ্রাফ নিয়ে বসেছি। সব এলোমেলো অবস্থায় আছে। ঠিক করে রেখেছি, কাজ শেষ না করে উঠব না।

মার্ফি’স ল বলে একটা ব্যাপার আছে। মার্ফি’স ল বলে -Anything that can go wrong, will go wrong -আমার বেলাও তাই হল। একের পর এক সমস্যা হতে লাগল। লিখতে গিয়ে দেখি বলপয়েন্টে কালি আসছে না। কালির কলম নিয়ে দেখা গেল ঘরে কালি নেই।

একের পর এক টেলিফোন আসতে লাগল। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই এত দিন থাকতে আজই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাঁদের কথাও দেখি অনেক জমে আছে, কিছুতেই শেষ হয় না। আমি টেলিফোন রিসিভার উঠিয়ে রাখলাম। দোকান থেকে এক ডজন বলপয়েন্ট আনিয়ে বসলাম, আর তখন আমার বড় মেয়ে বলল, ‘বাবা, এক জন লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তোমাকে না বলেছি, কেউ এলে বলবে আমি বাসায় নেই?’

আমার মেয়ে বলল, ‘আমি মিথ্যা বলতে পারি না, বাবা।’

‘মিথ্য কথা বলতে পার না মানে? আমার তো ধারণা, তুমি সারাক্ষণই মিথ্যা কথা বল।’

‘মঙ্গলবারে বলি না। মঙ্গলবার হচ্ছে সত্য-দিবস।’

অনেক কষ্টে রাগ সামলালাম। কিছু দিন আগে কী-একটা নাটকে দেখিয়েছে মঙ্গলবার সত্য-দিবস, সেদিন মিথ্যা বলা যাবে না।

আমি মনের বিরক্তি চেপে রেখে বসার ঘরে ঢুকলাম। অপরিচিত এক ভদ্রলোক বসে আছেন। অসম্ভব রোগা, লম্বা এক জন মানুষ—যাকে দেখলেই সরলরেখার কথা মনে হয়। এই গরমে গলায় একটা মাফলার। চোখে মোটা চশমা। ভদ্রলোক বসে আছেন মূর্তির মতো। মনে হচ্ছে ধ্যানে বসেছেন।

ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। লম্বাটে মুখ। দাড়ি আছে। চুল লম্বা। দাড়ি, চুল, পরনের কালো কোট সবই কেমন যেন এলোমেলো। প্রথম দর্শনে মনে হয় ভবঘুরে ধরনের কেউ। তবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে এই ভাবটা চলে যায়। মনে হয় লাজুক ধরনের একজন মানুষ এসেছেন। যে-কোনো কারণেই হোক মানুষটা বিব্রত বোধ করছেন।

আমি বললাম, ‘আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?’

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘জ্বি।’

‘আজ আমি একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত। আপনি কি অন্য একদিন আসতে পারেন?’

‘জ্বি, পারি।’

‘তাহলে তাই করুন।‘

‘জ্বি আচ্ছা।’

বলেই ভদ্রলোক আবার বসে পড়লেন। আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, আপনি বোধহয় লক্ষ করেন নি। আমি সঙ্গে ছাতা আনি নি। বৃষ্টিটা কমলেই চলে যাব।’

আমি ফিরে এসে আমার কাজে মন দিলাম। তিন ঘন্টা একনাগাড়ে কাজ করলাম। অসাধ্যসাধন যাকে বলে। আর কোনো ঝামেলা হল না। মার্ফি সাহেবের আইন দেখা যাচ্ছে সবসময় কাজ করে না। আমি ভুলেই গেলাম যে বসার ঘরে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। কী কারণে যেন বসার ঘরে গিয়েছি, ভদ্রলোককে দেখে চমকে উঠলাম।

‘আপনি আছেন এখনো?’

‘জ্বি।‘

‘বৃষ্টি তো থেমে গেছে!’

‘তা গেছে, কিন্তু কাউকে কিছু না-বলে যাই কী করে?’

আমি লজ্জিত বোধ করলাম। ভদ্রলোক দীর্ঘ সময় একা-একা বসে আছেন। বসার ঘরে কেউ আসে নি, কারণ আমার টিভি শোবার ঘরে। সবাই টিভির সামনে চোখ বড়-বড় করে বসে আছে। টিভিতে নিশ্চয়ই কোনো নাটক হচ্ছে।

আমি বললাম, ‘আপনাকে কি ওরা চা দিয়েছে?’

‘জ্বি-না।’

‘চা খাবেন এক কাপ?’

‘আরেক দিন যখন আসব, তখন খাব।’

আমি বললাম, ‘আরেক দিন আসার দরকার নেই। আজই বলে ফেলুন। চট করে কি বলতে পারবেন?’

‘না, পারব না। আমি আরেক দিন আসব।’

‘আপনার নামটা তো জানা হল না।’

‘আমার নাম মিসির আলি।‘

‘আমি কি আপনাকে চিনি?’

‘জ্বি-না। চেনার কোনো কারণ নেই। আমি অ্যাবনর্মাল সাইকোলজি বিষয়ে পড়াশোনা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টটাইম শিক্ষক।’

‘আমার সঙ্গে আপনার যোগাযোগের কারণটা আমি বুঝতে পারছি না।’

‘আরেক দিন যখন আসব, আপনাকে বুঝিয়ে বলব। আজ যাই, রাত হয়ে গেছে।’ ভদ্রলোক চলে গেলেন। ভদ্রলোককে বেশ আত্মভোলা লোক বলেও মনে হল। একটা পলিথিনের ব্যাগ ফেলে গেছেন। ব্যাগে একটা পাউরুটি এবং ছোট-ছোট দুটো কলা। মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের সকালবেলার নাশতা।

আমি বুঝতে পারলাম না, অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির একজন অধ্যাপক আমার কাছে ঠিক কী চান? আমার আচার-আচরণে অস্বাভাবিক কিছু তো নেই। রহস্যটা কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *