০৬. ভাইরাস V-305
ভয়াবহ ভাইরাস। এই দ্রুত পরিবর্তন ক্ষমতার ভাইরাস মানুষের
সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ছয়
থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে নষ্ট করে দেয়। দশ থেকে বারো ঘন্টার মধ্যে অবর্ণনীয় কষ্টের মৃত্যু। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত নেয়া যায় নি।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
(রোগব্যাধি পরিচ্ছেদ)
নিনিতা লালকুঠিতে কতদিন পার করেছে সে জানে না। এখানে সময় এবং তারিখ জানার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোথাও কোনো থ্রিডি পর্দা নেই। ঘড়ি নেই, ক্যালেন্ডার নেই। জায়গাটা যেন সময়ের বাইরে। দিন-রাতের প্রভেদ বোঝা যাচ্ছে। আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেন্দ্র পরিচালকদের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল। যেসব প্রশ্ন নিনিতা তাকে করবে বলে ভেবেছিল, তার কিছুই করা হয় নি। অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে ফিরে এসেছে।
নিনিতার প্রশ্ন : আজ কী বার? এবং এখন কটা বাজে?
উত্তর : আপনার সময় এবং তারিখ জানার প্রয়োজন নেই।
নিনিতার প্রশ্ন : কেন প্রয়োজন নেই।
উত্তর : কম্পিউটার সিডিসি ঠিক করেছেন প্রয়োজন নেই। কাজেই প্রয়োজন নেই।
নিনিতার প্রশ্ন : ভয়ঙ্কর সব অপরাধীকে এখানে রাখা হয়েছে। তাদের স্মৃতি নষ্ট করা হচ্ছে। আমি কী অপরাধ করেছি?
উত্তর : এর উত্তর সিডিসি জানে। আমি জানি না।
নিনিতার প্রশ্ন : আমি কোনো এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। কার কাছে প্রতিকার চাইব?
উত্তর : সিভিসির কাছে।
নিনিতার প্রশ্ন : প্রতিকার কীভাবে চাইব? কার মাধ্যমে চাইব?
উত্তর : লালকুঠির বাসিন্দারা কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।
নিনিতার প্রশ্ন : আমি কি একবারের জন্যে আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?
উত্তর : লালকুঠির বাসিন্দারা কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।
মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ। সে সব অবস্থায় সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। বৎসরের পর বত্সর মহাকাশযানের ছোট্ট একটা কামরায় বাস করতে তার সমস্যা হয় না। নিনিতার সমস্যা হচ্ছে। সে কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। কয়েকদিন আগে আয়নায় নিজেকে দেখে নিনিতা চিনতে পারল না। হঠাৎ যেন তার বয়স বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে ঘোলাটে। তার সারাক্ষণ পানির পিপাসা হচ্ছে, অথচ সে সেভাবে পানি পাচ্ছে না। ফুড প্রো দৈনিক পানির রেশনের বাইরে একফোঁটা পানিও দেবে না। নিনিতা তার ইউনিট দিয়ে পানি কিনতে পারে, কিন্তু লালকুঠিতে তাও সম্ভব না।
নিনিতার পাশের কামরায় থাকেন বৃদ্ধ শেন। তিনি বেশ হাসিখুশিই আছেন। তাকে কখনো চিন্তিত মনে হয় না। বরং মনে হয় তিনি লালকুঠিতে হলিডে কাটাতে এসেছেন। শেন কয়েকবারই নিনিতার সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করেছেন। নিনিতার প্রতিবারই অসহ্য বোধ হয়েছে। ভদ্রলোকের গল্পের বিষয়বস্তু একটাই। দেখা হওয়া মাত্র তিনি বলবেন, নিনিতা, আমার স্ত্রীকে আমি কীভাবে হত্যা করি সেই গল্পটা শুনতে চাও? খুবই মজা পাবে।
এই গল্পটা আমি শুনতে চাচ্ছি না।
সে এক মিনিট আগেও বুঝতে পারে নি যে, আমি তাকে হত্যা করব। হয়েছে কী শোন …
আমি আপনাকে বলেছি যে, এই গল্প শুনতে চাচ্ছি না।
হত্যার কায়দাটা শুনলে তোমার ভালো লাগবে। আমি তাকে বললাম, এই তোমার গলাটা তো অন্য মেয়েদের তুলনায় লম্বা। কতটুকু লম্বা মেপে দেখি। বলেই দুহাতে তার গলা চেপে ধরলাম।
নিনিতা এইটুকু শুনে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ধারণা এই লোক তার স্ত্রীকে যেভাবে খুন করেছে তাকেও খুন করবে। পুরনো টেকনিক ব্যবহার করবে না। নতুন কোনো টেকনিকে যাবে।
লোকটির ধারেকাছে নিনিতা থাকতে চায় না। ডাইনিং হলে খেতে বসার সময় শেন এসে তার পাশে বসবেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো গল্প ফাঁদবে। নিনিতা এই লোকের কোনো গল্পই শুনতে চায় না, তারপরেও তাকে শুনতে হয়।
নিনিতা! তুমি কি ক্রীতদাস শব্দটার সঙ্গে পরিচিত?
নিনিতা জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
শেন বলল, আমরা যন্ত্রের হাতের ক্রীতদাস। যন্ত্রের ইচ্ছার বাইরে যাবার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই। আচ্ছা নিনিতা, তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর?
হা।
স্ত্রীকে হত্যা করেছি এইজন্যে?
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখ না কেন? সিডিসি আমাকে বাধ্য করেছে খুন করতে।
বাধ্য করবে কেন?
যাতে তারা আমাকে এখানে এনে আটকে ফেলতে পারে। তুমি ঠান্ডা মাথায় বলো, তোমার প্রতি তারা কি অন্যায় করেছে?
হ্যাঁ।
তাহলে তো আমার প্রতিও অন্যায় করতে পারে। তাদের পরিকল্পনায় আমি স্ত্রীকে খুন করে বিচারের অপেক্ষায় আছি। অদ্ভুত না?
আমি আপনার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আগ্রহ বোধ করছি না।
তোমাকে কথাবার্তা চালাতে হবে না। তুমি শুধু শুনে যাও। ভাইরাস V-305 বিষয়ে আমার একটা থিওরি আছে। থিওরিটা শুনতে চাও?
না।
শুনতে না চাইলেও বলি। যে-কোনো মুহূর্তে তারা আমার স্মৃতি নষ্ট করে দেবে। তখন আর কাউকে কিছু বলে যেতে পারব না। আমার ধারণা V-305 ভাইরাসের পুরোটাই ভুয়া। এই অজুহাত তুলে তারা শহরের সব মানুষ মেরে ফেলছে।
তাদের লাভ কী?
পৃথিবী মানুষশূন্য করবে। পৃথিবীতে রাজত্ব করবে SF রোবটরা।
নিনিতা বলল, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন রোবট আইন আছে। এই আইনে কোনো রোবট মানব সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারবে না।
শেন বললেন, তারা আইনের একটা ফাঁক বের করেছে।
কী ফাঁক?
কী ফাঁক তা জানি না। তবে চিন্তা করছি। চিন্তা করে কিছু বের করতে পারলে তোমাকে জানাব।
আমাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।
তাও ঠিক। স্মৃতি নষ্ট হওয়া মানেই সব জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ থেকে ভেজিটেবল। ধীরে ধীরে আবার ভেজিটেবল থেকে মানুষ। ততদিনে তোমার একশ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে। পানি বন্ধ। তোমাকে বেঁচে থাকতে হলে ক্রেডিট খরচ করে পানি কিনতে হচ্ছে। নিনিতা, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেব।
আপনার বুদ্ধির আমার প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন না থাকলেও বুদ্ধি দিয়ে রাখি। তুমি ডায়েরি লেখা শুরু কর। স্মৃতি নষ্ট করার পর আবার যখন বুঝতে শিখবে, তখন ডায়েরি পড়ে অনেক কিছু জানবে যার স্মৃতি তোমার নেই।
নিনিতা বলল, ওরা ডায়েরি নষ্ট করে ফেলবে না?
শেন বললেন, না। রোবটিক আইনের একটি কঠিন ধারা আছে। মানুষের সৃষ্টিশীলতায় কোনো বাধা দেয়া যাবে না। এবং তার প্রতিটি সৃষ্টি রক্ষা করতে হবে। তুমি যদি কাগজে কাকের ঠ্যাং বর্গের ঠ্যাং আঁক তাও তারা রক্ষা করবে।
নিনিতা বলল, কেন?
শেন বললেন, সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারটি রোবটদের নেই। তাদের সর্ব কর্মকাণ্ড লজিকনির্ভর। সৃষ্টিশীলতা লজিকের বাইরের জিনিস। তারা এটা ধরতে চেষ্টা করছে বলেই মানুষের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি তাদের সীমাহীন আগ্রহ।
আপনি ডায়েরি লেখেন?
না। ডায়েরি লেখা একটি মেয়েলি ব্যাপার। আমি কোনো মেয়েলি ব্যাপারে নেই।
পুরুষালি ব্যাপার কোনটা? বকবক করা।
শেন বললেন, পুরুষালি ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করা। আমি তাই করি। যদিও জানি আমার এই চিন্তা কোনো কাজে আসবে না, তাও করি।
পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?
মানুষ্যবিহীন একদল SF রোবট। কিংবা তারচেয়েও উন্নত কোনো রোবটশ্রেণী। শুধু পৃথিবীতে কেন, কোথাও মানুষ থাকবে না। মঙ্গল গ্রহে মানুষদের যে শহর ছিল, তাদের একটিতে V-305 ভাইরাস পাওয়া গেছে এবং যথারীতি শহর বন্ধু। হা হা হা।
নিনিতা বলল, হা হা করছেন কেন? এটা কি হাসির কিছু?
শেন বললেন, অবশ্যই হাসির। ভালো কথা, রোবটরা যে রসিকতা ধরতে পারে না এই তথ্য জানো?
জানি।
কেন রসিকতা ধরতে পারে না সেটা জানো?
না।
রসিকতা লজিকনির্ভর না। এই কারণেই তারা রসিকতা ধরতে পারে না। হা হা হা।
দয়া করে হা হা বন্ধ করুন।
শেন বললেন, আমি হা হা বন্ধ করব না। আমি হা হা করেই যাব। হা হা হা।
আপনি উন্মাদ।
ঠিক বলেছ। কিছুটা উন্মাদ। সেই কারণেও আনন্দিত, কারণ মানুষই উন্মাদ হয়। রোবট কখনো হয় না। হা হা হা।
.
লালকুঠির প্রধান কর্মকর্তার সামনে নিনিতা দাঁড়িয়ে আছে।
প্রধান কর্মকর্তা (হিউমোনয়েড রোবট, টাইপ k2) বলল, আমি কি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি?
নিনিতা বলল, হ্যাঁ। আমি আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখতে চাই। আমার একটি ওয়ার্ড প্রসেসর দরকার। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি পুরনো দিনের মতো কাগজ এবং কলম পাই।
পুরনো দিনের কাগজ-কলম মিউজিয়াম ছাড়া কোথাও নেই। তোমাকে দেয়া যাবে না। ওয়ার্ড প্রসেসরও দেয়া যাবে না।
নিনিতা বলল, আমি যতদূর জানি মানুষের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে তোমরা বাধা হতে পারি না।
তুমি ঠিকই জানো। রোবট আইনের ৩ক ধারায় এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তবে তুমি এই ধারার একটি উপধারা জানে না। সেখানে বলা হয়েছে, এই আইন লালকুঠির অধিবাসীদের জন্যে প্রযোজ্য না।
আমি এই উপধারা জানতাম না। আমাকেও কি অন্যদের মতো স্মৃতিভ্রষ্ট করা হবে?
করার তো কথা। লালকুঠিতে কেউ এসেছে, তার স্মৃতি নষ্ট করা হয় নি। এমন ঘটনা ঘটে নি।
আমার অপরাধ?
এই প্রশ্ন তুমি আগেও অনেকবার করেছ। প্রতিবার যে জবাব দিয়েছি আজও সেই জবাব দিচ্ছি। তোমার অপরাধ কী তা আমি জানি না। আমার জানার কথা না। মূল কম্পিউটার সিডিসি জানে।
নিনিতা বলল, তোমাকে অকারণে কিছুক্ষণ বিরক্ত করলাম। দুঃখিত। বিদায়।
বিদায়।
.
নিনিতা ডায়েরি লেখা শুরু করেছে, তবে পুরোটাই মনে মনে। এই ডায়েরি লেখা অর্থহীন। তারপরেও সময় কাটানো। সে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ডায়েরি লেখে—
আজ সোমবার।
সোমবার শুধু শুধু বললাম। কী বার আমি জানি না। লালকুঠির কেউ জানে। আমাদের দিন তারিখহীন এবং বারহীন। আমাদের প্রধান কাজ অপেক্ষা করা। আমরা সবাই সবুজ রঙের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করি। সবুজ রঙের একটা গাড়ি আসে। একজনকে ধরে নিয়ে যায়। সে তার পরদিন ভেজিটেবল হয়ে ফিরে আসে। নবজাত এক শিশুর মতো তার আচরণ। সে কথা বলতে জানে না। কোনো কিছুর নাম জানে না। সে কে তাও জানে না। এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক সহনীয় শাস্তি। কম্পিউটারকে এই কথা কে বোঝাবে?
আমি তীব্র হতাশায় ডুবে আছি। কুন নামে আমার একজন স্বামী ছিল। আমার সুখের সংসার ছিল। আমরা দুজন মহান আহানের চন্দ্রগীতি শুনতে যেতাম। এইসব এখন শুধুই স্মৃতি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, কুন নামে আমার কেউ নেই। সবই কল্পনা। আমি জন্ম থেকেই এখানে আছি।
গত পরশু সবুজ গাড়ি এসে একজনকে নিয়ে গেছে। তার বয়স অল্প। চেহারা কঠিন, কিন্তু চোখ মায়াময়। সে ঠান্ডাগলায় গাড়ির সঙ্গে আসা SF রোবটকে বলল, তোমাদের একটি আইন আছে, ৩ক ধারা। এই ধারা বলছে, কোনো অবস্থাতেই মানুষের সৃষ্টিশীলতা ক্ষস্তি হয় এমন কিছু করা যাবে না। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে তার সৃষ্টিশীলতার আধার। তোমরা তোমাদের আইনেই তা নষ্ট করতে পার না।
SF রোবট (সে একজন তরুণী) মিষ্টি হেসে বলল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এই আইন লালকুঠির অধিবাসীদের জন্যে প্রযোজ্য না।
লোকটি বলল, একমাত্র হত্যা অপরাধের শাস্তি হচ্ছে স্মৃতিবিনাশ। আমি কাউকে হত্যা করি নি।
SF তরুণী রোবট বলল, তুমি একটি SF রোবট নষ্ট করেছ। SF রোবট হত্যা এবং মানুষ হত্যা একই ধরনের অপরাধ।
মানুষ এবং রোবট এখন সমান সমান?
মানুষ এবং SF রোবট সমান সমান।
তাহলে আমার বলার কিছু নেই। আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও নিয়ে যাও।
সবুজ গাড়ি যাদের নিয়ে যায়, তাদের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেয়। ঐ লোকটিকে এখনো ফেরত দেয় নি। এর মানে কী কে জানে! অন্যের কথা ভেবে কী হবে? আমাকে ভাবতে হবে আমার নিজের কথা।
সবুজ গাড়ি আমাকে নিয়ে যাবে, চব্বিশ ঘণ্টা পর ফেরত দেবে। আমি বড় হব শিশুর মতো। তখন যদি কুনের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমি কি তাকে চিনতে পারব? মস্তিষ্কের কোনো গভীর অতলে তার কোনো ছায়া থাকবে না?
খাবারের ঘণ্টা বাজছে।
লালকুঠির নিয়ম সবাইকে একসঙ্গে খেতে হবে। আমি আমার পছন্দের খাবার খাব তা হবে না। প্রতিদিন একই মেনু। কোনোরকম বেশকম নেই।
এক বাটি স্যুপ।
এক বাটি সালাদ। ফিস সালাদ।
দুপিস রুটি।
এক বাটি মাংস।
এক গ্লাস ফলের রস।
খাবারের সময়টা আমার কাছে অসহ্য লাগে। কারণ খুঁজে খুঁজে আমার পাশের একটা জায়গা দখল করেন শেন। সারাক্ষণ বকবক করেন। আমি অপেক্ষা করে আছি, কবে এই মানুষটাকে নিতে সবুজ গাড়ি আসবে। ছি, কী ভয়ঙ্কর চিন্তা। আমি বদলে গেছি। ভয়ঙ্কর সব চিন্তা ক্লোজই আমার মাথায় আসে। রাতে বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখি।
গত রাতে দেখা দুঃস্বপ্নটা বলি। আমি দেখলাম, আমাকে নেবার জন্যে সবুজ গাড়ি এসেছে।
গাড়ি আমাকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলছে। গাড়ির চালক SF তরুণী রোবট বলল, ম্যাডাম, আপনার কি কোনো শেষ ইচ্ছা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাই।
অন্তরঙ্গ সময়ের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। আমরা শিশু পালনের লাইসেন্স পেয়েছি। আমি গর্ভধারণ করতে চাই।
SF রোবট বলল, অনুমতি দেয়া হলো।
সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নে আমি চলে গেলাম আমার ঘরে। গিয়ে দেখি কুন সংসার করছে মীন নামের SF রোবটের সঙ্গে। তাদের একটা সন্তান হয়েছে। মীনের কোলে সেই সন্তান। কুন আমাকে দেখে বলল, তুমি কে?
আমি বললাম, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি নিনিতা।
কুন বলল, নিনিতা বলে কাউকে আমি চিনি না।
মীন বলল, যাকে চেন না তার সঙ্গে কথা বলছ কেন? ওকে ঘর থেকে বের করে দাও।
ওরা দুজন মিলে জোর করে আমাকে বের করে দিল। এই দৃশ্য দেখে মীনের কোলের সন্তানটা মহাখুশি। হাততালি দিচ্ছে এবং বলছে—মা নাই। মা চলে গেছে।
অসুস্থ মানুষের দুঃস্বপ্নগুলিও হয় অসুস্থ। আমি প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। আমি এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চাই।
.
নিনিতার মনে মনে ভায়েরি লেখা বন্ধ করতে হলো। তার দরজার পাশে সবুজ গাড়ির SF তরুণী দাঁড়িয়ে।
নিনিতা বলল, কী ব্যাপার?
আপনাকে যেতে হবে।
এখন?
হ্যাঁ এখন।
তোমরা তো ভোরবেলায় আস। এখন কেন?
রোবট তরুণী মিষ্টি করে হাসল।
নিনিতা বলল, শেষ ইচ্ছা পূরণের কোনো ব্যবস্থা কি তোমাদের আছে? স্মৃতি নষ্ট করার আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছা কি পূরণ হবে?
ম্যাডাম! এমন কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই।
আমি বিশেষ কিছু চাচ্ছি না। আমি শুধু আমার স্বামীকে একবার হ্যালো বলব।
সম্ভব হবে না।
আমি কি এখানে যারা আছে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি? সবাই ডাইনিং রুমে আছে।
হ্যাঁ পার।
নিনিতা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
ডাইনিং রুমে নিনিতাকে নিয়ে ঢুকল SF তরুণী। সবাই খাওয়া বন্ধ করে চমকে তাকাল। নিনিতা বলল, আমাকে নিতে সবুজ গাড়ি এসেছে। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি যদি আমার ব্যবহারে কাউকে আহত করে থাকি, তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। বিদায়। আবার হয়তো আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে, তখন আমি কাউকে চিনতে পারব না।
নিনিতার গলা ধরে এল। শেন উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, এখানে যারা উপস্থিত তাদের বলছি এবং হাস্যমুখী SF রোবট তরুণীকে বলছি–নিনিতা নামের যে মেয়েটিকে আজ তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবার জন্যে সে কোনো অপরাধ করে নি। কেন তাকে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে তা সে জানে না। আমরা মানুষ। যেহেতু লালকুঠিতে বাস করছি আমরা জানার অধিকার হারিয়েছি। আপনারা সবাই রোবট তরুণীর দিকে একটু তাকান। দেখুন সে হাসছে। সবাইকে বলা হয় SF রোবট মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট। এই কি আবেগের নমুনা? একজন নিরপরাধ তরুণীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে সে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তার মুখভর্তি হাসি। ধিক রোবট শাসিত পৃথিবী। ধিক ধিক।
এই পর্যন্ত বলেই শেন আচমকা তার খাবারের প্লেট ছুঁড়ে দিল রোবট তরুণীর দিকে। রোবট তরুণী দ্রুত মাথা নিচু করায় কিছু হলো না। ঝনঝন শব্দে খাবারের প্লেট ভাঙল। চারদিকে খাবার ছড়িয়ে পড়ল।
রোবট তরুণী বলল, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না। এই চেষ্টা কারো জন্যেই সুফল বয়ে আনে না।
শেন ক্ষিপ্ত গলায় বলল, সুফল আমি তোর… ঢুকিয়ে দেই।
রোবট তরুণী বলল, আপনি খেতে বসুন। উত্তেজনা পরিহার করুন।
শেন বলল, চুপ কুত্তি। তুই রোবট, তুই উত্তেজনা পরিহার করবি। আমরা মানুষ। আমরা উত্তেজনা পরিহার করি না। তুই তোর সুন্দর হাসিমুখ নিয়ে বিদেয় হ। নয়তো আমি তোর মুখে পিশাব করে দেব।
আপনি নামি বিজ্ঞানীদের একজন। মহান আবিষ্কারক। আপনার কাছ থেকে ভদ্র ভাষা আশা করছি।
হা করে কথা বলবি না কুত্তি। আরেকবার মুখ খুললে তোর মুখে আমি হেগে দেব।
রোবট তরুণী নিনিতাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
.
গাড়ি দ্রুতবেগে চলছে। নিনিতা দুহাতে মুখ ঢেকে আছে। তার আশেপাশের কিছুই দেখতে ইচ্ছা করছে না। গাড়ি চালাচ্ছে রোবট তরুণী। সে বলল, আমার নাম এলিতা। তোমার নামের সঙ্গে মিল আছে। তোমার নামের শেষে আছে। আমার নামের শেষেও তাঁ।
নিনিতা জবাব দিল না। এলি বলল, আজকের ডাইনিং হলের ঘটনাটা ভাবছি। তোমর মানুষরা যে এত দ্রুত উত্তেজনার শেষ সীমায় পৌঁছতে পার আমার জানা ছিল না।
নিনিতা বলল, তোমার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আমার ভালো লাগছে না।
এলিতা বলল, ডাইনিং হলে আমি হাসছিলাম। কাজটা ঠিক হয় নি। আমার উচিত ছিল গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা। আমি মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট। আমি যেহেতু জানি তুমি খুবই আনন্দময় একটা ঘটনার মুখোমুখি হবে—আমি আমার আবেগ লুকাতে পারি নি।
স্মৃতি নষ্টের প্রক্রিয়াটা যে আনন্দজনক তা জানতাম না।
আচমকা গাড়ি থামল। পুরোপুরি থেমে গেল। এলি বলল, আমি তোমাকে তোমার স্বামীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ঘটনাটা কি যথেষ্ট আনন্দজনক না?
নিনিতা বলল, ঠাট্টা করছ?
এলিতা বলল, ঠাট্টা ব্যাপারটা আমরা ঠিক বুঝি না। উদ্ভট কিছু বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলাটা না-কি ঠাট্টা! আমি উদ্ভট কিছু বলছি না। তোমাকে আমি তোমার ঘরের সামনে নামিয়ে দেব। তুমি আচমকা ঘরে ঢুকে তোমার স্বামীকে চমকে দেবে। পেছনের সিটে একটা গিফট বক্স আছে। গিফট বক্সে চারটা টিটান ড্রিংসের বোতল এবং মঙ্গলগ্রহের রেড নাটস আছে। রেড নাটস কখনো খেয়েছ?
না।
অতি স্বাদু জিনিস। তবে সামান্য হেলুসিনেশন হতে পারে। সবার হয় না। কারো কারো হয়।
যা বলছ সত্যি বলছ?
এলি বলল, SF রোবটদের মিথ্যা বলার ক্ষমতা আছে। তবে আমি যা বলছি সত্যি বলছি। তুমি গিফট বক্স হাতে নিয়ে স্বামীর কাছে যাচ্ছি।
আমাকে এতদিন আটক রাখা হয়েছিল কেন?
তোমার ওভারীতে Eggs তৈরি হচ্ছিল না। এরকম পরিস্থিতিতে প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হলে শরীর Eggs তৈরি করে। শরীর যখন ধরে নেয় সে মারা যাচ্ছে তখন সে চেষ্টা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রেখে যেতে, তখনি Eggs তৈরি হয়।
সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।
গাড়ি কি স্টার্ট দেব? না-কি আরো কিছু জানতে চাও?
আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে চাই।
এলিতা বলল, মানুষের আবেগের ধারেকাছে যাওয়া কোনো রোবটের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাও?
নিনিতা ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, চাই।
Leave a Reply