০৫. মিসির আলি খাতা খুলে বসেছেন

মিসির আলি খাতা খুলে বসেছেন। আজকের দিন শুরু করবেন ব্যক্তিগত কথামালায় এক পাতা লিখে। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, পিরিচে টোস্ট বিস্কুট। সকালের প্রথম চা। জসু পরোটা-ভাজি আনতে গেছে। সে নিজে ভালো পরোটা বানায়, তবে নিজের বানানো পরোটা সে খেতে পারে না। তার পরোটা-ভাজি সে দোকান থেকে কিনে আনে। দুপুরে প্রায়ই সে মল্লিক সাহেবের কাচ্চি হাউস থেকে খেয়ে আসে। কাচ্চি হাউসের লোকজন তাকে চেনে। জসুকে টাকা দিতে হয় না।

মিসির আলি লিখছেন —

নাতিদের প্রসঙ্গে মল্লিক সাহেব দু’বার আমাকে বলেছেন, তাঁর এক হালি নাতি। দুই নাতি এবং দুই নাতনি

আমি তাঁর দুই নাতির কথাই জানি। জসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেও দুই জনের কথাই বলছে।

মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে যেমন তাদের দুই বাবাকে দেখে, মল্লিক সাহেবও কি একইভাবে দুই নাতির জায়গায় চার নাতি দেখেন? বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। হাতে সময় আছে।

মল্লিক সাহেবের বাড়ির অবস্থা শান্ত। ‘পশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্চুপ’- টাইপ শান্ত। একটি শিশু মারা গেছে, তার প্রভাব কারো ওপরেই মনে হয় পড়ে নি। ছক্কা-বক্কা ছেলে কোলে নিয়ে আগের মতোই হাঁটাহাঁটি করছে। আগে দু’জনের কোলে দুটি ছেলে থাকত। এখন একজন ভাগাভাগি করে দু’জনের কোলে থাকছে।

সুরমা হোমিও হাসপাতালে মল্লিক সাহেব নিয়মিত বসা শুরু করেছেন। সুরমা তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম।

এই স্ত্রীকে মনে হয় মল্লিক সাহেব খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর বেবিটেক্সির প্রতিটির পেছনে লেখা, ‘সুরমা পরিবহন’।

মল্লিক সাহেবের প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো আমার হাতে নেই। মহিলা রূপবতী ছিলেন, সব সময় বোরকা পরে

থাকতেন। ঘরের মধ্যেও বোরকা খুলতেন না।

এই বাড়ির সবকিছুই জট পাকিয়ে আন্ধা গিট্টু হয়ে আছে। এই জাতীয় আন্ধা গিট্টুর সুবিধা হচ্ছে, কোনোরকমে একটা গিট্টু খুলে ফেললে বাকিগুলি একের পর এক আপনাতেই খুলতে থাকে। আমাকে অবশ্যি গিট্টু খোলার দায়িত্ব কেউ দেয় নি। কর্মহীন মানুষ কর্ম খুঁজে বেড়ায়। আমার মনে হয় এই দশাই চলছে।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ঠাণ্ডা সরপড়া চায়ে চুমুক দিলেন। তাঁর মুখ সামান্য বিকৃতও হল না। নিজের মনেই ভাবলেন, এক ধরনের নির্বিকারত্ব সবার মধ্যেই আছে। তিনি যেমন চায়ের ঠাণ্ডা গরম বিষয়ে নির্বিকার, মল্লিকের দুই পুত্রও আশপাশে কী ঘটছে সেই বিষয়ে নির্বিকার। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের শিশুপুত্র বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। অবশ্য এই শিশুটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে তা না। মল্লিক সাহেব তার চিকিৎসা করেছেন। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেন নি। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শিশুদের জন্য বিষ।

সিগারেট হাতে বারান্দায় এসে মিসির আলি অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলেন। মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কানে ধরে উঠবোস করছে। কতবার উঠবোস করা হচ্ছে তারা সেই হিসেবও রাখছে। শব্দ করে বলছে–৪১, ৪২, ৪৩ ..

ছক্কা-বক্কা দুই ভাইয়ের একটির শিশুপুত্র দু’জনের মাঝখানে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। তার হাতে কাঠি লজেন্স। সে লজেন্স চুষছে।

এ ধরনের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। মিসির আলি ঘরে ঢুকে The Others Side of Black Hole বই খুললেন। বিজ্ঞান যে পর্যায়ে চলে গেছে এখন যে কোনো গাঁজাখুরি গল্পও বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ব্ল্যাকহোলের বইটিতেও লেখক এই জিনিস করেছেন। কঠিন বিজ্ঞানের লেবাসে কল্পগল্প।

চাচাজি আসব?

মিসির আলি চমকে তাকালেন। দুই ভাই মুখ কাঁচুমাচু করে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে বাচ্চাটি নেই। মিসির আলি বই বন্ধ করে বললেন, এসো।

দুই ভাই ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।

চাচাজি, আপনার ঘরে একটু বসি?

বসো। কোনো সমস্যা নেই। চা খাবে?

জি-না।

সকালের নাশতা করেছ?

জি। বিরিয়ানি খেয়েছি।

কথা বলছে বড়ভাই। ছোটভাই ঠোঁট নাড়াচ্ছে। এইবার ছোটভাই কথা শুরু করল, বড়জন চুপ।

বাবা এক শ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলেছিলেন, আমরা এক শ দশ বার করেছি। দশটা ফ্রি করে দিয়েছি। ভালো করেছি না চাচাজি?

অবশ্যই ভালো করেছ। শাস্তিটা হয়েছে কী জন্য? অপরাধ কী করেছিলে?

উনার দিকে তাকিয়ে হেসেছি।

হেসে ফেলার জন্য শাস্তি?

খারাপ হাসি হেসেছি চাচাজি।

হাসির ভালো-খারাপ আছে?

জি আছে।

মিসির আলি বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটা খারাপ হাসি দাও তো। দেখি ব্যাপারটা কী?

দুই ভাই চুপ করে আছে। মনে হয় তাদের পক্ষে খারাপ হাসি দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব না।

ছোটভাই বলল, চাচাজি, আপনি কি অন্য ঘরে যাবেন? আমরা এখন বেয়াদবি করব।

কী বেয়াদবি করবে?

সিগারেট খাব।

আমার সামনে খাও। অসুবিধা নেই।

চাচাজি, মন থেকে অনুমতি দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

আপনার মতো মানুষ ত্রিভুবনে কম আছে।

বলতে বলতে বড়ভাই শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করল। একটা সিগারেটই দু’জনে মিলে টানছে। কুৎসিত গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। তারা যে সিগারেট টানছে তা সাধারণ সিগারেট না। গাঁজাভর্তি সিগারেট।

মিসির আলির মনে হল রহস্যের একটা জট খুলেছে। গাঁজা ডিলিউশনের দরজা খুলে দেয়। এইজন্যই লোকগানে বলা হয়—’গাঁজার নৌকা শূন্যের ভরে যায়।’

বক্কা বিনীত গলায় বলল, চাচাজি কি একটা টান দিবেন?

মিসির আলি বললেন, না। তোমরা কি নিয়মিত খাও?

দুই ভাই একসঙ্গে বলল, জি-না। আজ একটা বিশেষ দিন।

বিশেষ দিন কী জন্য?

দুই ভাইয়ের কেউই জবাব দিল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল।

তার মিনিট দশেকের মাথায় জিপভর্তি করে পুলিশের গাড়ি চলে এল। পুলিশের কাছে দুই ভাই স্বীকার করল, তারা ধাক্কা দিয়ে তাদের বাবাকে কুয়ায় ফেলে দিয়েছে।

দমকল বাহিনীর লোক এসে গহিন কুয়া থেকে অনেক ঝামেলা করে মল্লিক সাহেবের ডেডবডি উদ্ধার করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *