৭. সন্ধ্যা হয়ে এসেছে

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

শেফা একা একা পুকুরপাড়ে বসে আছে। সে খুব ভয় পেয়েছে। একটু আগে সে ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখে এসেছে। দাদীজানের ঘরে বাবা বসে আছেন। বাবা হাউমাউ করে কাঁদছেন। দাদীজান বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এর মানে কী? কী হয়েছে? কাকে সে জিজ্ঞেস করবে। পুকুরপাড়ে সে কাঁদার জন্যে এসেছিল। এখন তার একটুও কান্না পাচ্ছে না। তার হাত পা কাঁপছে।

কামরাঙ্গা গাছ ভর্তি পাখি। বেশির ভাগই টিয়াপাখি। এরা চুপচাপ থাকে, হঠাৎ হঠাৎ সবাই একসঙ্গে ডেকে ওঠে এবং শেফা ভয়ংকর চমকে উঠে।

শেফার ভয়-ভয় করছে। সন্ধ্যাবেলা পুকুরপাড়ে একা একা থাকা ঠিক না। অশরীরা এই সময় নেমে আসে। কিন্তু শেফা কোথায় যাবে? মা শোবার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। মায়ের ভয়ংকর কিছু হয়েছে এটা সে বুঝতে পারছে। এই ভয়ংকর কিছুটা কী?

বড় আপারও ভয়ংকর কিছু হয়েছে। বড় আপা বারান্দায় চেয়ারে রসে আছে। তার চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। তার ঠোঁট কীভাবে যেন কেটেছে। মাছের ঠোঁট বড়শি লেগে যেভাবে কেটেছিল অবিকল সেইভাবে কেটেছে। সেই ঠোঁট ফুলে কী বিশ্রী হয়েছে। বড় আপা ঠোঁটে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কী অদ্ভুত ভাবেই না বসে আছে। শেফা দুবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কিন্তু শেফা নিশ্চিত যে আপা তাকে দেখতে পায়নি।

কী হচ্ছে এ বাড়িতে! মাছটা মারা ঠিক হয়নি। মনে হয় মৃত মাছটার অভিশাপ লেগে গেছে। মাছটা বেঁচে থাকলে শেফা অবশ্যই মাছটাকে পুকুরে ফেলে দিত।

‘ছোট আপা!’

শেফা চমকে তাকাল। দেলোয়ার ভাই সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শেফার অবস্থাও কি তার আপার মতো হয়েছে। একটা মানুষ হেঁটে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল তারপরও শেফা তাকে দেখতে পেল না। মানুষটা যখন কথা বলল, তখনি শুধু দেখল।

‘দেলোয়ার ভাই আমার খুব মনটা খারাপ।’

‘বুঝতে পারছি।’

‘কী হয়েছে আপনি কি কিছু জানেন?’

‘জানি না ছোট আপা। তবে যাই হোক সমস্যা থাকবে না। সব আগের মতো হয়ে যাবে?’

‘কেন?’

‘চাচাজীর উপর আল্লাহপাকের খাস রহমত আছে। পীর বংশের মানুষ। উনার পীরাতিও আছে। আর আমি নিজেও দোয়া করতেছি—একটা খতম শুরু করেছি।’

‘আপনার উপর কি আল্লাহপাকের রহমত আছে?’

‘না। আমি কে,আমি কেউ না। তারপরেও দোয়া করতে দোষ নাই।’

‘আমার ধারণা আপনি খুবই ভালো মানুষ। আমি যখন বড় হব তখন আপনার মতো একজন মানুষকে বিয়ে করব।’

‘আপনি রাগ করেননি তো?’

‘না।’

‘আপনার মতো গরিব-টরিব ধরনের কাউকেই বিয়ে করতে হবে। কারণ আমার চেহারাতো ভালো না।’

‘তোমার চেহারা ভালো না কে বলেছে?’

‘আমি জানি।’

‘না তুমি জানো না।’

‘দেলোয়ার ভাই।’

‘বল।’

‘আপনি আমার জন্যেও দোয়া করবেন যেন আমার খুব ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। নিজের বিয়ের জন্যে নিজে দোয়া করতে লজ্জা লাগে। তারপরও গত শবেবরাতে আমি দোয়া করেছি।’

‘আল্লাহপাক তোমার দোয়া কবুল করেছেন।’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘কিছু কিছু জিনিস বোঝা যায়। আমিও আজ মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে দোয়া করব যেন এমন একজনের সঙ্গে তোমার বিবাহ হয় যে সারাজীবন তোমাকে মাথায় করে রাখে।

‘থ্যাঙ্ক য়্যু। থ্যাংক য়্যু ভেরি মাচ।’

দেলোয়ার হাসছে। মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে তার দোয়া করার কথা কিন্তু সে এখনই দোয়া করে ফেলল—’চাচাজীর চেয়ে একশ গুণ ভালো একটা ছেলের সঙ্গে যেন ছোটআপার বিবাহ হয়। হে পারোয়ারদেগার। হে দিনদুনিয়ার মালিক, হে রহমানুর রহিম, গরিবের এই দোয়াটা তুমি কবুল কর। আমিন।’

.

সন্ধ্যা মিলিয়েছে।

মীরার দাদীমার নামাজে দাঁড়ানোর কথা। তিনি নামাজে দাঁড়াননি। ছেলের মাথায় পানি ঢালছেন। শেফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আজহার সাহেব তাঁর মাকে চিনতে পারছেন না, ছোট মেয়েটাকেও চিনতে পারছেন না। তিনি নিজের মনে খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প করে যাচ্ছেন –নেদারল্যান্ডে এক আদিবাসীগোষ্ঠী আছে, যাদের বলা হয় পাপভক্ষক, Sin eaters. এরা মানুষের পাপ খেয়ে ফেলতে পারে। কেউ যখন মারা যায় পাপভক্ষকদের খবর দেয়া হয়। এরা দলবেঁধে এসে মৃত মানুষটার সব পাপ খেয়ে মানুষটাকে নিষ্পাপ করে ফেলে।

.

মীরা মা’র ঘরে ঢুকল। ক্ষীণ স্বরে ডাকল, মা।

মনোয়ারা জেগে উঠলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় তাঁর সবকিছু যেন কেমন এলোমেলো লাগছে। তিনি উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক দেখছেন।

মীরা নিচুগলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, মা তুমি একটু আস।

‘কেন?’

‘বাবা কেমন যেন ছটফট করছেন। দাদীজান বাবার মাথায় পানি ঢালছেন। বাবা মরে যাচ্ছে মা।’

মনোয়ারা উঠে বসলেন। মীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা তুমি বাবাকে শান্ত কর। আর শোন—র‍্যাটমের যে-প্যাকেটগুলি আছে, আমাকে দাও। আমি খাব। তোমাদের এই কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না মা।

মনোয়ারা বললেন, ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি বেঁচে আছি না! আমার এত কষ্টের সংসার আমি জলে ভেসে যেতে দেব না। আয় কাছে আয়, আদর করে দেই।

মীরা মাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, মা আমি আরেকটা অন্যায় করেছি। ড্রাইভার চাচাকে ঢাকা যেতে দেইনি।

মনোয়ারা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ভালো করেছিস। ঐ ছেলেকে আমার দরকার নেই। আয় তোর বাবার কাছে যাই।

1 Comment
Collapse Comments
হামিদুল September 19, 2021 at 4:28 pm

Adunik somajer nirmom sotto.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *