০৯. মিসির আলি চোখ মেললেন

স্যার, চোখ মেলুন।

মিসির আলি চোখ মেললেন। তাঁর কাছে মনে হল তিনি হাসপাতালে আছেন। তাঁকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। এই ডাক্তার লাল সোয়েটারের ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে।

স্যার, আপনি একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আছেন এবং ভালো আছেন। আপনার শরীর খাদ্য গ্রহণের জন্য এখনো তৈরি না বলে আপনাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। স্যার, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?

পারছি।

পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে চান। কথা বলবেন?

হুঁ।

পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব এসে সামনে দাঁড়ালেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মিসির আলির এখন মনে হল, তাঁর হেলুসিনেশন হচ্ছে না। তিনি বাস্তবে বাস করছেন। হেলুসিনেশনের দৃশ্যগুলো চড়া রঙে আঁকা হয়। এখন তা না।

মিসির আলি বললেন, আমি কত দিন বন্দি ছিলাম?

রকিব বললেন, ছয় দিন।

আমি বন্দি—এই খবর আপনাদের কে দিল?

একজন মহিলা টেলিফোনে জানিয়েছেন। তাঁর নাম পারুল।

কবে জানিয়েছে?

যেদিন আপনাকে আটকানো হয় তার পরদিন ভোরবেলা। আমরা তাঁর কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেই নি। কারণ এই মহিলা উদ্ভট সব কথা বলছিলেন। তাঁর মৃত শ্বশুর জীবিত হয়ে ফিরে এসেছেন, এইসব হাবিজাবি।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। কথা বলতে বা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, স্যার, আপনি রেস্ট নিন। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আপনার কিছু সাহায্যও আমাদের দরকার। মৃত মানুষকে জীবিত দেখার ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। একজন দাবি করছেন, তিনি মল্লিক সাহেব। তাঁর কর্মচারীরাও তা-ই বলছে।

মিসির আলি চোখ না মেলেই বললেন, একজন মৃত মানুষ কখনোই জীবিত হয়ে ফিরবে না। এটা মাথায় রাখুন। আমার ধারণা আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারব। তবে সুস্থ হওয়ার জন্য আমাকে কিছুটা সময় দিন।

রকিব বললেন, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। চোখ মেললেন তের ঘণ্টা পর। শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

.

মুন হাউস হোটেলে ২১২ নম্বর ঘর। সময় সন্ধ্যা ৭টা।

মিসির আলি বিছানায় বসে আছেন। তাঁর সামনে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে মল্লিক সাহেব বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের মুখ হাসি হাসি। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন।

কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট একটা নাটক হয়েছে। নাটক দেখেও তিনি তৃপ্তির হাসি হেসেছেন।

নাটকটার প্রধান চরিত্র জসু। সে মিসির আলির জন্য চা নিয়ে এসেছিল। ঘরে ঢুকে মল্লিক সাহেবকে বসে থাকতে দেখে আর্ত চিৎকার দিল—ও আল্লাগো! হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মল্লিক সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ভয় খাইছে। প্যান্টে পিশাব না করে দেয়।

মিসির আলি বললেন, ভয় পাওয়ারই কথা। সবার কাছে আপনি একজন মৃত মানুষ। আপনার শবদেহ কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। তারপর আপনাকে জীবিত দেখা যাচ্ছে। আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন।

মল্লিক দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, পুরা ঘেংড়া অবস্থা!

মিসির আলি বললেন, ঘেংড়া অবস্থা মানে কী?

পাবলিক তো ভয় খাবেই।

অতিরিক্ত বেড়ছেড়াকে বলে ঘেংড়া অবস্থা। পাবলিকের ভয় খাওয়ারই কথা। পুলিশও ভয় খাচ্ছে। ঘটনা শোনেন, মজা পাবেন। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব সাহেবের সঙ্গে হাত মিলাবার জন্য হাত বাড়ালাম, উনি লাফ দিয়ে দুই ফুট সরে গেলেন। একমাত্র আপনাকে দেখলাম ভয় খান নাই। আপনাকে দেখে কিছুটা আচানক হয়েছি। আপনি কেন ভয় খান নাই?

মিসির আলি বললেন, আমি জানি মৃত মানুষ কখনো জীবিত হয়ে ফেরে না। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। এইজন্য ভয় পাই নি।

মল্লিক সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, অন্য ব্যাপারটা কী? আমারে একটু বুঝায়ে বলেন।

মিসির আলি বললেন, আপনার যমজ ভাই আছে, যে দেখতে অবিকল আপনার মতো। সে মারা গেছে অথবা খুন হয়েছে। তার ডেডবডি কুয়ায় ফেলা হয়েছে। আপনার না।

মল্লিক সাহেব গলা নামিয়ে বললেন, আমার যমজ ভাই আছে, তার বিষয়ে কেউ জানল না—এটা কেমন কথা!

মিসির আলি বললেন, কেউ জানে না তা ঠিক না। আপনার দুই ছেলে তো প্রায়ই বলত, এরা দু’জন মল্লিককে দেখে। একজন ভালো। একজন মন্দ।

পাগলের কথা আপনি ধরবেন? দু’টাই পাগল। নির্বোধ পাগল। প্রায়ই দেখবেন এরা কানে ধরে উঠবোস করছে। কেউ তাদের কানে ধরে উঠবোস করতে বলে নাই। তারপরেও করছে। বলুন তো কেন?

মিসির আলি বললেন, জানি না কেন?

অনুমান করতে পারেন?

না। অনুমানও করতে পারছি না।

মল্লিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই দুই ছাগলকে আমি প্রায়ই একশ বার পঞ্চাশ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলি। এরা অ্যাডভান্স করে রাখে। খাতায় লেখা থাকে। সেখান থেকে বাদ দেয়। এদের কোনো কথার উপর বিশ্বাস রাখা যায়? আপনি বলেন? পাগলের সাক্ষী কি কোর্ট গ্রাহ্য করবে? চুপ করে থাকবেন না। কথা বলেন।

মিসির আলি বললেন, পাগলের সাক্ষ্য কোর্ট গ্রাহ্য করে না।

এই তো এখন পথে আসছেন। বড় পুত্র ছক্কার ছেলে মারা গেল। কিসমত নাম। তার মধ্যে কোনো বিকার নাই। এক ফোঁটা চোখের পানি নাই। আরেকজনের বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে।

মিসির আলি বললেন, কিসমত কার ছেলে এই নিয়ে মনে হয় বিতর্ক আছে।

মল্লিক বললেন, কোনো বিতর্ক নাই রে ভাই। বিতর্ক দুই বদ পুলার দুই বদ স্ত্রী তৈরি করেছে। কুৎসিত নোংরা কথা চালু করেছে। এইজন্য এদের একজনরে আমি ডাকি বড়কুত্তি, আরেকজনরে ডাকি ছোটকুত্তি। আরে কুত্তি, তোদের শ্বশুর নাকি তোদের তার সাথে সেক্স করতে বলে। এরকম ঘটনা ঘটলে তোরা কেন সোনামুখ করে তার কাছে যাবি? কেন পাবলিকরে বলবি না? পুলিশের কাছে যাবি না? মিসির আলি সাহেব, বলেন, আমার কথায় কি যুক্তি আছে?

মিসির আলি বললেন, যুক্তি আছে।

মল্লিক বললেন, বড়কুত্তিটা আবার বলে তার কোনো সন্তানাদি নাই। আরে কুত্তি, সিজারিয়ান করে তোর পেটের সন্তান বের করা হয়েছে। পেটে সিজারিয়ানের দাগ আছে।

মিসির আলি বললেন, সে তা হলে মিথ্যাটা কেন বলছে?

মল্লিক সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানি না। আমি যেমন জানি না, যারা এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে তারাও জানে না। আমি ঘটনা জানার অনেক চেষ্টা নিয়েছি ভাইসাহেব। বড়কুত্তিটাকে তিন দিন খাওয়া পানি ছাড়া আটকায়ে রেখেছিলাম। ঘটনা কী বল। বললে ছাড়া পাবি।

ঘটনা বলেছে?

না, বলে নাই। তবে এই বিষয়ে আমার অনুমান একটা আছে। অনুমান সত্য কি না জানি না।

কী অনুমান শুনি?

দুই মেয়ে এই ধরনের কথা বলেছে যাতে আমার দুই পুত্র আমার উপর রাগ করে। আমাকে খুন করে। সমস্যা কি জানেন? আমার দুই পুত্রের রাগ করার ক্ষমতা নাই। একবার কী হল ঘটনা শুনেন। বাড়ির একটা বিড়াল মটরগাড়ির চাকার নিচে পড়ে মারা গেল। আমার দুই পুত্র দানাপানি বন্ধ করে দিল। দুইজনে দুইজনের গলা জড়ায়ে ধরে কাঁদে। আমি বললাম, বিড়াল তোদের বাপ না মা? বিড়াল মরে গেছে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস? কানে ধরে পঞ্চাশবার উঠবোস কর, তারপর খেতে বস। তারা দু’জনেই বলল, জি আচ্ছা। পঞ্চাশবার কানে ধরে উঠবোস করল, তারপর মল্লিক বিরানি হাউস থেকে দুই প্লেট বিরানি খেয়ে ঘুমাতে গেল, যেন কিছুই হয় নাই। আমি যে কথাগুলি বললাম, সেগুলি কি বিশ্বাস হচ্ছে?

হচ্ছে।

এখন আপনাকে আসল কথা বলি। এতক্ষণ যা বললাম সবই ফালতু কথা। আসল কথা হচ্ছে, আমি বাবা-মা’র এক সন্তান। আমার কোনো যমজ ভাই নাই। আপনি এবং পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও কোনো যমজ ভাইয়ের সন্ধান পাবেন না।

মিসির আলি বললেন, কুয়াতে যে ডেডবডি পাওয়া গেল সেটা তা হলে কার?

মল্লিক সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, খুঁজে বের করেন কার। সিআইডি মিআইডি কী কী যেন আছে, সবে মিলে খুঁজুক। বার করুক ডেডবডি কার। ইন্সপেক্টর রকিব সাহেব যদি প্রমাণ করতে পারেন ডেডবডি আমার যমজ ভাইয়ের, তা হলে আমি উনার পিশাব গ্লাসে ভর্তি করে চুমুক দিয়ে খাব। এক হাজার বার কানে ধরে উঠবোস করব। এখন ভাই আমি বিদায় নিব। আপনাকে একটা শেষ কথা বলি। আমার উপর কোনো রাগ রাখবেন না। আমি আপনাকে আটকাই নাই। বড়কুত্তি আটকায়েছে। সে ভালো সাজার জন্য পরদিনই পুলিশকে টেলিফোন করেছে। এমনভাবে করেছে যে, পুলিশ তার কথা পাগলের প্রলাপ ভেবেছে। আমি যখন টের পেলাম ঘরে কেউ আটক আছে তখন থানা থেকে পুলিশ নিয়ে এলাম। রকিব সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেই আমার কথার সত্যতা পাবেন। ভাইসাহেব, ইজাজত দেন। বিদায় নেই। আসসালামু আলায়কুম।

ব্যক্তিগত কথামালায় মিসির আলির সর্বশেষ লেখা
বিষয় : মল্লিক সাহেব

পুলিশ ব্যাপক অনুসন্ধান করেও মল্লিক সাহেবের কোনো যমজ ভাই আছে তা প্রমাণ করতে পারে নি। আমি অনেক চেষ্টা করেও পুলিশকে DNA পরীক্ষায় রাজি করাতে পারি নি। মৃত মানুষ এবং মল্লিক সাহেবের DNA পরীক্ষার ফলাফল তদন্তে সাহায্য করত।

আমার কাছে মনে হচ্ছে, পুলিশ তদন্তের বিষয়েও আগ্রহী না। ছক্কা-বক্কাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তারা আগের মতোই আছে। দুই ভাই বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে। একসঙ্গে স্নান করছে। সময় পেলেই কানে ধরে উঠবোস করে খাতায় হিসেব জমা করছে। মল্লিক সাহেব নিয়ম করে হোমিও ক্লিনিকে বসছেন। রোগী দেখছেন। সব আগের মতো চলছে।

মল্লিক পরিবারের রহস্য সমাধানের চেষ্টা আমি করেছি। সমাধান করতে পারি নি। মল্লিক সাহেব সহায়তা করলে হয়তো কিছু হতো। তিনি সহযোগিতার ধারে কাছেও নাই। তিনি আমার কাছে যে একেবারেই আসেন না, তা না। মাঝে মধ্যেই আসেন, নানান বিষয়ে কথা বলেন, একটি বিষয় ছাড়া। অবিকল তাঁর মতো দেখতে যে মানুষটির মৃতদেহ কুয়া থেকে তোলা হল সে কে? তাঁর সঙ্গে মল্লিক সাহেবের সম্পর্ক কী?

মাল্টিপল পার্সোনালিটি মনোবিজ্ঞানের স্বীকৃত বিষয়। একজন ভালো মানুষ এবং একজন মন্দ মানুষ একজনের মধ্যে বিকশিত হতে পারে। ভালো মানুষ মল্লিক এবং মন্দ মানুষ মল্লিক—একই ব্যক্তি। এটি মনোবিজ্ঞানে গ্রাহ্য। কিন্তু দু’জন আলাদা দুই মানুষ, যাদের একজনকে খুন করা যায়, তা কী করে হয়?

আমি চেষ্টা করেছি চম্পা ও পারুলের সঙ্গে কথা বলতে। তারা রাজি হয় নি।

এই দুই মেয়ে মল্লিককে খুন করেছে বলে যে দাবি করছে ত মিথ্যা। অ্যান্টাসি নামে কোনো ইঁদুর মারা বিষ নেই। অ্যান্টাসি নামটাও হঠাৎ করে তাদের মাথায় এসেছে। অ্যান্টাসিড থেকে ‘ড’ বাদ দিয়ে অ্যান্টাসি। মল্লিক সাহেবের বাড়িতে গোটাচারেক বিড়াল আছে। যে বাড়িতে বিড়াল থাকে সে বাড়িতে ইঁদুর থাকে না।

আমি একপর্যায়ে জীবিত এবং মৃত মল্লিকের DNA পরীক্ষা নিজ খরচে করতে চেয়েছিলাম, তাও সম্ভব হল না। পরীক্ষাটা হয় সিঙ্গাপুরে। যে পরিমাণ অর্থ পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন, তা আমার ছিল না।

আমি নিজেও মনে হয় মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। প্রায়ই যে ঘরে বন্দি ছিলাম সেই ঘর স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে লাল টেলিফোন বাজতেই থাকে। আমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় একজন বলে—DNA টেস্ট করা হয়েছে। রিপোর্ট লিখে নিন। জীবিত এবং মৃত দু’জনের একই DNA, অর্থাৎ দু’জন একই ব্যক্তি।

স্বপ্ন আর কিছুই না, আমার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন। আমি কি তা হলে ভাবছি, মৃত এবং জীবিত একই মানুষ? এর মানেই বা কী?

আমি মুন হাউস হোটেলের ২১২ নম্বর ঘরে এখনো আছি। কাক— দম্পতির ওপর লক্ষ রাখছি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েছে। কাক- দম্পতির সে-কী আনন্দ! তাদের আনন্দ দেখে মল্লিক পরিবারের জটিলতা ভোলার চেষ্টা করছি। যখন মনে হয় পুরোপুরি ভুলে গেছি, তখনই স্বপ্নে লাল টেলিফোন বেজে ওঠে। কেউ-একজন বলে, জীবিত এবং মৃত মল্লিক একই ব্যক্তি। প্লিজ, টেক নোট!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *