দেবী – ৬

মিসির আলি সাহেব দেখলেন তাঁর ঘরের সামনে চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো টিউটোরিয়েল ক্লাস আছে নাকি? আজ বুধবার, টিউটোরিয়েল ক্লাস থাকার কথা নয়। তবে কে জানে হয়তো নতুন রুটিন দিয়েছে। তিনি এখনো নোটিস পান নি।

‘এই, তোমাদের কী ব্যাপার?’

মেয়েগুলি জড়সড় হয়ে গেল।

‘কি, তোমাদের সঙ্গে কোনো ক্লাস আছে?’

‘জ্বি-না স্যার।’

‘তাহলে কি? কিছু বলবে?‘

‘স্যার, নোটিস বোর্ডে আপনি একটা নোটিস দিয়েছিলেন, সেই জন্যে এসেছি।’

‘কিসের নোটিস?’

তিনি ভুরু কোঁচকালেন। মেয়েগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

‘কী নোটিস দিয়েছিলাম?’

‘স্যার, আপনি লিখেছেন–কারো এক্সট্রাসেন্সরি পারসেপশনের ক্ষমতা আছে কি না আপনি পরীক্ষা করে বলে দেবেন।

মিসির আলি সাহেবের সমস্ত ব্যাপারটা মনে পড়ল। মাস দুয়েক আগে এ-রকম একটা নোটিস দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এই প্রথম চার জনকে পাওয়া গেল, যারা উৎসাহী। এবং সব ক’টি মেয়ে। মেয়েগুলো রোগা। তার মানে কি অকন্টের ব্যাপারে রোগা মেয়েরাই বেশি উৎসাহী? তিনি মনে-মনে একটা নোট তৈরি করলেন, এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে হল বিষয়টি ইন্টারেস্টিং। একটা সার্ভে করা যেতে পারে।

‘এস তোমরা। ঘরে এস। তোমরা তাহলে জানতে চাও তোমাদের ইএসপি আছে কি না?’

মেয়েগুলি কথা বলল না। যেন একটু ভয় পাচ্ছে। মুখ সবারই শুকনো।

‘বস তোমরা। চেয়ারে আরাম করে বস।’

ওরা বসল। মিসির আলি সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। নিচু গলায় বললেন, ‘সব মানুষের মধ্যেই ইএসপি কিছু পরিমাণ থাকে। টেলিপ্যাথির কথাই ধর। তোমাদের নিজেদেরই হয়তো এ-বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। সহজ উদাহরণ হচ্ছে, ধর, এক দিন তোমাদের কারো মনে হল আজ অমুকের সাথে দেখা হবে। যার সঙ্গে দেখা হবার কথা মনে হচ্ছে, সে কিন্তু এখানে থাকে না। থাকে চিটাগাং। কিন্তু সত্যি-সত্যি দেখা হয়ে গেল। কি, হয় না এ-রকম?

মেয়েগুলো কথা বলল না। এর মধ্যে এক জন রুমাল দিয়ে কপাল মুছতে লাগল। মেয়েটি ঘামছে। নার্ভাস হয়ে পড়ছে মনে হয়। নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে। মিসির আলি বিস্মিত হলেন। নার্ভাস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বিষয়ের চর্চা এখনো বিজ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না। বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই অনুমানের ওপর। তবে আমেরিকায় একটি ইউনিভার্সিটি আছে—ডিউক ইউনিভার্সিটি। ওরা কিছু-কিছু এক্সপেরিমেন্টাল কাজ শুরু করেছে। মুশকিল হচ্ছে, ফলাফল সবসময় রিপ্রডিউসিব নয়।’

মিসির আলি সাহেব ড্রয়ার খুলে দশটি চৌকো কার্ড টেবিলে বিছালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘পরীক্ষাটি খুব সহজ। এই কার্ডগুলোতে বিভিন্ন রকম চিহ্ন আছে। যেমন ধর ক্রস, স্কয়ার, ত্রিভুজ, বিন্দু। কোনটিতে কী আছে সেটা অনুমান করতে চেষ্টা করবে। দু’-এক বার কাকতালীয়ভাবে মিলে যাবে। তবে ফলাফল যদি স্ট্যাটিসটিক্যালি সিগনিফিকেন্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে তোমাদের ইএসপি আছে। এখন এস দেখি, কে প্রথম বলবে? তোমার কী নাম?’

‘নীলুফার।’

‘হ্যাঁ নীলুফার, তুমিই প্রথম চেষ্টা কর। যা মনে আসে তা-ই বল।’

‘আমার কিছু মনে আসছে না।’

‘তাহলে অনুমান করে বল।’

মেয়েটি ঠিকমতো বলতে পারল না। তার সঙ্গীরাও না। মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘নাহ্, তোমাদের কারো কোনো ইএসপি নেই।’ ওরা যেন তাতে খুশিই হল। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘না থাকাই ভালো। আধুনিক মানুষদের এ-সব থাকতে নেই। এতে অনেক রকম জটিলতা হয়।’

‘কী জটিলতা?’

‘আছে, আছে।’

‘বলুন না স্যার।’

মিসির আলি লক্ষ করলেন, নীলুফার নামের মেয়েটিই কথা বলছে। স্পষ্ট সতেজ গলা।

‘অন্য আরেক দিন বলব। আজ তোমরা যাও।’

নীলুফার বলল, ‘এমন কিছু কি স্যার আছে, যা করলে ইএসপি হয়?’

‘লোকজন বলে, প্রেমে পড়লেও এই ক্ষমতাটা অসম্ভব বেড়ে যায়। আমি ঠিক জানি না। তোমরা যদি কেউ কখনো প্রেমে পড়, তাহলে এস, পরীক্ষা করে দেখব।’

কথাটা বলেই মিসির আলি অপ্রস্তুত বোধ করলেন। ছাত্রীদের এটা বলা ঠিক হয় নি। কথাবার্তায় তাঁর আরো সাবধান হওয়া উচিত। এ-রকম হালকা ভঙ্গিতে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।

‘স্যার, আমরা যাই?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা হবে।’

মিসির আলি নিচের টীচার্স লাউঞ্জে চা খেতে এলেন। বেলা প্রায় তিনটা। লাউঞ্জে লোকজন নেই। পলিটিক্যাল সায়েন্সের রশিদ সাহেব এক কোণায় বসে ছিলেন। তিনি অস্পষ্ট স্বরে ডাকলেন, ‘এই যে মিসির সাহেব, অনেক দিন পর মনে হয় এলেন এদিকে। চা খাবেন?

‘কে যেন বলছিল, আপনি নাকি ভূতে ধরা সারাতে পারেন। ঠিক নাকি?’

‘জ্বি-না। আমি ওঝা নই।

‘রাগ করলেন নাকি? আমি কথার কথা বললাম।

‘না, রাগ করব কেন?’

‘আচ্ছা মিসির আলি সাহেব, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?’

‘না।’

রশিদ সাহেব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

‘আত্মা, আত্মায় বিশ্বাস করেন?

‘না ভাই, আমি একজন নাস্তিক।’

‘আত্মা নেই—এই জিনিসটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? কী কী যুক্তি আছে আপনার হাতে?’

মিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। রশিদ সাহেব বললেন, ‘আত্মা যে আছে, এর পক্ষে বিজ্ঞানীদের কিছু চমৎকার যুক্তি আছে।’

‘থাকলে তো ভালোই। বিজ্ঞানীরা জড়জগৎ বাদ দিয়ে আত্মাটাত্মা নিয়ে উৎসাহী হলেই কিন্তু ঝামেলা। রশিদ সাহেব, আমার মাথা ধরেছে। এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। কিছু মনে করবেন না।’

মিসির আলি চা না-খেয়েই উঠে পড়লেন। তাঁর সত্যি-সত্যি মাথা ধরেছে। প্রচণ্ড ব্যথা। বড় রকমের কোনো অসুখের এটা পূর্বলক্ষণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *