অনীশ – ০৫

আমার বাবা মারা যান, যখন আমার বয়স পনের মাস।

বাবার অভাব আমি বোধ করি নি, কারণ বাবা সম্পর্কে আমার কোনো স্মৃতি নেই। স্মৃতি থাকলেই অভাববোধের ব্যাপারটা চলে আসত। আমাকে মানুষ করেছেন আমার মা। তিনি অত্যন্ত সাবধানী মহিলা। বাবার অভাব যাতে আমি কোনোদিন বুঝতে না-পারি, তার সবরকম চেষ্টা তিনি বাবার মৃত্যুর পর থেকেই করে আসছেন। তিনি যা—যা করেছেন তার কোনোটিই কোনো সুস্থ মহিলা কখনো করবেন না। মা হচ্ছেন একজন অসুস্থ, অস্বাভাবিক মহিলা। যেহেতু জন্ম থেকেই আমি তাঁকে দেখে আসছি, তাঁর অস্বাভাবিকতা আমার চোখে ধরা পড়তে অনেক সময় লেগেছে।

বাবার মৃত্যুর পর ঘর থেকে তাঁর সমস্ত ছবি, ব্যবহারি জিনিস সরিয়ে ফেলা হয়—কিছু নষ্ট করে দেওয়া হয়, কিছু পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমার দাদার বাড়িতে। মা’র যুক্তি ছিল—বাবার স্মৃতিজড়িত কিছু তাঁর চারপাশে রাখতে পারবেন না। স্মৃতির কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর নেই।

বাবা কেমন ছিলেন, তিনি কী করতেন, কী গল্প করতেন—এ-সব নিয়েও মা কখনো আমার সঙ্গে কিছু বলেন নি। বাবার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই তাঁর নাকি অসম্ভব কষ্ট হয়। মা এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বাবার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। বাবার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গেই সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। আমার নাম ‘তিতলী’, যা বাবা আগ্রহ করে রেখেছিলেন তা-ও বদলানো হল। আমার নতুন নাম হল রূপা। তিতলী নাম মা বদলালেন, কারণ এই নাম তাঁকে বাবার কথা মনে করিয়ে দিত।

মা অসম্ভব রূপবতী। আরেকটি বিয়ে করাই মা’র জন্যে স্বাভাবিক ছিল। পাত্রের অভাব ছিল না। রূপবতীদের পাত্রের অভাব কখনো হয় না। মা বিয়ে করতে রাজি হলেন না। বিয়ের বিপক্ষে একটি যুক্তি দিলেন, যে-ছেলেটিকে বিয়ে করব তার স্বভাব—চরিত্র যদি রূপার বাবার চেয়ে খারাপ হয়, তাহলে কখনো তাকে ভালবাসতে পারব না। দিনরাত রূপার বাবার সঙ্গে তার তুলনা করে নিজে কষ্ট পাব, তাকেও কষ্ট দেব। সেটা ঠিক হবে না। আর যদি ছেলেটি রূপার বাবার চেয়ে ভালো হয়, তাহলে রূপার বাবাকে আমি ক্ৰমে-ক্রমে ভুলে যাব। তাও ঠিক হবে না। এই মানুষটিকে আমি ভুলতে চাই না।

আমার মামারা ছাপোষা ধরনের মানুষ। মা’কে নিয়ে তাঁরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কন্যাসহ বোনের বোঝা মাথায় নেবার মত সামর্থ্য বা ইচ্ছা কোনোটাই তাঁদের ছিল না। তবু মা তাঁদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে রইলেন। কিছুদিন তিনি এক ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন, তারপর যান অন্য ভাইয়ের বাসায়। মামারা ধরেই নিলেন মা তাঁর জীবনটা এভাবেই পার করবেন। তাঁরা মা’র সঙ্গে কুৎসিত গলায় ঝগড়া করেন। গালাগালি করেন। মা নির্বিকার। আমার বয়স যখন পাঁচ হল তখন আমাকে বললেন, ‘রূপা, তোকে তো এখন একটা স্কুলে দিতে হয়। ঘুরে-ঘুরে জীবন পার করলে হবে না। আমাকে থিতু হতে হবে। আমি এখন একটা বাসা ভাড়া নেব। সম্ভব হলে একটা বাড়ি কিনে নেব।’

আমি বললাম, ‘টাকা পাবে কোথায়?’

মা বললেন, ‘টাকা আছে। তোর বাবার একটা পয়সাও খরচ করি নি, জমা করে রেখেছি।’

বাবা বিদেশি এক দূতাবাসে চাকরি করতেন। চাকরিকালীন সময়ে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান বলে ইন্সুরেন্স থেকে এবং দূতাবাস থেকে বেশ ভালো টাকাই পেয়েছিলেন। মা সেই টাকার অনেকখানি খরচ করে নয়াটোলায় দোতলা এক বাড়ি কিনে ফেললেন। বেশ বড় বাড়ি। প্রায় এক বিঘা জমি নিয়ে বাড়ি। একতলা দোতলা মিলে অনেকগুলি ঘর। ভেতরের দিকে দুটো আমগাছ, একটা সজনেগাছ, একটা কাঁঠালগাছ। বাড়ি পুরনো হলেও সব মিলিয়ে খুব সুন্দর। একতলাটা পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া হল। আমরা থাকি দোতলায়। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি। মা সেই পাঁচিল আরো উঁচু করলেন। ভারি গেট করলেন। একজন দারোয়ান রাখলেন। আমাদের নতুন জীবন শুরু হল।

নতুন জীবন অনেক আনন্দময় হওয়া উচিত ছিল। মামাদের ঝগড়া-গালাগালি নেই। অভাব-অনটন নেই। এত বড় দোতলায় আমরা দু’ জনমাত্র মানুষ। বাড়িটাও সুন্দর। দোতলায় রেলিং দেওয়া টানা-বারান্দাও আছে। আমার খেলার সঙ্গী-সাথীও আছে। একতলার ভাড়াটের আমার বয়সী দু’টি যমজ মেয়ে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের নিজস্ব বাড়িতে আমার ভয়াবহ জীবন শুরু হল। মা সারাক্ষণ আমাকে আগলে রাখেন। নিজে স্কুলে নিয়ে যান, যে-চারঘন্টা স্কুল চলে মা মাঠে বসে থাকেন। ছুটি হলে আমাকে নিয়ে বাসায় ফেরেন। দুপুরে খাবার পরই আমাকে আমার ঘরে আটকে দেন। ঘুমুতে হবে। বিকেলে যদি বলি, ‘মা, নিচে খেলতে যাই?’

তিনি গম্ভীর মুখে বলেন, ‘না। দোতলার বারান্দায় বসে খেল। খেলার জন্যে নিচে যেতে হবে কেন?’

‘নিচে গেলে কী হবে মা?’

‘তুমি নিচে গেলে আমি এখানে একা-একা কী করব?’

আসল কথা হচ্ছে মা’র নিঃসঙ্গতা। আমি তাঁর একমাত্র সঙ্গী। সেই সঙ্গী তিনি একমুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করবেন না। দিনের পর দিন রাগারাগি করেছি, কান্নাকাটি করেছি, কোনো লাভ হয় নি।

কতবার বলেছি, ‘মা, সবাই কত জায়গায় বেড়াতে যায়—চল আমরাও যাই। বেড়িয়ে আসি।’

‘কোথায় যাবে?’

‘চল কক্সবাজার যাই।’

‘না।’

‘তাহলে চল অন্য কোথাও যাই।’

‘ঢাকার বাইরে যেতে আমার ইচ্ছা করে না।’

‘ঢাকার ভেতরেই কোথাও যাই চল।’

‘কোথায় যেতে চাস?’

‘মামাদের বাড়ি।’

‘না।’

‘বাবার দেশের বাড়িতে যাবে মা? বড়চাচা তো লিখেছেন যেতে।’

‘সেই চিঠি তুমি পড়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন পড়লে? আমি বলি নি—আমার কাছে লেখা কোনো চিঠি তুমি পড়বে না? বলেছি, না বলি নি?’

‘বলেছ।’

‘তাহলে কেন পড়েছ?’

‘আর পড়ব না মা।’

‘এইভাবে বললে হবে না। চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়াও। কানে ধর। কানে ধরে বল—আর পড়ব না।

মা’র চরিত্রে অস্বাভাবিকতার বীজ আগে থেকেই ছিল। যত দিন যেতে লাগল তত তা বাড়তে লাগল। মানুষের মানিয়ে চলার ক্ষমতা অসাধারণ। আমি মা’র সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে লাগলাম, এবং চলতেও লাগলাম। নিজের মনে থাকি। প্রচুর গল্পের বই পড়ি। মাঝে-মাঝে অসহ্য রাগ লাগে। সেই রাগ নিজের মধ্যে রাখি, মা’কে জানতে দিই না। আমার বয়স অল্প হলেও আমি ততদিনে বুঝে গিয়েছি—আমিই মা’র একমাত্র অবলম্বন। তাঁর সমস্ত জগৎ, সমস্ত পৃথিবী আমাকে নিয়েই।

মাঝে-মাঝে মা এমন সব অন্যায় করেন, যা ক্ষমার অযোগ্য। আমি সেই অপরাধও ক্ষমা করে দিই। একটা উদাহরণ দিই। আমি সেবার ক্লাস নাইনে উঠেছি। যারা এস. এস. সি. পরীক্ষা দেবে তাদের ফেয়ারওয়েল হচ্ছে। ফেয়ারওয়েলে নাটক করা হবে। আমাকে নাটকে একটা পার্ট দেওয়া হল। আমার উৎসাহের সীমা রইল না। মা’কে কিছুই জানালাম না। জানালে মা নাটক করতে দেবেন না। মা জেনে গেলেন। গম্ভীর হয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। আমি মা’কে সহজ করার অনেক চেষ্টা করলাম। মা সহজ হলেন না। যেদিন নাটক হবে তার আগের রাতে খাবার টেবিলে মা প্রথমবারের মতো বললেন, ‘তোমাদের নাটকের নাম কি?’

আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম—’হাসির নাটক মা। নাম হচ্ছে—দুই দু’ গুণে পনের। দম ফাটানো হাসির নাটক।’

‘তোমার চরিত্রটা কী?

‘আমি হচ্ছি বড় বোন, পাগলাটে ধরনের মেয়ে। তাকে যে-কাজটি করতে বলা হয় সে সবসময় তার উল্টো কাজটি করে। তারপর খুব অবাক হয়ে বলে—Ohmy God, এটা কী করলাম! আমার অভিনয় খুব ভালো হচ্ছে মা। আমাদের বড়আপা গতকালই আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন—আমার ভেতর অভিনয়ের জন্মগত প্রতিভা আছে। চর্চা করলে আমি খুব নাম করব। মা, তুমি কি নাটকটা দেখবে?’

‘না।’

‘দেখতে চাইলে দেখতে পারবে। এই অনুষ্ঠানে গার্জিয়ানরা আসতে পারবেন না। তবে বড়আপা বলেছেন, যারা অভিনয় করছে তাদের মা’রা ইচ্ছে করলে আসতে পারবেন। তুমি যাবে মা? চল না। প্লীজ।’

মা শুকনো গলায় বললো, ‘দেখি।’

‘তুমি গেলে আমি অসম্ভব খুশি হব মা। অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব খুশি হব। এত খুশি হব যে চিৎকার করে কাঁদব।’

মা কিছু বললেন না। আমার মনে ক্ষীণ আশা হল মা হয়তো যাবেন। আনন্দে সারা রাত আমি ঘুমুতে পারলাম না। তন্দ্রামতো আসে আবার তন্দ্রা ভেঙে যায়। কী যে আনন্দ!

ভোরবেলা দরজা খুলে বেরুতে গিয়ে দেখি দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ। আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, ‘মা-মা-মা।’

মা এলেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘তালাবন্ধ করে রেখেছ কেন মা?’

মা শীতল গলায় বললেন, ‘আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম-তোমার অভিনয় করা ঠিক হবে না।’

‘কী বলছ তুমি মা?’

‘যা সত্যি তাই বলছি।’

‘স্কুলে আপারা কী মনে করবে মা! আমি না-গেলে নাটক হবে না।’

‘না-হলে না-হবে। নাটক এমন কিছু বড় জিনিস না।

‘পরে যখন স্কুলে যাব ওদের আমি কী বলব?’

‘বলবি অসুখ হয়েছিল। মানুষের অসুখ হয় না?’

আমি কাঁদতে-কাঁদতে বললাম, ‘ঠিক আছে মা—আমি স্কুলে যাব না। তুমি তালা খুলে দাও।’

‘তালা সন্ধ্যার সময় খুলব।’

আমি যাচ্ছি না দেখে স্কুলের এক আপা আমাকে নিতে এলেন, মা তাঁকে বললেন, ‘মেয়েটা অসুস্থ। খুবই অসুস্থ। সে মামার বাড়িতে আছে।’ একবার ভাবলাম চিৎকার করে বলি—আপা আমি বাড়িতেই আছি, মা আমাকে তালাবন্ধ করে রেখেছে। পরমুহূর্তেই মনে হল—থাক।

মা তালা খুললেন সন্ধ্যাবেলায়। তাঁকে কিছুমাত্র লজ্জিত বা দুঃখিত মনে হল না।

শুধু রাতে আমার সঙ্গে ঘুমুতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। কান্না দেখে আমি মা’র অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম।

.

আমি যখন ক্লাস টেনে উঠলাম তখন মা আরো একটি বড় ধরনের অপরাধ করলেন। আমাদের একতলায় তখন নতুন ভাড়াটে। তাদের বড় ছেলের নাম আবীর। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে অনার্স পড়েন। লাজুক স্বভাবের ছেলে। কখনো আমার দিকে চোখ তুলে তাকান না। যতবার আমার সঙ্গে দেখা হয় তিনি লজ্জায় লাল হয়ে যান। আমি ভেবে পাই না, আমাকে দেখে উনি এত লজ্জা পান কেন? আমি কী করেছি? আমি তো তাঁর সঙ্গে কথাও বলি না। তাঁর দিকে তাকাইও না।

একদিন সন্ধ্যাবেলা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছাদে গিয়েছি, দেখি, উনি ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন। আমাকে দেখে চমকে উঠে বললেন, ‘আমার বাবা আমাকে আপনাদের এই ছাদটা দেখতে পাঠিয়েছেন, এই জন্যে ছাদে এসেছি। অন্য কিছু না।’

আমি বললাম, ‘ছাদ দেখতে পাঠিয়েছেন কেন?’

‘আমার বড় বোনের মেয়ে হয়েছে। এই বাসায় ওর আকিকা হবে। বাবা বললেন—ছাদে প্যান্ডেল করে লোক-খাওয়াবেন, যদি ছাদটা বড় হয়।

‘ছাদটা কি বড়?’

‘বড় না, তবে খুব সুন্দর। আমি যদি কিছুক্ষণ ছাদে থাকি আপনার মা কি রাগ করবেন?’

‘না, রাগ করবেন কেন?’

‘ওঁকে দেখলেই মনে হয় আমার উপর উনি খুব রাগ করে আছেন। আমার কেন জানি মনে হয়—উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না।’

আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ‘আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। মা শুধু আমার উপর রাগ করেন, আর কারো উপর রাগ করেন না।’

তিনি বললেন, ‘আপনি যে এতক্ষণ ছাদে আছেন, আমার সঙ্গে কথা বলছেন, এটা জানতে পারলে আপনার মা খুব রাগ করবেন।’

‘রাগ করবেন কেন? আর আপনি আমাকে আপনি-আপনি করছেন কেন? শুনতে বিশ্রী লাগছে। আমি আপনার ছোট বোন মীরার চেয়েও বয়সে ছোট। আমাকে তুমি করে বলবেন।’

মনে হল আমার কথা শুনে তিনি খুব ঘাবড়ে গেলেন। আমার দারুণ মজা লাগল। উনি অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘আপনি কি মানে তুমি কি রোজ ছাদে এসে চা খাও?

‘হ্যাঁ। হেঁটে-হেঁটে চা খেতে আমার খুব ভালো লাগে। হেঁটে-হেঁটে চা খাই, আর নিজের সঙ্গে গল্প করি।’

‘নিজের সঙ্গে গল্প কর মানে?’

‘আমার তো গল্প করার কেউ নেই। এই জন্যে নিজের সঙ্গে গল্প করি। আমি একটা প্রশ্ন করি। আবার আমিই উত্তর দিই। আচ্ছা, আপনি চা খাবেন? আপনার জন্যে চা নিয়ে আসব?’

‘না-না-না।’

এ-রকম চমকে উঠে ‘না-না’ করছেন কেন? আপনার জন্যে আলাদা করে চা বানাতে হবে না। মা একটা বড় টী-পটে চা বানিয়ে রেখে দেন। একটু পরপর চা খান। আমি সেখান থেকে ঢেলে এককাপ চা নিয়ে আসব। আপনি আমার মতো হাঁটতে—হাঁটতে চা খেয়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।’

‘ইয়ে—তাহলে দু’ কাপ চা আন। দু’ জনে মিলেই খাই। তোমার মা জানতে পারলে আবার রাগ করবেন না তো?’

‘না, রাগ করবেন না।’

আমি ট্রে-তে করে দু’ কাপ চা নিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে যাচ্ছি—মা ডাকলেন, ‘বুড়ি এদিকে আয়। কি ব্যাপার? চা কার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিস?’

আমি মা’র কথা বলার ভঙ্গিতে ভয়ানক চমকে উঠলাম। কী ভয়ংকর লাগছে মা’কে! হিংস্র কোনো পশুর মতো দেখাচ্ছে। তাঁর মুখে ফেনা জমে গেছে। চোখ টকটকে লাল।

‘তুই কি আবীর ছেলেটির জন্যে চা নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘এতক্ষণ কি ছাদে তার সঙ্গে কথা বলছিলি?’

‘ও কি তোর হাত ধরেছে?’

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘এ-সব কী বলছ মা!’

‘হ্যাঁ কি না?’

‘মা, আমি শুধু দু’–একটা কথা…’

‘শোন্ বুড়ি, তুই এখন আমার সঙ্গে নিচে যাবি। ঐ বদ ছেলের মা’কে তুই বলবি—আপনার ছেলে আমার গায়ে হাত দিয়েছে। আমি ঐ বদ ছেলেকে শিক্ষা দেব, তারপর বাড়ি থেকে তাড়াব। কাল দিনের মধ্যেই এই বদ পরিবারটাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে হবে।

আমি কাঁদতে-কাঁদতে বললাম, ‘এ-সব তুমি কী বলছ মা?’

মা হিসহিস করে বললেন, ‘আমি যা বললাম তা যদি না করিস, আমি তোকে খুন করব। আল্লার কসম আমি তোকে খুন করব। আয় আমার সঙ্গে, আয় বললাম, আয়।’

আমি কাঁদতে-কাঁদতে মা’র সঙ্গে নিচে গেলাম। মা আবীরের মা’কে কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনার ছেলে আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে। আপনার ছেলেকে ডেকে আনুন। এর বিচার করুন।

ছেলের মা হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘আপা, আপনি এ-সব কী বলছেন? আমার ছেলে এ-রকম নয়। আপনি ভুল সন্দেহ করছেন। আবীর এমন নোংরা কাজ কখনো করবে না।’

‘আপনি আপনার ছেলেকে ডেকে আনুন। আমি তার সামনেই কথা বলব।’

উনি এসে দাঁড়ালেন। লজ্জায় ভয়ে বেচারা এতটুক হয়ে গেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মা আমাকে বললেন, ‘বুড়ি বল, বল তুই। এই বদ ছেলে কি তোর গায়ে হাত দিয়েছে? সত্য কথা বল্। সত্য কথা না-বললে তোকে খুন করে ফেলব। বল্ এই ছেলে কি তোর গায়ে হাত দিয়েছে?’

আমি কাঁদতে-কাঁদতে বললাম, ‘হ্যাঁ, দিয়েছে।’

‘বুকে হাত দিয়েছে কি না বল্। দিয়েছে বুকে হাত? ‘হ্যাঁ।’

মা কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনি নিজের কানে শুনলেন আমার মেয়ে কি বলল, এখন ছেলেকে শাস্তি দেবেন বা দেবেন না সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমার কথা হল আগামীকাল দুপুরের আগে আপনারা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।’

আমি এক পলকের জন্যে তাকালাম আবীর ভাইয়ের দিকে। তিনি পলকহীন চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। সেই চোখে রাগ, ঘৃণা বা দুঃখ নেই; শুধুই বিস্ময়।

তাঁরা পরদিন দুপুরে সত্যি-সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। রাতে মা আমার সঙ্গে ঘুমুতে এসে, আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে লাগলেন। আমি মনে-মনে বললাম, ‘মা, তোমাকে আমি ক্ষমা করতে চেষ্টা করছি, পারছি না। তুমি এমন করে কেঁদো না মা। আমার কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছি। আর কষ্ট দিও না।’

.

প্রথম পর্যায়ের লেখা এই পর্যন্তই। তারিখ দেওয়া আছে। সময় লেখা—রাত দু’টা পনের। সময়ের নিচে লেখা—একটানা অনেকক্ষণ লিখলাম। ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমুতে যাব। মা আমার বিছানায় এসে শুয়েছেন। আজ সারা দিন হাঁপানিতে কষ্ট পেয়েছেন। এখন সম্ভবত হাঁপানিটা কমেছে। আরাম করে ঘুমুচ্ছেন। আজ সারা দিন মা’র নামাজ কাজা হয়েছে। ঘুম ভাঙলে কাজা নামাজ শুরু করবেন। রাত পার করে দেবেন নামাজে কাজেই মা’র ঘুম না ভাঙিয়ে খুব সাবধানে বিছানায় যেতে হবে।

মিসির আলি তাঁর নোটবই বের করে পয়েন্ট নোট করতে বসলেন। পয়েন্ট একটিই—মেয়ের মা’র চরিত্রে যে-অস্বাভাবিকতা আছে তা মেয়ের মধ্যেও চলে এসেছে। মেয়ে নিজে তা জানে না। সে নিজেকে যতটা স্বাভাবিক ভাবছে তত স্বাভাবিক সে নয়। একটি স্বাভাবিক মেয়ে তার মৃত বাবার জন্যে অনেক বেশি ব্যস্ততা দেখাত। এত বড় একটি লেখার কোথাও সে বাবার নাম উল্লেখ করে নি। এমন না যে বাবার নাম তার অজানা। মা’র সম্পর্কে রূপবতী শব্দটি সে ব্যবহার করেছে—বাবা সম্পর্কে কিছুই বলে নি। তার মা, এত বড় একটা কাণ্ড করার পরেও মা’র কষ্টটাই তার কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে সে মা’র কাছ থেকে আলাদা করতে পারছে না। এর ফলাফল সাধারণত শুভ হয় না। এত বড় ঘটনার পরেও যে মা’র কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারছে না—সে আর কোনোদিনও পারবে না।

মিসির আলি রূপার খাতার পাতা ওল্টালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *