অনীশ – ০১

হাসপাতালের কেবিন ধরাধরি ছাড়া পাওয়া যায় না, এই প্রচলিত ধারণা সম্ভবত পুরোপুরি সত্যি নয়। মিসির আলি পেয়েছেন, ধরাধরি ছাড়াই পেয়েছেন। অবশ্যি জেনারেল ওয়ার্ডে থাকার সময় একজন ডাক্তারকে বিনীতভাবে বলেছিলেন, ‘ভাই একটু দেখবেন—একটা কেবিন পেলে বড় ভালো হয়।’ এই সামান্য কথাতেই কাজ হবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আজকাল কথাতে কিছু হয় না। যে-ডাক্তারকে অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি বুড়ো। মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হয় সমগ্র মানবজাতির ওপরই তিনি বিরক্ত। কোনো ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মানবজাতি নিঃশেষ হয়ে আবার যদি এককোষী এ্যামিবা থেকে জীবনের শুরু করে তাহলে তিনি খানিকটা আরাম পান। তাঁকে দেখে মনে হয় নি তিনি মিসির আলির অনুরোধ মনে রাখবেন। কিন্তু ভদ্রলোক মনে রেখেছেন। কেবিন জোগাড় হয়েছে পাঁচতলায়। রুম নাম্বার চার শ নয়।

সব জায়গায় বাংলা প্রচলন হলেও হাসপাতালের সাইনবোর্ডগুলি এখনো বদলায় নি। ওয়ার্ড, কেবিন, পেডিয়াট্রিকস—এ-সব ইংরেজিতেই লেখা। শুধু রোমান হরফের জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা হরফ। হয়তো এগুলির সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায় নি। কেবিনের বাংলা কী হবে? কুটির? জেনারেল ওয়ার্ডের বাংলা কি ‘সাধারণ কক্ষ’?

যতটা উৎসাহ নিয়ে মিসির আলি চার শ’ ন’ নম্বর কেবিনে এলেন ততটা উৎসাহ থাকল না। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করলেন—বাথরুমের ট্যাপ বন্ধ হয় না। যত কষেই প্যাচ আটকানো যাক, ক্ষীণ জলধারা ঝরনার মতো পড়তেই থাকে। কমোডের ফ্ল্যাশও কাজ করে না। ফ্ল্যাশ টানলে ঘড়ঘড় শব্দ হয় এবং কমোডের পানিতে সামান্য আলোড়ন দেখা যায়। এই পর্যন্তই। তার চেয়েও ভয়াবহ আবিষ্কারটা করলেন রাতে ঘুমোতে যাবার সময়। দেখলেন বেডের পাশে সাদা দেয়ালে সবুজ রঙের মার্কার দিয়ে লেখা—

‘এই ঘরে যে থাকবে
সে মারা যাবে।
ইহা সত্য। মিথ্যা নয়।।’

মিসির আলির চরিত্র এমন নয় যে এই লেখা দেখে তিনি আঁৎকে উঠবেন এবং জেনারেল ওয়ার্ডে ফেরত যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তবে বড় রকমের অসুখবিসুখের সময় মানুষের মন দুর্বল থাকে। মিসির আলির মনে হল তিনি মারাই যাবেন। সবুজ রঙের এই ছেলেমানুষি লেখার কারণে নয়, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মে। তাঁর লিভার কাজ করছে না বললেই হয়! মনে হচ্ছে লিভারটির আর কাজ করার ইচ্ছেও নেই। শরীরের একটি অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে অন্য অঙ্গগুলিও তাকে অনুসরণ করে। একে বলে সিমপ্যাথেটিক রিঅ্যাকশন। কারো একটা চোখ নষ্ট হলে অন্য চোখের দৃষ্টি কমতে থাকে। তাঁর নিজের বেলাতেও মনে হচ্ছে তাই হচ্ছে। লিভারের শোকে শরীরের অন্যসব অঙ্গ—প্রত্যঙ্গগুলিও কাতর। একসময় ফট করে কাজ বন্ধ করে দেবে। হৃৎপিন্ড বলবে-কী দরকার গ্যালন গ্যালন রক্ত পাম্প করে? অনেক তো করলাম। শুরু হবে অনির্দিষ্টের পথে যাত্রা। সেই যাত্রা কেমন হবে তিনি জানেন না। কেউই জানে না। প্রাণের জন্ম-রহস্য যেমন অজানা, প্রাণের বিনাশ-রহস্যও তেমনি অজানা।

তিনি শুয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। বেল টিপে নার্সকে ডাকলেই সে কড়া কোনো ঘুমের অষুধ খাইয়ে দেবে। মিসির আলির ধারণা, এরা ঘুমের ট্যাবলেট এ্যাপ্রনের পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রুগীর সামান্য কাতরানির শব্দ কানে যাওয়ামাত্র ঘুমের ট্যাবলেট গিলিয়ে দেয়। কাজেই ওদের না-ডেকে মাথার যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে থাকাই ভালো। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর পরের জগৎ নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে।

ধরা যাক মৃত্যুর পরে একটি জগৎ আছে। পার্টিকেলের যদি অ্যান্টি-পার্টিকেল থাকতে পারে, ইউনিভার্সের যদি অ্যান্টি-ইউনিভার্স হয়, তাহলে শরীরের এ্যান্টি—শরীর থাকতে সমস্যা কী? যদি মৃত্যুর পর কোনো জগৎ থাকে কী হবে সেই জগতের নিয়ম-কানুন? এ-জগতের প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন কি সেই জগতেও সত্যি? এখানে আলোর গতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল, সেখানেও কি তাই? নিউটনের গতিসূত্র কি সেই জগতের জন্যেও সত্যি? হাইজেনবার্গের আনসার্টিনিটি প্রিন্সিপ্‌ল? একই সময়ে বস্তুর গতি এবং অবস্থান নির্ণয় করা অসম্ভব। পরকালেও কি তাই? নাকি সেখানে এটি খুবই সম্ভব?

মিসির আলি কলিং বেলের সুইচ টিপলেন। প্রচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে। বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছেন না, আবার একা-একা বাথরুম পর্যন্ত যাবার সাহস ও পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে বাথরুমের দরজায় পড়ে যাবেন।

অল্পবয়েসী একজন নার্স ঢুকল। তার গায়ের রঙ কালো, মুখে বসন্তের দাগ, তার পরেও চেহারায় কোথায় যেন একধরনের স্নিগ্ধতা লুকিয়ে আছে। মিসির আলি বললেন, এত রাতে আপনাকে ডাকার জন্যে আমি খুব লজ্জিত। আপনি কি আমাকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে যাবেন? আমি বমি করব।

‘বাথরুমে যেতে হবে না। বিছানায় বসে-বসেই বমি করুন—আপনার খাটের নিচে গামলা আছে।’

সিস্টার মিসির আলিকে ধরে-ধরে বসালেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, বমি ভাব সঙ্গে—সঙ্গে কমে গেল। মিসির আলি বললেন, ‘সিস্টার, আপনার নাম জানতে পারি?’

‘আমার নাম সুস্মিতা। আপনি কি এখন একটু ভালো বোধ করছেন?’

‘বমি গলা পর্যন্ত এসে থেমে আছে। এটাকে যদি ভালো বলেন তাহলে ভালো।’

‘আপনার কি মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?’

‘হচ্ছে।’

‘খুব বেশি?’

‘হ্যাঁ, খুব বেশি।’

‘আপনি শুয়ে থাকুন। আমি রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ানকে ডেকে নিয়ে আসছি। তিনি হয়তো আপনাকে ঘুমের কোনো অষুধ দেবেন। তা ছাড়া আপনার গা বেশ গরম। মনে হচ্ছে টেম্পারেচার দুই-এর উপরে।’

সুস্মিতা জ্বর দেখল। এক শ’ দুই পয়েন্ট পাঁচ। সে ঘরের বাতি নিভিয়ে ডাক্তারকে খবর দিতে গেল।

মিসির আলি লক্ষ করছেন, তাঁর মাথার যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে। ঘর অন্ধকার, তবু চোখ বন্ধ করলেই হলুদ আলো দেখা যায়। চোখের রেটিনা সম্ভবত কোনো কারণে উত্তেজিত। ব্যথার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি? আচ্ছা—জ্বর মাপার যন্ত্র আছে থার্মোমিটার! ব্যথা মাপার যন্ত্র এখনো বের হল না কেন? মানুষের ব্যথা-বোধের মূল কেন্দ্র—মস্তিষ্ক। স্নায়ু ব্যথার খবর মস্তিষ্কে পৌছে দেয়। যে-ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ব্যথার পরিমাপক, সেই সিগন্যাল মাপা কি অসম্ভব?

ব্যথা মাপার একটা যন্ত্র থাকলে ভালো হত। প্রসববেদনার তীব্রতা নাকি সবচেয়ে বেশি। তার পরেই থার্ড ডিগ্রী বার্ন। তবে ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতাও একেক মানুষের একেক রকম। কেউ-কেউ অতি তীব্র ব্যথাও শান্তমুখে সহ্য করতে পারে। মিসির আলি পারেন না। তাঁর ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকতে। ব্যথা ভোলবার জন্যে কী করা যায়? মস্তিষ্ককে কি কোনো জটিল প্রক্রিয়ায় ফেলে দেওয়া যায় না? উল্টো করে নিজের সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? কিংবা একই বাক্য চক্রাকারে বলা যায় না?

শিবে বন্ধু কি থাব্য?

শিবে বন্ধু কি থাব্য?

শিবে বন্ধু কি থাব্য?

নার্স ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বাতি জ্বালাল। ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

মিসির আলি বললেন, ‘আমার ডেলিরিয়াম হচ্ছে। একটি বাক্য বারবার উল্টো করে বলছি।’ব্যথা কি খুব বেশি’’—এই বাক্যটিকে আমি উল্টো করে বলছি, ‘শিবে বন্ধু কি থাব্য?

ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘কোনো রুগীর যখন ডেলিরিয়াম হয়, সে বুঝতে পারে না যে ডেলিরিয়াম হচ্ছে।’

‘আমি বুঝতে পারি। কারণ আমার কাজই হচ্ছে মানুষের মনোজগৎ নিয়ে। ডাক্তার সাহেব, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিন। সম্ভব হলে খানিকটা অক্সিজেন দেবারও ব্যবস্থা করুন। আমার মস্তিষ্কে অক্সিজেন ডিপ্রাইভেশন হচ্ছে। আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে।

‘কি হেলুসিনেশন?’

‘আমি দেখছি আমার হাত দুটো অনেক লম্বা হয়ে গেছে। এখনো লম্বা হচ্ছে।’

মিসির আলি গানের সুরে বলতে লাগলেন—

‘ম্বাল তক তহা রমাআ।
ম্বাল তক তহা রমাআ।
ম্বাল তক তহা রমাআ।’

ডাক্তার সাহেব নার্সকে প্যাথিড্রিন ইনজেকশান দিতে বললেন।

.

মিসির আলির ঘুম ভাঙল সকাল ন’টার দিকে।

ট্রে–তে করে হাসপাতালের নাশতা নিয়ে এসেছে। দু’ স্লাইস রুটি, একটা ডিম সেদ্ধ, একটা কলা এবং আধ গ্লাস দুধ। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটির জন্যে বেশ ভালো খাবার—স্বীকার করতেই হবে। তবু বেশির ভাগ রুগী এই খাবার খায় না। তাদের জন্যে টিফিন ক্যারিয়ারে ঘরের খাবার আসে। ফ্লাস্কে আসে দুধ।

জেনারেল ওয়ার্ডের অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। সেখানকার রুগীরা হাসপাতালের খাবার খুব আগ্রহ করে খায়। যারা খেতে পারে না, তারা জমা করে রাখে। বিকেলে তাদের আত্মীয়স্বজনরা আসে। মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে এই খাবারগুলি তারা খেয়ে ফেলে। সামান্য খাবার, অথচ কী আগ্রহ করেই-না খায়! বড়ো মায়া লাগে মিসির আলির। কতবার নিজের খাবার ওদের দিয়ে দিয়েছেন। ওরা কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়েছে।

আজকের নাশতা মিসির আলি মুখে দিতে পারলেন না। পাউরুটিতে কামড় দিতেই বমি ভাব হল। এক চুমুক দুধ খেলেন। কলার খোসা ছাড়ালেন, কিন্তু মুখে দিতে পারলেন না। শরীর সত্যি-সত্যি বিদ্রোহ করেছে।

খাবার নিয়ে যে এসেছে, সে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। রুগী খাবার খেতে পারছে না, এই দৃশ্য নিশ্চয়ই তার কাছে নতুন নয়। তবু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দুঃখিত। লোকটি স্নেহময় গলায় বলল, ‘কষ্ট কইরা খান। না-খাইলে শরীরে বল পাইবেন না।’

মিসির আলি শুধুমাত্র লোকটিকে খুশি করবার জন্যে পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে মুখে দিলেন। খেতে কেমন যেন ঘাসের মতো লাগছে।

আজ শুক্রবার।

শুক্রবারে রুটিন ভিজিটে ডাক্তাররা আসেন না। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁদের ঘর—সংসার আছে, পুত্র-কন্যা আছে। জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী আছে। একটা দিন কি তাঁরা ছুটি নেবেন না? অবশ্যই নেবেন। মিসির আলি ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর কাছে কেউ আসবে না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে এ্যাপ্রন গায়ে মাঝবয়েসী এক ডাক্তার এসে উপস্থিত। ডাক্তার আসার এটা সময় নয়। প্রথমত শুক্রবার, দ্বিতীয়ত দেড়টা বাজে, লাঞ্চ ব্রেক। ডিউটির ডাক্তাররাও এই সময় ক্যান্টিনে খেতে যান।

ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘কেমন আছেন?’

মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, ‘ভালো থাকলে কি হাসপাতালে পড়ে থাকি?’

‘আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে ভালো আছেন। কাল রাতে খুব খারাপ অবস্থায় ছিলেন। প্রবল ডেলিরিয়াম

‘আপনি রাতে এসেছিলেন?’

‘জ্বি।’

‘চিনতে পারছি না। মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। গত রাতে কী ঘটেছে কিচ্ছু মনে নেই।’

ডাক্তার সাহেব চেয়ারে বসলেন। তাঁর শরীর বেশ ভারি। শরীরের সঙ্গে মিল রেখে গলার স্বর ভারি। চশমার কাঁচ ভারি। সবই ভারি ভারি, তবুও মানুষটির কথা বলার মধ্যে সহজ হালকা ভঙ্গি আছে। এ-জাতীয় মানুষ গল্প করতে এবং গল্প শুনতে ভালবাসে। মিসির আলি বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি বলুন।’

‘একটা সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এই কেবিনটা ছেড়ে অন্য একটা কেবিনে চলে যেতে পারেন। একজন মহিলা এই কেবিনে আসতে চাচ্ছেন।’

মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘আমি এই মুহূর্তে কেবিন ছেড়ে দিচ্ছি।’

‘এই মুহূর্তে ছাড়তে হবে না। কাল ছাড়লেও হবে।’

ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিসির আলি বললেন, ‘ভদ্রমহিলা বিশেষ করে এই কেবিনে আসতে চাচ্ছেন কেন?’

‘তাঁর ধারণা, এই কেবিন খুব লাকি। কেবিনের নম্বর চার শ’ নয়। যোগ করলে হয় তের। তের নম্বরটি নাকি তাঁর জন্যে খুব লাকি। সৌভাগ্য-সংখ্যা। নিউমোরলজি’—র হিসাব।’

‘কী অদ্ভুত কথা!’

ডাক্তার সাহেব হালকা স্বরে বললেন, ‘অসুস্থ অবস্থায় মন দুর্বল থাকে। দুর্বল মনে তের নম্বরটি ঢুকে গেলে সমস্যা।’

‘মনের মধ্যে যা ঢুকেছে তা বের করে দিন।’

ডাক্তার সাহেব হেসে ফেলে বললেন, ‘এটা তো কোনো কাঁটা না রে ভাই, যে,চিমটা দিয়ে বের করে নিয়ে আসব। এর নাম কুসংস্কার। কুসংস্কার মনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শিকড় ছড়িয়ে দেয়। কুসংস্কারকে তুলে ফেলা আমার মতো সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। যাই ভাই। আপনি তাহলে কাল ভোরে কেবিন নম্বর চার শ’ পাঁচে চলে যাবেন। কেবিনটা সিঁড়ির কাছে না, কাজেই হৈ-চৈ হবে না। তা ছাড়া জানালার ভিউ ভালো। গাছপালা দেখতে পারবেন।’

মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি এই রুম ছাড়ব না। এখানেই থাকব।

ডাক্তার সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকালেন। কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মিসির আলি বললেন, ‘রুম ছাড়ব না, কারণ ছাড়লে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। আমি এই জীবনে কুসংস্কার প্রশ্রয় দেবার মতো কোনো কাজ করি নি। ভবিষ্যতেও করব না।’

‘ও, আচ্ছা।

‘আপনি যদি অন্য কোনো কারণ বলতেন, রুম ছেড়ে দিতাম। আমার কাছে চার শ’ নয় নম্বর যা, চার শ’ পাঁচ-ও তা। তফাত মাত্র চারটা ডিজিটের।

ডাক্তার সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘আপনি কি ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলবেন? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভদ্রমহিলা এ-ঘরে না-আসা পর্যন্ত অপারেশন করাবেন না। অপেক্ষা করবেন। অথচ অপারেশনটা জরুরি।’

‘ওঁর অসুবিধা কী?’

‘কিডনির কাছাকাছি একটা সিস্টের মতো হয়েছে। আপনি যদি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন তাহলে ভালো হয়। ভদ্রমহিলাকে আপনি চেনেন।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। ভালো করেই চেনেন। উনি অনুরোধ করলে না বলতে পারবেন না।’

‘নাম কি তাঁর?’

‘আমি ওঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি কথা বলুন।’

.

মিসির আলি তাকিয়ে আছেন।

দরজা ধরে যে-মহিলা দাঁড়িয়ে, তাঁর বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হলেও তাঁকে দেখাচ্ছে বালিকার মতো। লম্বাটে মুখ, কাটা-কাটা চেহারা। অসম্ভব রূপবতী। সাধারণত রূপবতীরা মানুষকে আকর্ষণ করে না—একটু দূরে সরিয়ে রাখে। এই মেয়েটির মধ্যে আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি বলল, ‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?

‘না।’

‘সে কী, চেনা উচিত ছিল তো! আপনি সিনেমা দেখেন না নিশ্চয়ই?’

‘না।’

‘টিভি? টিভিও দেখেন না? টিভি দেখলেও তো আমাকে চেনার কথা!’

‘আমার টিভি নেই। বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে অবশ্যি মাঝে-মাঝে দেখি। আপনি কি কোনো অভিনেত্রী?’

‘হ্যাঁ। এলেবেলে টাইপ অভিনেত্রী নই। খুব নামকরা। রাস্তায় বের হলে ‘ট্রাফিক জ্যাম’ হয়ে যাবে।’

মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিতে মিসির আলি হেসে ফেললেন। মেয়েটিও হাসল। অভিনেত্রীর মাপা হাসি নয়, অন্তরঙ্গ হাসি। সহজ-সরল হাসি।

‘আপনি কিন্তু এখনো আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি।’

‘কী নাম?’

‘আসমানী। এটা আমার আসল নাম। সিনেমার জন্যে আমার ভিন্ন নাম আছে। সেই নাম আপনার জানার দরকার নেই। ভেতরে আসব?’

‘আসুন।’

মেয়েটি ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল। গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর করে বলল, ‘শুনলাম আপনি নাকি কুসংস্কার সহ্য করতে পারেন না।’

‘ঠিকই শুনেছেন। সহ্য করি না এবং প্রশ্রয় দিই না।’

‘কুসংস্কার-টুসংস্কার কিছু না। আপনি আপনার ঘরটা আমাকে ছেড়ে দিন। আমার এই কেবিনটা খুব পছন্দ। আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি। প্লীজ।’

মেয়েটি সত্যি-সত্যি হাতজোড় করল। মিসির আলি লজ্জায় পড়ে গেলেন। এ কী কাণ্ড!

‘আমি এক্ষুণি ছেড়ে দিচ্ছি। হাতজোড় করতে হবে না।’

‘থ্যাংকস!’

থ্যাংকস বলারও প্রয়োজন নেই, তবে আমার ধারণা, এই কেবিনটিতেও শেষ পর্যন্ত আপনি থাকতে রাজি হবেন না।’

‘এ-রকম মনে হবার কারণ কী?’

‘আপনি রাতে যখন ঘুমুতে যাবেন তখন হঠাৎ করে দেয়ালের একটা লেখা আপনার চোখে পড়বে—সবুজ মার্কারে কাঁচা-কাঁচা হাতে লেখা—

এই ঘরে যে থাকবে
সে মারা যাবে।
ইহা সত্য, মিথ্যা নয়।

লেখা পড়েই আপনি আঁৎকে উঠবেন। যেহেতু আপনার মন খুব দুর্বল, সেহেতু আপনি আর এখানে থাকবেন না।’

আসমানী বলল, ‘কোথায় লেখাটা—দেখি।’

তিনি লেখাটা দেখালেন। আসমানী বলল, ‘কে লিখেছে?’

মিসির আলি থেমে-থেমে বললেন, ‘যে লিখেছে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, তবে আমি অনুমান করতে পারি, একটি বাচ্চা মেয়ের লেখা। মেয়েটির উচ্চতা চার ফুট দু’ ইঞ্চি। এবং মেয়েটি এই ঘরেই মারা গেছে।’

আসমানী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এ-সব আপনার অনুমান?’

‘জ্বি, অনুমান। তবে যুক্তিনির্ভর অনুমান।’

‘যুক্তিনির্ভর অনুমান মানে?’

‘এক-এক করে বলি। এটা একটা মেয়ের লেখা তা অনুমান করছি দেয়ালে আঁকা কিছু ছবি দেখে। সবুজ মার্কারে আঁকা বেশ কিছু ছবি আছে, সবই বেণী-বাঁধা বালিকাদের ছবি। মেয়েরা একটা বয়স পর্যন্ত শুধু মেয়েদের ছবি আঁকে।

‘তাই বুঝি?’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘আর মেয়েটির উচ্চতা কীভাবে আঁচ করলেন?’

‘মেয়েটির উচ্চতা আঁচ করেছি আরো সহজে। আমরা যখন দেয়ালে কিছু লিখি, তখন লিখি চোখ বরাবর। মেয়েটি বিছানায় বসে-বসে লিখেছে। সেখান থেকে তার উচ্চতা আঁচ করলাম।’

‘দাঁড়িয়েও তো লিখতে পারে। হয়তো মেঝেতে দাঁড়িয়ে লিখেছে।’

‘তা পারে। তবে মেয়েটি অসুস্থ। বিছানায় বসে-বসে লেখাই তার জন্যে যুক্তি—সঙ্গত।’

আসমানী গম্ভীর গলায় বলল, ‘মেয়েটি যে বেঁচে নেই তা কী করে অনুমান করলেন? কাউকে জিজ্ঞেস করেছেন?’

‘না, কাউকে জিজ্ঞেস করি নি। এটাও অনুমান। বাচ্চারা দেয়ালে লেখার ব্যাপারে খুবই পার্টিকুলার। যা বিশ্বাস করে তা-ই সে দেয়ালে লেখে। যদি বাচ্চাটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যেত তাহলে অবধারিতভাবে এই লেখার জন্যে সে লজ্জিত বোধ করত এবং হাসপাতাল ছেড়ে যাবার আগে লেখাটি নষ্ট করে যেত।’

‘আপনি কী করেন জানতে পারি?’

‘মাস্টারি করতাম, এখন করি না। পার্ট টাইম টীচার ছিলাম। অস্থায়ী পোস্ট। চাকরি চলে গেছে।’

‘আপনি আমাকে দেখে কি আমার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?’

‘একটা সামান্য কথা বলতে পারি—আপনার আসল নাম আসমানী নয়। অন্য কিছু।’

‘এ-রকম মনে হবার কারণ কী?’

‘আসমানী নামটি আপনি এমনভাবে বললেন যাতে আমার কাছে মনে হল অচেনা একটি শব্দ বলছেন। তার চেয়েও বড় কথা আপনার পরনে আসমানী রঙের একটি শাড়ি। শাড়িটি পরার পর থেকেই হয়তো আসমানী নামটা আপনার মাথায় ঘুরছে। প্রথম সুযোগে এই নামটি বললেন।’

‘আমার ডাক নাম ‘বুড়ি’।’

মিসির আলি কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বুড়ি বলল, ‘আপনি অনুমানগুলি কীভাবে করেন?

‘লজিক ব্যবহার করে করি। সামান্য লজিক। লজিক ব্যবহার করার ক্ষমতা সবার মধ্যেই আছে। বেশির ভাগ মানুষই তা ব্যবহার করে না। যেমন আপনি ব্যবহার করছেন না। ভেবে বসে আছেন চার শ’ নয় নম্বর ঘরটি আপনার জন্যে লাকি। এ-রকম ভাবার পিছনে কোনো লজিক নেই।’

‘লজিকই কি এই পৃথিবীর শেষ কথা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে লজিকই হচ্ছে পৃথিবীর শেষ কথা—। লজিকের বাইরে কিছু নেই? পৃথিবীর সমস্ত রহস্যের সমাধান আছে লজিকে, পারবেন বলতে?’

‘পারব।’

‘ভালো কথা। শুনে খুশি হলাম। আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?’

‘আমার নাম মিসির আলি। আপনি কি কাল ভোরে এই কেবিনে আসতে চান? না মত বদলেছেন?’

‘আমি কাল ভোরে চলে আসব। যাই মিসির আলি সাহেব। স্লামালিকুম।’

.

মেয়েটি নিজের কেবিনে ফিরে গেল। রাত দশটার ভেতর সে চার শ’ নয় নম্বর কেবিনে আগের রুগীর যাবতীয় তথ্য জোগাড় করল। এই কেবিনে ‘লাবণ্য’ নামের দশ বছর বয়সী একটি মেয়ে থাকত। হার্টের ভাল্বের কী একটি জটিল সমস্যায় সে দীর্ঘদিন এই ঘরটিতে ছিল। মারা গেছে মাত্র দশ দিন আগে। তার ওজন তেষট্টি পাউণ্ড। উচ্চতা চার ফুট এক ইঞ্চি।

মিসির আলি সাহেব সামান্য ভুল করেছেন। তিনি বলেছেন চার ফুট দু’ ইঞ্চি। এইটুকু ভুল বোধহয় ক্ষমা করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *