১০. পুলিশ কমিশনার

১০

পুলিশ কমিশনার রাত এগারটায় পুরানা পল্টন এলাকায় এলেন। থমথম করছে চারদিক। একটি ভিখিরিকেও দেখা গেল না। দোকানপাট পর্যন্ত বন্ধ। তিনি লক্ষ করলেন, একতলার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই এই প্রচণ্ড গরমেও জানালা বন্ধ করে শুয়েছে। আতঙ্কের মতো ভয়াবহ কিছুই নেই। এবং পুলিশের শাস্ত্রে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের মতো ভয়াবহ কিছুই নেই। মিছিলের মানুষজন হঠাৎ ক্ষিপ্তের মতো পুলিশের গাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কারণ রাইফেল হাতে পুলিশকে দেখে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়।

সাজ্জাদ হোসেন গাড়ি থেকে নেমে সিগারেট ধরালেন। এ অঞ্চলে টহল পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন তাদের জন্যে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলবেন। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হল, গোরস্থানের ভেতর কিছু ফিক্সড পোস্ট সেন্ট্রি দেয়া দরকার। লুকিয়ে থাকার জন্যে গোরস্থান হচ্ছে আদর্শ জায়গা। কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। একসময় আত্মগোপনকারী দেয়াল টপকে ঝাঁপিয়ে পড়বে অসতর্ক পথচারীর ওপর।

তিন জন পুলিশের একটি দল আসছে গল্প করতে করতে। সাজ্জাদ হোসেন লক্ষ করলেন, এদের সঙ্গে টর্চলাইট নেই। অথচ বলে দেয়া হয়েছিল, পাঁচ-ব্যাটারির একটি টর্চলাইট যেন সঙ্গে থাকে। পুলিশ বাহিনীতে একটি কাজও কি কখনো ঠিকমতো করা হবে না।

‘হন্ট।’

তিন জন দাঁড়িয়ে পড়ল এবং স্যালুট দিল।

‘তোমরা তিন জন কেন? একেকটা দলে দু’ জন করে থাকতে বলেছি। তৃতীয় জন এসে জুটল কীভাবে?’

জানা গেল, এই ব্যবস্থা তারা নিজেরা করে নিয়েছে। তিন জন থাকলে নাকি মনে বেশি সাহস থাকে।

‘তোমরা কি লোহার রড হাতে একটা লোকের ভয়ে আধমরা হয়ে গেছ? এক জন আনসারের সাহসও তো তোমাদের চেয়ে বেশি।’

ওরা কিছু বলল না। তিনি থমথমে গলায় বললেন, ‘মেইন রোড ধরে হাঁটছ কেন? আমি বলেছি না, অলি-গলিতে থাকবে এবং কিছুক্ষণ পরপর বাঁশি বাজাবে? আমি পনের মিনিট এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, একবারও তো তোমাদের বাঁশি শুনলাম না!’

‘বাঁশি শুনলে তো স্যার ঐ ব্যাটা সাবধান হয়ে যাবে। ধরতে পারব না।’

‘ঐ ব্যাটার জন্যে আমার মোটেও মাথাব্যথা নেই। বাঁশি বাজানো দরকার অন্যদের সাহস দেবার জন্যে। যাতে সবাই বুঝতে পারে, ভালো পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। বুঝতে পারছ?’

‘জ্বি স্যার।’

‘আর শোন, রাত একটার পর যাকেই দেখবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। খালিগায়েই হোক কিংবা কোট-প্যান্ট পরাই হোক। বুঝতে পারছ?’

‘জ্বি স্যার।’

সাজ্জাদ হোসেন গোরস্থানে ঢুকলেন। সন্দেহজনক কিছুই কোথাও নেই। টুপিপরা দু’-তিন জন লোক ঘোরাফেরা করছে। এরা গোরস্থানেরই লোক। তবু তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ওদের এক জন হাসি মুখে বলল, ‘গোরস্থানে কোনো আজেবাজে লোক ঢোকে না স্যার। গোরস্থান হইল গিয়া আল্লাহ্ পাকের খাস জায়গা।

সাজ্জাদ হোসেন প্রচণ্ড ধমক দিয়ে তাকে থামালেন। তাঁর আঠার বছরের পুলিশী জীবনে তিনি ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের গোরস্থান এবং মসজিদে লুকিয়ে থাকতে দেখেছেন।

‘তোমরা সজাগ থাকবে এবং লক্ষ রাখবে।‘

‘জ্বি আচ্ছা স্যার।’

‘কাল থেকে গোরস্থানের ভেতরেও আমি পুলিশ বসাব।’

‘জ্বি আচ্ছা স্যার।’

‘যত শুয়োরের বাচ্চা!’

ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পুলিশ সাহেব গালটা কাকে দিলেন, বোঝা গেল না। এই লোকের মেজাজ খারাপ। গোরস্থানের ভেতর কেউ এ-রকম গরম দেখায় না। এত সাহস কারো নেই।

সাজ্জাদ হোসেন তাঁর জীপ নিয়ে আরো খানিকক্ষণ এই অঞ্চলে ঘুরলেন। একটা পাগল-ছাগল রড হাতে বের হয়েছে এবং সেই কারণে এ-জাতীয় পুলিশী তৎপরতার কোনো মানে হয় না। কিন্তু এটা করতে হয়েছে, কারণ এক জন মন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি এই অঞ্চলে। এমনিতেই মন্ত্রীদের যন্ত্রণায় প্রাণ বের হয়ে যায়, তার ওপর ইনি হচ্ছেন নন পার্লামেন্টারিয়ান মন্ত্রী। এঁদের গরমই আলাদা।

তিনি মন্ত্রীসাহেবের শ্বশুরবাড়ির সামনে জীপ থামালেন। বাড়ির সামনেই পুলিশ পাহারা আছে। সব ক’ জন মন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ির সামনে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হলে তো সর্বনাশ! বিশাল এক পুলিশবাহিনী লাগবে মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনদের জন্যে।

সাজ্জাদ হোসেনের মুখ তেতো হয়ে গেল। তিনি শব্দ করে থুথু ফেললেন। মিসির আলির বাড়িও এ-অঞ্চলে। ঠিকানা সঙ্গে নেই। ঠিকানা থাকলে এক বার যাওয়া যেত। মিসির আলির কাজের মেয়েটি সম্পর্কেও তিনি কিছু খোঁজখবর নিয়েছেন। হারিয়ে-যাওয়া বেশকিছু মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো দিয়ে মিসির আলিকে আপাতত ঠাণ্ডা করা যাবে।

সেন্ট্রি এগিয়ে আসছে।

সাজ্জাদ হোসেন বললেন, ‘কী খবর?’

‘খবর স্যার ভালোই।’

‘সব ঠিকঠাক?’

‘জ্বি স্যার। তবে স্যার, এই বাড়ির লোকজন আমার সাথে খুব রাগারাগি করছে।’

কেন?’

‘এরা নাকি দু’ জন সেন্ট্রি চেয়েছিল। এক জন দেখে রেগে গেছে।’

‘দু’ জন লাগবে কেন? এরা কোন দেশের মহারাজ?’

‘স্যার, কী বললেন?’

‘কিছু বলি নি। যাও, ডিউটি দাও।’

‘এরা স্যার জিজ্ঞেস করছিল, তোমাদের ডিউটি অফিসার কে।’

‘তাই নাকি?’

‘জ্বি স্যার। বলছিল, ব্যাটার চাকরি খাব।’

সাজ্জাদ হোসেন আবার থুথু ফেললেন। মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনেরা কথায় কথায় চাকরি খেতে চায়। চাকরি ছাড়া ওদের মুখে অন্য কিছু রোচে না। শালা!

‘সেন্ট্রি।’

‘জ্বি স্যার?’

‘যাও, ডিউটি কর। দেখি, আমি আরেক জনকে পাঠাব।’

সাজ্জাদ হোসেন মনে মনে ভাবলেন, ‘পুলিশের চাকরি করার মানেই হচ্ছে পদে-পদে অপমানিত ও অপদস্থ হওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *