১৪. ড. শায়লার ডায়েরি

১৪

ড. শায়লার ডায়েরি।

ডায়েরি ইংরেজিতে লেখা। এখানে বাংলা ভাষ্য দেয়া হল। শুরুর দু’টি লাইন, I am lost. I am totaly lost.

.

আমি তলিয়ে গেছি। পুরোপুরি তলিয়ে গেছি। আমার ব্রেইনের নিউরো ট্রান্সমিটার সিগন্যাল পাঠানোয় ভুল করছে কিংবা তথ্য গুছাতে পারছে না। সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।

শারীরিকভাবেও আমি ভেঙে পড়েছি। শরীরে প্রচুর অ্যালকোহল নেবার পরও আমার ঘুম আসছে না। আমার ক্ষুধা কমে গেছে তবে তৃষ্ণা বেড়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন পানি খাচ্ছি তাতেও শুকনা ভাব দূর হচ্ছে না। এই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভার্টিগো সমস্যা। সারাক্ষণ মনে হয় চারপাশের সবকিছু ঘুরছে। চোখ বন্ধ করে রাখলেও এই ঘূর্ণন বন্ধ হয় না।

আমার জীবনের ঘটনা প্রবাহ ভালোমতো লিখে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ আমার জীবনের ঘটনাবলি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমি নিজে ব্যাখ্যা করতে পারলে ভালো হত, তা পারছি না। বিশেষ বিশেষ সময়ে হাতির পা কাদামাটিতে আটকে পড়ে, মিসির আলি স্যারের পা এখন কাদাবন্দি। তিনি অবিশ্যি পা টেনে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।

হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমি কী আর করতে পারি।

আমি দু’জন জোয়ার্দারকে দেখলাম। এদের চেহারা এক, নাম এক, এমনকি টেলিফোন নাম্বার এক কিন্তু দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা। একজন বিয়ে করেছেন তাঁর একটি মেয়ে আছে। মেয়েটির একটি পোষা বিড়াল আছে। বিড়ালটার নাম পুফি।

অন্যজন চিরকুমার। তবে তারও একটি বিড়াল আছে। বিড়ালটার নাম কুফি

বরকতউল্লাহ নামের একজনকে আমি দেখলাম তারও মনে হয় দুটি সত্তা। এক জায়গায় তিনি মৃত অন্য জায়গায় তিনি জীবিত।

এই উদ্ভট হাস্যকর ব্যাপার কল্পকাহিনীর জন্য ঠিক আছে। আমার জন্য ঠিক নেই। আমি কল্পকাহিনীর কোনো চরিত্র না।

মিসির আলি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আমি কি পাগল হয়ে গেছি?

স্যার বললেন, এখনো হও নি তবে সম্ভাবনা আছে।

সম্ভাবনা যে আছে তা আমার মতো কেউ জানে না। জোয়ার্দারের সঙ্গে আমার বিয়ের পাকা কথা হয়েছিল তারপর কুৎসিত অজুহাতে বিয়ে ভেঙে যায়। তখন একবার আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। লোকলজ্জার ভয়ে দেশে আমার কোনো চিকিৎসা করা হয় নি। আমাকে ইন্ডিয়ার রাঁচিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

কাজেই পাগলামির বীজ আমার মধ্যে আছে। এটা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কখনো কখনো জাগে।

আমি আমার ব্রেইনের সিটি স্ক্যান করিয়েছি। মস্তিষ্কের কিছু জায়গায় অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা (super activity) দেখা গেছে। মৃগীরোগীদের মধ্যে এরকম দেখা যায়। আমার কি বিশেষ কোনো ধরনের মৃগীরোগ হয়েছে? যখন রোগের আক্রমণ হয় তখন আমি অন্য জোয়ার্দারকে দেখতে পাই?

আমি মাঝে মাঝেই এজি অফিসে যাই। কখনো সেখানে দেখি বরকতউল্লাহ সাহেব বেঁচে আছেন কখনো দেখি বরকতউল্লাহ সাহেব বেঁচে নাই। দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা এজি অফিস।

মিসির আলি স্যার বললেন, তুমি যে এজি অফিসে বরকতউল্লাহ জীবিত সেখান থেকে একটা খবরের কাগজ আনবে এবং যেখানে বরকতউল্লাহ সাহেব মৃত সেখান থেকে একটা খবরের কাগজ আনবে।

আমি তা করেছি। দেখা গেছে একটা খবরের কাগজ মিরর ইমেজ। পুরোটা উল্টা করে লেখা। আয়নার সামনে ধরলেই শুধু পড়া যায়।

এর মানে কী? আমি মিসির আলি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, একজন মানুষের পক্ষে কি একই সময় দু’টি ভিন্ন সত্তায় যাওয়া যায়?

স্যার বললেন যাওয়া যায়। মনে কর তুমি স্বপ্ন দেখছ। স্বপ্নে তুমি জেগে তোমার মা’র সঙ্গে গল্প করছ। এখন তোমার দু’টি সত্তা হয়ে গেল। একটিতে তুমি ঘুমাচ্ছ একটিতে তুমি জেগে আছ।

আমি বললাম, একজন জোয়ার্দার সত্যি আছেন, আরেকজনকে আমি স্বপ্নে দেখছি এরকম কি হতে পারে?

স্যার বললেন, হতে পারে। চিরকুমার জোয়ার্দার হয়তো তোমার ব্রেনের সৃষ্টি। তাঁর প্রতি তীব্র আবেগের কারণে ব্রেইন এই খেলাটা খেলাচ্ছে তবে কিন্তু আছে।

কী কিন্তু?

মিরর ইমেজগুলো কিন্তু। তুমি খবরের কাগজের মিরর ইমেজ এনেছ এর অর্থ তুমি স্বপ্নের জগৎ থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসেছ। এটা কোনোক্রমেই সম্ভব না। প্রকৃতি এ ধরনের কিছুই ঘটতে দেবে না।

আমি বললাম, স্যার আমি কি এই বিষয়টা জোয়ার্দারের সঙ্গে আলাপ করব?

স্যার বললেন, করতে পার। দুই জোয়ার্দারের সঙ্গেই আলাপ করবে। কে কীভাবে নিচ্ছে তা দেখবে। তোমার সমস্যা সমাধানের জন্য এঁদের দু’জনেরই সাহায্য লাগবে।

এর মধ্যে চিরকুমার জোয়ার্দার এক রাতে তাঁর সঙ্গে খেতে বলল। সে নিজেই রাঁধবে। একা থাকার কারণে তাঁর রান্নার হাত নাকি খুলেছে। সন্ধ্যা মিলাবার পরপর তাঁর বাসায় গেলাম। বেল টিপতেই বাচ্চা একটা মেয়ে দরজা খুলল। তার হাতে বিড়াল।

আমি বলাম, তোমার নাম অনিকা?

অনিকা বলল, হ্যাঁ। আর এর নাম পুফি।

তোমার বাবা বাসায় নেই?

না। মাকে নিয়ে নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে গেছেন। আমাদের চাল শেষ হয়ে গেছে এই জন্য। আমরা মিনিকেট চাল খাই। আপনি মিনিকেট চাল চেনেন?

হুঁ।

মিনিকেট চাল কীভাবে বানানো হয় তা জানেন?

না।

মোটা চালকে মেশিনে কেটে চিকন বানানো হয়। একে বলে মিনিকাট। মিনিকাট থেকে এসেছে মিনিকেট।

বাহ্ তুমি তো অনেক কিছু জান।

কুকুর এবং বিড়ালের মধ্যে তফাত জানেন?

কিছুটা জানি। তুমি কী জান বল শুনি।

কুকুরকে যখন খাবার দেয়া হয় তখন কুকুর ভাবে মানুষ আমাদের দেবতা। এই জন্য মানুষ আমাদের খাওয়াচ্ছে। আর বিড়ালকে যখন খাবার দেয়া হয় তখন বিড়াল ভাবে আমরা মানুষের দেবতা এই জন্য মানুষ আমাদের যত্ন করছে।

সুন্দর তো। কার কাছে শুনেছ?

আমাদের মিসের কাছ থেকে। মিসের নাম শিরিন। আমরা তাকে ডাকি বি শিরিন।

বি শিরিন কেন?

উনি বাঁটকু তো এই জন্য বি শিরিন। বাঁটকু শিরিন থেকে বি শিরিন

মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে আমার হৃদয় হাহাকার পূর্ণ হল। এই চমৎকার মেয়েটা তো আমারও হতে পারত।

অনিকা বলল, আপনি কি বাবার জন্য অপেক্ষা করবেন?

আমি বললাম, না। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাব।

চা খাবেন? আমি চা বানাতে পারি। বসার ঘরে বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।

মেয়েটির বসার ঘরে বসলাম। এই ঘর আমি ছবিতে দেখেছি। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে।

মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অপশন দিয়ে ক্যালেন্ডারের ছবি তুললাম। ক্যালেন্ডারের লেখা ছবিতে উল্টা এল। মিরর ইমেজ। কী হচ্ছে এসব?

বাসায় ফিরে হুইস্কির বোতল খুলে বসলাম। পেগের পরে পেগ খাচ্ছি, নেশা হচ্ছে না।

রাত একটার দিকে আমার কাছে টেলিফোন এল। জোয়ার্দার টেলিফোন করেছে। সে বলল, আমি তোমার জন্য রান্না করেছি তুমি আস নি কেন? কোনো সমস্যা?

সমস্যা তো বটেই। এই সমস্যা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি কী করব তাও বুঝতে পারছি না। Is there any one who can help. God of God! Help me please.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *