০৩. মল্লিক সাহেবের দুই পুত্ৰ

মল্লিক সাহেবের দুই পুত্র মিসির আলির সামনে বসে আছে। তাদের বসার ভঙ্গি আড়ষ্ট, দৃষ্টি এলোমেলো। তবে এলোমেলো দৃষ্টিতেও শৃঙ্খলা আছে। এক ভাই ছাদের দিকে তাকালে, অন্য ভাইও ছাদ দেখে। ছাদ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একজন যদি জানালা দিয়ে তাকায়, অন্যজনও জানালার দিকে তাকায়। কে কাকে অনুসরণ করছে? মিসির আলির কাছে স্পষ্ট না। কেউ কাউকে অনুসরণ করছে এরকমও মনে হচ্ছে না। সম্ভবত যা করছে একসঙ্গে করছে।

দুই ভাইয়ের চেহারায় কোনো মিল নেই। বড়ভাই (শফিকুল গনি ছক্কা) শ্যামলা, মোটাসোটা, বেঁটে। ছোটভাই (আবদুল গনি বক্কা) ফর্সা, রোগা পাতলা এবং লম্বা। দু’জনেরই গোঁফ আছে। লুঙ্গির ওপর হাফ হাতা শার্ট। একই রঙের লুঙ্গি (সবুজ), একই রঙের শার্ট (কমলা)। মিসির আলি মনে করার চেষ্টা করলেন এরা আগেও মিল করে শার্ট পরত কি না। তাদের জুতাও একই রকম—কালো রাবারের জুতা।

শফিকুল গনি বলল, চাচা, ভালো আছেন?

মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।

আবদুল গনি বলল, একটা কাগজ আপনাকে দেখাতে এনেছি। আপনার পরামর্শ দরকার।

মিসির আলি বললেন, কাগজ দেখাও।

দুই ভাই চুপ করে বসে রইল। কোনো কাগজ বের করল না। দু’জনই ডান পা নাচাচ্ছে এবং অতি দ্রুত নাচাচ্ছে। ‘মিসির আলি এর আগে কাউকে এত দ্রুত পা নাচাতে দেখেন নি।

শফিকুল গনি বলল, একটা হ্যান্ডবিল ছাপাব, লেখা ঠিক আছে কি না যদি দেখে দেন।

মিসির আলি বললেন, দেখে দিব। কাগজটা দাও।

এবারো কাগজ বের হল না। দুই ভাই আগের নিয়মে পা নাচাচ্ছে, তবে এবার নাচাচ্ছে বাঁ পা। মিসির আলি কাগজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছেন এই দুই ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী কি না। সম্ভাবনা প্রবল। কাগজটা দেখে দিন বলার পরও তারা কাগজ বের করছে না—এটা মানসিক ক্ষমতার অভাবই বোঝায়।

তোমরা চা খাবে?

দু’জন একই সঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ল।

তোমাদের বাবার কোনো খোঁজ কি পাওয়া গেছে?

দু’জন আবারো একই সঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ল।

কাগজের কথা বলছিলে, কাগজটা কি আসলেই দেখাবে?

দু’জন একই সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল, তবে কাগজ বের করল না।

জসু ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। ট্রেতে তিন কাপ চা। দুই ভাই আগে চা খাবে না বলেছে, এখন দু’জন একই সঙ্গে অতি দ্রুত চায়ের কাপ নিল এবং অতি দ্রুত চা শেষ করল। প্রায় শরবত খাওয়ার মতোই বড় বড় চুমুক দিল। মিসির আলি এই দুই ভাইয়ের মতো এত দ্রুত গরম চা কাউকে খেতে দেখেন নি।

শেষ পর্যন্ত ছোটভাই আবদুল গনি বক্কার শার্টের পকেট থেকে কাগজ বের হল। পরিষ্কার ঝকঝকে হাতের লেখা। মানসিক প্রতিবন্ধীদের হাতের লেখা সুন্দর হয়। মিসির আলি বিজ্ঞাপনটা দু’বার পড়লেন।

সন্ধান চাই

আমাদের পিতাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ সন্ধান দিলে তাকে কুড়ি হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দেওয়া হইবে। কোনো পুলিশ ভাই যদি সন্ধান দেন, তিনিও পুরস্কারের দাবিদার হবেন। যদি কয়েকজন একত্রে সন্ধান দেন, তবে পুরস্কারের টাকা সমভাবে তাহাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এই নিয়ে কোনো বিবাদ বিসংবাদ করা যাইবে না।

বিবাদ উপস্থিত হইলে আমাদের দুই ভাইয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গণ্য হইবে।

ইতি
শফিকুল গনি ছক্কা (বড়ভাই)
আবদুল গনি বক্কা (ছোটভাই)

মিসির আলি বললেন, হ্যান্ডবিলে কি তোমাদের বাবার ছবি যাবে?

জি-না, ছবি পাওয়া যায় নাই।

ছবি না পেলে তাঁর একটা বর্ণনা দিতে হবে। তা না হলে মানুষ বুঝবে কীভাবে এ মল্লিক দেখতে কেমন। তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম আছে, কিন্তু ঠিকানা কোথায়? শফিকুল গনি বলল, ঠিকানা ইচ্ছা করে দেই নাই। ঠিকানা দিলে বাজে লোক ঝামেলা করবে। বলবে, এই জায়গায় দেখেছি। ওই জায়গায় দেখেছি।

মিসির আলি বললেন, ঠিকানা ছাড়া তোমাদের সন্ধান দিবে কীভাবে?

আবদুল গনি বলল, সন্ধান না দিলেও অসুবিধা হবে না।

মিসির আলি বললেন, আমি তোমাদের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমাদের কাছে যদি মনে হয় বিজ্ঞাপন ঠিক আছে তা হলে ঠিক আছে।

দুই ভাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তাদের আনন্দিত মনে হচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, যে সোফাটায় তোমরা এতক্ষণ বসে ছিলে সেটা তোমাদের। কাউকে পাঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।

শফিকুল গনি বলল, চাচাজি। এটা আপনার কাছে রেখে দিন। এটা আমার বাবার একটা স্মৃতি।

মিসির আলি বললেন, স্মৃতি বলছ কেন? তোমরা কি নিশ্চিত তিনি মারা গেছেন?

দুই ভাই একসঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মৃত যদি তোমরা জানো তা হলে সন্ধান চেয়ে হ্যান্ডবিল ছাপাচ্ছ কেন?

শফিকুল গনি বলল, কেউ যেন না ভাবে আমরা সন্ধান করি নাই। চাচাজি যাই।

তোমরা হ্যান্ডবিলে ঠিকানা দাও নাই, এটা লোকজনের চোখে পড়বে না?

আবদুল গনি বলল, এটা নিয়ে কেউ কিছু মনে নিবে না। সবাই জানে আমরা বোকা।

মিসির আলি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তিনি ব্যক্তিগত কথামালার খাতা খুললেন। ‘ছক্কা-বক্কা দুই ভাই’ শিরোনামে কিছুক্ষণ লিখলেন। তাঁর লেখা—

হুক্কা বক্কা দুই ভাই

বাবা-মায়ের উদ্ভট মানসিকতার কারণে অনেক সন্তানদের উদ্ভট ডাকনাম নিয়ে সমাজে বাস করতে হয়। আমার জানা মতে, কিছু উদ্ভট ডাকনাম—

নাট-বল্টু (দুই যমজ ভাই। বাবা বুয়েট থেকে পাস করা আর্কিটেক্ট)

ডেঙ্গু (এক ডাক্তার বাবার পুত্রের নাম)

অঙ্ক, মানসাঙ্ক (বাবা স্কুলের অঙ্ক শিক্ষক। অঙ্ক ছেলের নাম, মানসাঙ্ক মেয়ের নাম)

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ছক্কা-বক্কা সম্পর্কে বেশি কিছু তিনি জানেন না।

জসুর কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। বুদ্ধি বিষয়ক তথ্য, তবে এই তথ্য ঘোলাটে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছক্কা-বক্কা এই দুই ভাইয়ের বুদ্ধি কেমন?

জসু বলল, দুই ভাই যখন একত্রে থাকে তখন বুদ্ধি নাই। আলাদা যখন থাকে তখন বেজায় বুদ্ধি।

আলাদা কখন থাকে? দুপুরে দুই ভাই দেখি কলপাড়ে একসঙ্গে গোসল করে।

জসু বলল, মাঝে মধ্যে আলাদা হয়। ধরেন, বড়ভাইরে তার পরিবার ডাক দিল। সে চইলা গেল। তখন ছোটভাই একলা।

মিসির আলি বললেন, এরা নাকি তাদের বাবাকে দুটা করে দেখে। এমন কিছু শুনেছিস?

শুনেছি। শুধু এই দুইজনই না। তাদের পরিবারও দেখেছে। ছোটভাইয়ের বউ একবার দুই শ্বশুর দেইখা ফিট পড়েছে। খাটের কোনায় লাইগা মাথা ফাটছে। হাসপাতালে নিতে হইছে। তয় এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর ফিট পড়ে না।

একই মানুষকে দু’জন দেখা বিষয়টাকে মিসির আলি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অপটিক্যাল হেলুসিনেশন। দৃষ্টি বিভ্রম। এই দুই ভাই তাদের দৃষ্টি বিভ্রম স্ত্রীদের কাছেও ছড়িয়ে দিয়েছে। সাইকোলজির পরিভাষায় এর নাম Induced Hallocination.

দৃষ্টি বিভ্রমের বড় শিকার স্কিজোফ্রেনিক রোগীরা। তাদের ব্রেইন কাল্পনিক ছবি তৈরি করে। রোগীরা সেই ইমেজ সত্যি মনে করে। তারা যে বাস্তবতায় বাস করে তার নাম Distorted reality |

স্কিজোফ্রেনিক রোগীদের ধর্মকর্মে প্রবল আসক্তি থাকে। এই দুই ভাইয়ের তা আছে। সারা দিন এরা নামাজ পড়ে না। সন্ধ্যার পর বারান্দায় জায়নামাজ বিছিয়ে বসে। অনেক রাত পর্যন্ত নামাজ পড়ে। জিকির করে।

মিসির আলি জসুকে জিজ্ঞেস করলেন, এই দুই ভাই মানুষ কেমন?

জসু বলল, অত্যধিক ভালো। সবার সাথে তাদের মধুর ব্যবহার। একটা ঘটনা বললে বুঝবেন। এই দুই ভাই গলির সামনের স্টলে চা খাইতেছে, এমন সময় আমি সামনে দিয়া যাই। বড়ভাই আমারে হাত উঁচায়ে ডাকল। মধুর গলায় বলল, জসু! আমরার সাথে এক কাপ চা খাও। যদি না খাও মনে কষ্ট পাব। এই ঘটনা শুধু যে আমার জীবনে ঘটেছে তা না। অচেনা অজানা মানুষের সাথেও ঘটেছে। অনেক ফকির মিসকিনও দুই ভাইয়ের সঙ্গে চা খেয়েছে।

এই বিষয়টা স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে কখনো ঘটে না। তারা কারো সঙ্গে মেশে না। আলাদা থাকে। তাদের বাস্তবতা আলাদা বলেই সাধারণ বাস্তবতার মানুষদের সঙ্গে মিশতে পারে না।

.

‘সন্ধান চাই’ হ্যান্ডবিল ছাপা হয়েছে। হ্যান্ডবিলে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এ মল্লিক কাচ্চি হাউসের ঠিকানা। হ্যান্ডবিল ফার্মগেটে বিলি হচ্ছে। কান্চি হাউসের কাস্টমারদেরও দেওয়া হচ্ছে।

ছাপা হ্যান্ডবিল নিয়ে দুই ভাই মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সেই আগের মতো অবস্থা। দু’জনের গায়েই এক রকম কাপড়। প্রথম দিনের মতোই দু’জন পা নাচাচ্ছে। সেই পা নাচানো অসম্ভব ‘সিনক্রনাইজড’। যেন একে অন্যের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে যুক্ত। বড়জনের ডান পা যখন নাচছে, তখন ছোটজনের ডান পা-ই নাচছে। সামান্য এদিক-ওদিকও হচ্ছে না।

ছক্কা বলল, চাচাজি ভালো আছেন?

মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।

বক্কা বলল, বাবার কুলখানির তারিখ ফেলেছি। আগামী বিষ্যুদবার বাদ মাগরেব। মিলাদ হবে, দোয়া হবে, এশার নামাজের পর বড়খানা

ছক্কা বলল, বড়খানায় থাকবে মুরগির রোস্ট, কাচ্চি বিরিয়ানি আর বোরহানি।

মিসির আলি বললেন, মৃত্যু নিশ্চিত না করেই কি কুলখানি করা যায়?

বক্কা বলল, যায়। আমরা মুনশি- মৌলবির সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ ইচ্ছা করলে নিজের কুলখানির খানা খেতেও পারে।

ছক্কা বলল, চাচাজি, আপনি কি কুলখানিতে আসবেন?

মিসির আলি বললেন, না।

বক্কা বলল, সমস্যা নাই। টিফিন ক্যারিয়ারে করে আপনার আর জসুর খানা পাঠায়ে দিব।

মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি একদৃষ্টিতে দুই ভাইকে লক্ষ করছেন। তাদের অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করার চেষ্টা। ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করে রাখতে পারলে সুবিধা হতো। ভিডিও ক্যামেরা ছাড়াই মিসির আলি একটি বিষয় লক্ষ করলেন। এক ভাই যখন কথা বলে তখন অন্য ভাই ঠোঁট নাড়ে। যে কথা বলে তার দিকে দৃষ্টি থাকে বলে অন্যজনের ঠোঁট নাড়া চোখে পড়ে না।

ছক্কা বলল, চাচাজি, যদি অনুমতি দেন তা হলে উঠি। কাজকর্ম আছে।

মিসির আলি বললেন, অনুমতি দিলাম।

অনুমতি পাওয়ার পরেও দুই ভাইয়ের কেউই উঠছে না। বিরতিহীন পা নাচিয়েই যাচ্ছে। এখন দু’জনের দৃষ্টিই ছাদের দিকে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে— ছাদে বিশেষ কিছু ঘটছে। ভীতিপ্রদ কিছু। তারা দু’জনই ভয় পাচ্ছে। একজন আরেকজনের পাশে সরে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *