০৩. ডাক্তারের ওয়েটিং লাউঞ্জ

ডাক্তারের ওয়েটিং লাউঞ্জে খানিকটা লজ্জিত এবং বিব্রত মুখে জোয়ার্দার বসে আছেন। তার কোলে এক প্যাকেট মাতৃভান্ডারের রসমালাই। হাতে সবুজ রঙের কার্ড সেখানে ইংরেজীতে লেখা Please wait.

এর নিচে লেখা 17.

তিনি অপেক্ষা করছেন। হাসপাতাল হচ্ছে মশা মাছি মুক্ত এলাকা। কিন্তু তার রসমালাইয়ের প্যাকেটের উপর স্বাস্থ্যবান দুটা নীল মাছি উড়াউড়ি করছে। রুগীদের কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে।

রসমালাই সঙ্গে করে আনা মস্ত বোকামী হয়েছে। তিনি সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন নি। ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর রোগ নিয়ে পরামর্শ করতে এসেছেন।

ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট জোয়ার্দারের দিকে তাকিয়ে বলল, রেডি হয়ে যান। নেক্সট আপনি।

জোয়ার্দার ভেবে পেলেন না রেডি হবার মানে কি। উঠে দাড়াতে হবে। দরজার সামনে যেতে হবে?

ভিজিটের টাকা দিন। পনেরোশ টাকা। হাইট আর ওজন মাপুন। ব্লাড পেশার মাপুন।

হাতে কি?

মিষ্টির প্যাকেট।

মিষ্টির প্যাকেট টেবিলে রেখে ওজন মাপুন। মিষ্টির প্যাকেট কার জন্যে?

ডাক্তারের জন্যে। আপনারাও খাবেন।

এসিসটেন্ট মুখ বিকৃত করে বলল, ডাক্তারের জন্যে আনবেন ভিজিট। মিষ্টি লাউ কুমড়া এইসব না।

জ্বি আচ্ছা।

এখন ঢুকে পড়ুন।

ডাক্তারের ঘরগুলি আলো ঝলমলে হয়। রুগীর চোখ মুখ দেখতে হয়।

জিভ দেখতে হয়। অল্প আলোয় সম্ভব না। সাইকিয়াট্রিষ্টের ঘর বলেই হয়তো আলো কম। ডাক্তারী টেবিলের ওপাশে শায়লা বসে আছে। মানুষের চেহারায় বয়সের ছাপা পড়ে। জোয়ার্দার অবাক হয়ে দেখলেন শায়লার চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ পড়ে নি। আগে রোগা পটকা ছিল এখন স্বাস্থ্যু ভাল হয়েছে। গায়ের চামড়া উজ্জ্বল হয়েছে। রঙিন স্কার্কে শায়লার মাথার চুল পেছন দিক থেকে বাধা। তাকে খানিকটা ইরানি মেয়ের মতো লাগছে। ডাক্তার শায়লা বললেন, আপনার নাম জোয়ার্দার?

জ্বি।

কি প্রবলেম নিয়ে এসেছেন বলুন। গুছিয়ে বলার চেষ্টা করুন কিছু যেন বাদ না পড়ে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের যখন গুছিয়ে কথা বলা দরকার তখন টেলিগ্রাফের ভাষায় কথা বলি। আর যখন সারা সংক্ষেপ বলা দরকার তখন পাঁচ শ, পৃষ্ঠার উপন্যাস শুরু করি। আপনি কিছু মনে করবেন। না। আমার ধুমপান করার অভ্যাস আছে। আমি সিগারেট টানতে টানতে আপনার কথা শুনিব। আপনার কোনো সমস্যা আছে?

জ্বি না।

জোয়ার্দারের বুক থেকে পাথর নেমে গেছে শায়লা তাকে চিনতে পারে নি। চিনতে না পারারই কথা। অল্প বয়সেই তার চুল পেকেছে। মাথায় টাক পড়েছে।

শায়লা সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, চুপ করে আছেন কেন? সমস্যা বলুন।

আমার ঘরে একটা বিড়াল ঢুকে।

সমস্যা এই না। আরো আছে?

এইটাই সমস্যা।

ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন?

জ্বি।

একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে বিড়াল ঢুকা সমস্যা হবে কেন? এরা খাদ্যের সন্ধানে ঢুকবে। আরামের সন্ধানেও ঢুকবে। বিড়াল আরাম পছন্দ করে। সে কি মাঝে মধ্যে আপনার পাশে আরাম করে শুয়ে হাই তুলে?

জ্বি।

যখন টিভি চলে। তখন টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে?

জ্বি।

ব্যাপারটা যে খুবই স্বাভাবিক। আপনি বুঝতে পারছেন?

জ্বি।

এমন যদি হতো বিড়ালটা টিভি দেখতে দেখতে টিভির নাটক নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা শুরু করত তাহলে ছিল সমস্যা। তখন আমার কাছে আসার একটা অর্থ হতো। এখন আপনি এসেছেন। শুধু শুধু কিছু টাকা খরচ করবার জন্যে। চা বা কফি কিছু খাবেন। আমার এখানে চা-কফির ব্যবস্থা আছে।

না।

বিয়ে করেছেন নিশ্চয়ই?

জ্বি।

ছেলেমেয়ে কি?

একটাই মেয়ে। নাম অনিকা। আমি এখন যাই?

না। আমি একটা সিগারেট শেষ করেছি। দ্বিতীয় সিগারেট ধরাব। সেটা শেষ করব তারপর যাবেন।

জ্বি আচ্ছা।

শায়লা দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, হাস্যকর বিড়ালের গল্প নিয়ে আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন। এখন আমি সেই ব্যাখ্যা করব। দয়া করে লজ্জা পাবেন না।

আপনার খুবই ইচ্ছা করছিল আমার সঙ্গে দেখা করার। আপনি লাজুক মানুষ কোনো অজুহাত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিড়ালের একটা গল্প অনেক চিন্তা ভাবনা করে বের করলেন। হয়েছে?

জোয়ার্দার মাথা নিচু করে থাকলেন। কিছু বললেন না। একবার ভাবলেন বলেন, বিড়ালের গল্পটা সত্যি। তারপর মনে হলো থাক।

শায়লা বললেন, আপনি যে মনে করে আমার জন্যে রসমালাই নিয়ে এসেছেন। এতে আমি বেশ অবাক হয়েছি। রসমালাইয়ের অংশটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আপনাকে নিয়ে ব্ৰহ্মপুত্রের পাড় ধরে হাঁটছি। লজ্জায় আমি অস্থির। হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই আপনি বললেন, তোমার কি মিষ্টি পছন্দ? আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম, রসমালাই। রসমালাই কেন, কোনো মিষ্টিই আমার পছন্দ না।

জোয়ার্দার অস্বস্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, শায়লা যাই?

শায়লা হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, আচ্ছা। আবার যদি কোনো কারণে আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে বা আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, সরাসরি চলে আসবেন। বিড়ালের কাহিনী ফাদার কিছু নাই।

আচ্ছা।

সঙ্গে ট্রান্সপোর্ট আছে? ট্রান্সপোর্ট না থাকলে বলুন আমার গাড়ি পৌঁছে দেবে।

জোয়ার্দার বললেন, লাগবে না।

প্রচন্ড অস্বস্থি নিয়ে জোয়ার্দার বাড়ি পৌঁছলেন। দরজা খুলে বাড়িতে ঢোকার পর অস্বস্থি কাটল। খালি বাড়ি। বসার ঘরে বাতি জুলছে। সোফায় বিড়ালটা শুয়ে আছে। তাকে দেখে একবার মাথা তুলে আবার আগের অবস্থায় চলে গেল। মনে হয়। ঘুমাচ্ছে। টিভিতে হিন্দি সিরিয়েল হচ্ছে। সিরিয়ালে লম্বা গলার একটা মেয়ে সুন্দর করে কাঁদছে। তার সামনে কঠিন চেহারার একজন যুবা পুরুষ। সে মেয়েলি গলায় কথা বলছে।

টিভি কে ছেড়েছে? বিড়ালটা নিশ্চয়ই না। জামালের কান্ড। জামালের কথাটা শায়লার বলা উচিত ছিল। লাভ হতো না। বিড়ালের ব্যাপারটা শায়লা যে ভাবে উড়িয়ে দিয়েছে জামালেরটাও উড়িয়ে দিবে।

জোয়ার্দার ডাকলেন, জামাল?

জামাল জবাব না দিয়ে শোবার ঘরের মুখে এসে দাঁড়াল।

কখন এসেছিস?

জামাল জবাব দিল না হাসল। জোয়ার্দার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোদের দুজনকে নিয়ে বিরাট দুঃশ্চিন্তায় আছি। দেখা যাবে শেষটায় আমি পাগল হয়ে যাব। আমাকে পাবনা পাগলা গারদে নিয়ে আটকে রাখবে। পাগলা পারদ চিনিস?

জামাল না সূচক মাথা নাড়ল।

জোয়ার্দার উঠে পড়লেন। তাঁকে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সহজ কোনো আইটেমে যেতে হবে। দুই মুঠ ভাত, এক মুঠ ডাল, এক চিমটি লবন আর একটা ডিম দিয়ে জাল। শেষটায় তেল দিয়ে বাগার।

জোয়ার্দার রান্না বসিয়েছেন। তার পাশে জামাল দাঁড়িয়ে আছে। সে উৎসুখ চোখে দেখছে। বিড়ালটা খাবার টেবিলে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

জোয়ার্দার জামালের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু খাবি?

জামাল না সূচক মাথা নাড়ল। জোয়ার্দার পুফির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কিছু খাবি? পুফি মাথা তুলে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিলো।

টিভির সামনে বসে জোয়ার্দার রাতের খাবার খাচ্ছেন। জামাল তার পাশে বসেছে। পুফি তার পায়ের কাছে। টিভিতে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। আগুন জ্বলিছে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ে পড়ে আগুনে কি যেন দিচ্ছে। আগুন ধাপ করে বাড়ছে। আগুনের পাশে বসা স্বামী স্ত্রী দুজনই ভয় পেয়ে খানিকটা পিছাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগছে।

মোবাইল টেলিফোন বাজছে। সিনেমাতেই মনে হয় বাজছে। একসময় বুঝা গেল সিনেমার না জোয়ার্দারের টেলিফোন বাজছে। তাকে উঠে টেলিফোন আনতে হলো না। পুফি লাভ দিয়ে উঠে দাতে কামড়ে ধরে টেলিফোন নিয়ে এলো। এইজাতীয় দৃশ্য বিদেশী সিনেমায় দেখা যায়। ঘরের বেড়াল খাওয়ানো এবং ঘুমানো ছাড়া কিছু করে না।

টেলিফোন করেছে অনিকা।

হ্যালো বাবা! বলতো আমরা কোথায়?

কক্সবাজারে।

হয় নি। দশে গোল্লা পেয়েছ। এখন আমরা সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডে। মামা একটা জাহাজ ভাড়া করে আমাদের সেন্টমার্টিন নিয়ে এসেছে।

মজা হচ্ছে মা?

খুব মজা হচ্ছে। এখন আমরা বার বি কিউ করছি। নাও মার সঙ্গে কথা বলো।

সুলতানা বললেন, এই একটা ইন্টারেস্টিং খবর শোন, রঞ্জুর সেন্টমাটিনে একটা হোটেল আছে। নাম দিয়েছে Solid Rock সমুদ্রের পাশের বাড়ি নাম দিয়েছে Solid Rock, অদ্ভুত না?

হুঁ।

ওর কি চমৎকার চমৎকার আইডিয়া। সে যে সেন্টমাটিনে হোটেল বানিয়ে বসে আছে তাই জানতাম না। আমি এত অবাক হয়েছি। তুমি অবাক হও নি?

হুঁ।

এখন টেলিফোন রাখছি, পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে মাংস পুড়ে যাচ্ছে। যাই।

আচ্ছা আরেকটু ধর অনিকা কথা বলবে।

অনিকা। কি খবর মা?

তোমাকে ছাড়া এসেছি তো বাবা এই জন্যে আমার বেশি ভাল লাগছে। न्म।

কয়েকদিন পরতো চলেই আসবে।

বাবা শোনা। আমি ডাবের পানি দিয়ে গোসল করেছি।

কেন?

মা বলেছে ডাবের পানি দিয়ে গোসল করলে স্ক্রীন ব্ৰাইট হয়। এই জন্যে।

তোমার স্ক্রীনতো এমিতেই ব্ৰাইট।

আরো ব্ৰাইট হবে। আমি তখন চাঁদের মতো হয়ে যাবো। চাঁদের গা থেকে যেমন আলো বের হয় আমার গা থেকেও বের হবে।

ভালোতো।

বাবা। আমি টেলিফোন রাখছি। মা ডাকছে। মাকে সাহায্য করতে হবে।

জোয়ার্দার ঘুমুতে গেছেন। ঘুম যখন আসি আসি করছে তখন তাঁর মোবাইল বাজতে শুরু করেছে। তার মোবাইল ধরার কোনো ইচ্ছা ছিল না, পুফি কামড়ে মোবাইল নিয়ে এসেছে বলে অনিচ্ছায় ধরতে হলো।

হ্যালো! কে বলছেন!

আমার নাম করিম। আমি শায়লা ম্যাড়ামের এসিসটেন্ট। ম্যাডাম জরুরী ভিত্তিতে আপনাকে একটু দেখা করতে বলেছেন।

আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন।

আপনিইতো আমাকে দিয়েছেন। টাকা দিয়ে যখন রশিদ নিলেন তখন টেলিফোন নাম্বারা এড্রেস সব দিলেন।

ও আচ্ছা।

আপনার পক্ষে কি এখন আসা সম্ভব? আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।

এখন সম্ভব না। আমি শুয়ে পড়েছি।

আগামীকাল কি আসতে পারবেন? সকাল দশটা থেকে এগারটা এই সময় ম্যাডাম বাসায় থাকেন।

কাল আমার অফিস আছে।

তাহলে রাতে চেম্বারে আসুন।

আচ্ছা।

রাত নটার দিকে এলেই হবে। রাত নটার পর ম্যাডাম আপনার জন্যে ফ্রি রাখবেন।

আচ্ছা।

জোয়ার্দার ঘুমিয়ে পড়লেন। করিম তারপরেও অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *