০২. সাধুবাবা

‘যুবক বয়স থেকেই আমাকে সবাই ডাকত সাধুবাবা।

‘যদিও ঠিক সাধু বলতে যা বোঝায় আমি তা নই। তবে প্রকৃতিটা একটু ভিন্ন ছিল। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে-দূরে রাখার স্বভাব আমার ছিল। শ্মশান, কবরস্থান এইসব আমাকে ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণ করত। অল্প বয়স থেকেই শ্মশান এবং কবরস্থানের আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। আমার বাবা শ্যামাকান্ত ভৌমিক তখন জীবিত। আমার মতিগতি দেখে অল্প বয়সেই আমার বিবাহ ঠিক করলেন। পাশের গ্রামের মেয়ে। ভবানী মিত্র মহাশয়ের প্রথমা কন্যা আরতি। খুবই রূপবতী মেয়ে। গ্রামাঞ্চলে এ-রকম মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। আমি বিবাহ করতে রাজি হলাম। কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে যাবার পর একটা দুর্ঘটনায় মেয়েটা মারা যায়।’

‘কী দুর্ঘটনা?’

‘সাপের কামড়। আমাদের এই অঞ্চলে সাপের উপদ্রব আছে। বিশেষ করে কেউটে সাপ।’

‘তারপর কী হল বলুন।

‘মেয়েটির মৃত্যুতে খুব শোক পেলাম। প্রায় মাথাখারাপের মতো হয়ে গেল। কিছুই ভালো লাগে না। রাতবিরাতে শ্মশানে গিয়ে বসে থাকি। সমাজ-সংসার কিছুতেই মন বসে না। গভীর বৈরাগ্য। কিছু দিন সাধু-সন্ন্যাসীর খোঁজ করলাম। ইচ্ছা ছিল উপযুক্ত গুরুর সন্ধান পেলে মন্ত্র নেব। তেমন কাউকে পেলাম না।…

‘আমার বাবা অন্যত্র আমার বিবাহের চেষ্টা করলেন। আমি রাজি হলাম না। বাবাকে বুঝিয়ে বললাম যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা না যে আমি সংসারের বন্ধনে আটকা পড়ি। পরিবারের অন্যরাও চেষ্টা করলেন—আমি সম্মত হলাম না। এ-সব আমার প্রথম যৌবনের কথা। না-বললে আপনি গল্পটা ঠিক বুঝতে পারবেন না। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?’

আমি বললাম, ‘না, বিরক্ত হব কেন?’

সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘প্রথম যৌবনের কথা সবাই খুব আগ্রহ করে বলে। আমি বলতে পারি না।’

‘আপনি তো ভালোই বলছেন। থামবেন না—বলতে থাকুন।’

সুধাকান্তবাবু আবার শুরু করলেন—

‘এরপর অনেক বছর কাটল। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরতাম বলেই বোধহয় ঈশ্বর আমার ঘরটাকেই শ্মশান করে দিলেন। পুরোপুরি একা হয়ে গেলাম। মানুষ যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমিও মানিয়ে নিলাম। আমার প্রকৃতির মধ্যে একধরনের একাকীত্ব ছিল, কাজেই আমার খুব অসুবিধা হল না। এখন আমি মূল ঘটনায় চলে আসব, তার আগে আপনি কি চা খাবেন?’

‘জ্বি না।’

‘খান একটু চা, ভালো লাগবে।’

আমার মনে হল ভদ্রলোকের নিজেরই চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, বানান। একটু ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে অবশ্যি।’

‘ভিতরে গিয়ে বসবেন?

‘জ্বি-না, এখানেই ভালো লাগছে।’

চা শেষ করার পর দ্বিতীয় দফায় গল্প শুরু হল। এইখানে আমি একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। আমার কাছে মনে হল ভদ্রলোকের গলার স্বর পাল্টে গেছে। আগে যে-স্বরে কথা বলছিলেন, এখন সেই স্বরে বলছেন না। একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনের ভুল হতে পারে। অনেক সময় পরিবেশের কারণে সবকিছু অন্য রকম মনে হয়।

সুধাকান্তবাবু বলতে শুরু করলেন—

‘গত বৎসরের কথা। কার্তিক মাস। আমি বাড়িতে ফিরছি। রাত প্রায় দশটা কিংবা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। আমার ঘড়ি নেই, সময়ের হিসাব ঠিক থাকে না।’

আমি সুধাকান্তবাবুকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার স্কুল তো নিশ্চয়ই চারটা-পাঁচটার দিকে ছুটি হয়। এত রাতে ফিরছিলেন কেন?’

সুধাকান্তবাবু নিচু গলায় বললেন, ‘রোজই এই সময়ে বাড়ি ফিরি। সকাল-সকাল বাড়ি ফেরার কোনো উৎসাহ বোধ করি না। পাবলিক লাইব্রেরি আছে। ঐখানে পত্রিকাটত্রিকা পড়ি, গল্পের বই পড়ি।’

‘বলুন তারপর কী হল।’

‘তারিখটা হচ্ছে বারই কার্তিক, সোমবার। আমি মানুষ হিসাবে বেশ সাহসী। রাতবিরাতে একা-একা ঘোরাফেরা করি। ঐ রাতে রাস্তায় নেমেই আমার ভয়ভয় করতে লাগল। কী জন্যে ভয় করছে সেটাও বুঝলাম না। তখন মনে হল – রাস্তায় একটা পাগলা কুকুর বের হয়েছে, ভয়টা বোধহয় ঐ কুকুরের কারণে। আমি একটা লাঠি হাতে নিলাম।…

‘শুক্লপক্ষের রাত। ফক্ককা জ্যোৎস্না, তবু পরিষ্কার সবকিছু দেখা যাচ্ছে না। কারণ কুয়াশা। কার্তিক মাসের শেষে এদিকে বেশ কুয়াশা হয়।…

‘নদীর কাছাকাছি আসতেই কুকুরটাকে দেখলাম। গাছের নিচে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং পিছনে-পিছনে আসতে লাগল। মাঝে-মাঝে চাপা শব্দ করছে। পাগলা কুকুর পিছনে-পিছনে আসছে, আমি এগুচ্ছি—ব্যাপারটা খুব ভয়াবহ। যে-কোনো মুহূর্তে এই কুকুর ছুটে এসে কামড়ে ধরতে পারে। আমি কুকুরটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলাম। ঢিল ছুঁড়লাম, লাঠি দিয়ে ভয় দেখালাম। কুকুর নড়ে না, দাঁড়িয়ে থাকে। চাপা শব্দ করতে থাকে। আমি হাঁটতে শুরু কললেই সেও হাঁটতে শুরু করে।…

‘যাই হোক, আমি কোনোক্রমে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছলাম। তখন আমার খানিকটা সাহস ফিরে এল। কারণ, পাগলা কুকুর পানিতে নামে না। পানি দেখলেই এরা ছুটে পালায়।…

‘অদ্ভুত কাণ্ড, কুকুর পানি দেখে ছুটে পালাল না! আমার পিছনে-পিছনে পানিতে নেমে পড়ল। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না।…

‘আমি নদীর ও-পারে উঠলাম। কুকুরটাও উঠল—আর ঠিক তখন একটা ব্যাপার ঘটল।’

সুধাকান্তবাবু থামলেন।

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘আপনি জটিল জায়গাগুলিতে দয়া করে থামবেন না। গল্পের মজা নষ্ট হয়ে যায়।’

সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘এটা কোনো গল্প না। ঘটনাটা কীভাবে বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না বলে থেমেছি।’

‘আপনি মোটামুটিভাবে বলুন, আমি বুঝে নেব।’

‘কুকুরটা আমার খুব কাছাকাছি চলে এল। পাগলা কুকুর আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন কিনা জানি না। ভয়ংকর দৃশ্য! সারাক্ষণ হাঁ করে থাকে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে, চোখের দৃষ্টিটাও অন্য রকম। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি। ছুটে পালাব বলে ঠিক করেছি, ঠিক তখন কুকুরটা কেন জানি ভয় পেয়ে গেল। অস্বাভাবিক ভয়। একবার এ-দিকে যাচ্ছে, একবার ও-দিকে যাচ্ছে। চাপা আওয়াজটা তার গলায় আর নেই। সে ঘেউঘেউ করছে। আমার কাছে মনে হল, সে কুকুরের ভাষায় আমাকে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। এ-রকম চলল মিনিট পাঁচেক। তার পরই সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরে ওপারে চলে গেল। পুরোপুরি কিন্তু গেল না, ও-পারে দাঁড়িয়ে রইল এবং ক্রমাগত ডাকতে লাগল।’

‘তারপর?’

‘আমি একটা সিগারেট ধরালাম। তখন আমি ধূমপান করতাম। মাস তিনেক হল ছেড়ে দিয়েছি। যাই হোক, সিগারেট ধরাবার পর ভয়টা পুরোপুরি কেটে গেল। হাত থেকে লাঠি ফেলে দিলাম। বাড়ির দিকে রওনা হব বলে ভাবছি, হঠাৎ মনে হল নদীর ধার ঘেঁষে বড়ো-হওয়া ঘাসগুলোর মাঝখান থেকে কী-একটা যেন নড়ে উঠল।’

‘আপনি আবার ভয় পেলেন?’

‘না, ভয় পেলাম না। একবার ভয় কেটে গেলে মানুষ চট করে আর ভয় পায় না। আমি এগিয়ে গেলাম।‘

‘কুকুরটা তখনো আছে?’

‘হ্যাঁ, আছে।’

‘তারপর বলুন।’

‘কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের ডেডবডি। এগার-বার বছর বয়স। পরনে ডোরাকাটা শাড়ি।’

‘বলেন কী আপনি!’

‘যা দেখলাম তাই বলছি।’

‘মেয়েটা যে মরে আছে তা বুঝলেন কী করে?’

‘যে-কেউ বুঝবে। মেয়েটা মরে শক্ত হয়ে আছে। হাত মুঠিবদ্ধ করা। মুখের কষে রক্ত জমে আছে।’

‘কী সর্বনাশ!’

‘আমি দীর্ঘ সময় মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।’

‘ভয় পেলেন না?’

‘না, ভয় পেলাম না। আপনাকে তো আগেই বলেছি, একবার ভয় পেলে মানুষ দ্বিতীয় বার চট করে ভয় পায় না।‘

‘তারপর কী হল বলুন।’

‘মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটা মেয়ে এইভাবে মরে পড়ে আছে, কেউ জানছে না। কীভাবে না জানি বেচারি মরল। ডেডবডি এখানে ফেলে রেখে যেতে ইচ্ছা করল না। ফেলে রেখে গেলে শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। আমার মনে হল এই মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া উচিত।’

‘আশ্চর্য তো!’

‘আশ্চর্যের কিছু নেই। আমার অবস্থায় পড়লে আপনিও ঠিক তাই করতেন।’

‘না, আমি তা করতাম না। চিৎকার করে লোক ডাকাডাকি করতাম।’আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। কাকে আপনি ডাকতেন?’

‘তারপর কী হল বলুন।’

সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘আপনি আমাকে একটা সিগারেট দিন। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।’

আমি সিগারেট দিলাম। বৃদ্ধ সিগারেট ধরিয়ে খকখক করে কাশতে লাগলেন।

অমি বললাম, ‘তারপর কী হল বলুন।’

সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘ঘটনাটা এখানে শেষ করে দিলে কেমন হয়? আমার কেন জানি আর বলতে ইচ্ছা করছে না।’

‘ইচ্ছে না করলেও বলুন। এখানে গল্প শেষ করার প্রশ্নই ওঠে না।’

‘এটা গল্প না।’

‘গল্প না যে তা বুঝতে পারছি। তারপর বলুন আপনি কী করলেন। মেয়েটাকে তুললেন?’

‘হ্যাঁ তুললাম। কেন তুললাম সেটাও আপনাকে বলি। একটা অপরিচিত মেয়ের শবদেহ কেউ চট করে কোলে তুলে নিতে পারে না। আমি এই কাজটা করলাম, কারণ এই বালিকার মুখ দেখতে অবিকল…’

সুধাকান্তবাবু থেমে গেলেন। আমি বললাম, ‘মেয়েটি দেখতে ঐ মেয়েটির মতো, যার সঙ্গে আপনার বিয়ের কথা হয়েছিল। আরতি?’

‘হ্যাঁ, আরতি। আপনার স্মৃতিশক্তি তো খুব ভালো।’

‘আপনি আপনার গল্পটা বলে শেষ করুন।’

‘মেয়েটি দেখতে অবিকল আরতির মতো। আমি মাটি থেকে তাকে তুললাম। মরা মানুষের শরীর ভারি হয়ে যায়, লোকে বলে। আমি দেখলাম মেয়েটার শরীর খুব হালকা। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, মেয়েটাকে তোলার সঙ্গে-সঙ্গে কুকুরটা চিৎকার বন্ধ করে দিল। আমার কাছে মনে হল চারদিক হঠাৎ যেন অস্বাভাবিক নীরব হয়ে গেছে। আমি মেয়েটাকে নিয়ে রওনা করলাম।’

‘আপনার ভয় করল না?’

‘না, ভয় করে নি। মেয়েটার জন্যে মমতা লাগছিল। আমার চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। কার-না-কার মেয়ে, কোথায় এসে মরে পড়ে আছে। বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। আমি কোলে করে একটা মৃতা বালিকা নিয়ে এসেছি, অথচ আমার মোটেও ভয় করছে না। আমি মেয়েটিকে ঘাড়ের উপর শুইয়ে রেখেই তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। তখন কেন জানি বুকটা কেঁপে উঠল। হাত-পা ঠাণ্ডা ।হয়ে এল। আমি ভাবলাম ঘর অন্ধকার বলেই এ-রকম হচ্ছে, আলো জ্বাললেই ভয় কেটে যাবে। মেয়েটাকে আমি বিছানায় শুইয়ে দিলাম।

‘খাটের নিচে হারিকেন থাকে। আমি হারিকেন বের করলাম। ভয়টা কেন জানি ক্রমেই বাড়তে লাগল। মনে হল ঘরের বাইরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। যেন আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজনরা চলে এসেছে। আমার বাবা, আমার ঠাকুরদা, আমার ছোটপিসি—কেউ বাদ নেই। ওরা যে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে, তাও আমি শুনতে পাচ্ছি।

‘হারিকেন জ্বালাতে অনেক সময় লাগল। হাত কেঁপে যায়। দেশলাইয়ের কাঠি নিভে যায়, সলতায় আগুন ধরতে চায় না। টপটপ করে আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। শেষ পর্যন্ত হারিকেন জ্বলল। আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। আমি খাটের দিকে তাকালাম—এটা আমি কী দেখছি! এটা কি সম্ভব? এ-সব কী? আমি দেখলাম, মেয়েটা খাটের উপর বসে আছে। বড়-বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল।। মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছি।

‘স্পষ্ট শুনলাম উঠোন থেকে ভয়ার্ত গলায় আমার বাবা ডাকছেন, ও সুধাকান্ত, ও সুধাকান্ত, তুই বেরিয়ে আয়। ও সুধাকান্ত, তুই বেরিয়ে আয়। ও বাপধন বেরিয়ে আয়।’

‘আমি বেরিয়ে আসতে চাইলাম, পারলাম না। পা যেন মাটির সঙ্গে গেঁথে গেছে। সমস্ত শরীর পাথর হয়ে গেছে। আমি মেয়েটির উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না। মেয়েটি একটু যেন নড়ে উঠল। কিশোরীদের মতো নরম ও কোমল গলায় একটু টেনে-টেনে বলল, “তুমি একা-একা থাক। বড়ো মায়া লাগে গো! কত বার ভাবি তোমারে দেখতে আসব। তুমি কি আমারে চিনতে পারছ? আমি আরতি গো, আরতি। তুমি কি আমারে চিনছ?”….

‘আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললাম, “হ্যাঁ”।…

।“তোমার জন্যে বড় মায়া লাগে গো, বড় মায়া লাগে। একা-একা তুমি থাক। বড় মায়া লাগে। আমি কত ভাবি তোমার কথা। তুমি ভাব না?”…

‘আমি যন্ত্রের মতো বললাম, “ভাবি”।…

‘আমার মনে হল বাড়ির উঠোনে আমার সমস্ত মৃত আত্মীয়স্বজন ভিড় করেছে। আট বছর বয়সে আমার একটা বোন পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল। সেও ব্যাকুল হয়ে ডাকছে—ও দাদা, তুই বেরিয়ে আয় দাদা। আমার ঠাকুরমার ভাঙা-ভাঙা গলাও শুনলাম—ও সুধাকান্ত, সুধাকান্ত।…

‘খাটের উপর বসে-থাকা মেয়েটা বলল, ‘তুমি ওদের কথা শুনতেছ কেন গো? এত দিন পরে তোমার কাছে আসলাম। আমার মনটা তোমার জন্যে কান্দে। ওগো, তুমি আমার কথা ভাব না? ঠিক করে বল—ভাব না?’…

‘ভাবি।’

“আমার গায়ে হাত দিয়ে বল, ভাবি। ওগো আমার গায়ে হাত দিয়ে বল।“…

‘আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। সবটাই মনে হচ্ছে স্বপ্ন। স্বপ্নে সবই সম্ভব। আমি মেয়েটির গা স্পর্শ করবার জন্যে এগুলাম, তখনি আমার মৃতা মা উঠোন থেকে চেঁচালেন—খবরদার সুধাকান্ত, খবরদার!…

‘আমার ঘোর কেটে গেল। এ আমি কী করছি? এ আমি কী করছি? আমি হাতে ধরে রাখা হারিকেন ছুঁড়ে ফেলে ছুটে ঘর থেকে বেরুতে গেলাম। খাটের উপর বসে-থাকা মেয়েটি পিছন থেকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার ডান পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরল। ভয়াবহ কামড়! মনে হল পায়ের হাড়ে সে দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছে।…

‘সে হাত দিয়ে আমাকে ধরল না। কামড়ে ধরে রাখল। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম বেরিয়ে যেতে। কিছুতেই পারলাম না। এতটুকু একটা মেয়ে—কী প্রচণ্ড তার শক্তি! আমি প্রাণপণে চেঁচালাম—কে কোথায় আছ, বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও। তখন একটা ব্যাপার ঘটল। মনে হল কালো একটা কী-যেন উঠোন থেকে ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির উপর। চাপা গর্জন শোনা যেতে লাগল। মেয়েটি আমাকে ছেড়ে দিল। আমি পা টানতে টানতে উঠোনে চলে এলাম।…

‘উঠোনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম ভিতরে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। ধস্তাধস্তি হচ্ছে ঐ পাগলা কুকুর এবং মেয়েটার মধ্যে। মেয়েটা তীব্র গলায় বলছে—ছাড়, আমাকে ছাড়।…

‘কুকুরটা ক্রুদ্ধ গর্জন করছে। সেই গর্জন ঠিক কুকুরের গর্জনও নয়। অদেখা ভুবনের কোনো পশুর গর্জন। সেই গর্জন ছাপিয়েও মেয়েটির গলার স্বর শোনা যাচ্ছে—আমারে খাইয়া ফেলতাছে। ওগো তুমি কই? আমারে খাইয়া ফেলতাছে।’

সুধাকান্তবাবু থামলেন।

আমি বললাম, ‘তারপর?’

তিনি জবাব দিলেন না। আমি আবার বললাম, ‘তারপর কী হল সুধাকান্তবাবু?’

তিনি আমার দিকে তাকালেন। যেন আমার প্রশ্নই বুঝতে পারছেন না। আমি দেখলাম তিনি থরথর করে কাঁপছেন। আমি বললাম, ‘কী হল সুধাকান্তবাবু?’

তিনি কাঁপা গলায় বললেন, ‘ভয় লাগছে। দেয়াশলাইটা একটু জ্বালান তো!’

আমি দেয়াশলাই জ্বাললাম। সুধাকান্তবাবু তাঁর পা বের করে বললেন, ‘দেখুন, কামড়ের দাগ দেখুন।’

আমি গভীর ক্ষতচিহ্নের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘ও এখনো আসে। বাড়ির পিছনে থপথপ করে হাঁটে। নিঃশ্বাস ফেলে। জানালার পার্ট হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়ে ভয় দেখায়। হাসে। নাকী সুরে কাঁদে। একেক দিন খুব বিরক্ত করে। তখন ঐ কুকুরটাও আসে। হুটোপুটি শুরু হয়ে যায়। সাধারণত কৃষ্ণপক্ষের রাতেই বেশি হয়।’

আমি বললাম ‘এটা কি কৃষ্ণপক্ষ?’

সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘না। চাঁদ দেখতে পাচ্ছেন না?’

আমি বললাম, ‘আপনি তো ভাই ভয়াবহ গল্প শোনালেন। আমি তো এখন রাতে ঘুমুতে পারব না।’

‘ঘুমানর দরকার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য উঠবে। চাঁদ ডুবে গেছে দেখছেন না?’

আমি ঘড়ি দেখলাম। চারটা বাজতে কুড়ি মিনিট। সত্যি-সত্যি রাত শেষ হয়ে গেছে।

সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘চা খাওয়া যাক, কি বলেন?’

‘হ্যাঁ, খাওয়া যাক।’

তিনি চুলা ধরিয়ে কেটলি বসিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললেন, ‘বড়ো বিরক্ত করে। মাঝে-মাঝে ঢিল মারে টিনের চালে, থু-থু করে থুথু ফেলে। ভয় করে। রাতবিরাতে বাথরুমে যেতে হলে হাতে জ্বলন্ত আগুন নিয়ে যেতে হয়। গলায় এই দেখুন একটা অষ্টধাতুর কবচ। কোমরে সবসময় একটা লোহার চাবি বাঁধা, তবু ভয় কাটে না।’

‘বাড়ি ছেড়ে চলে যান না কেন?’

‘কোথায় যাব বলেন? পূর্বপুরুষের ভিটে।’

‘কাউকে সঙ্গে এনে রাখেন না কেন?’

‘কেউ থাকতে চায় না রে ভাই, কেউ থাকতে চায় না।‘

সুধাকান্তবাবু চায়ের কাপ হাতে তুলে দিলেন। চুমুক দিতে যাব, তখনি বাড়ির একটা কপাট শব্দ করে নড়ে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। হাওয়ার কোনো বংশও নেই—কপাটে শব্দ হয় কেন?

আমি সুধাকান্তবাবুর দিকে তাকালাম। তিনি সহজ গলায় বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই—চা খান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হবে।’

বাড়ির পিছনের বনে খচমচ শব্দ হচ্ছে। আসলে আমি অস্থির বোধ করছি। এই অবস্থা হবে জানলে কে আসত এই লোকের কাছে! আমার ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যাই। সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘ভয় পাবেন না।’

আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি একমনে মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন। নিশ্চয়ই ভূত-তাড়ান মন্ত্র। আমি খুব চেষ্টা করলাম ছোটবেলায় শেখা আয়াতুল কুরসি মনে করতে। কিছুতেই মনে পড়ল না। মাথা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে। গা দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে। ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে বাতাসের অক্সিজেন হঠাৎ করে অনেকখানি কমে গেছে। ভয় নামক ব্যাপারটি যে কত প্ৰবল এবং কী-রকম সর্বগ্রাসী, তা এই প্রথম বুঝলাম

একসময় ভোর হল।

ভোরের পাখি ডাকতে লাগল। আকাশ ফর্সা হল। তাকিয়ে দেখি গায়ের পাঞ্জাবি ভিজে জবজব করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *