০২. মিসির আলি বটগাছের গুড়িতে

মিসির আলি বটগাছের গুঁড়িতে বসে আছেন। বসার জন্য জায়গাটা সুন্দর। অর্ধেক বটগাছ রায়না নদীর উপর। নদীর পানি শিকড়ের মাটির অনেকটাই ধুয়ে নিয়ে গেছে। অসহায় বটবৃক্ষ নিজেকে রক্ষার জন্যে অসংখ্য ঝুরি নামিয়েছে। সে এখনো টিকে আছে। কতদিন টিকবে কে জানে।

প্রথমবারের মতো মিসির আলির মনে হল তাঁর একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হতো। নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছের ছবি তুলে রাখতেন। ভাতের থালা হাতে নিরন্ন ভিখিরি ছেলের ছবি তুলতে ফটোগ্রাফাররা পছন্দ করেন। এই বিশাল গাছও এই অর্থে ভিক্ষুক। সে বেঁচে থাকার জন্য করুণা ভিক্ষা করছে নদীর কাছে। যে নদীর নাম রায়না।

মিসির আলি আরাম করে বসেছেন। পায়ের নিচের পানির ছলাৎ শব্দ শুনতে ভালো লাগছে। নদীর পানি যদিও সব সময় একই গতিতে বইছে কিন্তু ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা থেমে থেমে হচ্ছে। কিছুক্ষণ ছলাৎ ছলাৎ তারপর আর শব্দ নেই কঠিন নীরবতা। এর কারণ কী? আমাদের চারপাশে অমীমাংসিত সব রহস্য।

নদীর নামটাও তো রহস্যের একটা। কে দিয়েছে রায়না নাম? প্রাচীন পৃথিবীতে মানবগোষ্ঠী খণ্ড খণ্ড ভাগ হয়ে নদীর পাশে বসতি করেছে। হঠাৎ কেউ একজন কি সেই নদীকে ব্রহ্মপুত্র নাম দিয়ে দিল। বিশাল এলাকা জুড়ে নদী। সবাই তাকে ডাকছে ব্রহ্মপুত্র নামে। কারণ কী? বটগাছের কথাই ধরা যাক। কে তার প্রথম নাম দিল? সেই নাম কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল? এমন তো না কিছু জায়গায় নাম বটবৃক্ষ আবার কিছু জায়গায় হুটবৃক্ষ।

মিসির আলির মাথায় এলোমেলো চিন্তা একের পর এক আসছে। তাঁর ভালোই লাগছে। নামকরণ রহস্যের সমাধান তাঁকে করতে হবে না। এই দায়িত্ব তাঁকে কেউ দেয় নি। রহস্যের প্রতি সামান্য কৌতূহল প্রদর্শন করলেই হবে।

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। তাঁর দৃষ্টি এখন পাখিদের কর্মকাণ্ডে। পাখিদের বড় অংশই বক। তারা মাছ ধরায় ব্যস্ত। দু’টা মাছরাঙা দেখা যাচ্ছে। মাছরাঙার প্রধান খাদ্য মাছ। তবে তারা মাছ ধরায় আগ্রহী না। তারা বাঁশের খুঁটিতে পাশাপাশি বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর একজন আরেক জনকে দেখছে। মাছরাঙা যে এত সুন্দর পাখি তা আগে তিনি লক্ষ করেন নি। ক্যামেরা থাকলে অবিশ্যি মাছরাঙার ছবি তুলতেন।

জায়গাটা নির্জন। নদীর পাড় ধরে লোক চলাচল নেই বললেই হয়। নদীতে অনেকক্ষণ পরপর নৌকার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। সবই ইনজিনের নৌকা। দ্রুত বিদায় হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম-বাংলার শ্লথ জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে।

মিসির আলি চায়ের ফ্লাস্ক বের করার জন্যে কাপড়ের ঝুলি খুললেন। আয়না মেয়েটা শুধু যে ফ্লাস্ক ভর্তি চা দিয়েছে তা-না এক প্যাকেট বিস্কিট দিয়েছে। বিস্কিটের নাম Energy. সাদা কাগজ এবং বল পয়েন্ট দিয়েছে। সে কি ভেবেছে মিসির আলি লেখক মানুষ? র‍্যাক্সিনে বাঁধানো একটা ডায়েরিও দেখা যাচ্ছে। মিসির আলি কৌতূহলী হয়ে ডায়েরি খুললেন। যা সন্দেহ করেছিলেন তাই। তাঁর ছাত্রের লেখা ডায়েরি। সে তার স্ত্রী আয়না সম্পর্কে লিখেছে।

চমৎকার কোনো জায়গায় বসে ডায়েরি পড়া যায় না। ডায়েরি বা গল্পের বই পড়ার অর্থ প্রসারিত দৃষ্টিকে গুটিয়ে নিয়ে আসা। ডায়েরি পড়ার চেয়ে মিসির আলি অনেক বেশি আগ্রহবোধ করছেন মাছরাঙা পাখিটার গতিবিধি লক্ষ করায়। এর নাম মাছরাঙা কেন হল? মাছ খেয়ে সে রাঙা হয়েছে এই জন্য? তা হলে তো বকের নাম হওয়া উচিত মাছসাদা। কারণ মাছ খেয়েই সে ধবধবে সাদা হয়েছে।

মিসির আলির চিন্তায় বাঁধা পড়ল। দু’টি মাছরাঙাই হঠাৎ উড়ে গেছে। তাদের উড়ে যাওয়ার পেছনেও ব্যাখ্যা আছে। গ্রামের এক তরুণী মেয়ে নদীতে স্নান করতে এসেছে। সে হয়তো ভেবেছে আশপাশে তাকে লক্ষ করার মতো কেউ নেই। অর্ধনগ্ন হওয়া যেতে পারে। মিসির আলি খাতা খুলে চোখ সরিয়ে নিলেন। মেয়েটির স্নান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর ছাত্রের লেখা পড়া একটি শোভন কর্ম।

.

“আমার বিয়ে হয় তেইশে শ্রাবণ। ইংরেজি তারিখটা মনে থাকে না। বাংলাটা মনে থাকে কারণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের দিনটাই আমার বিয়ের তারিখ।

স্ত্রীর নাম কুলসুম। বিয়ের আগে আমি তাকে দেখিনি। দেখার তেমন কৌতূহলও বোধ করি নি। আমার দূর সম্পর্কের এক মামা বিয়ে ঠিক করে দেন। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের মেয়ে। বিএ পাস করেছে। বিএতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। মেয়েটির এই যোগ্যতাই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। গ্রামের এক কলেজ থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়া সহজ কথা না। মামা মেয়েটির ছবি দেখিয়েছেন। মেয়েটি সুশ্রী। বোঁচা নাক তবে তাতে খারাপ দেখাচ্ছিল না। মামা বললেন, মেয়েটির গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যামলা। আমি ধরেই নিলাম মেয়ে কালো। বিয়ের পাত্রীর গায়ের রঙ কালো হলে তাকে উজ্জ্বল শ্যামলা বলাই শিষ্টাচার।

আমি আমার হবু স্ত্রীর গায়ের রঙ বা চেহারা নিয়ে মাথা ঘামালাম না তার প্রধান কারণ পাত্র হিসেবে আমি নিচের দিকে। আবার বাবা-মা নেই। বাড়িঘর নেই চাকরিটাই সম্বল। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা এতিম ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে আগ্রহী না। তাঁরা চান মেয়ে যেন থাকে শ্বশুর-শাশুড়ির আদরে ও প্রশ্রয়ে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে রকম ঘটে না।

তেইশে শ্রাবণ সোমবার সন্ধ্যায় আমার বিয়ে হল। ঠিক হল মেয়ে বাবার বাড়িতেই থাকবে। কলেজ থেকে কোয়ার্টার পাওয়ার পর মেয়ে উঠিয়ে নেয়া হবে।

.

বাসরের আয়োজন হল মেয়ের বাবার বাড়িতে। বাড়িটা সুন্দর। দোতলা পাকা দালান। যে ঘরে বাসর সাজানো হল সে ঘরটা বেশ বড়। পাশে রেলিং দেয়া বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে নদী দেখা যায়। নদীর নাম রায়না।

বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার পর কিছু মেয়েলি আচার আছে। একই গ্লাসে শরবত খাওয়া। আয়নায় মুখ দেখা ইত্যাদি। সব আচারই পালন করা হল শুধু আয়নায় মুখ দেখার অংশটা বাদ গেল। আমাকে জানানো হল—মেয়ে আয়নায় মুখ দেখবে না কারণ সে খুব আয়না ভয় পায়। আমার সামান্য খটকা লাগল। মেয়ে আয়না ভয় পাবে কেন? সে সিজিওফ্রেনিক না তো? কিছু সিজিওফ্রেনিক নিজের মুখোমুখি হতে ভয় পায় বলে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারে না। তাদের মনোবিশ্লেষণের একটা পর্যায়ে বড় বড় আয়নার সামনে দাঁড় করানো হয়। নিজের মুখোমুখি হওয়াতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়। এই বিষয়ে আমার শিক্ষক মিসির আলি সাহেবের একটি পেপার আছে। নাম Mind Mirror game.

কুলসুমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হল বাসররাতে। আমার এক বৃদ্ধা নানিশাশুড়ি তাকে নিয়ে এলেন। গ্রামের বৃদ্ধারা অশ্লীল কথা বলতে পছন্দ করে। এই বৃদ্ধাও তার ব্যতিক্রম না। তিনি ধাক্কা দিয়ে কুলসুমকে আমার গায়ে ফেলে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘জামাই! জিনিস দিয়া গেলাম। শাড়ি, ব্লাউজ খুইল্যা দেইখা নেও সব ঠিক ঠিক আছে কি না।’ এই বাক্যটির পর তিনি আরো একটি কুৎসিত বাক্য বললেন। সেই বাক্যটি লেখা সম্ভব না। ঘেন্নায় আমার শরীর প্রায় জমে গেল। আমি আমার স্ত্রীর দিকে লজ্জায় থাকাতেও পারছিলাম না। না জানি মেয়েটা কী মনে করছে।

নানিশাশুড়ি ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র কুলসুম মাথার ঘোমটা সরিয়ে স্পষ্ট এবং শুদ্ধ ভাষায় বলল, “তুমি নানিজানের কথায় কিছু মনে কোরো না। গ্রামের এক বৃদ্ধার কাছ থেকে সুরুচি আশা করা যায় না।’

আমি হতভম্ব হয়ে কুলসুমের দিকে তাকালাম। হতভম্ব হবার প্রধান কারণ— আমি আমার সমগ্র জীবনে এত রূপবতী মেয়ে দেখি নি। নিখুঁত সৌন্দর্য সম্ভবত একেই বলে। হেলেন অব ট্রয়, কুইন অব সেবা, ক্লিওপেট্রা এরা কেউ এই মেয়েটির চেয়েও সুন্দর তা হতেই পারে না। আমি নিজের অজান্তেই বললাম, Oh my God. কী দেখছি!

কুলসুম বলল, আমাকে দেখছ। আর কী দেখবে?

আমি এখন খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে কুলসুমকে দেখছি। কোনো হিসেবই মিলছে না। গ্রামে বড় হওয়া একটা মেয়ে আগ বাড়িয়ে বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে তুমি তুমি বলে কথা বলা শুরু করবে না। চোখে চোখ রেখে স্বাভাবিকভাবে বসে থাকবে। সারাক্ষণ জড়সড় হয়ে থাকার কথা। আমার চিন্তা-ভাবনা সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। কী বলব বুঝতে পারলাম না।

কুলসুম বলল, তোমার গরম লাগছে না?

আমি তখন প্রবল ঘোরে। গরম-শীতের কোনো অনুভূতি নেই। তারপরেও বললাম, হুঁ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামবে। এমন ঠাণ্ডা লাগবে যে রীতিমতো শীত করবে।

আমি বললাম, হুঁ।

কুলসুম বলল, বৃষ্টি নামলে আমরা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখব।

আমি বললাম, আচ্ছা।

আমাদের এই বারান্দা থেকে নদী দেখা যায়। নদীর নামটা সুন্দর। তোমাকে কি কেউ নদীটার নাম বলেছে?

আমি বললাম, বলেছিল। এখন ভুলে গেছি।

নদীর নাম রায়না।

আমি বললাম, ও আচ্ছা রায়না।

কুলসুম বলল, রায়না’র সঙ্গে কীসের মিল বল তো?

আমি বললাম, জানি না।

কুলসুম বলল, আয়না। রায়না আয়না। আমার ডাকনাম কিন্তু আয়না।

তাই নাকি?

হুঁ।

আমি প্রায় অপলকেই তাকিয়ে আছি আয়না নামের মেয়েটির দিকে সে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। কথা শুনছি। বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটির প্রতিটি কথার অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যা ধরতে পারছি না। মাথার ভেতর আয়না এবং রায়না ঘুরপাক খাচ্ছে

‘নদীর নাম রায়না
সেই নদীতে সিনান করে
অবাক মেয়ে আয়না।

আমি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছি। ছড়া কবিতা এইসব কখনো আমার মাথায় আসে না। তা হলে ছড়া তৈরি করছি কেন? সমস্যাটা কী।

আয়না হাসিমুখে বলল, দেখ দেখ বৃষ্টি নেমেছে

ঘরের পর্দা কাঁপছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। জানালার লাগোয়া কদমগাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দ। আয়না বলল, চল বারান্দায় বসি। সে এসে হাত ধরে আমাকে দাঁড় করাল। আমার ঘোর আরো প্রবল হল।

বারান্দা অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। তার নীল আলোয় চারদিক স্পষ্ট হয়ে আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা দু’জন পাশাপাশি দু’টা বেতের চেয়ারে বসে আছি। আমার রীতিমতো শীত লাগছে। আয়না একটা চাদর এনে আমার গায়ে দিয়েছে। বাইরে ঠাণ্ডা। চাদরের নিচে আরামদায়ক উষ্ণতা। আয়না বলল, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?

হুঁ।

আয়না বলল, ঘুম পেলে ঘুমাও। সারা দিন নানান ধকল গেছে। তুমি ক্লান্ত হয়ে আছ। ঘুম পাবারই কথা। তুমি আরাম করে ঘুমাও তো। রেস্ট নাও। আমি ডেকে দেব।

আচ্ছা।

আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। আমার ঘুম ভাঙল পরদিন ভোরে। আয়না আমাকে ডেকে তুলল। তার হাতে চায়ের কাপ। আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। কারণ আমার সামনে যে আয়না দাঁড়িয়ে আছে সে রাতের আয়না না। সাধারণ বাঙালি এক তরুণী। গায়ের রঙ শ্যামলা। বোঁচা নাক। আমি প্রচণ্ড দ্বিধার মধ্যে পড়লাম। গত রাতে যে আয়নাকে দেখেছি, সে সত্যি না এখন যে আয়না আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে সত্যি? আমি কি কোনো মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি? সিজিওফ্রেনিক রোগীর মতো হেলুসিনেশন হচ্ছে?

আয়না বলল, তুমি পানি দিয়ে কুলি করে চা খাবে নাকি বাসি মুখে চা খাবে?

আমি জবাব দিলাম না। আয়নার হাত থেকে চায়ের কাপ নিলাম। আয়না বলল, ঠিক আছে বাসি মুখেই চা খাও। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে নিচে যাও। বাবা নাশতা নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বেলা কিন্তু অনেক হয়েছে। সাড়ে ন’টা বাজে।

.

নাশতার টেবিলে আয়নার বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে নাকি?

আমি বললাম, না।

রাতে ভালো গরম পড়েছিল। গরমে মনে হয় ঘুমাতে পার নাই।

আমি বললাম, বৃষ্টি নামার পর সব ঠাণ্ডা। আরাম করে ঘুমিয়েছি।

উনি অবাক হয়ে বললেন, বৃষ্টি মানে? বৃষ্টি হয় নাই তো।

আমি অবাক হয়ে বললাম, বৃষ্টি হয় নাই?

তিনি আমার শাশুড়িকে ডেকে বললেন, জামাই কী বলছে শোন। কাল রাতে নাকি বৃষ্টি হয়েছে।

আমার শাশুড়ি বললেন, ‘হপন’ দেখেছে।”

.

এই পর্যন্ত পড়ে মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন।

গ্রামের মেয়েটির স্নান শেষ হয়েছে। সে চলে গেছে। মাছরাঙা পাখি ফিরে এসেছে। সে বসেছে ঠিক আগের জায়গায়। ডাইনিং টেবিলে কে কোন চেয়ারে বসবে সেটা যেমন ঠিক করা থাকে পাখিদের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই। আমি বসব এই খুঁটিতে তুমি বসবে ঐটায়।

মিসির আলি সাহেব! আপনি এইখানে। আপনার সন্ধানে সমস্ত অঞ্চল চষে ফেলেছি। মাইকে ঘোষণা দিব কি না চিন্তায় আছি আর আপনি এইখানে বসা। বটগাছ হল সাপের আড্ডা। চলে আসেন। চলে আসেন।

তরিকুল ইসলাম উদ্বিগ্ন গলার স্বর বের করলেন। মিসির আলি বললেন, শীতকালে সাপ থাকে না। সব হাইবারনেশানে চলে যায়। শীত নিদ্ৰা।

তরিকুল ইসলাম বললেন, পুরানা নিয়মকানুন এখন নাই। অনেক সাপ আছে শীতকালেও জেগে থাকে। আসেন তো ভাই। চিতল মাছ চলে এসেছে। আপনাকে না দেখায়ে কাটতেও পারছি না। চিতল মাছ রাঁধতে সময় লাগে না কিন্তু কাটাকুটি বিরাট হাঙ্গামা। বটগাছের গুঁড়িতে বসে করছিলেন কী?

দৃশ্য দেখছিলাম।

দৃশ্য দেখার কী আছে এখানে। কিছুই নাই। আধমরা এক নদী। নদীর পাড় ঘেঁষে যে হাঁটবেন সেই উপায় নাই। সবাই নদীর পাড়ে হাগে। গ্রামের মানুষদের এমনই মেন্টালিটি—বাড়িতে সেনিটারি পায়খানা করে দিলেও হাগতে আসবে নদীর পাড়ে।

মিসির আলি বললেন, এই প্রসঙ্গটা থাক। আসুন অন্য কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করি।

কী প্রসঙ্গ?

আপনার জামাইকে নিয়ে কথা বলুন। বাড়িতে যেতে যেতে আপনার জামাইয়ের কথা শুনি। সে কেমন ছেলে?

ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হবে অত্যধিক ভালো। আয়নার সঙ্গে তার বনিবনা হয় নাই। তারপরেও সে সব সময় আমার খোঁজখবর করে। গত ঈদে আমাকে সিল্কের পাঞ্জাবি দিয়েছে। তার শাশুড়ির জন্য লাল পেড়ে কাতান শাড়ি।

ভালো তো।

আমের সিজনে দুই ঝুড়ি আম আনবেই। রাজশাহীর আম। এক ঝুড়ি খিরসাপাতি আরেক ঝুড়ি ল্যাংড়া।

আয়নার সঙ্গে বনিবনা হল না কেন?

ছেলের কোনো দোষ নাই। মেয়েটির সমস্যা। মাথা খারাপ মেয়ে। কোনো কারণ ছাড়া দুই দিন তিন দিন দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।

ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?

তরিকুল ইসলাম বললেন, ডাক্তার কবিরাজ কিছু করতে পারবে না রে ভাই! মূল বিষয় হচ্ছে—খারাপ বাতাস। জানি সায়েন্স এইসব স্বীকার করবে না। তারপরেও খারাপ বাতাস বলে একটা বিষয় আছে। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মিসির আলি কিছু বললেন না। তরিকুল ইসলাম বললেন, খারাপ বাতাস তৈরি করে খারাপ জিন-ভূত। তাবিজ-কবচ দিয়ে জিন-ভূত তাড়ানো যায়, কিন্তু খারাপ বাতাস তাড়ানো যায় না। এইটাই সমস্যা।

.

মিসির আলিকে আয়োজন করে মাছ দেখানো হল। গজফিতা আনা হয়েছিল। গজফিতা দিয়ে মিসির আলিকেই সেই মাছ মাপতে হল। তিন ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি। মিসির আলি মাছ মাপামাপি করছেন সেই দৃশ্যের ছবি তোলা হল মোবাইল টেলিফোনে। একটা ছবি না, একাধিক ছবি

মিসির আলি হতাশ বোধ করলেও যন্ত্রণা সহ্য করে গেলেন। মোবাইল ফোনের সঙ্গে ক্যামেরা যুক্ত হয়ে বিরাট সমস্যা হয়েছে। সবাই ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটি। এর অর্থ এক কোটি ফটোগ্রাফার ক্যামেরা হতে ঘুরছে।

তরিকুল ইসলাম বললেন, ভাই সাহেব! আমার ধারণা পাঁচ দশ বছরের মধ্যে এমন ক্যামেরা বার হবে যা দিয়ে ভূত-প্রেতের ছবি তোলা যাবে। যারা এইসব বিশ্বাস করে না, তাদের গালে পড়বে থাপ্পড়। ঠিক বলেছি কি না বলুন।

মিসির আলি বললেন, সে রকম ক্যামেরা আবিষ্কার হলে অবিশ্বাসীরা বড় ধরনের ধাক্কা অবশ্যই খাবে।

আপনি কি অবিশ্বাসী?

জি।

তরিকুল ইসলাম বললেন, আচ্ছা যান আমি আপনাকে ভূত দেখাব। কথা দিলাম।

ভূত দেখাবেন?

অবশ্যই দেখাব। আমার লাগবে বড় সাইজের গজার মাছ। সেই মাছ আগুনে পুড়ে জঙ্গাল ভোগ দিতে হবে। সব ধরনের ভূত-প্রেতের প্রিয় খাদ্য হচ্ছে গজার মাছ। খড়ের আগুনে আধাপুড়া গজার মাছ। আর পেতনিগুলোর প্রিয় খাদ্য ইলিশ মাছ ভাজা। আপনি আগামী শনিবার পর্যন্ত থাকুন আমি প্রেত দেখায়ে দিব। শনি- মঙ্গলবার ছাড়া এদের দেখা পাওয়া কঠিন।

.

মিসির আলি ভোজনরসিক মানুষ না, কিন্তু চিতল মাছের পেটি আগ্রহ করে খেলেন। পোলাওয়ের চালের সুগন্ধি ভাত। প্রচুর ধনেপাতা দেয়া মাছের পেটি। বাটি ভর্তি চিতল মাছের গাদা দিয়ে বানানো কোপ্তা। পেটি খাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা করে কোপ্তা মুখে দিয়ে চিবুতে হয়। খাবার তদারকি করছেন হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রী। আয়নাকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, আয়না কোথায়?

হেডমাস্টার বললেন, মাছ রান্না হচ্ছে তো–ও দোতলা থেকে নামবে না। মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।

মিসির আলি বললেন, আমাদের নবীজিও (সা.) মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। তিনি কখনো মাছ খান নি। একবার ইয়েমেনে তাঁকে মাছ খেতে দেয়া হয়েছিল। দুর্গন্ধ বলে তিনি সরিয়ে রেখেছিলেন।

হেডমাস্টার বললেন, জানতাম না তো।

এই জ্ঞান হেডমাস্টার সাহেবকে তেমন অভিভূত করতে পারল না। তিনি শুরু করলেন ভূতের গল্প

বুঝলেন ভাই সাহেব! আমি নিজের চোখে ভূত দেখেছি। দুই বছর আগে। চৈত্র মাসে। ঘটনাটা বলব?

বলুন শুনি।

আপনি যে ঘরে ঘুমান, সেই ঘরে আমি এবং আমার স্ত্রী শুয়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার, কিন্তু ক্যারাম খেলার আওয়াজ আসছে।

ক্যারাম?

জি ক্যারাম। বড় একটা ক্যারামবোর্ড কিনেছিলাম। আমার স্ত্রী ক্যারাম খেলতে পছন্দ করেন, তার জন্যই কেনা। সেই ক্যারামে কেউ ক্যারাম খেলছে। ঘটাস ঘটাস শব্দে স্ট্রাইকার মারছে। গুটি গর্তে পড়ছে। আমি টর্চ ফেলে দেখি ক্যারামবোর্ড মেঝেতে বিছানো। গুটি বোর্ডে ছড়ানো। ঘরে কেউ নেই। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

একদিনই শুনেছেন। আর শুনেন নি?

জি না। ঐ ঘরে থাকাই ছেড়ে দিলাম।

মিসির আলি বললেন, ক্যারামবোর্ডটা কি আছে? না সেটাও ফেলে দিয়েছেন।

ক্যারামবোর্ড আছে। ক্যারামবোর্ড ফেলব কেন? আপনার ঘরেই আছে। রাতে ঘুম ভাঙলে একটু খেয়াল রাখবেন। ক্যারাম খেলার শব্দ শুনলেও শুনতে পারেন। তবে ভয় পাবেন না। যেসব ভূত-প্রেত মানুষের বাড়িতে থাকতে আসে তারা সাধারণত নিরীহ হয়। এদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অবশ্য প্রটেকশান নেয়া আছে আপনার তোশকের নিচে মোজা ভর্তি সরিষা আর দু’টা রসুন রাখা আছে। সরিষা এবং রসুন যেখানে থাকে সেখানে ভূত আসে না।

কারণ কী?

রসুন আর সরিষার ঝাঁজ তারা সহ্য করতে পারে না। ভূত-প্রেতের স্মেল সেন্স খুবই ডেভেলপড। রাতে কী খাবেন বলেন।

রাতে কিছু খাব না-রে ভাই।

অসম্ভব কথা বললেন। রাতে খাবেন না মানে? রাজহাঁস কখনো খেয়েছেন? রাজহাঁস খাওয়াই।

এত সুন্দর একটা প্রাণী। তাকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলব? আমি এর মধ্যেই নাই। হেডমাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি তো ছাতু খাওয়া হিন্দু সাধুর মতো কথা বলছেন। আপনি হিন্দু সাধু না। আপনি গরু খাওয়া মুসলমান। রাজহাঁস খেতেই হবে।

মিসির আলি হতাশ গলায় বললেন, ঠিক আছে রাজহাঁস খাব।

.

মিসির আলিকে রক্ষা করল তাঁর দুর্বল পাকস্থলী। চিতল মাছের পেটি দুর্বল স্টমাক সহ্য করল না। সন্ধ্যার দিকে কয়েকবার বমি করে তিনি নেতিয়ে পড়লেন। রাজহাঁস না খেয়েই রাতে ঘুমুতে গেলেন। তাঁকে কিছু খেতে হবে না এই আনন্দেই তিনি অভিভূত। আধশোয়া হয়ে লেপ গায়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে। কদম ফুলের হালকা সুবাস নাকে আসছে। তিনি ঠিক করলেন, শীতকালে ফুল ফোটে এমন কদমের চারার খোঁজ করবেন। ঢাকায় যে বাড়িতে থাকেন তার সামনে ফাঁকা জায়গা আছে। কদমের চারা সেখানে পুঁতে দেবেন।

মাজেদ নামের নয়-দশ বছরের একটা ছেলেকে দেয়া হয়েছে গা-হাত-পা টিপে তাকে আরাম দেবার জন্য। মিসির আলি তাকে সে সুযোগ দেন নি। একটা মানুষ তার গা ছানাছানি করবে এই চিন্তাই তাঁর কাছে অরুচিকর।

মনে হচ্ছে মাজেদকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁর ঘরে কম্বল পেতে ঘুমানোর জন্যে। সে খাটের দক্ষিণ দিকে মহানন্দে বিছানা করছে।

মিসির আলি বললেন, মাজেদ! তুমি স্কুলে যাও?

জে না স্যার।

যাও না কেন?

মাস্টার ভালো না। পিটন দেয়।

লেখাপড়া শিখতে ইচ্ছা করে না?

জে না।

বড় হয়ে কী করবে? ক্ষেতের কাজ?

খলিফার কাজ শিখব। সদরে দোকান দিব।

তোমার বংশে খলিফা আছে?

আমার বড় মামা খলিফা। নাম সবুর মিয়া। সবেই ডাকে সবুর খলিফা।

আমার ঘরে তোমাকে না ঘুমালেও চলবে। আমার শরীর সেরে গেছে।

আমারে আপনের লগে ঘুমাতে বলছে। না ঘুমাইলে পিটন দিবে।

কে পিটন দিবে?

হেডস্যার।

তা হলে ঘুমাও। খাওয়াদাওয়া হয়েছে?

জে। রাজহাঁসের সালুন দিয়া খাইছি।

রাজহাঁসের সালুন শুনে পেটে আরেক দফা মোচড় দিচ্ছিল। মিসির আলি সেটা সামলালেন। মাজেদের নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বালিশে মাথা ছোঁয়ানো মাত্র ঘুমিয়ে পড়ার সৌভাগ্য তাঁর নেই। তাঁকে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে। বইপত্র তেমন নিয়ে আসেন নি। নিশি যাপন কঠিন হবে।

মিসির আলি ছাত্রের লেখা ডায়েরি হাতে নিলেন। আয়না মেয়েটির বিষয়ে আরো কিছু জানা যাক। আজ সারা দিনে একবারও তার সঙ্গে দেখা হয় নি। মাছে আঁশটে গন্ধে কাতর এই মেয়ে কি শুয়ে পড়েছে? নাকি সেও নিশি যাপন করছে? মিসির আলি ডায়েরি খুললেন।

.

“আয়নাকে তার বাবা-মা’র কাছে রেখে আমি চলে এলাম। টিচার্সদের মেসে থাকি। ক্লাস নেই। প্রাইভেট টিউশনি করি। কোনো কিছুতেই মন বসে না। আমি আয়নাকে একটা মোবাইল টেলিফোন কিনে দিয়েছিলাম। টেলিফোন সে ব্যবহার করে না। আমি যতবার টেলিফোন করি, তার সেট বন্ধ পাই। আয়নাকে প্রতি সপ্তায় একটা করে চিঠি দেই, সে চিঠিরও জবাব দেয় না।

এক মাসের মাথায় আমি কোয়ার্টার পেয় গেলাম। তিন কামরার ঘর। বারান্দা আছে। দক্ষিণমুখী জানালা। প্রচুর বাতাস। আয়নাকে এখন নিজের কাছে এনে রাখার আর বাধা নেই।

ঘর সাজানোর কিছু আসবাবপত্র কিনলাম। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলনা। হাঁড়ি- পাতিল কিনলাম না, আয়নাকে সঙ্গে নিয়ে কিনব। ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কিনতে মেয়েরা সব সময় আনন্দ পায়। তবে আয়না আর দশটা মেয়ের মতো না। সে আলাদা এবং প্রবলভাবেই আলাদা। সে কি আগ্রহ নিয়ে হাঁড়িকুড়ি কিনতে যাবে?

এক রাতের ঘটনা। আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে এসে ঘুমানোর আয়োজন করছি। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কারেন্ট চলে গেছে। ঘর অন্ধকার। মোমবাতি জ্বালিয়েছি। বাতাসে মোমবাতি নিভু নিভু করছে। আমি দরজা জানালা বন্ধ করে বাতাস আটকালাম, আর তখন মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো কে?

আমি আয়না।

কেমন আছ আয়না?

ভালো না।

ভালো না কেন?

জানি না।

আমি তোমাকে অনেকগুলো চিঠি পাঠিয়েছি। তুমি পেয়েছ?

হ্যাঁ।

পড়েছ?

না।

পড় নি কেন?

ভালো লাগে না।

ভালো না লাগলে পড়ার দরকার নেই। এই শোন, আমি কোয়ার্টার পেয়েছি। ছিমছাম সুন্দর বাসা। বড় বারান্দা। দক্ষিণ দিকে বারান্দা তো প্রচুর বাতাস।

তোমার ঘরে কি আয়না আছে?

অবশ্যই আছে। আয়না থাকবে না কেন?

কয়টা আয়না?

তোমার জন্য একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেছি। সেখানে আয়না আছে। বাথরুমে আয়না আছে। আরেকটা যেন কোথায় আছে। ও আচ্ছা, বেসিনের সঙ্গে।

তুমি একটা আয়নার সামনে দাঁড়াও তো।

কেন?

আছে একটা ব্যাপার। আয়নার সামনে দাঁড়াও

এই বলেই আয়না টেলিফোনের লাইন কেটে দিল।

আমি চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারলাম না। সে মোবাইল সেট বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। চমকে দেখি আয়নায় আমার স্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে। তার পরনে শাড়ি। ঘোমটা দেয়া। মুখ হাসি হাসি। সে এখন আছে অতি রূপবতী রূপে। তার আশপাশে কিছুই নেই।

প্রথমে ভাবলাম বিকট চিৎকার দেই। সেই ভাবনা স্থায়ী হল না। বিকট চিৎকার কেন দেব? আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে আমার স্ত্রী। কেন এরকম দেখছি তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমার কাছে না থাকলেও ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

আমার শিক্ষক মিসির আলি সব সময় বলতেন—সব মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তখন সে যুক্তির সিঁড়ি থেকে সরে দাঁড়ায়। নিজেকে সমর্পণ করে রহস্যময়তার কাছে। এই কাজটি কখনো করা যাবে না। আমাদের এগুতে হবে যুক্তির কঠিন পথে। মনে রাখতে হবে প্রকৃতি দাঁড়িয়ে আছে যুক্তির উপর। যুক্তি নেই তো প্রকৃতিও নেই।

মিসির আলি স্যার আমার কাছে অতিমানব। তাঁর কথা অবশ্যই অভ্রান্ত। কিন্তু আমি আয়নায় কী দেখছি?

আমি আয়নার ভেতরে আয়না মেয়েটিকে বললাম, তুমি এখানে কী করছ?

আয়না হাসল। মাথা সামান্য কাত করল। আমি বললাম, আমি তোমার ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু বুঝাও।

আয়না না সূচক মাথা নাড়ল।

তুমি আমাকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছ। এটা তুমি করতে পার না। You must speak out.

আয়না কথা বলা শুরু করল। সমস্যা একটাই। আমি তার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না। তার ঠোঁট নড়ছে। কিন্তু আমি কিছু শুনছি না। ভয়াবহ অবস্থা। আমি মোমবাতি হাতে বাথরুমে আয়নার কাছে গেলাম। সেই আয়নার ভেতরেও আমার স্ত্রী বসে আছে। কথা বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনছি না।”

মিসির আলিকে ডায়েরি পড়া বন্ধ রাখতে হল কারণ ঘরের ভেতর খটাস খটাস শব্দ হচ্ছে। কে যেন ক্যারাম খেলছে। মাজেদের নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। সে খেলছে না এটা বুঝা যায়। তা হলে কে? মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কদম ফুলের গন্ধ না। কড়া গন্ধ।

মিসির আলি ইচ্ছা করলেই উঁচু হয়ে খাটের ওপাশে কী হচ্ছে তা দেখতে পারেন। তিনি তা করলেন না। ডায়েরি বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। খটাস খটাস শব্দ হতেই থাকল। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। খটাস খটাস শব্দ থেমে গেল। কড়া মিষ্টি গন্ধটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর তৃপ্তির ঘুম হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *