দেবী – ৮

সোহাগী হাইস্কুলের হেডমাস্টার সাহেব দারুণ অবাক হলেন। রানুর ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসেছেন—এর মানে কী? অতি দিন আগে কী হয়েছিল, না-হয়েছিল, তা কি এখন আর কারো মনে আছে? আর মনে থাকলেও এইসব ব্যাপার নিয়ে এখন ঘাঁটাঘাঁটি করাটা বোধহয় ঠিক নয়। কিন্তু যে-ভদ্রলোক এসেছেন, তাঁকে মুখের ওপর না বলতেও বাধছে। ভদ্রলোক হাজার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক। মানী লোক। তা ছাড়া এত দূর এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মুখে বলছেন রানু অসুস্থ এবং তিনি রানুর এক জন চিকিৎসক। কিন্তু এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ মাসখানেক আগেই রানুকে তিনি দেখে এসেছেন। কিছুমাত্র অসুস্থ মনে হয় নি। আজ হঠাৎ এমন কী হয়েছে যে ঢাকা থেকে এই ভদ্রলোককে আসতে হল?

‘রানুর কী হয়েছে বললেন?’

‘মানসিকভাবে অসুস্থ।’

‘আমি তো সেদিনই তাকে দেখে এলাম।‘

‘যখন দেখেছেন তখন হয়তো সুস্থই ছিল।’

‘কী জানতে চান আপনি, বলেন।’

‘নদীতে গোসলের সময় কী ঘটেছিল, সেটা বলেন।’

‘সে-সব কি আর এখন মনে আছে?’

‘ঘটনাটা বেশ সিরিয়াস এবং নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে বহু বার আলোচিত হয়েছে, কাজেই মনে থাকার কথা। আপনার যা মনে আসে তাই বলেন।’

হেডমাস্টার গম্ভীর স্বরে ঘটনাটা বললেন। রানুর গল্পের সঙ্গে তাঁর গল্পের কোনো অমিল লক্ষ করা গেল না। শুধু ভদ্রলোক বললেন, ‘মেয়েরা গোসল করতে গিয়েছিল দুপুরে, সন্ধ্যায় নয়।’

‘পায়জামা খোলার ব্যাপারটি বলেন। পায়জামাটা কি পাওয়া গিয়েছিল?’

‘আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’

‘রানু বলছিল, নদীতে গোসল করবার সময় সেই মরা মানুষটি তার পায়জামা খুলে ফেলে।’

‘আরে না না, কী বলেন!‘

‘ওর পরনে পায়জামা ছিল?’

‘হ্যাঁ, থাকবে না কেন?‘

‘আপনার ঠিক মনে আছে তো?’

‘মনে থাকবে না কেন? পরিষ্কার মনে আছে। আপনি অন্য সবাইকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’

‘ঐ মরা মানুষটি সম্পর্কে কী জানেন?’

‘কিছুই জানি না রে ভাই। থানায় খবর দিয়েছিলাম। থানা হচ্ছে এখান থেকে দশ মাইল। সেই সময় যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। থানাঅলারা আসে দু’ দিন পরে। লাশ তখন পচে-গলে গিয়েছে। শিয়াল-কুকুর কামড়াকামড়ি করছে। থানাঅলারা এসে আমাদের লাশ পুঁতে ফেলতে বলে। আমরা নদীর ধারেই গর্ত করে পুঁতে ফেলি।’

‘আচ্ছা, ঐ লাশটি তো উলঙ্গ ছিল, ঠিক না?’

‘জ্বি-না, ঠিক না। হলুদ রঙের একটা প্যান্ট ছিল আর গায়ে গেঞ্জি ছিল।‘

মিসির সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত হল।

‘আপনার ঠিক মনে আছে তো ভাই?’

‘আরে, এটা মনে না-থাকার কোনো কারণ আছে? পরিষ্কার মনে আছে।’

‘লাশটি কি বুড়ো মানুষের ছিল?’

‘জ্বি–না, জোয়ান মানুষের লাশ।‘

‘আর কিছু মনে পড়ে?’

আর কিছু তো নেই মনে পড়ার।’

‘আপনার ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই, অনুফা যার নাম। শুনেছি ওর শ্বশুরবাড়ি কাছেই।’

‘হরিণঘাটায়। আপনি যেতে চান হরিণঘাটা?’

‘জ্বি।’

‘কখন যাবেন?’

‘আজকেই যেতে পারি। কত দূর এখান থেকে?’

‘পনের মাইল। বেবিট্যাক্সি করে যেতে পারেন।’

‘রাতে ফিরে আসতে পারব?’

‘তা পারবেন।’

‘বেশ, তাহলে আপনি আমাকে ঠিকানা দিন।‘

‘দেব। বাড়িতে চলেন, খাওয়াদাওয়া করেন।’

‘আমি হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে এসেছি।’

‘তা কি হয়, অতিথি-মানুষ! আসুন আসুন।’

ভদ্রলোক বাড়িতে নিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বড়ই গম্ভীর হয়ে রইলেন। মাথার ওপর হঠাৎ এসে পড়া উপদ্রবে তাঁকে যথেষ্ট বিরক্ত মনে হল। ভালো করে কোনো কথাই বললেন না। অকারণে বাড়ির এক জন কামলার ওপর প্রচণ্ড হম্বিতম্বি শুরু করলেন।

কিন্তু অনুফার বাড়িতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ঘটল। মেয়েটি আদর-যত্নের একটি মেলা বাধিয়ে ফেলল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটির স্বামী সন্ধ্যাবেলাতেই জাল নিয়ে পুকুরে নেমে গেছে। অনুফা পরিচিত মানুষের মতো আদুরে গলায় বলল, ‘রাতে ফিরবেন কি–কাল সকালে যাবেন।’ লোকজন মিসির আলিকে দেখতে এল। এরা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ। মেয়েটিও মনে হয় বেশ ক্ষমতা নিয়ে আছে। সবাই তার কথা শুনছে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে তাঁকে গোসলের জন্যে গরম পানি করে দেওয়া হল। একটা বাটিতে নতুন একটা গায়ে মাখার সাবান। মোড়কটি পর্যন্ত ছেঁড়া হয় নি। বাংলাঘরে নতুন চাদর বিছিয়ে বিছানা করা হল। মেয়েটির বৃদ্ধ শ্বশুর একটি ফর্সী হুক্কাও এনে দিলেন এবং বারবার বলতে লাগলেন, খবর না দিয়ে আসার জন্যে ঠিকমতো খাতির-যত্ন করতে না পেরে তিনি বড়ই শরমিন্দা। তবে যদি কালকের দিনটা থাকেন, তবে তিনি হরিণঘাটার বিখ্যাত মাগুর মাছ খাওয়াবেন। খাওয়াতে না-পারলে তিনি বাপের ব্যাটা না—ইত্যাদি ইত্যাদি।

মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি সত্যি-সত্যি এক দিন থেকে গেলেন। মিসির আলি সাহেব এ-রকম কখনো করেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *