দেবী – ১২

১২

গভীর রাতে আনিস জেগে উঠল। শুনশান নীরবতা চারদিকে। রানু হাত-পা ছড়িয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো ঘুমোচ্ছে। জানালার আলো এসে পড়েছে তার মুখে। অদ্ভুত সুন্দর একটি মুখ। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। আনিস ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। বাথরুমে যেতে হবে।

বাথরুমে পানি জমে আছে। পাইপ জ্যাম হয়ে গেছে। বাড়িঅলাকে বলতে হবে। আনিস নোংরা পানি বাঁচিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই শুনল ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। নূপুর বাজছে যেন। এর মানে কী? মনের ভুল কি? মনের ভুল হবার কথা নয়। বেশ বোঝা যাচ্ছে নূপুর পায়ে দিয়ে ঝমঝম করতে-করতে কেউ—একজন এঘর-ওঘর করছে। শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছে। মনের ভুল হবার কথা নয়।

বাথরুমের দরজা খুলতেই শব্দটা চট করে থেমে গেল। শুধু একটা তীব্র ফুলের গন্ধ আনিসকে অভিভূত করে ফেলল। একটু আগেও তো এ-রকম সৌরভ ছিল না। আনিসের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বিস্ময়ের ঘোর অবশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আনিসের মনে পড়ল একতলার বাগানে হাস্নাহেনার প্রকাণ্ড একটা ঝাড় আছে। বাতাসের ঝাপটায় ফুলের গন্ধই উড়ে এসেছে বারান্দায়। আনিস কিছুক্ষণ একা-একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল—নূপুরের শব্দ আবার যদি পাওয়া যায়।

দোতলার একটা বাচ্চা ছেলে শুধু কাঁদছে। তার মা তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। একটা রিকশা গেল টুনটুন করে। ব্যস, আর কিছু শোনা গেল না।

শোবার ঘরে রানু ঘুমোচ্ছে। মড়ার মতো। জানালা খোলা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরে। আনিস জানালা বন্ধ করতে গিয়ে শুনল, রান্নাঘর থেকে জিতু মিয়া সাড়াশব্দ দিচ্ছে। কান্না চাপার আওয়াজ।

‘জিতু মিয়া।‘

জিতু ফুঁপিয়ে উঠল। আনিস রান্নাঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। জিতু মশারির ভেতর জবুথবু হয়ে বসে আছে।

‘জিতু, কি হয়েছে রে?’

‘কিছু হয় নাই।‘

‘বসে আছিস কেন?’

‘ঘুম আহে না।’

‘স্বপ্ন দেখেছিস?’

জিতু মাথা নাড়ল।

‘কী স্বপ্ন?’

‘এক জন মাইয়া মানুষ পাকের ঘরে হাঁটতে আছিল।’

‘এই দেখেছিস স্বপ্নে?’

‘স্বপ্নে দেখি নাই। নিজের চোখে দেখলাম।’

‘দূর ব্যাটা, অন্ধকারে তুই মানুষ দেখলি কীভাবে? যা, ঘুমো।’

জিতু শুয়ে পড়ল। আনিস বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই, আমি জেগে আছি, ঘুমো তুই।’

‘আচ্ছা।’

‘আর শোন, রান্নাঘরে বাতি জ্বালানো থাকুক।’

‘আচ্ছা।’

জিতু শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। আনিস একটি সিগারেট ধরাল। ঘুম চটে গেছে। তাকে এখন দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে হবে। এক পেয়ালা চা খেতে পারলে মন্দ হত না। রাত তো বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা। বাকি রাতটা তার জেগেই কাটবে মনে হয়। সিগারেট টানতে ভালো লাগছে না। পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে।

ঘুমের মধ্যে রানু শব্দ করে হাসল। আনিস মৃদু স্বরে ডাকল, ‘এই রানু।’

রানু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘কি?’

‘জেগে আছ নাকি?’

‘হ্যাঁ।‘

‘কী আশ্চর্য, কখন জাগলে?’

‘অনেকক্ষণ। তুমি বাথরুমে গেলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে।’

‘আমাকে ডাকলে না কেন?’

‘শুধু-শুধু ডাকব কেন?’

আনিস সিগারেট টানতে লাগল। রানু বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। জানালা বন্ধ করলে কেন?’

‘গরম কোথায়? বেশ ঠাণ্ডা তো!’

‘আমার গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড় না।’

‘এই ঠাণ্ডার মধ্যে ফ্যান ছাড়ব কি, কী যে বল!’

রানু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুমি যখন বাথরুমে ছিলে তখন কি নূপুরের শব্দ শুনেছ?’

আনিস ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘না তো, কেন?’

‘না, এমনি। আমি শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম।’

‘ঘুমাও রানু।’

‘আমার ঘুম আসছে না।’

‘ঘুম না এলে উঠে বস, গল্প করি। চা খাওয়া যেতে পারে, কি বল?’

রানু উঠে বসল কিন্তু জবাব দিল না। আনিস দেখল রানু কোন ফাঁকে গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। তুমি আমার দিকে তাকিও না, প্লীজ!’

‘এইসব কী রানু? ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে আছে।’

‘কী করব, বড্ড গরম লাগছে। তুমি বরং রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে সব অন্ধকার করে দাও।’

‘না, বাতি জ্বালানো থাক।’

আনিস দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। রানু বলল, ‘আমাদের গ্রামে একটা মন্দির আছে, তার গল্প এখন শুনবে না?’

‘আহ্, মন্দির-ফন্দিরের গল্প এখন শুনব না।’

‘আহ্, শোন না! আমার বলতে ইচ্ছে করছে। আমি যখন খুব ছোট, তখন একা-একা যেতাম সেখানে।

‘কি মন্দির? কালীমন্দির?’

‘নাহ্, বিষ্ণুমন্দির বলত ওরা। তবে কোনো বিষ্ণুমূর্তি ছিল না। একটি দেবী ছিল। হিন্দুরা বলত রুকমিনী দেবী।’

‘তুমি মন্দিরে যেতে কী জন্যে?’

‘এমনি যেতাম। ছোট বাচ্চা পুতুল খেলে না?’

‘কী করতে সেখানে?’

‘দেবীমূর্তির সাথে গল্পগুজব করতাম। ছেলেমানুষি খেলা আর কি!’

বলতে-বলতে রানু খিলখিল করে হেসে উঠল। আনিস স্পষ্ট শুনল সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে কোথাও নূপুর বাজছে। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’

‘কী শুনব?’

‘নূপুরের শব্দ শুনছ না?’

আনিস দৃঢ় স্বরে বলল, ‘না। তুমি ঘুমাও রানু।’

‘আমার ঘুম আসছে না।’

‘শুয়ে থাক। তুমি অসুস্থ।’

রানু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি অসুস্থ।’

‘তোমাকে খুব বড় ডাক্তার দেখাব আমি।’

‘আচ্ছা।’

‘এখন শুয়ে থাক।’

রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি ঐ দেবীকে গান গেয়ে শোনাতাম।’

‘ঐ সব অন্য দিন শুনব।

‘আজ রাতে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।‘

আনিস এসে রানুর হাত ধরল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আনিস অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার গা তো পুড়ে যাচ্ছে।’

‘হুঁ, বড্ড গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড়বে?’

আনিস উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। ঘর ভর্তি হয়ে গেল ফুলের গন্ধে। আর তখনি রানু অত্যন্ত নিচু গলায় গুনগুন করে কী যেন গাইতে লাগল। অদ্ভুত অপার্থিব কোনো-একটা সুর—যা এ-জগতের কিছু নয়। অন্য কোনো ভুবনের। রান্নাঘর থেকে জিতু ডাকতে লাগল, ‘ও ভাইজান, ভাইজান।’

আনিস রানুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে গায়ের চাদর টেনে দিল। জিতুকে বলল, এ ঘরে যেন না আসে। তারপর নেমে গেল নিচে, বাড়িঅলার মেয়েটিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে।

নীলু এল সঙ্গে সঙ্গে। আনিস দেখল রানু শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে। জিতু মিয়া শুধু জেগে আছে। কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে। নীলুর সঙ্গে তার বাবাও আসছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘হয়েছেটা কী?’ আনিস ভাঙা গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি না, কেমন যেন করছে।’

‘কী করছে?’

আনিস জবাব দিল না। নীলু বলল, ‘বাবা, তুমি শুয়ে থাক গিয়ে, আমি এখানে থাকি। রাত তো বেশি নেই।’ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে নেমে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, ‘হাসপাতালে নিতে হলে বলবেন, ড্রাইভারকে ডেকে তুলব।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

রানু বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল। এক বারও জাগল না। নীলু সারাক্ষণ তার পাশে রইল! আনিসের সঙ্গে তার কথাবার্তা কিছু হল না। আনিস বসার ঘরের সোফায় বসে ঝিমুতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *