রাত আটটা বাজে। মিসির আলি তার শোবার ঘরের খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। যথেষ্ট গরম পড়েছে কিন্তু মিসির আলির গায়ে হলুদ চাদর। তার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মিসির আলির হাতে স্টিফান কিং এর ভৌতিক উপন্যাস নাম skeletion crew. তিনি অনেকখানি পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভয়ের জায়গাগুলি ধরতে পারছেন না।
স্যার আসব?
মিসির আলি বই থেকে মুখ তুললেন। শ্যামলা চেহারার মধ্য বয়স্ক এক মহিলা দাঁড়িয়ে। মিসির আলি কিছু বললেন না।
আপনার বাইরের দরজা। হাট করে খোলা। কলিংবেল নেই বলে কড়া নেড়েছি। তারপর সাহস করে ঢুকে পড়লাম।
সাধারণত চাদরে পা ঢাকা থাকলে কেউ চাদর সরিয়ে পা বের করে সালাম করে না। এই মহিলা তাই করল।
মিসির আলি বললেন, আমি কি তোমাকে চিনি?
না স্যার।
তুমি যে ভাবে পা ছুঁয়ে সালাম করলে তা থেকে মনে হয়ে ছিল আমার ছাত্রী। ছাত্র ছাত্রীরাই এ ভাবে আমাকে সালাম করে। সালামের মধ্যে ভক্তির চেয়ে ভয় ভাব প্ৰবল থাকে।
আমার ছিল?
হ্যাঁ ছিল।
স্যার আমার নাম শায়লা। আমি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিতে Ph.D করেছি। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড। এক সময় আপনি এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়াশোনা করেছেন।
মিসির আলি বললেন, শুনে খুশি হলাম। আমার পি এইচ ডি ডিগ্রি নেই।
সবার এই ডিগ্ৰী লাগে না। স্যার। আপনার লাগে না।
মিসির আলি বললেন, শায়লা তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট ধরাও আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই।
তুমি টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে তৃষ্ণার্তের মত তাকাচ্ছ। একটু দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছ ইংরেজীতে একে বলে short breath. নিকোটিনে যারা অভ্যস্ত তাদের সিগারেট দেখলেই নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়তে থাকে।
শায়লা বলল, আমার বিষয়ে আর কি বলতে পারেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি লেফট হ্যান্ডার।
শায়লা বলল, আমিতো এমন কিছু করি নি। যা থেকে বুঝা যাবে আমি লেফট হ্যান্ডার। আপনাকে সালাম করার সময়ও ডান হাতে সালাম করেছি।
মিসির আলি বললেন, তোমার বা হাতের আঙ্গুলো নিকোটিনের দাগ আছে। লেফট হ্যান্ডাররা বঁ হাতে সিগারেট খায়। তুমি শুধু যে নিকোটিনে আসক্ত তা-না, তুমি এলকোহলিক।
শায়লা হ্যান্ডব্যাগ খুলে সিগারেট বের করতে করতে বলল, আমি এলকোহলিক এটা ঠিকই ধরেছেন। কি ভাবে ধরেছেন জানতে চাচ্ছি না। জানা জরুরী না। আমি আপনার কাছ থেকে একটা বিষয় জানতে এসেছি। আমার নিজের না, আমার পেশেন্টের বিষয়। পেশেন্টের নাম আবুল কাশেম জোয়ার্দার। এজি অফিসের বড় কর্মকর্তা। পোষ্টের নাম ডেপুটি একাউন্টেন্ট জেনারেল। তিনি একজন মৃত মানুষকে তার ঘরে ঘুরা ফেরা করতে দেখে। এটা কি সম্ভব?
মিসির আলি বললেন, ভিজুয়েল হেলুসিনেশান অবশ্যই সম্ভব। অনেকেই মৃত মানুষকে দেখেছে তার সঙ্গে কথা বলেছে এমন বলে।
আমার পেশেন্ট মৃত মানুষের তিনটা ছবি তুলেছেন। মানুষটার নাম বরকতউল্লাহ। ছবিতে মৃত বরকতউল্লাকে দেখা যাচ্ছে আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখছে। স্যার এটা কি সম্ভব?
মিসির আলি বললেন, সম্ভব না। মানুষের ভ্ৰান্তি হয়। যন্ত্রের হয় না। মৃত মানুষের ছবি তোলা হয়েছে এমন গল্প শোনা যায় না। ট্ৰিক ফটোগ্রাফিতে কিছু ছবি তোলা হয়েছে। সবই লোক ঠকানো ছবি তাও প্রমাণিত হয়েছে। তোমার ছবিগুলি রেখে যাও দেখব।
এখান দেখবেন না।
এখন ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না।
শায়লা বলল, পাঁচটা ছবি খামে ভর্তি করে রেখে যাচ্ছি।
মিসির আলি বললেন, তুমি না বললে তিনটা ছবি।
শায়লা বলল, বরকতউল্লাহ সাহেবের তিনটা ছবি। দুটা আছে বিড়ালের ছবি।
মৃত বিড়াল জীবিত হয়ে ঘুরছে তার ছবি।
শায়লা বলল, বিড়ালের কিছু রহস্য আছে। পরে বলব।
ঠিক আছে। পরে বললেও হবে।
শায়লা বলল, এই ভদ্রলোকের সমস্যা সমাধান আমার নিজের জন্যে খুব জরুরী। তিনি আমাকে বিরাট ধাঁধার মধ্যে ফেলেছেন। ঐ ভদ্রলোককে নিয়ে আমার খুবই ব্যক্তিগত একটা ঘটনা আছে; ঘটনাটা বলব?
মিসির আলি বললেন, আরেক দিন শুনব।
স্যার! আমি কি আজ চলে যাব?
মিসির আলি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।
স্যার আমি কি আরো কিছু সময় থাকতে পারি। কোনো কথা বলব না। চুপচাপ বসে থাকব।
বসে থাকতে চাচ্ছে কেন?
কোন কারণ নেই স্যার।
কারণ অবশ্যই আছে। মানুষ কারণ ছাড়া কোনো কাজই করে না। তুমি কেন বসে থাকতে চাচ্ছ তা আমি জানি।
শায়লা বলল, আপনি জানলে বলুন আমি শুনি। আমার নিজের জানা নেই।
মিসির আলি বললেন, তুমি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে চাচ্ছ কারণ তুমি আশা করছি তুমি বসে থাকতে থাকতেই আজ ছবি দেখব।
শায়লা বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনি ছবিগুলি এখন দেখছেন না, পরে দেখবেন। এর পেছনেও নিশ্চয়ই কারণ আছে। কারণটা বলুন আমি চলে যাচ্ছি।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমার উপর বিরক্ত বলেই এখন ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না। ডক্টর অব ফিলসফি হয়ে বসে আছ আর বিশ্বাস করছ মৃত মানুষের ছবি তোলা হয়েছে। ছবিতে মৃত মানুষ টিভি দেখছে। হোয়াট এ নুইসেন্স।
শায়লা উঠে দাড়াল এবং লজ্জিত গলায় বলল, স্যার আমি সরি।
Leave a Reply