০১. স্যার ম্যাজিক দেখবেন

স্যার ম্যাজিক দেখবেন?

মিসির আলি বিরক্ত মুখে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালেন। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। বোঝা যাচ্ছে অভাব-অনটনে আছে। গায়ের শার্ট মলিন। চেহারাও শার্টের মতোই মলিন। যদিও হাসি-খুশি ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় লাভ হচ্ছে না। যুবকের চোখেও মনে হয় সামান্য সমস্যা আছে। সারাক্ষণ চোখ পিটপিট করছে। চোখের অশ্রুগ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে চোখ পিটপিট রোগ হয়। এর কি তাই হয়েছে? সে ক্ষুধার্তও। তাকে পিরিচে করে বিস্কিট এবং চানাচুর দেয়া হয়েছিল। সে সবই খেয়েছে। বিস্কিটের কিছু কণা পড়ে ছিল। তর্জনীর মাথায় সেই কণাগুলো মাখিয়ে সে জিভে ছোঁয়াল।

যুবকের নাম তিনি জানেন না। নাম জানার কোনো আগ্রহও বোধ করছেন না। তাঁর কাছে যুবকটি কেন এসেছে তা-ও ধরতে পারছেন না। তিনি এমন কোনো মজার চরিত্র না যে তাঁর সঙ্গে কথা বলে কেউ মজা পাবে। যুবক আবার বলল, স্যার, ম্যাজিক দেখবেন?

মিসির আলি বললেন, ম্যাজিক দেখব না। ম্যাজিক আমার পছন্দের বিষয় নয়।

যুবক হাসি হাসি গলায় বলল, কেন পছন্দ না জানতে পারি?

মিসির আলি বললেন, ম্যাজিকের ভেতর প্রতারণার একটা ব্যাপার থাকে। এই প্রতারণার অংশটা আমার অপছন্দ। আমি প্রতারণা পছন্দ করি না।

স্যার আমি যে ম্যাজিক দেখাব তার মধ্যে কোনো প্রতারণা নেই। মেন্টাল ম্যাজিক। আমার অনেক দিনের শখ আমি আমার মানসিক ক্ষমতার নমুনা আপনাকে দেখাই।

মিসির আলি যুবকের দিকে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টিতে তেমন কৌতূহল অবশ্য দেখা গেল না।

যুবকের মানসিক ক্ষমতা দেখার ব্যাপারেও মিসির আলি কোনো আগ্রহ বোধ করলেন না। তিনি নিজের উপর সামান্য বিরক্তও হলেন। তাঁর কৌতূহল এত দ্রুত কমছে কেন? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কৌতূহল কমতে থাকে? সেই কমার হারটা কেমন?

মিসির আলি বললেন, তোমার নাম কী?

যুবক আগ্রহের সঙ্গে বলল, মনসুর। আপনার সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। আপনার নামের শুরু ম দিয়ে। আমার নামের শুরুও ম দিয়ে।

যুবক আবারো বলল, আমি কি স্যার আমার মানসিক ক্ষমতার একটা ম্যাজিক আপনাকে দেখাব? দেখলে আপনি খুবই মজা পাবেন।

মিসির আলি হ্যাঁ বা না বলার আগেই মনসুর পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। হতদরিদ্র যুবকদের পকেটেও কেন জানি দামি সিগারেটের প্যাকেট থাকে। এর কাছে তা নেই। সস্তা সিগারেটের প্যাকেটের ন্যাতন্যাতা ফিল্টারবিহীন সিগারেট।

আমি ম্যাজিকটা দেখাব সিগারেট দিয়ে।

মনসুর একটা সিগারেট টেবিলের উপর রাখল। মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। সিগারেটের দিকে এখন সে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তার মাথা নিচু হয়ে আছে। চোখে পিটপিটানিও বন্ধ।

স্যার ভালো করে দেখুন। আমি সিগারেটটা হাত দিয়ে স্পর্শও করি নি। আমি শুধু তাকিয়ে আছি। দেখুন চোখের দৃষ্টিতে আমি কী করছি!

মিসির আলি মোটামুটি বিস্মিত হলেন। সিগারেট নড়ছে। গড়িয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। বিস্মিত হবার মতোই ব্যাপার।

যুবকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে মানসিক ক্ষমতার এই ম্যাজিক দেখাতে তার রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।

স্যার কেমন দেখলেন?

ভালো। ইমপ্রেসিভ।

এখন যা দেখালাম তার নাম টেলি-কাইনেটিক্স। মানসিক শক্তির সাহায্যে বস্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানো। আপনি কি টেলি-কাইনেটিক্সের কথা শুনেছেন?

শুনেছি।

মনসুর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, ইসরায়েলের এক যুবক, তার নাম য়ুরি গেলার। সে মানসিক ক্ষমতা দিয়ে চামচ বাঁকা করে ফেলতে পারত। আমার এত ক্ষমতা নেই। তবে যা আছে তা-ও খারাপ না। চামচ বাঁকা করতে না পারলেও আমি পাতলা তার বাঁকা করতে পারি। ঠিক বলেছি না স্যার?

মিসির আলি সামান্য নড়ে বসলেন। হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।

টেবিলের উপর থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে দিল। দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেট একবারে ধরল না। বেশ কয়েকটা কাঠি খরচ করতে হল। একজন বয়স্ক মানুষ সামনে বসে আছে তা নিয়ে তার মধ্যে কোনো সঙ্কোচ দেখা গেল না।

সিগারেট থেকে তীব্র গন্ধ আসছে। গাঁজার গন্ধ। মিসির আলির মন সামান্য খারাপ হল।

সিগারেট শেষ করে আমি আমার ক্ষমতার অন্য একটা ভার্সান আপনাকে দেখাব। আপনি মজা পাবেন।

আচ্ছা।

আপনার সামনে সিগারেট টানছি আপনি কিছু মনে করছেন না তো? সস্তা সিগারেট বলেই এমন কড়া গন্ধ আসছে। আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু না। গাঁজা না।

মনে করছি না।

এখন স্যার মোটা দেখে একটা বই আমার হাতে দিন। যতটা মোটা হয় তত ভালো।

ডিকশনারি দিলে চলবে?

চলবে।

মনসুরের সিগারেট শেষ হয় নি। সে আধ খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বই নিয়ে বসল। তার ধ্যানমগ্ন মূর্তি দেখতে ভালো লাগছে। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনসুর তার দুই হাত দিয়ে কোমর ধরে আছে। একটু ঝুঁকে এসেছে বইয়ের দিকে। তার কপাল আবারো ঘামছে। ঘটনা যা ঘটছে তা বিস্ময়কর। বইয়ের পাতা একের পর এক উল্টে যাচ্ছে।

স্যার কেমন দেখছেন?

ভালো।

আমি হিপনোটিজমও পারি। যে কোনো মানুষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।

ও আচ্ছা!

আজ অবশ্য পারব না। আজ আমার মন ভালো নেই। কোনো কিছুতেই কনসেনট্রেট করতে পারছি না। মন অসম্ভব খারাপ। এই মুহূর্তে আমার চেয়ে বেশি মন খারাপ মানুষ বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না।

মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছ’টা দশ। সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা তাঁর একা থাকতেই ভালো লাগে। মানসিক ক্ষমতাওয়ালা কারো সামনে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। মনসুর এখনো বসে কেন তিনি বুঝতে পারছেন না। সে তার মেন্টাল ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছিল দেখানো হয়েছে। আরো কিছু কি বাকি আছে? নাকি সে তার ঘুম পাড়ানো ক্ষমতাও দেখাবে। যাবার আগে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে চলে যাবে। সন্ধ্যাবেলা তিনি চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে পারবেন।

মনসুর আরেকটা সিগারেট ধরাল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, দিয়াশলাই জ্বালানোর সময় তার হাত সামান্য কাঁপছে। পারকিনসন্স ডিজিজ প্রাথমিক অবস্থায় এরকম হয়। এই যুবকের পারকিনসন্স ডিজিজ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তা হলে আঙুল কাঁপছে কেন? মানসিক অস্থিরতা? মনের প্রবল অস্থিরতা শরীরে ছায়া ফেলে। মনের প্রবল কাঁপুনি শরীরে চলে আসে।

মনসুর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মিসির আলির দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, এই জাতীয় ক্ষমতা সবচে বেশি দেখা যায় যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে। এদের অনেকেই লেভিটেশন করতে পারেন। লেভিটেশন হচ্ছে শূন্যে ভাসা। অসম্ভব কোনো ব্যাপার না। দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। সাধনা এবং মনের কনসেনট্রেশন। সাধনা আমি করে যাচ্ছি—সমস্যা একটাই, মনের একাগ্রতাটা আসছে না। মন খুবই বিক্ষিপ্ত।

ও আচ্ছা।

লেভিটেশনের দিকে আমি অনেকটা এগিয়েছি। মাটি থেকে এক ইঞ্চির মতো উঠতে পারি।

ও আচ্ছা।

বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। পাঁচ-দশ সেকেন্ড পারি।

যুবক বিস্মিত চোখে তাকাল। তার বিস্মিত হবার কারণ আছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন আগ্রহশূন্য চোখে। তার ভাবভঙ্গিতে এটা স্পষ্ট যে—মানসিক ক্ষমতাধর যুবকটি বিদায় হলে তিনি খুশি হবেন। তিনি যুবকের শূন্যে ভাসা দেখতে চান না।

স্যার, আমি উঠি?

আচ্ছা!

আমার মেন্টাল ম্যাজিক মনে হয় আপনার ভালো লাগে নি?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। মনসুর বলল, আমার ক্ষমতার ব্যাপারটা কেমন লেগেছে একটু কি বলবেন?

মিসির আলি বললেন, মোটামুটি লেগেছে।

যুবক চাপা গলায় বলল, মানুষের মনের ক্ষমতা অনুভবের ব্যাপার। মানসিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায় না। সেই প্রমাণ আমি দেখালাম তারপরেও আপনি বলছেন মোটামুটি?

হ্যাঁ তা বলছি।

আমি কি জানতে পারি এখন আপনি মোটামুটি না বলে বলবেন—চমৎকার?

মিসির আলি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। অপ্রীতিকর একটা কথা এখন তাঁকে বলতে হবে। বলতে না পারলেই তিনি খুশি হতেন। কিন্তু উপায় নেই। এই যুবক অপ্রীতিকর কথা বলতে তাঁকে বাধ্য করছে।

মনসুর।

জি।

তুমি যদি সত্যি তোমার মানসিক ক্ষমতার কোনো প্রমাণ দেখাতে আমি খুশি হতাম। তুমি যা দেখিয়েছ তা হচ্ছে সাধারণ ম্যাজিকের কৌশল। সিগারেট টেবিলের উপর রেখেছ তারপর মাথা নিচু করে খুব সাবধানে ফুঁ দিয়েছ। তুমি যা দেখিয়েছ তা মানসিক ক্ষমতা না, ফুসফুসের ক্ষমতা।

মনসুর তাকিয়ে আছে। মিসির আলি লক্ষ করলেন, তার চোখ ধক করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। মিসির আলি বললেন, আমি কি ভুল বলেছি?

না।

তুমি তা হলে ওঠো।

আপনার কি এখন কাজ আছে?

আমার এখন কোনো কাজ নেই। কাজ না থাকলেই আমি যে লোকজনের সঙ্গে গল্প করি তা না।

আপনি আমাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছেন?

তা-ও না। আমি খুব ভদ্রভাবে বলার চেষ্টা করছি যে আমি এখন একা থাকতে চাচ্ছি।

আপনার ধারণা আমি একজন ফ্রড, ভাঁওতাবাজ?

তা-ও না। ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে যে ধরনের কথা বলেন তুমিও তাই বলেছ, এতে দোষ ধরার কিছু নেই।

আমার কিন্তু সত্যি সত্যি মানসিক ক্ষমতা আছে। আজ দেখাতে পারলাম না। একদিন এসে দেখিয়ে যাব।

সত্যি ক্ষমতাটা আজ দেখালে তো তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখাতে হতো না।

মনসুর চাপা গলায় বলল, সত্যি ক্ষমতা আমি কাউকে দেখাই না। দেখাতে চাইলেও দেখাতে পারি না। বিশেষ বিশেষ সময়ে এই ক্ষমতা আমার মধ্যে আসে। যদি কখনো আসে আপনাকে দেখাব।

ঠিক আছে।

আপনাকে বিরক্ত করার জন্য এবং আপনার সঙ্গে যে মিথ্যা কথা বলেছি সে জন্য আমি দুঃখিত।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

মোটেই ঠিক নেই। সবই বেঠিক তবে আমি একদিন এসে সব ঠিক করে দিয়ে যাব।

যুবক মাটিতে ফেলে দেয়া তার আধ খাওয়া সিগারেট আবার হাতে নিয়ে ধরাল। তামাকের কটু গন্ধে মাথা ধরে যাবার মতো অবস্থা হল।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। কথাবার্তা পর্ব শেষ হয়েছে এই সিগন্যাল দেয়া হল। এরপরও মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন যুবক নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকবে না। তার সামান্য চক্ষুলজ্জা থাকলে সে চলে যাবে।

স্যার যাই?

মিসির আলি চোখ খুললেন না। মাথা নাড়লেন। মনসুর চলে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেও তা বোঝা যাচ্ছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জুতার শব্দ। মনসুর স্যান্ডেল পরে আসে নি, জুতা পরে এসেছে। কী রকম জুতা, কালো না ব্রাউন? কত দিনের পুরোনো জুতা? জুতার ফিতাগুলো কীভাবে বেঁধেছে? জুতার ফিতা বাঁধা থেকে একজন মানুষের চরিত্র খানিকটা বলে দেয়া যায়। কেউ খুব শক্ত করে ফিতা বাঁধে। কারো ফিতা বাঁধায় ঢিলাঢালা ভাব থাকে। মিসির আলি লক্ষ করেন নি

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায়। তিনিও সম্ভবত বদলাচ্ছেন। আগের মতো খুঁটিয়ে কিছু লক্ষ করছেন না। মনসুর একটা চেকশার্ট পরে এসেছে। এটা মনে আছে। সাদা কাপড়ে নীল সবুজ চেক। শার্টের বুক পকেটে একটা ফাউন্টেন পেন ছিল। ফাউন্টেন পেনের কথা মনে আছে—কারণ আজকাল ফাউন্টেন পেন কেউ ব্যবহার করে না। ফাউন্টেন পেন কেন, বল পয়েন্ট কলমও কেউ সঙ্গে রাখে না। বল পয়েন্ট কলম যেখানে যাওয়া যাবে সেখানেই পাওয়া যাবে, কাজেই সঙ্গে রাখার দরকার কী।

একটা সময় ছিল যখন কলম, ঘড়ি, চশমা এই তিনটি জিনিসকে সাজগোছের অংশ ধরা হতো। ইস্ত্রি করা শার্টের পকেটে থাকবে কলম। চোখে জিরো পাওয়ারের চশমা, হাতে ঘড়ি। রেডিওতে যখন খবর পাঠ করা হবে তখন চট করে হাতঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়াও কালচারের অঙ্গ ছিল। একে বলা হতো রেডিও টাইম। আজকাল কেউ বোধ হয় খবর শুনে ঘড়ির টাইম ঠিক করে না। রেডিও টাইম বলেও বোধ হয় কিছু নেই। রেডিওর পরে অনেক কিছু চলে এসেছে—টিভি টাইম, স্যাটেলাইট টাইম। আচ্ছা মনসুরের হাতে কি ঘড়ি ছিল? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। সম্ভবত ছিল না। থাকলে চোখে পড়ত। কিংবা হয়তো ছিল, তাঁর চোখে পড়ে নি। চোখে পড়ার ক্ষমতা কমে গেছে। বার্ধক্য গুণনাশিনী।

এই যুবকের মধ্যে বিশেষ কিছু কি আছে যা দিয়ে তাকে আলাদা করা যায়? Identification Mark, পাসপোর্টে যেমন লেখা থাকে, অবশ্যই আছে। থাকতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আলাদা। প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ আলাদা। একজন মানুষের আঙুলের ছাপ পৃথিবীর জীবিত বা মৃত কোনো মানুষের সঙ্গে মিলবে না। গায়ের গন্ধ দিয়েও মানুষকে আলাদা করা যায়। প্রতিটি মানুষের গায়ের গন্ধ আলাদা। কুকুর মানুষকে তার চেহারা বা কাপড়-চোপড় দিয়ে চেনে না, চেনে গায়ের গন্ধ দিয়ে।

মিসির আলির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর যুবক কি যাবার আগে তাঁকে হিপনোটাইজি করে গেছে? সন্ধ্যাবেলায় তাঁর কখনো ঘুম আসে না। আজ কেন আসছে? মিসির আলি কয়েকবারই চেষ্টা করলেন ঘুমের ঘোর থেকে উঠে আসতে। পারলেন না। তাঁর চোখের পাতায় কেউ যেন আইকা গাম লাগিয়ে দিয়েছে।

ঘুমাচ্ছেন?

মিসির আলি চোখ মেললেন। বাড়িওয়ালার ভাগ্নি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আজ শাড়ি পরেছে। শাড়িতে তাকে শুধু যে বড় লাগছে তাই না, সুন্দরও লাগছে। কিছুটা সাজগোছও করেছে। গোসল করে চুল বেঁধেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। গলায় সোনার চেইন চিকচিক করছে। দুই হাতে সোনার চুড়ি। পায়ের লাল স্যান্ডেল জোড়াও মনে হয় নতুন। চোখে কাজল দেয়ার জন্য হয়তো—চোখের দিকে তাকালে মায়া-মায়া ভাব হচ্ছে। চোখে কাজল পরলে মায়া ভাব আসে কেন? কালো রঙের সঙ্গে কি মায়া সম্পর্কিত?

তোমার কী খবর রেবু?

জি ভালো। আপনি অসময়ে চেয়ারে বসে ঘুমুচ্ছিলেন কেন? শরীর খারাপ?

ঘুমাচ্ছিলাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম।

আমি কি বসব আপনার সামনের চেয়ারটায়?

বস।

আমি যে প্রায়ই এসে আপনাকে বিরক্ত করি আপনি বিরক্ত হন না তো?

না, আমি বিরক্ত হই না। তা ছাড়া তুমি প্রায়ই আস না তো। হঠাৎ হঠাৎ আস।

মেয়েটা মাথা দুলিয়ে বলল, আমি রোজই আসি। সব দিন আপনার সঙ্গে কথা বলি না। বারান্দা থেকে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যাই। আপনার কাছে আসি না। মামার কারণে আসি না। বারবার আপনার এখানে আসতে দেখলে মামা হয়তো অন্য কিছু ভেবে বসবে।

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী ভাববে?

রেবু শান্ত গলায় বলল, ভাববে আপনার সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে গেছে।

রেবু চেয়ারে বসল। মিসির আলি মেয়েটির কথায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলালেন। চেয়ারে বসার ভঙ্গি খুব ভালো করে লক্ষ করলেন। সব মানুষ একভাবে চেয়ারে বসে না। একেকজন একেকভাবে বসে। কেউ ধপ করে বসে পড়ে। কেউ বসে নরম ভঙ্গিতে। যেন চেয়ারে বসছে না, কারো কোলে বসছে।

রেবু বলল, আজ আমাকে খুব সুন্দর লাগছে না?

হুঁ, লাগছে।

আপনার ঘরে আলো কম তো, এই জন্য ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। আজ আমাকে ফরসাও লাগছে।

ও, আচ্ছা!

আজ আমি এত সাজগোছ করেছি কেন, বলুন তো?

বলতে পারছি না।

কী আশ্চর্য, বলতে পারছেন না কেন? আমার মামার ধারণা আপনার অসম্ভব বুদ্ধি এবং আপনি সবকিছু বলতে পারেন। মামা কী বলে জানেন? মামা বলে, আপনি যে কোনো মানুষকে পাঁচ মিনিট চোখের দেখা দেখে বলে দিতে পারেন দু’দিন আগে দুপুরবেলা সে কোন তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছিল।

মিসির আলি হেসে ফেললেন। রেবুর মামা আজমল সাহেবের তাঁর প্রসঙ্গে উচ্চ ধারণার কথা মিসির আলি জানেন। সেই ধারণা এতটা উঁচুতে তা জানতেন না। মানুষ বাড়িয়ে কথা বলতে ভালবাসে। এই ভদ্রলোক অনেক বেশি ভালবাসেন।

রেবু পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুন তো, আজ দুপুরবেলা আমি কী দিয়ে ভাত খেয়েছি?

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, ইলিশ মাছ দিয়ে। কচুর লতিও রান্না হয়েছিল। তুমি কচুর লতি খাও নি?

রেবু হতভম্ব গলায় বলল, আশ্চর্য কী করে বললেন?

কী করে বললাম সেটা তো আমি বলব না।

প্লিজ বলুন! আমি আপনার পায়ে পড়ি। কথার কথা না। আমি কিন্তু সত্যি আপনার পায়ে ধরব। প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। আমি পাগল টাইপ মেয়ে। যা বলি তা করে ফেলি।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আজ সকালে তোমার মামা যখন বাজার করে ফিরছিলেন তখন আমি বারান্দায় বসা। তোমার মামা বললেন, বাজারে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মাছের মধ্যে শুধু ইলিশ। আমি দেখলাম বাজারের ব্যাগে দু’টা ইলিশ মাছ। আর কচুর লতি। তুমি একবার বলেছিলে তুমি কচুর লতি খাও না। তোমার গলা কুটকুট করে। কাজেই সব মিলিয়ে-ঝিলিয়ে বলেছি। আমার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নেই।

আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম—আপনার অনেক ক্ষমতা।

মিসির আলি হাসলেন। রেবু বলল, আজ আমি সাজগোছ করেছি কারণ হল— আজ বিকেলে আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল। আমাকে বিয়ে দেবার খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রায়ই লোকজন আমাকে দেখতে আসছে।

আজ যাদের দেখতে আসার কথা ছিল তারা দেখতে আসে নি?

উঁহু। খবর পাঠিয়েছে। একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে বলে আসতে পারছে না, পরে এক সময় আসবে। আমার ধারণা এরা আর কোনোদিনই আসবে না।

এরকম ধারণা কেন?

বিয়ের কথাবার্তা হলে সবাই মেয়ে সম্পর্কে গোপনে খোঁজখবর করে। এরাও আমার সম্পর্কে খোঁজ করে ভয়ঙ্কর খবরটা জেনে ফেলেছে। আমার জীবনে একটা

ভয়ঙ্কর খবর আছে।

ভয়ঙ্কর খবরটা কী?

রেবু খুব সহজভাবে বলল, আমার যখন ষোল বছর বয়স তখন আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এক বছরের মতো পাগল ছিলাম। জেনেশুনে কেউ কি আর পাগল বউ ঘরে আনবে?

এখন তো তুমি আর পাগল না?

এখনো পাগল, তবে খুব সামান্য। আচ্ছা আমি উঠি, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো, সন্ধ্যাবেলা আপনার ঘরে বসে থাকলে মামা খুব রাগ করবে। খারাপ কিছু ভাববে। খুব খারাপ কিছু। খুব খারাপ বলতে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পারছেন তো? অবশ্যই বুঝতে পারছেন। আপনার যা বুদ্ধি!

আবার এস।

আপনাকে বলতে হবে না। আমি আসব। আপনি তো আর জানেন না। আপনি আমাকে যা করতে বলবেন আমি তাই করব। আপনি যদি আমাকে রাত তিনটার সময় আসতে বলেন আমি আসব। যদিও জানি আপনি সেটা কখনো করবেন না।

মিসির আলি হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। রেবু ঠিকই বলেছে তার পাগলামি পুরোপুরি সারে নি। এখনো বেশ খানিকটা আছে।

রেবু বলল, আচ্ছা কিছুক্ষণ আগে একটা লোক এসেছিল আপনার কাছে। সে কে?

তার নাম মনসুর

লোকটা অনেকক্ষণ আপনার কাছে ছিল।

হুঁ।

কে আপনার কাছে আসে, কখন আসে, কতক্ষণ থাকে—সব আমি খেয়াল রাখি।

ও আচ্ছা!

লোকটা কিন্তু ভালো না। আপনি ওকে আপনার কাছে আসতে নিষেধ করে দেবেন।

লোকটা ভালো না বুঝলে কী করে?

সে যখন চলে যাচ্ছিল তখন আমি দোতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকটা আমার দিকে তাকাল। খুব খারাপভাবে তাকিয়েছিল। আপনি অবশ্যই তাকে এখানে আসতে নিষেধ করে দেবেন।

আচ্ছা।

যদি দেখি সে আবারো আপনার কাছে এসেছে তাহলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব। আজ যাই?

আচ্ছা।

আপনার জন্য কি চা বানিয়ে ফ্লাস্কে করে পাঠিয়ে দেব?

না, দরকার নেই।

অবশ্যই দরকার আছে। সন্ধ্যাবেলা মানুষের চা খেতে ইচ্ছা করে না! আমি চা পাঠিয়ে দেব। ঘরে যদি কোনো খাবার থাকে তাও পাঠাব। মনে হয় নেই। মামাদের বাসায় বিকেলে নাশতা খাবার চল নেই। সন্ধ্যা মিলাতে না মিলাতে সবাই চা খেয়ে ফেলে। যাই হোক, আমি আপনার জন্য চা পাঠাচ্ছি।

আচ্ছা ঠিক আছে।

সুগার পটে আলাদা করে চিনি দিয়ে দেব। কষ্ট করে নিজে মিশিয়ে নেবেন। পারবেন না?

পারব।

রেবু চলে গেল। মিসির আলি মনে মনে হাসলেন। চা পাঠানোর কথা, নাশতা পাঠানোর কথা এই মেয়ে আগে অনেকবার বলেছে। চা-নাশতা কখনো আসে নি। আজো আসবে না।

মেয়েটি সম্পর্কে মিসির আলি তেমন কিছু জানেন না। সে চাঁদপুরে থাকে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে মামার কাছে বেড়াতে এসেছে। মামা মেয়েটির বিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। রেবু সম্পর্কে এইটুকু তথ্য তাঁর কাছে আছে। আজ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি তথ্য। ষোল বছর বয়সে মেয়েটি পাগল হয়ে গিয়েছিল। খুবই ভয়াবহ তথ্য। ভয়াবহ কারণ পাগলামিকে এক ধরনের অসুখ বলা হলেও এই অসুখের জাত আলাদা। এই অসুখ মানুষের কনসেন্সকে আক্রমণ করে। কনসেন্স হচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব। যে অসুখ অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান দেয়; সেই অসুখ অসুখ না, অন্য কিছু।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মিসির আলি চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা। যেন কোনো একটা জটিল হিসেব মিলছে না।

জটিল হিসেবের ব্যাপারটা আসছে কেন তাও বুঝতে পারছেন না। আজ সারা দিন তিনজন মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে—রেবুর মামা, মনসুর এবং রেবু। এরা এমন কিছু কি করেছে যা তিনি সারা দিন ধরতে পারেন নি—তাঁর অবচেতন মন ধরে ফেলেছে। এবং অবচেতন মন চেতন মনের কাছে একটু পরপর খবর পাঠাচ্ছে। অবচেতন মন খবর পাঠায় নানা ধরনের প্রতীকের মাধ্যমে, ধাঁধার মাধ্যমে। সেই সব প্রতীক এবং রিডলস ডিকোড করার দায়িত্ব চেতন মনের। চেতন মন তা করতে পারছে না।

আচ্ছা, এক এক করে ধরা যাক। প্রথমে রেবুর মামা—আজমল সাহেব।

আজমল হোসেন

বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। রোগা। সামান্য হাঁপানির মতো আছে। জর্দা দিয়ে প্রচুর পান খান। ব্যবসায়ী মানুষ বাড়ি ভাড়া দেন। কর্মী টাইপ। সারা দিন কাজ করেন। রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েন। ব্যবসায়ীদের কখনো সুনিদ্রা হয় না। তাঁর হয়। মোটামুটি রুটিনে বাঁধা জীবন। সপ্তাহে তিন দিন বাজার করেন। বুধ, শুক্র, রবি। রবিবারে আমিন বাজার থেকে গরুর মাংস কেনেন। বৃহস্পতিবার রাতটা ধর্ম-কর্মের জন্য আলাদা করা সেদিন সন্ধ্যায় কাকরাইল মসজিদে যান মাগরেবের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরে এসে তাঁর বাড়ির ছাদের ঘরে জিকির করেন। মিসির আলি এক বছর হল এ বাড়িতে সাবলেট থাকেন। এক বছর রুটিনের ব্যতিক্রম হতে দেখেন নি।

মনসুর নামে যুবকটির কথা ভাবা যাক। মনসুর কি তার আসল নাম? কেন জানি মনে হয় মনসুর তার আসল নাম না। ‘কেন জানি মনে হচ্ছে’ আবার কী? অকারণে মানুষের কিছু মনে হয় না। প্রতিটি মনে হবার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। মনসুর যুবকটির আসল নাম না এটা মনে হবার কারণ কী? মনসুর শব্দটা সে অদ্ভুত ভালো উচ্চারণ করছে এইটা কি কারণ? সেই দুই সিলেবলেই বলে মন সুর। মনসুর যদি যুবকটির নাম হতো তা হলে সে এক সিলেবলেই উচ্চারণ করত। শব্দটির সঙ্গে সে খুব পরিচিত নয় বলেই…

যুক্তিটা মিসির আলির পছন্দ হচ্ছে না। ভাসা ভাসা যুক্তি। মনে হচ্ছে তিনি জলের উপর ওড়াউড়ি করছেন। জল স্পর্শ করতে পারছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *