১৭. একটি চিঠি এসেছে

১৭

মিসির আলির কাছে একটি চিঠি এসেছে।

এই কারণে তিনি অসম্ভব বিরক্ত। চিঠি না খুলেই তিনি একপাশে ফেলে রেখেছেন। এখন বিরক্তি কমানোর চেষ্টায় সুন্দর কিছু কল্পনা করার চেষ্টা করছেন। সুন্দর কোনো কল্পনাও মাথায় আসছে না।

তাঁর বিরক্তির মূল কারণ হচ্ছে, জটিল একটি বিষয় নিয়ে তিনি ভাবছিলেন। পিয়ন ঠিক এই সময় চিঠি নিয়ে এল। এবং এমনভাবে কড়া নাড়তে লাগল, যেন ভূমিকম্প হচ্ছে–এক্ষুণি সবাইকে ঘর থেকে বের করতে হবে। তিনি দরজা খুলে বললেন, ‘কি ব্যাপার?’

‘স্যার, একটি চিঠি।’

‘রেজিস্ট্রি চিঠি?’

‘জ্বি না।’

‘তাহলে এত হৈচৈ করছেন কেন? দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।‘

মিসির আলি আবার তাঁর চিন্তায় ফিরে যেতে চেষ্টা করলেন। তিনি ভাবছিলেন, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে। ঈশ্বরের কল্পনাই তাঁর কাছে আপত্তিজনক মনে হয়, তবু তিনি ধরে নিলেন : এক জন ঈশ্বর আছেন–যিনি অসীমকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের মতো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীও অসীমকে ধারণ করতে পারে। সে তা ধারণ করে মস্তিষ্কে। তার কল্পনা অসীম, তার চিন্তা অসীম।

ধর্মগ্রন্থগুলোও বারবার মানুষকে ঈশ্বর বলেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে–Then Moses said to God, If I come to the people of Israel and say to them: The God has sent me to you and they ask me, what is his name? What shall I say to them? God said to Moses: I AM WHO I AM. And he said say: this to the people of Israel: I AM has sent me to you.

এই অংশটির মানে কি? মানে হচ্ছে ঈশ্বরের নাম হচ্ছে–আমি। ইসলাম ধর্মেও একই ব্যাপার। আল্লাহ্ বলেন–মানুষের মধ্যে তিনি নিজেকে ফুৎকার করেছেন। এক পয়গাম্বরের কাহিনী আছে, যিনি ঘোষণা করলেন, ‘আনাল হক’–আমিই আল্লাহ্। হিন্দু ধর্মে মানুষকে বলা হয়েছে–নর-নারায়ণ।

মানুষ যদি ঈশ্বর হয়, তাহলে সর্বজগতের ওপর তার আধিপত্য থাকবে। মুনিরের কথাই ধরা যাক। তার কথামতো যদি অসংখ্য জীবন মানুষের থাকে এবং সে যদি ঈশ্বর হয়, তাহলে প্রতিটি জীবন সম্পর্কেই সে জানবে।

কিন্তু তা সে জানে না। কেন জানে না? মানুষের যে অংশ অসীমকে ধারণ করে অর্থাৎ মস্তিষ্কের সেই অংশ পুরোপুরি কাজ করে না বলেই সে জানে না। মানুষ যে তার মস্তিষ্কের অংশমাত্র ব্যবহার করে, এটা তো আজ বিজ্ঞানীদের কাছে স্বীকৃত সত্য। মস্তিষ্কের একটি বিশাল অংশের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা নেই। কারণ সেই অংশটি সুপ্ত।

কারো কারো ক্ষেত্রে সুপ্ত অংশ কিছুটা জেগে ওঠে। তার চারপাশের অসীম জগৎ সম্পর্কে সে কিছুটা ধারণা পেতে থাকে। যেমন মুনির পাচ্ছে।

থিওরি হিসেবে এটা কেমন? মোটেই সুবিধের নয়। মিসির আলি ভূ কুঞ্চিত করলেন। একটি থিওরি দাঁড় করাতে ধর্মগ্রন্থের সাহায্য নেয়াটাই তাঁর অপছন্দ। যে কোনো থিওরি বা হাইপোথিসিস দাঁড়ায় লজিকের ওপর–অন্য কোনো কিছুর ওপরে নয়। ধর্মগ্রন্থের ওপরে তো নয়ই।

মিসির আলির বিরক্তি আরো বাড়ল। মুনিরের সমস্যাটিকে আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। নিজের ওপরই কেমন যেন রাগ হচ্ছে।

তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে খাম খুলে চিঠি বের করলেন। সেখানে লেখা—

স্যার,

আমি খুব অসুস্থ। আমাকে কি আপনি দেখতে আসবেন?

আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি পিজিতে। ওয়ার্ড নম্বর তিন শত ছয়

টুনু

এই টুনু যে মুনির, এটা ধরতেও তাঁর অনেক সময় লাগল। অনেক দিন থেকেই তিনি মুনিরের খবর রাখেন না। নিজের পড়াশোনা এবং চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত। মুনিরও যে তাঁর কাছে আসছে না, এটা তিনি লক্ষ করেন নি। কোনো-একটা কাজ নিয়ে ডুবে থাকলে তাঁর এ-রকম হয়।

নিজের ওপর তাঁর বিরক্তি লাগছে। দরজায় কার যেন ছায়া পড়েছে। তিনি দরজার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘এস নীলু।’

নীলু হালকা গলায় বলল, ‘আমি আসায় কি আপনি বিরক্ত হয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, হয়েছি। এখন এক জায়গায় যাচ্ছি। তুমি আসায় আটকা পড়লাম।’

‘আমি আপনাকে আটকাবার জন্যে আসি নি। যেখানে যাচ্ছেন যান।’

‘তুমি তাহলে অপেক্ষা কর–আমি চট করে কাপড় বদলে আসি। তোমার হাতে কি?’

‘চা-পাতা। খুব ভালো চা। সিলেটে আমার এক মামা আছেন। চা বাগানে কাজ করেন। তিনি পাঠিয়েছেন।

‘থ্যাঙ্কস্।’

‘আপনি কাপড় বদলাতে বদলাতে কি আমি চট করে আপনার জন্যে এক কাপ চা বানাব?’

‘না, দেরি হয়ে যাবে।’

মিসির আলি তৈরি হয়ে বেরুতে যাবার সময় নীলু বলল, ‘আমি এখানে থাকব, আপনি ঘুরে আসুন।’

‘তুমি এখানে থাকবে মানে?’

‘আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।’

‘আমি কখন ফিরব, তার কি কোনো ঠিক আছে?’

‘যত দেরিই হোক অপেক্ষা করব।’

‘একা-একা?’

‘হ্যাঁ, একা-একা। আপনি একা-একা থাকতে পারলে আমি পারব না কেন?’

মিসির আলি কথা বাড়ালেন না, হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন।

.

মুনিরকে দেখে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। এ কী অবস্থা! এত দ্রুত এক জন মানুষের শরীর এত খারাপ হয় কীভাবে? জীবিত কোনো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।

মুনিরের বেডের পাশে এক জন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ইশারায় মিসির আলিকে কথা বলতে নিষেধ করলেন, বারান্দায় যেতে বললেন।

মিসির আলি বললেন, ‘এই অবস্থা হল কীভাবে?’ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছি না।’

‘হয়েছেটা কী?’

‘তাও তো জানা যাচ্ছে না। ড্রাগ এডিক্ট বলে গোড়ায় সন্দেহ হচ্ছিল, এখন তা মনে হচ্ছে না। ব্রেইনে কিছু বাড়তি ব্যাপার আছে। টিউমারজাতীয় কিছু হতে পারে।’

‘বলেন কী!’

‘নিউরোলজিস্ট সোবাহান সাহেব ভালো বলতে পারবেন। উনিই দেখছেন। আপনি বরং ওঁর সঙ্গে কথা বলুন।’

‘উনি কি আছেন?’

‘হ্যাঁ, আছেন।’

সোবাহান সাহেব বললেন, ‘ওপেন না করে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে টিউমারের ব্যাপারটা হতে পারে। স্নায়ুর সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগের জায়গায় টিউমার ডেভেলপ করছে বলে মনে হচ্ছে। সিমটম মিলে যাচ্ছে।’

‘যদি টিউমার হয়, তাহলে কী হবে?’

‘খুবই ফেটাল হবে। অবস্থা দ্রুত খারাপ হবে। হচ্ছেও তাই। পেশেন্টের হেলুসিনেশন হচ্ছে। বলল আমাকে–বাবা-মা এদের নাকি দেখতে পাচ্ছে। আপনি এই পেশেন্টের আত্মীয়স্বজনকে খবর দিন। আমার মনে হয় না, আমাদের খুব একটা কিছু করার আছে। একটা যা পারি সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। তার প্রয়োজন হচ্ছে না। রোগী ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে। দিন-রাত ঘুমুচ্ছে। এটাও এক দিক দিয়ে ভালো।’

মিসির আলি রোগীর কাছে ফিরে এলেন। মুনিরের ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুনিরের ঘুম খুব প্রশান্ত নয় বলে তাঁর ধারণা হল। ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করছে। দ্রুত চোখের পাতা পড়ছে। REM (Rapid eye movement ) -তার মানে স্বপ্ন দেখছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে তার জগতে। কার সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে, সে কী বলছে কে জানে?

‘মুনির, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?’

‘পারছি।’

‘আমি কে বল তো?’

‘আপনি মিসির আলি।’

‘এই তো পারছ–গুড বয়। তোমার যে এই অবস্থা, তা তো জানতাম না। আমি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।’

মুনির উঠে বসতে চেষ্টা করল। মিসির আলি তাকে আবার শুইয়ে দিলেন।’কী হয়েছে তোমার?’

মুনির ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল। জেনারেল ওয়ার্ডে অসংখ্য রোগী। এর মধ্যে এক জন মারা গেছে, তাকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড়। ফিনাইলের গন্ধ ছাড়িয়ে বিকট এক ধরনের গন্ধ আসছে, যে-গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে যায়। মিসির আলি বললেন, ‘এখানে বেশি দিন থাকলে তো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে!’

মুনির চাপা গলায় বলল, ‘বেশিক্ষণ তো এখানে থাকি না। অন্য জীবনগুলোতে ঘুরে বেড়াই। এখন আর আমার আসতে ইচ্ছে করে না। খুব কম আসি। এই যে এসেছি, আমার ভালো লাগছে না। চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখানে যতক্ষণ থাকি প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হয়।’

‘এখন হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, হচ্ছে।’

‘খুব বেশি?’

‘হ্যাঁ, খুব বেশি। আমার কী হচ্ছে বলুন তো? অন্য যে-সব জীবনের কথা বলি, সে-সব কি সত্যি, না সবই স্বপ্ন?’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘অন্য যে-জগতে আমি যাই, সেখানেও আপনার মতো এক জন আছেন। তাঁকেও আমি আমার সমস্যার কথা বলেছি।’

‘তিনি কী বললেন?’

‘তিনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগের একটা পথ খুঁজছেন।’

‘পেয়েছেন কোনো পথ?’

‘হ্যাঁ। তিনি বলেছেন, পত্রিকায় তিনি বিজ্ঞাপন দেবেন। জগৎগুলো মোটামুটি একই রকম, কাজেই দু’ জগতের পত্রিকাগুলোও একই রকম হবে। ঐ জগতের পত্রিকায় যে বিজ্ঞাপন ছাপা হবে, এ জগতের পত্রিকাতেও প্রায় কাছাকাছি ধরনের বিজ্ঞাপন ছাপা হবে। ঐ বিজ্ঞাপনই হবে যোগসূত্র। বুঝতে পারছেন কিছু?

‘পারছি। উনি কি বিজ্ঞাপন ছাপতে দিয়েছেন?’

‘এখনো না। ভাষা কী হবে তাই নিয়ে ভাবছেন। ভাষাটা তিনি এমন করতে চান, যাতে দেখামাত্রই আপনি বুঝতে পারেন। স্যার, আমি আর থাকতে পারছি না, মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে।

‘খুব বেশি যন্ত্রণা?’

‘হ্যাঁ, খুব। আমি আর পারছি না। আপনি কি একটা কাজ করবেন?’

‘বল, কী কাজ?’

‘বিনুকে একটু নিয়ে আসবেন? বিনু যদি আমার পাশে এসে বসে, যদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তাহলে আমার যন্ত্রণাটা কমবে।’

‘তোমার এরকম মনে হবার কারণ কি?’

‘আমার মাথার যন্ত্রণাটা শুধু এই জগতেই হয় না। সব ক’টা জগতে হয়। বিনু তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তখন যন্ত্রণাটা কমে।’

‘তুমি অতীতে যেতে পার বলে মনে হয়। অন্য জীবনের ছোটবেলার কথা তুমি বল। ভবিষ্যতে কি যেতে পার?’

‘না, পারি না। সব ক’টা জীবনে দেখেছি, একটা সময়ে আমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। ঐ সময়টাতে আমি যাই না।’

‘তুমি কি ইচ্ছামতো যেখানে যেতে চাও যেতে পার?’

‘না, পারি না। হঠাৎ জীবনের একটা সময়ে এসে উপস্থিত হই। সেটা পছন্দ না-হলে অন্য কোথাও যাই। স্যার, আপনি বিনুকে খবর দেবেন?’

‘দেব।’

.

বিনুকে তিনি খবর দিতে পারলেন না। সেদিন তার গায়ে হলুদ হচ্ছে। বাড়িতে আনন্দ এবং উল্লাস। বিনুর জীবন নতুন একটি খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। তাকে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ মিসির আলি দাঁড় করাতে পারলেন না। হয়তো বিনুরও অসংখ্য জীবন আছে, হয়তো নেই। হয়তো এই একটিই তার জীবন। এই জীবনটি জটিলতামুক্ত হোক–মিসির আলি মনে-মনে এই কামনাই করলেন।

.

মিসির আলি বাসায় ফিরলেন অনেক রাতে। দরজা তালাবদ্ধ। নীলু দরজা বন্ধ করে চলে গিয়েছে। তালা ভেঙে ঢুকতে হল। ঘর পরিপাটি করে গোছান। নীলু এর মধ্যে রান্না করেছে। খাবারদাবার গুছিয়ে রেখেছে টেবিলে।

নীলু একটা চিঠিও লিখে রেখে গেছে। ‘–মানুষের একটাই জীবন, নাকি অসংখ্য জীবন–তা আমি জানি না। এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নেই। আমি জানি, আমার একটাই জীবন। আপনাকে কিছুতেই তা নষ্ট করতে দেব না।’

সুন্দর গোটা গোটা হাতের লেখা। অনেক সময় নিয়ে সে লিখেছে এবং হয়তো-বা লিখতে মেয়েটির চোখ ভিজে উঠেছে। নীলু কখনো কাঁদে না, সেই জন্যেই বোধ হয় অতি অল্পতে তার চোখ ভিজে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *