০৮. শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট থেকে কয়েকটা লাইন

কেমন আছ সায়রা?

চাচা আমি ভালো আছি।

খুব ভালো আছ সেরকম মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে দুবার ইনহেলার নিলে।

আমার মন ভালো না। যখন আমার মন খারাপ থাকে তখন শ্বাসের সমস্যা হয়।

মন খারাপ কেন?

আমার হাসবেন্ডের শরীর হঠাৎ বেশি খারাপ করেছে। কাল রাতে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চেয়েছিলাম। সে রাজি হয় নি। সে বলেছে জীবনের শেষ কিছুদিন সে তার নিজের বাড়িতে কাটাতে চায়।

উনি কি নিশ্চিত যে তাঁর জীবনের শেষ সময় এসে গেছে?

উনি নিশ্চিত না হলেও আমি নিশ্চিত।

এত নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছ? ইবলিশ শয়তান এসে তোমাকে বলেছে যে তিনি মারা যাচ্ছেন?

আমাকে বলে নি। বাবাকে এসে বলেছে।

সায়রা চা খাবে?

না।

চা খাও। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। এস কিছুক্ষণ মন খুলে গল্প করি। আমার ধারণা তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।

দেখা হবে না কেন?

দেখা হবে না কারণ দেখা হবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ইবলিশ শয়তান- ঘটিত যে-সমস্যা তার সমাধান করেছি। সমাধান জানার পর তুমি যে আমার কাছে আসবে তা মনে হয় না।

সমাধান করে ফেলেছেন?

হ্যাঁ করেছি।

আপনি কি আমার লেখা পুরোটা পড়েছেন?

আমি থার্ড চ্যাপ্টার পর্যন্ত পড়েছি।

আরো দুটা চ্যাপ্টার আছে সেই দুই চ্যাপ্টার পড়বেন না?

না।

না কেন?

তুমি লেখাটা মূলত লিখেছ আমাকে কনফিউজ করার জন্য। আমি যতই পড়ছি ততই কনফিউজ হচ্ছি। ইবলিশ যেমন করে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশায় তুমি নিজেই তা করেছ। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য গোপন করেছ আবার অতি তুচ্ছ তথ্য খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছ।

সায়রা বানু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনার সমাধানটা কী বলুন।

না?

মিসির আলি বললেন, সমাধান তুমি নিজেও করেছ। অনেক আগেই করেছ। তাই হ্যাঁ।

তা হলে আমার কাছে এসেছ কেন?

কনফারমেশনের জন্য। আপনার যতটা আস্থা আপনার বুদ্ধির ওপর আছে আমার ততটা নেই।

মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, চা নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে কথা বলি।

সায়রা বলল, আগে কথা শেষ হোক তারপর চা খাবেন।

মিসির আলি বসে পড়লেন। সায়রা বলল, চা এখন খেতে চাচ্ছি না কেন আপনাকে বলি। চা খেলেই আপনি সিগারেট ধরাবেন। এমনিতেই আমার শ্বাসকষ্ট। সিগারেটের ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টটা বাড়বে। এখন বলুন আপনার সমাধান।

মিসির আলি বললেন, তুমি তোমার গলার স্বর পুরুষদের মতো করতে পার তাই না?

সায়রা বানু চমকাল না। সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ।

মিসির আলি বললেন, তোমার বোন যখন আলাদা ঘরে থাকা শুরু করল তুমি তখন জানালার বাইরে থেকে পুরুষের মতো গলা করে কথা বলতে। ইবলিশ শয়তান সেজে কথা বলা।

সায়রা বলল, হ্যাঁ। ও আলাদা থাকতে গেল তখন আমার খুব রাগ লাগল। আমি তাকে ভয় দেখিয়েছিলাম যাতে সে আবার আমার সঙ্গে থাকতে শুরু করে।

ইবলিশ শয়তান সেজে তুমি তোমার বাবার সঙ্গেও কথা বলেছ?

হ্যাঁ বলেছি।

ওনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছ?

হ্যাঁ। বাবাকে ভয় দেখানো জরুরি ছিল।

তুমি তোমার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে যে-বর্ণনা দিয়েছ সে বর্ণনাটা ভুল। তুমি লিখেছ ছাদের ঠিক যে-জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে ইথেনের মৃত্যু হয়েছে তোমার মার মৃত্যুও সেখান থেকে পড়েই হয়েছে। অথচ তোমার মার মৃত্যু এ বাড়িতে হয় নি।

সায়রা বলল, এ বাড়িতে হয় নি এটা ঠিক তবে তাঁর মৃত্যু ছাদ থেকে পড়েই হয়েছিল।

মিসির আলি বললেন, তোমাদের বাড়ির পুরোনো ইলেকট্রিসিটি বিলগুলি ঘেঁটে আমি একটা মজার তথ্য পেয়েছি। দেখলাম পাঁচ মাস তোমরা এই বাড়িতে ছিলে না।

সায়রা বলল, এই তথ্যটা মজার কেন?

এই তথ্যটা মজার কারণ তখন প্রশ্ন আসে এই পাঁচ মাস তোমরা কোথায় ছিলে। হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে কেন?

সায়রা বলল, আপনি ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছেন যে আমরা ইথেনের বাচ্চা ডেলিভারির জন্য বাইরে গিয়েছি। কিন্তু আমি তো খাতায় লিখেছি ইথেনের পোস্টমর্টেম করা হয়। তার পেটে কোনো বাচ্চা পাওয়া যায় নি।

মিসির আলি বললেন, এমন কি হতে পারে না যে ঐ পাঁচ মাস তোমরা গোপনে কোথাও ছিলে। ইথেনের বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাটাকে কোথাও দত্তক দিয়ে তোমরা চলে এসেছ।

সায়রা বলল, চাচা আপনি চা খেতে চেয়েছিলেন চা খান। মেয়েটা কোথায় ওকে বলুন চা দিতে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটিকে আমি ইচ্ছা করেই আজ বাসায় রাখি নি। আমি চাচ্ছিলাম না আমাদের কথাবার্তার সময় সে থাকুক। আমার এক বন্ধু আছে নাম হারুন বেপারী। নাসরিনকে পাঠিয়েছি ঐ বাড়িতে। আজ সারা দিন সে ঐ বাড়িতে থাকবে। চা আমাকেই বানাতে হবে। সায়রা তোমার জন্য কি বানাব?

হ্যাঁ।

মিসির আলি চা এনে দেখেন সায়রা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। তিনি সায়রার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। সায়রা নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিল। ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি ইচ্ছা করলে সিগারেট ধরাতে পারেন।

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন।

সায়রা বলল, কথা শেষ করুন।

মিসির আলি বললেন, ইথেনের মৃত্যুর পর রমনা থানায় একজন মহিলা এবং একজন পুরুষের টেলিফোন কলটা খুবই রহস্যজনক। আমি তোমাদের ঐ বাড়িটি দেখতে গিয়েছি। গাছগাছালিতে ঢাকা বাড়ি। এই বাড়ির ছাদে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা দূরের অ্যাপার্টমেন্ট হাউস থেকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অথচ এর মধ্যে একজন দেখে ফেলল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। অন্ধকারে কোনো রঙ দেখা যায় না। কাজেই যে- বলেছে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি তাকে দেখতে হয়েছে খুব কাছ থেকে। কিংবা সে জানে যে হত্যাকাণ্ডটি করেছে তার গায়ে ছিল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। ঐ ভয়াবহ দিনে তোমার বাবার গায়ে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি ছিল?

হ্যাঁ।

মিসির আলি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, টেলিফোন দুটা আমার ধারণা তুমি করেছ প্রথমে মেয়ের গলায় তার পরপরই পুরুষের গলায়।

আমি টেলিফোন করব কেন?

দুটা কারণে করবে। যাতে তোমার বাবা তোমাকে সন্দেহ না করেন। যাতে তোমার বাবার ধারণা হয় কাজটা ইবলিশ শয়তান করেছে।

তোমার বাবার রূপ ধরে সে ছাদে গেছে। তোমার বোনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। সায়রা বলল, আপনার ধারণা ইথেনকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি? মিসির আলি বললেন, আমি এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত।

সায়রা বলল, হত্যাকারীর মোটিভ থাকে। আমার মোটিভ কী?

মিসির আলি বললেন, পুরো ঘটনা আমি যদি অন্যভাবে সাজাই তা হলে তোমার একটা মোটিভ বের হয়ে আসে। সাজাব?

সাজান। তার আগে আমার একটা প্রশ্ন, আপনার ধারণা আমি একজন ভয়ংকর হত্যাকারী। মোটামুটি ইবলিশ শয়তানের কাছাকাছি। তাই যদি হয় আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য আসব কেন? আপনাকে তা হলে আমার প্রয়োজন কেন?

মিসির আলি বললেন, আমাকে তোমার কেন প্রয়োজন সেটা পরে বলি? আগে পুরো ঘটনা অন্যভাবে সাজাই?

হ্যাঁ সাজান।

তুমি লিখেছ ইথেনের মৃত্যু যেভাবে হয়েছে তোমার মার মৃত্যুও সেভাবে হয়েছে। তা হলে ধরে নেই তুমি নিজেই তোমার মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছ। কেন ফেলেছ আমি জানি না। এই অংশটি আমার কাছে পরিষ্কার না। আমার ধারণা এই মৃত্যু বিষয়ে তোমার বাবার মনে কিছু খটকা ছিল। খটকা দূর করার জন্য ইবলিশ শয়তানের উপস্থিতি তুমি কাজে লাগালে। সায়রা তুমি কি আরেক কাপ চা খাবে?

না।

তুমি চাইলে আমি আলোচনা বন্ধ রাখতে পারি।

আপনার যা বলার বলুন আমি শুনছি।

মিসির আলি বললেন, ইথেনের পেটে সন্তান আসার অংশটিকেও আমি সম্পূর্ণ অন্যভাবে সাজাব। যেভাবে সাজাব তাতে জিগ-স পাজল খাপে খাপে মেলে। সন্তানটি আসলে এসেছিল তোমার পেটে। সন্তানটি তুমি নষ্ট কর নি। যে পাঁচ মাস তোমরা বাইরে ছিলে সেই পাঁচ মাসে সন্তানটি পৃথিবীতে আসে এবং তাকে কোথাও দত্তক দেওয়া হয়। ইথেন পুরো বিষয়টি জানে। তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া তোমার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইথেন নামের মেয়েটা পেটে কথা রাখা টাইপ মেয়ে না। তাকে বিশ্বাস করা যায় না। ঠিক বলেছি?

হ্যাঁ ঠিক বলেছেন।

তোমার লেখা তিনটা চ্যাপ্টার আমি পড়ে ফেলেছি। এই তিন চ্যাপ্টারে তুমি তোমার স্বামীর কথা কিছুই লেখ নি। আমি তাঁর সম্পর্কে সামান্যই জানি। শুধু এইটুকু জানি যে তিনি অসুস্থ। তাঁর সম্পর্কে আমরা কম জানি কারণ তুমি জানাতে চাচ্ছ না। তাঁর অসুখটা কী?

ডাক্তার ধরতে পারছে না। দেশের ডাক্তাররা দেখেছে। বাইরের ডাক্তাররাও দেখেছে। শুরুতে ক্যানসার ভাবা হয়েছিল। এখন ভাবা হচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। কোনো কিছু খেতে পারে না। হজম করতে পারে না।

মিসির আলি বললেন, মাথার চুল উঠে যাচ্ছে?

সায়রা সামান্য চমকাল। তবে সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ।

মিসির আলি বললেন, আর্সেনিক পয়েজনিং বলে একটা বিষয় আছে। খাবারের সঙ্গে যদি অতি সামান্য পরিমাণ হেভি মেটাল যেমন আর্সেনিক, এন্টিমনি কিংবা লেড দেওয়া হয় তা হলে শরীরের কলকবজা এমনভাবে নষ্ট হবে যে ডাক্তাররা তার কারণ ধরতে পারবে না। হেভি মেটাল জড়ো হবে চুলের গোড়ায়। চুল পড়তে শুরু করবে। হেভি মেটালের সাহায্যে মানুষ খুন করার সহজ বুদ্ধির জন্য একজন রসায়নবিদ দরকার। বুঝতে পারছ?

পারছি।

এই মানুষটাকে সরিয়ে দেবার চিন্তা তোমার মাথায় এসেছে কারণ তোমার মনে ভয় ঢুকে গেছে যে এই মানুষটা তোমার অতীত ইতিহাস জেনে ফেলবে। তুমি তোমার সন্তানকে প্রটেক্ট করতে চেয়েছ। ভালো কথা তোমার এই সন্তানের বাবা কি তোমার প্রাইভেট টিচার রকিব সাহেব?

হ্যাঁ।

উনি কোথায়?

জানি না কোথায়। তাঁর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।

মিসির আলি বললেন, এখন আমি বলি তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?

সায়রা বলল বলুন।

সিরিয়েল কিলাররা অহংকারী হয়। তাদের ধারণা জন্মে যায় কারোরই সাধ্য নেই তাদের অপরাধ ধরার। তারা বুদ্ধির খেলা খেলতে পছন্দ করে। অন্যকে বুদ্ধিতে হারাতে পছন্দ করে। তুমি আমার কাছে বুদ্ধির খেলা খেলতে এসেছ। এটা ছাড়াও তুমি তোমার মেয়ের জন্য একটি ভালো আশ্রয়ও চাচ্ছিলে। তোমার কাছে মনে হয়েছিল আমি একটা ভালো আশ্রয়। নাসরিন কি তোমার মেয়ে না?

হ্যাঁ।

ইথেন যে চিঠি তার মেয়েকে লিখেছিল বলে তুমি উল্লেখ করেছ সেই চিঠি আসলে তোমার লেখা। তুমি তোমার মেয়েকে লিখেছ। ইথেন আর্টসের ছাত্রী। ফরমালডিহাইড কী তা সে জানে না। তুমি জান। তোমার ব্যাপারটা আমি ধরতে পারি এই চিঠি পড়ে। তোমার খাতায় এই চিঠিটা যদি না থাকত তা হলে আমি মনে হয় না তোমাকে ধরতে পারতাম।

সায়রা কাঁদছে। মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট থেকে কয়েকটা লাইন বলি। লাইনগুলি নিশ্চয়ই তোমার পরিচিত।

তুমি শেক্সপিয়ারের এই নাটকে অভিনয় করতে চেয়েছিলে-

And my ending is despair
Unless I be relieved by prayer,
As you from crimes would pardoned be,

সায়রা চোখ মুছতে মুছতে বলল,

But release me from my bands
With the help of your good hands.

মিসির আলি বললেন, পুলিশকে সবকিছু খুলে বললে কেমন হয় সায়রা?

সায়রা বলল, আপনি বলতে বললে আমি অবশ্যই বলব।

মিসির আলি বললেন, তুমি কী করবে বা করবে না সেটা তোমার ব্যাপার। আমি কাউকে উপদেশ দেই না। ভালো কথা তুমি একবার বলেছিলে তোমার বাবার হাতের রান্না খাওয়াবে। মনে আছে? ওনার সঙ্গে আমার দেখা করার শখ আছে। একজন পুণ্যবান মানুষ কী করেন জান? তিনি যখন কাউকে হাত দিয়ে স্পর্শ করেন তখন তাঁর অন্ধকার নিজের ভেতর নিয়ে নেন

সায়রা বলল, চাচা আপনি কি আমাকে একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেবেন?

মিসির আলি বললেন, না। কিন্তু তার পরেও হাত বাড়িয়ে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *