১৩. রান্নাঘরে চায়ের কাপে

১৩

রান্নাঘরে চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দ হচ্ছে। বসার ঘরে অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে শায়লা। সে ছবিগুলো নিতে এসেছে। তাঁর ধারণা মিসির আলি ছবি দেখেন নি। এক সপ্তাহ পার হয়েছে এখনো ছবি না দেখা হয়ে থাকলে আর দেখা হবে না।

রান্নাঘর থেকে মিসির আলি বললেন, শায়লা তুমি চায়ে ক’ চামচ চিনি খাও।

দু’ চামচ।

মিসির আলি বললেন, ঘরে টোস্ট বিস্কিট আছে। চায়ের সঙ্গে খাবে?

না স্যার।

মিসির আলি ট্রেতে দু’কাপ চা এবং পিরিচে কয়েকটা টোস্ট বিস্কিট নিয়ে ঢুকলেন। শায়লার সামনে ট্রে রাখতে রাখতে বললেন, একটা টোস্ট বিস্কিট খেয়ে দেখ ভালো লাগবে। টোস্ট বিস্কিটের গায়ে পনির দেয়া আছে। পনিরের উপর এক ফোঁটা রসুনের রস। গার্লিক টোস্ট উইথ চিজ। রান্নার বইয়ে পেয়েছি।

আপনি রান্নার বই পড়েন?

কেন পড়ব না? আমি রাঁধতে পারি না কিন্তু রান্নার বই পড়তে ভালবাসি। তুমি কি জান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পার্ল এস বাকের চায়নিজ রান্নার উপর একটা বই আছে। আমি অনেক খোঁজ করছি কিন্তু বইটা পাচ্ছি না।

মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। তিনি কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন। শায়লা বাড়তি কৌতূহলের কারণ ধরতে পারছে না।

স্যার আপনি কি ছবিগুলো দেখার সময় পেয়েছিলেন?

মিসির আলি বললেন, তুমি যেদিন ছবিগুলো দিয়ে গেলে তার পরদিন ভোরবেলায় দেখেছি। এজি অফিসের সঙ্গে দুপুরবেলা যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে জানলাম বরকতউল্লাহ সাহেব জীবিত। প্রমোশন পেয়ে তিনি ডিএজি হয়েছেন।

শায়লা চায়ে চুমুক দিয়েছিল, মিসির আলির কথায় বিষম খেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, Oh God.

তোমার নিজের কী ধারণা জোয়ার্দার সাহেব কেন একজন জীবিত মানুষকে মৃত ঘোষণা করলেন?

স্যার আমার ধারণা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার অজুহাত হিসেবে এইসব গল্প করেন। উনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কথাবার্তা অনেক দূর এগোনোর পর বিয়ে ভেঙে যায়। আমার প্রতি উনার আলাদা দুর্বলতা একটা কারণ হতে পারে।

তোমার কি ঐ ভদ্রলোকের প্রতি কোনো দুর্বলতা আছে?

না।

বিয়ে করেছ?

জি না।

বাড়িতে একা থাক?

জি। আমি আর একটা কাজের মেয়ে।

জোয়ার্দার কি জানে তুমি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন কর?

জানেন না। আমি তাকে বলেছি যে একটি মেয়েকে আমি পালক নিয়েছি। ওর সঙ্গে দুষ্টুমি করে আমার সময় কাটে।

মিথ্যা কথা কেন বলেছ?

যাতে সে কোনো রং সিগন্যাল না পায়। ভেবে না বসে তাঁর সঙ্গে বিয়ে না হওয়ায় আমি মেয়ে দেবদাস হয়ে গেছি।

মিসির আলি বললেন, তাই তো হয়েছ। তুমি যখন হাইলি ইনটকসিকেটেড অবস্থায় থাক তখন কি জোয়ার্দারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ কর?

দু’বার করেছি।

জোয়ার্দারের তোমার প্রতি কী মনোভাব তা আমি জানি না। তবে তুমি যে মহিলা দেবদাস তা আমি যেমন জানি তুমিও জান। রোগীর সমস্যা নিয়ে ছুটে এসেছ আমার কাছে।

শায়লা উঠে দাঁড়াল। আহত গলায় বলল, স্যার আমি যাব। চেম্বারের সময় হয়ে গেছে। ছবিগুলো দিন।

মিসির আলি বললেন, বস। ছবি নিয়ে তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। ছবিগুলো অত্যন্ত বিস্ময়কর।

বিস্ময়কর কোন অর্থে?

মিসির আলি বললেন, সব অর্থেই। তুমি বস আমি বলছি।

তিনি পড়ার টেবিলে ড্রয়ারে রাখা ছবিগুলো নিয়ে এলেন। অনিকার কোলের বিড়াল এবং আলাদা বিড়ালের ছবি শায়লার সামনে রাখতে রাখতে বললেন, বিড়াল দু’টার মধ্যে তুমি কি কোনো পার্থক্য দেখছ?

শায়লা বলল, জি না। দু’টা একই বিড়াল।

মিসির আলি বললেন, একই বিড়াল না। একটার ডান চোখের উপর সাদা স্পট, অন্যটার বাঁ চোখের উপর সাদা স্পট। বিড়াল দু’টার একে অন্যের মিরর ইমেজ। বাচ্চা মেয়েটার কোলের বিড়াল আয়নার সামনে যে বিড়াল দেখা যাবে অন্যটা সেই বিড়াল।

শায়লা বলল, ঠিক বলেছেন। আমার চোখে কেন পড়ল না?

তুমি ভালো করে তাকাও নি এই জন্য চোখে পড়ে নি। এখন বরকতউল্লাহ সাহেবের একটা ছবি দেখাচ্ছি। এই দেখ। ছবিটিতে অতি অদ্ভুত একটা বিষয় আছে। এটা বের কর।

শায়লা বলল, স্যার আমি অদ্ভুত কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

মিসির আলি বললেন, বরকতউল্লাহ সাহেবের তিনটা ছবি আমাকে দিয়ে গেছ এই একটাতে বরকতউল্লাহ সাহেবের পেছনের দেয়াল খানিকটা ছবিতে এসেছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে। ক্যালেন্ডারের একটা কোনা ছবিতে এসেছে। ক্যালেন্ডারের কোনার দু’টা তারিখই এসেছে উল্টা। এর অর্থ বরকতউল্লাহ সাহেবের মিরর ইমেজ আছে এই ছবিতে।

শায়লা বিস্মিত গলায় বলল, এর মানে কী?

মিসির আলি বললেন, আমিও তোমার মতোই ভাবছি, ‘এর মানে কী’?

শায়লা বলল, আমাকে দু’দিন সময় দিন আমি ঘটনা বের করে ফেলব।

মিসির আলি বললেন, গুড লাক।

তাঁর গলার স্বরে তেমন ভরসা নেই।

.

শায়লা এজি অফিসে। দুপুর একটা লাঞ্চ বিরতি। শায়লা খোঁজ নিয়ে জানল, জোয়ার্দার আজ অফিসে আসেন নি। সিক লিভ নিয়েছেন। বরকতউল্লাহ অফিসে আছেন।

সরকারি অফিসে ঢিলাঢালা ভাব থাকে। হুটহাট করে যে কোনো ঘরে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে।

বরকতউল্লাহর ঘরের সামনে টুল পেতে বেয়ারা বসে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে শায়লা ঢুকে পড়ল। বেয়ারা কিছু বলল না, উদাস চোখে তাকিয়ে রইল।

বরকতউল্লাহর সামনে হটপটে দুপুরের খাবার। তিনি এখনো খাওয়া শুরু করেন নি। শায়লা বলল, আমি অসময়ে চলে এসেছি। তার জন্য লজ্জিত। আমি আপনার এক মিনিট সময় নেব।

বলুন কী ব্যাপার।

শায়লা ব্যাগ থেকে তিনটা ছবি বের করে বরকতউল্লাহর সামনে রাখতে রাখতে বলল, এই ছবিগুলো নিশ্চয়ই আপনার।

হ্যাঁ।

ছবিগুলো কে তুলেছে?

বরকতউল্লাহ একটা ছবি হাতে নিয়ে বলল, কে তুলেছে বলতে পারছি না।

কোথায় তোলা হয়েছে তা বলতে পারবেন?

না।

আপনি কি আপনার অফিসের কলিগ জোয়ার্দার সাহেবের বাসায় কখনো গিয়েছিলেন?

না তো।

আপনার কাছ থেকে এক মিনিট সময় নিয়েছিলাম। এক মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। এখন আমি যাই?

বরকতউল্লাহ বললেন, আপনি বসুন। আপনার পরিচয় দিন। হুট করে এসে কয়েকটা ছবি দেখিয়ে চলে যাবেন তা তো হবে না। ছবিগুলো কে তুলেছে?

শায়লা বলল, আমি একজন ডাক্তার। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি হল আমার বিষয়। আমার একজন পেশেন্ট আমাকে এই ছবিগুলো দিয়েছেন। আমি বিষয়টা অনুসন্ধান করছি।

আপনার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি নিজেও এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যাই।

শায়লা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হল। তাঁর পেছনে পেছনে বরকতউল্লাহ বের হলেন। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।

এজি অফিস থেকে জোয়ার্দারের বাসার ঠিকানা শায়লা নিয়েছে। ভরদুপুরে জোয়ার্দারের বাসায় উপস্থিত হওয়া কোনো কাজের কথা না। শায়লা তাই করল।

অনেকক্ষণ বেল টেপার পর জোয়ার্দার নিজেই দরজা খুললেন, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শায়লার দিকে।

শায়লা বলল, আপনি কি আমাকে চিনেছেন?

জোয়ার্দার বললেন, চিনব না কেন? তুমি আগের মতোই আছ। শরীর সামান্য ভারী হয়েছে। আমার ঠিকানা কোথায় পেয়েছ?

আপনার অফিস থেকে ঠিকানা নিয়েছি।

আমি যে এজি অফিসে কাজ করি সেটা জান কীভাবে?

শায়লা বলল, আমার শরীর খারাপ লাগছে, মাথা ঘুরছে আমি কি আপনার বসার ঘরে কিছুক্ষণ বসতে পারি?

অবশ্যই পার। এস।

আপনার স্ত্রী কিছু মনে করবেন না তো?

জোয়ার্দার বললেন, শায়লা আমি তো বিয়েই করি নি। স্ত্রী আসবে কোত্থেকে?

শায়লা বিড়বিড় করে বলল, ও আচ্ছা আচ্ছা। আমি এক গ্লাস পানি খাব।

তুমি বস আমি পানি আনছি। তোমাকে এরকম বিধ্বস্ত লাগছে কেন? দুপুরে খেয়েছ?

না।

আমার সঙ্গে দুপুরে খেতে কোনো সমস্যা আছে?

না।

শায়লা বলল, আপনার মেয়ে অনিকা কোথায়?

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে একটু আগে বলেছি আমি বিয়ে করি নি এখন হঠাৎ মেয়ে প্রসঙ্গ তুললে কেন? আমি একা বাস করি। একাও ঠিক না। আমার একটা পোষা বিড়াল আছে।

শায়লা বলল, বিড়ালের নাম কি পুফি?

হ্যাঁ পুফি। বিড়ালের নাম জানলে কীভাবে।

শায়লা জবাব দিল না। চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল। জোয়ার্দার বললেন, কোনো সমস্যা?

শায়লা বলল, হ্যাঁ সমস্যা বিরাট সমস্যা। আমার মাথা দপদপ করছে। মাথায় পানি ঢালতে হবে। আপনার বাথরুমটা কি ব্যবহার করতে পারি?

অবশ্যই পার। এস বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *