১৯. এ এক অচেনা নীলু

১৯

নিজের মেয়েকে চিনতে না পারার মতো কষ্টের কি কিছু আছে? জাহিদ সাহেব বসে-বসে তাই ভাবেন। তাঁর বড় অস্থির লাগে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এ-রকম হবে, জানতেন। দুই মেয়ে বড় হবে–এদের বিয়ে হবে, আলাদা জীবন হবে। তিনি পড়ে থাকবেন একা। এ-অবস্থা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। পুরোপুরি সে-রকম অবশ্যি হয় নি। এক মেয়ে তাঁর সঙ্গেই আছে। কিন্তু এই মেয়েকে তিনি চেনেন না। এ এক অচেনা নীলু।

আজ দুপুরে খেতে গিয়ে দেখেন, মাংসের ভুনা তরকারি এবং খিচুড়ি করা হয়েছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘আজ খিচুড়ি যে!

নীলু বলল, ‘তুমি খেতে চেয়েছিলে, তাই।’

জাহিদ সাহেব খেতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কাউকে সে-কথা বলেন নি। নীলুর সঙ্গে গতকাল রাত থেকেই তাঁর কোনো কথা হয় নি। অথচ সে ঠিকই জানল। শুধু আজই নয়, এ-রকম প্রায়ই হয়। বড় অস্বস্তি লাগে। শুধু অস্বস্তি নয়, একটু ভয়ভয়ও করে। একেক রাতে ভয়টা অসম্ভব বেড়ে যায়। কেন বাড়ে, তাও তিনি জানেন না। তাঁর ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যান। যেখানে কেউ তাঁর কোনো খোঁজ পাবে না।

প্রথম এ রকম হল বিলুর বিয়ের চার দিন পর। বিলু নেই। বিয়েবাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা সব চলে গেছে। বাড়ি একেবারেই খালি। মনটন খারাপ করে জাহিদ সাহেব নিজের ঘর ছেড়ে ঘুমাতে গেলেন নীলুর পাশের ঘরে। এক জন কেউ থাকুক আশেপাশে, যাতে ডাকলে সাড়া পাওয়া যায়।

অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম এল না। সামনের জীবন কেমন কাটবে, তাই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মৃত স্ত্রীর কথা মনে করে খানিকক্ষণ কাঁদলেন। প্রথম জীবনে একটি ছেলে হয়েছিল–দেড় বছর বয়সে মারা যায়। মিষ্টি কথা বলত। পাখিকে বলত ‘বাকি। ফুলকে বলত ‘কুল’। অনেক দিন পরে মৃত ছেলের কথা মনে করেও চোখ মুছলেন। আর ঠিক তখন একা অদ্ভুত ব্যাপার হল। চাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধে অভিভূত হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী! ফুলের গন্ধ আসছে কোথেকে? তাঁর নিজের এক সময় বিরাট ফুলের বাগান ছিল। সে-সব আর কিছু নেই। বাগান জঙ্গল হয়েছে।

জাহিদ সাহেব অবাক হয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই নূপুরের শব্দ শুনলেন। খুব হালকা, কিন্তু স্পষ্ট। এর মানে কী? তিনি নীলুর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য। নীলু যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। গভীর রাতে কে এসেছে নীলুর ঘরে? জাহিদ সাহেব ভয়ার্ত গলায় ডাকলেন, ‘নীলু, ও নীলু।’

নীলু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দরজা খুলল।

’কার সঙ্গে কথা বলছিস?’

‘আছে এক জন। তুমি চিনবে না।’

জাহিদ সাহেব ঘরে উকি দিলেন। কাউকে দেখতে পেলেন না। নীলু বলল, ‘ঘুমিয়ে পড় বাবা। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?

জাহিদ সাহেব বললেন, ‘কী হচ্ছে এ-সব! কার সঙ্গে কথা বলছিলি?’

‘ও তুমি বুঝবে না বাবা।’

‘বুঝব না মানে? বুঝব না মানে কী?’

‘অনেক কথা বাবা। পরে তোমাকে বলব।

‘না, এখনি শুনব।’

নীলু বলল, এবং নীলুর কথা তিনি কিছুই বুঝলেন না। একজন—কেউ নীলুর সঙ্গে আছে–যে নীলুকে তার মহাবিপদ থেকে রক্ষা করেছিল। কী অদ্ভুত কথা!

জাহিদ সাহেব দারুণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে লাগলেন। তাঁর ধারণা হল, নীলুর বড় কোনো অসুখ হয়েছে। তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললেন। দু’ জন পীরের কাছ থেকে তাবিজ আনালেন। সেইসব তাবিজ পরতে নীলু কোনো আপত্তি করল না। ডাক্তারদের অষুধপত্র খেতেও তার কোনো অনীহা দেখা গেল না। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না। এবং হবেও না কোনোদিন। তাঁর বাকি জীবন কাটবে অদ্ভুত এই নীলুকে সঙ্গে নিয়ে–যাকে তিনি চেনেন না, বোঝেন না। যে মনের কথা বুঝে ফেলে। যার ঘরে অপরিচিত এক রমণীকণ্ঠ শোনা যায় এবং দমকা হাওয়ার মতো চাঁপা ফুলের গাঢ় গন্ধ যাকে হঠাৎ ঘিরে ফেলে।

.

আজ বুধবার। আকাশে মেঘ নেই। রৌদ্রোজ্জ্বল একটি সুন্দর সকাল। জাহিদ সাহেব অনেক দিন পর উৎফুল্ল বোধ করলেন। তাঁর মনে হল, দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে। নীলু ভালো হয়ে যাবে। তাঁর চমৎকার একটি বিয়ে হবে। ছেলেপুলে আসবে তাদের সংসারে। সেই সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর শেষজীবন ভালোই কাটবে। এক জন মানুষ তো সারা জীবন দুঃখী থাকতে পারে না। দুঃসময়ের পর আসে সুসময়। জীবনচক্রের এই এক কঠিন নিয়ম। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে দুঃসময়টা দীর্ঘ হয়, এই যা। যেমন তাঁর হয়েছে।

জাহিদ সাহেব ডাকলেন, ‘নীলু, নীলু মা।’ অনেক দিন পরে তাঁর কণ্ঠে আনন্দ ঝরে পড়ল।

নীলু এল না। তিনি উঁকি দিলেন নীলুর ঘরে। তার ঘর অন্ধকার। দরজা জানালা বন্ধ। পর্দা টেনে দেয়া, ঘরের বাতাস ভারি হয়ে আছে।

‘কী হয়েছে নীলু?’

‘কিছু হয় নি।’

‘এভাবে শুয়ে আছিস কেন? শরীর ভালো না?’

তিনি নীলুর কপালে হাত দিলেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নীলুর চোখ-মুখ রক্তবর্ণ। তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে মা?’

‘কিছু হয় নি।’

‘কিছু হয় নি মানে? তোর গায়ে তো প্রচণ্ড জ্বর! কখন জ্বর এল? ডাক্তার ডাকা দরকার। এক্ষুণি দরকার।

‘বাবা, এই নিয়ে তুমি ভাববে না। কাউকে ডাকার দরকার নেই।

‘দরকার নেই, বললেই হল!’

‘বাবা, তোমায় পায়ে পড়ি! আমাকে একা থাকতে দাও। বিরক্ত করো না। ভয় নেই, জ্বর সেরে যাবে।’

জাহিদ সাহেব লক্ষ করলেন, নীলু কাঁদছে!

‘মা, কী হয়েছে তোর?’

‘কিচ্ছু হয় নি বাবা। আমি সেরে যাব। আমি আবার আগের মতো হব। যে আমার সঙ্গে থাকত, সে আমাকে বলেছে।

‘সে কে?’

‘আমি নিজেও জানি না, সে কে। এক মহাবিপদে সে আমাকে রক্ষা করেছিল। বাবা, তুমি যাও।’

জাহিদ সাহেব মুখ কালো করে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। চমৎকারভাবে যে-দিনটি শুরু হয়েছিল, সেটি খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। তিনি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে একা-একা বারান্দায় বসে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *