ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানের পর্দা ক্রমেই হালকা হয়ে যাচ্ছে। এবং এই পর্দা কাঁপছে। দুলছে! শুভ্ৰ জেগে উঠছে এবং প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ছে! মজার ব্যাপার ঘুমের সময় সে যে স্বপ্ন দেখছে এই স্বপ্লের ধারাবাহিকতা তাতে নষ্ট হচ্ছে না। স্বপ্নটা যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকেই আবারো শুরু হচ্ছে। স্বপ্নের ঘটনা সামান্য বদলে যাচ্ছে কিন্তু মূল পাত্র-পাত্রী ঠিকই থাকছে। তবে পত্ৰিপাত্রীদের চেহারা পাল্টাচ্ছে।
স্বপ্নে মীরা ছিল। মীরার সঙ্গে প্ৰায় তালগাছের মত লম্বা একটি মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটা হাঁটছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লম্বা মেয়েটা স্বপ্নে শুধুই হাসছিল। পুরুষদের মত হাসছিল। ভরাট গম্ভীর গলার হাসি। মাঝখানের বিরতির পর স্বপ্ন আবার যখন শুরু হল। তখনো মীরা আছে, এবং মীরার সঙ্গিনীও আছে। তবে সে আর আগের মত লম্বা না বরং মীরার চেয়েও বেঁটে হয়ে গেছে। এবং তার চেহারাও পাল্টে গেছে। তাকে দেখাচ্ছে খানিকটা বিনুর মত। এই বিনু যে প্রথমে দেখা তালগাছ মেয়ে তা বোঝা যাচ্ছিল তার হাসি থেকে। সবকিছু বদলালেও তার হাসি বদলায় নি। সেই আগের মত ভরাট গম্ভীর গলার হাসি। শুভ্ৰ ঠিক করল তাকে জিজ্ঞেস করবে- আপনি তো একটু আগেই প্রায় তালগাছের মত লম্বা ছিলেন। এখন এমন বেটে হয়ে গেছেন কেন? আপনাকে দেখাচ্ছে স্লীপিং বিউটির সাত বামুনের একজনের মত।
যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কথা থাকে সেই প্রশ্ন স্বপ্লে কখনোই করা হয় না। সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করা হয়। কাজেই শুভ্র যা বলল তা হচ্ছে- আপনি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেন? মেয়েটা বলল (হাসতে হাসতে), আমি খুঁড়িয়ে হাঁটছি কারণ আমার একটা পা কাঠের। দেখতে চান?
শুভ্ৰ বলল, না।
স্বপ্নে সময়ের ব্যাপারটা বদলে যায়। দীৰ্ঘবাক্য বলতে খুব কম সময় লাগে, আবার সামান্য না বলতেও অনেক সময় লাগে। শুভ্র দীর্ঘ সময় নিয়ে না বলল, তার আগেই মেয়েটা তার কাঠের পা দেখাবার জন্যে তার শাড়ি তুলে ফেলেছে। শুভ্ৰ অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটার পা মোটেই কাঠের না। রক্ত-মাংসের পা। শুভ্র বলল, আপনার পা তো কাঠের না। মেয়েটা বলল, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখ। হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে কী করে বুঝবে?
মেয়েটার গলার স্বর বিনুর মত। সে এখন হাসছেও খুব স্বাভাবিকভাবে। শুভ্র বিনুর পা ছুঁয়ে দেখতে গেল তখনি তার ঘুম ভাঙিল। সে খুবই অপরিচিত জায়গায় শুয়ে আছে। তার বিছানা নরম। বিছানার উপর বালিশ নরম। গায়ের উপর পাতলা চাঁদর দেয়া। সে যে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, সেই দেয়ালটা অপরিচিত। দেয়ালে পেন্সিল দিয়ে কয়েকটা টেলিফোন নাম্বার লেখা। শুভ্র দেয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই দেখল। খাটে আসমানী বসে আছে। আসমানীর হাতে মগ। মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে। আসমানীর চেহারা সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগছে। শান্ত সুখী সুখী মুখ। সে চোখে টেনে কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে সুন্দর করে ফেলত ঠিকই। তবে খানিকটা অপরিচিতও করে ফেলত। মেয়েটা এখনো চোখে কাজল দেয় নি বলে তার চোখ খুবই পরিচিত লাগছে।
আসমানী বলল, চা আনছি।
শুভ্র বলল, ও।
নেন, আগে কুলি করেন।
মেয়েটা মগে করে শুধু যে চা এনেছে তা না, তার এক হাতে পানির গ্লাসও ধরা আছে। পানির গ্লাস চোখে পড়ে নি। ধোয়া উঠা মগ চোখে পড়েছে।
আসমানী বলল, নেন। কুলি করেন। চিলমচিতে কুলি ফেইলা চা খান।
মেয়েটা এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে যেন শুভ্র দীর্ঘদিন ধরে এ বাড়িতে বাস করে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চিলমচিতে কুলি ফেলে চা খায়।
চায়ে চিনি টিনি সব ঠিক হইছে?
চায়ে চিনি ঠিক হয় নি, সামান্য কম হয়েছে। তারপরেও শুভ্র বলল, হ্যাঁ ঠিক হয়েছে।
আপনার ঘুম ভাল হইছে?
হুঁ।
হুঁ বললেন কেন? আপনার ঘুম মোটেই ভাল হয় নি। ঘুমের মইধ্যে খুব ছটফট করছেন। দুঃস্বপ্ন দেখেছেন।
তুমি জানলে কী করে?
জানব না কেন? আমি তো আপনার পাশেই বইসা ছিলাম।
বলতে বলতে আসমানী হাসল; এই হাসিও কী স্বাভাবিক! যেন শুভ্ৰর বিছানার পাশে বসে থেকে রাত কাটানো এই মেয়েটির অনেক পুরনো অভ্যাস।
আপনি রাতে খুবই খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন ঠিক না? ভাং এর সরবতের এই একটা খারাপ ব্যাপার আছে। কম খেয়ে ঘুমুতে গেলে সবাই দুঃস্বপ্ন দেখে। বেশি কইরা খাইলে দেখে শান্তির স্বপ্ন।
ও আচ্ছা।
আমি একবার কী স্বপ্ন দেখছিলাম জানেন? আমি স্বপ্নে দেখছিলাম। আমাকে ঘিরে ভন ভন করে নীল মাছি উড়তেছে। মাছিগুলি দেখতে মানুষের মাথার মত। পরিচিত সব মানুষের মাথা যেন ছোট হয়ে গেছে। যেখানে কান থাকার কথা সেখানে পাখা। সবাইরে চেনা যাইতেছে।
ইন্টারেস্টিং।।
আপনি এই এ রকম কোনো স্বপ্ন দেখছেন?
না। এখন কটা বাজে?
দশটা এখনো বাজে নাই। কিছুক্ষণের মইধ্যে দশটা বাজব। আপনি কি মাশতা খাইবেন?
আমি কোনো নাশতা খাব না। আমি এখন চলে যাব।
আচ্ছা।
আরেক কাপ চা খেতে পারি। চা-টা ভাল হয়েছে।
আসমানী কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছে। সে একবারও বলল না— নাশতা খেয়ে যান। নাশতা না খেয়ে যাবেন কেন? যে মেয়ে খুব যত্ন করে তাকে সারা রাত রেখে দিয়েছে, সে সকালে নাশতা না খাইয়ে বিদেয় করে দিচ্ছে। ব্যাপারটা মিলছে না। তারপরেও মনে হচেচ্ছ ঠিক আছে।
যা ঘটছে সব। এত স্বাভাবিক লাগছে কেন? এখন যা ঘটছে তা স্বপ্নের অংশ নাতো? একমাত্র স্বপ্নদৃশ্যেই সব স্বাভাবিক লাগে। শুভ্র একবার আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখেছিল। উড়তে উড়তে সে যেন কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে। সে মোটেই বিস্মিত হয় নি। তার কাছে মনে হচ্ছিল- সে তো উড়বেই।
তুমি যখন স্বপ্ন দেখ। তখন স্বপ্নটাকেই বাস্তব মনে হয়। স্বপ্নভঙ্গের পর বুঝতে পার— এতক্ষণ যা ঘটেছে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। পৃথিবীতে যখন তুমি বাস কর, তখন এই পৃথিবীটাকে তোমার কাছে বাস্তব মনে হয়। পৃথিবীর জীবনটাও যে স্বপ্লের জীবনের মত অলিক ভ্রান্তি তা তুমি বুঝতে পারবে যখন তুমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে।
কথাগুলি কার? প্রতিটি লাইন মনে আছে অথচ লাইনগুলি করে তা মনে আসছে। না কেন? শুভ্ৰ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার মাথা কি কাজ করছে না? মস্তিষ্কের নিওরোনে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে? এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সবচে জটিলতম বস্তু হল মানুষের মস্তিষ্ক। জঠিল এবং রহস্যময়। মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র একটি অংশই শুধু মানুষের নিয়ন্ত্রণে। বাকি অংশ কাজ করে সম্পূর্ণ তার মত।
কাগজ পোড়ার গন্ধ আসছে। এই গন্ধের সঙ্গে মিশেছে জুতা পালিশের গন্ধ। শুভ্রর ঘুম পাচ্ছে। আসমানী চা নিয়ে এলে, চা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়? আসমানীর উপর তার রাগ করা উচিত। প্রচণ্ড রাগা! আসমানী যা করেছে। তাকে সমর্থন করার কোনোই কারণ নেই। সে তাকে ইচ্ছে করে ড্রাগ মেশানো অষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে না।
ভাং-এর সরবত শুনলে তেমন কিছু মনে হয় না। কিন্তু ধুতুরা পাতা কচলে ভাং-এর সরবত বানানো হয়। ধুতুরা গাছ এই পৃথিবীর খুবই রহস্যময় গাছ। এই গাছ মানুষের চেতনার উপর কাজ করে।
শুধু মানুষ না, যাবতীয় পশুপাখি এই গাছের ফল, গাছের পাতা এবং শিকড়ে আক্রান্ত হয়। মানুষ-পশু-পাখি এক চেতনা থেকে অন্য চেতনায় চলে যায়। তখন সেই চেতনার জগতকেই মনে হয় সত্যি জগৎ। বাকি সব মিথ্যা।
আসমানী চা নিয়ে এসেছে। তার হাতে একটা পিরিচ্চে মাখন লাগানো টেষ্ট বিসকিট। আসমানী বলল, আপনের নতুন ম্যানেজার সাহেব আপনারে নিতে এসেছেন।
শুভ্র বলল, ও।
আসমানী বলল, উনি আমার সঙ্গে খুব রাগারগি করছেন।
কেন?
কারণ উনার ধারণা হয়েছে আমি কৌশল করে আপনাকে এখানে রেখে দিয়েছি।
তোমার ধারণা তুমি কৌশল কর নি?
না।
ভাং-এর সরবত দিয়ে তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলে। সারারাত আমি মরার মত ঘুমুলাম। এখন বলছি তুমি কৌশল কর নি!
আমি কোনো কৌশল করি নাই। আপনের খুব ইচ্ছা করতেছিল এখানে রাত কাটাবার। সাহস করে কথাটা বলতে পারতেছিলেন না। আমি সেই সাহসটা দিয়েছি।
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, আমার খুব ইচ্ছা করছিল এখানে থাকার?
আসমানী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
শুভ্র বলল, সেটা কী করে বুঝে ফেললে?
ইচ্ছা করতেছিল বলেই আপনি বলামাত্র থেকে গেলেন। একবারও আপত্তি করলেন না। ঘুম থেকে উঠেও কিছু বলেন নাই।
সব মানুষ এক রকম না। একেক মানুষ একেক রকম।
আসমানী শব্দ করে হাসল। শুভ্র বলল, তুমি হাসছ কেন? আসমানী বলল, আপনের কথা শুনে হাসতেছি।
হাসার মত কী বললাম?
আপনের ধারণা আপনে অন্যদের চেয়ে আলাদা। আপনে মোটেই আলাদা না। সব মানুষই এক রকম। যদিও তারা মনে করে তারা একেক জন একেক রকম। এইটা মনে করে সে আনন্দ পায়।
তুমি কী করে বুঝলে সবাই এক রকম?
আমার পক্ষে বোঝা সবচে সহজ। কত পুরুষের সাথে আমি বসি। চা ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
চিনি ঠিক হইছে?
হ্যাঁ।
আসমানী আবারো শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র বলল, হাসছ কেন? আসমানী বলল, আপনের চায়ে আমি এক দানা চিনি দেই নাই। অথচ আপনে বলছেন চায়ে চিনি হইছে। এই জন্যে হাসতেছি। আপনে এখন একবার চুমুক দিন
শুভ্ৰ চায়ে চুমুক দিল। আসলেই চায়ে কোনো চিনি নেই। আসমানী এখনো হাসছে। তবে এখন আগের মত শব্দ করে হাসছে না। নিঃশব্দ হাসি। শুভ্ৰ বলল, তুমি এই কাজটা কেন করলে?
দেখার জন্যে যে আপনে বুঝতে পারেন কি না।
তুমি কি অনেকের সঙ্গেই এই কাজটা করি?
হ্যাঁ।
কেন করে?
একবারতো বললাম, মজা করার জন্যে করি।
কীসের মজা?
কীসের মজা সেটা আরেক দিন বলব। আইজ না।
আজই বল। শুনে যাই।
আইজ না। আরেক দিন। আপনার ম্যানেজারের খুব রাগ হইতেছে। আপনে আইজ চলে যান। আপনের আগের ম্যানেজারটা ভাল ছিল। রাগারগি কম করত—এই ম্যানেজারের রাগ বেশি। খালি ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে। আমি এই ম্যানেজারের নাম দিলাম ছাঁৎ ম্যানেজার।
শুভ্রর যেতে ইচ্ছা করছে না। সে চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চা-টা খেতেও তার খারাপ লাগছে না। ভালই লাগছে।
জাহানারার মনে হল তাঁর মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। শুধু মুখ না, সারা শরীর দিয়েই বের হচ্ছে। বাথটাব ভর্তি পানি নিয়ে সেই পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে। থাকতে পারলে ভাল হত। সেটা সম্ভব না। বাথটাবের পানিতে তিনি গোসল করতে পারেন না; শরীরের ময়লা পানিতে মেশে। সেই নোংরা পানিই আবার গায়ে দেয়া— কী কুৎসিত, কী নোংরা! তিনি এখন বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দুহাতে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছেন। তাতে মুখের গরম কমছে না। সারা মুখে বরফ ঘষলে গরমটা বোধহয় কমত। ফ্রিজে বরফ নেই। বরফের ট্রে-টা খালি।
বিনু কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাঁকে কৌতূহলী চোখে দেখছে। এমনভাবে দেখার কী আছে! তিনি অস্বাভাবিক কিছু তো করছেনও না। চোখে মুখে পানি দিচ্ছেন। এটা নতুন কিছুও তো নয়। মাঝে মধ্যেই তাঁর মনে হয় চোখ মুখ দিয়ে আগুনের হালকা বের হচ্ছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথাও হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন। এটা স্নায়ুর একটা অসুখ। স্নায়ুর অসুখ তো মানুষের হতেই পারে। এই অসুখের সঙ্গে শুভ্ৰর কোনো সম্পর্ক নেই। শুভ্র একটা রাত বাইরে কাটিয়েছে এটা এমন কোনো ব্যাপার না। ছেলে বড় হয়েছে। মাঝে মধ্যে সে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে বসলে সময়ের হিসেব থাকে না, রাত হয়ে যায়। এত রাতে ফেরার চেয়ে না ফেরাই ভাল। তবে খবরটা দিতে পারত। শুভ্ৰ কোনোই খবর দেয় নি। রাত একটার দিকে টেলিফোন করে অফিসের নতুন ম্যানেজার জানিয়েছে – ছোট সাহেব রাতে ফিরবেন না। সকালে ফিরবেন।
জাহানারা বললেন, রাতে ফিরবে না কেন?
বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে গল্প করছেন।
জাহানারা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। ম্যানেজার বলল, আম্মা আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ঘুমিয়ে পড়েন।
ম্যানেজারের টেলিফোন পেয়ে জাহানারার দুশ্চিন্তা পুরোপুরি চলে গিয়েছিল। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমুতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিছানায় শোয়ামাত্র তাঁর মনে হল— শুভ্ৰ বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে গল্প করছে এই খবরটা তার ম্যানেজার কীভাবে জানল? ম্যানেজারের তো জানার কথা না! শুভ্ৰ নিশ্চয়ই ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধু বান্ধবের বাসায় গল্প করতে যায় নি।
শুভ্রর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন এরকম ঘটনা ঘটত। হঠাৎ হঠাৎ ম্যানেজার টেলিফোন করে বলত— বড় সাহেবের একটা কাজ পড়ে গেছে। রাতে তিনি আসতে পারবেন না। জাহানারা বলতেন, আচ্ছা। কী কাজে বড় সাহেব আটকা পড়েছেন, তিনি কোথায় রাত কাটাবেন- কিছুই জিজ্ঞেস করতেন না। ম্যানেজার টেলিফোন রাখার আগে বলতো- আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ঘুমিয়ে পড়েন।
গতকাল রাতে ম্যানেজার শুভ্ৰ সম্পর্কে একই কথা বলেছে। এর মানে কী? দুই এবং দুই যোগ করলে চার হয়। মানুষের ব্যাপারে এমন অংক করা কি ঠিক? মানুষ কোনো অংক না। শুভ্র এবং শুভ্রর বাবা এক না। দুজন দুধরনের মানুষ। জাহানারার সারারাত এক ফোঁটা ঘুম হল না। ভোর থেকে শুরু হল— গরম লাগার অসুখ। মনে হচ্ছে কেউ তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখ মুখ দিয়ে আগুনের হালকা বের হচ্ছে।
বিনু বলল, আপনার কী হয়েছে?
তিনি বিনুর দিকে তাকিয়ে খুব সহজ গলায় বললেন, কিছু হয় নি।
কিছু যে হয় নি এটা ভাল করে বুঝানোর জন্যে তিনি সামান্য হাসলেন। তারপর আগ্রহ নিয়ে বললেন, বিনু তুমি আমের টক রাঁধতে পার? ছোট মাছ দিয়ে কাঁচা আম দিয়ে টক। আমের টক রান্না কর তো। আজ কেন জানি আমের টক খেতে ইচ্ছা করছে।
বিনু তাকিয়ে আছে! কিছু বলছে না। জাহানারা বললেন, গরমের সময় টক খেলে গরম কমে এটা কি তুমি জান বিনু?
বিনু না-সূচক মাথা নাড়ল। জাহানারা বললেন, গরম দেশের সব ফল এই কারণেই টক হয়। ঠাণ্ডার দেশে তুমি কোনো টক ফলের গাছ পাবে না। যেমন ধর তেঁতুল গাছ। এই গাছ হয় আমাদের গরমের দেশে। শীতের দেশে হয় না। কারণ ওদের তেঁতুল খাবার কোনো দরকার নেই। আমাদের আছে। কথাগুলি আমাকে বলেছে শুভ্ৰ। শুভ্রের কথা মন দিয়ে শুনলে অনেক কিছু শিখা যায়।
বিনু বলল, আপনার কি জ্বর এসেছে?
জাহানারা বিরক্ত গলায় বললেন, জ্বর আসবে কেন?
বিনু বলল, আপনার চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।
বারবার চোখে পানির ঝাপটা দিচ্ছি। এই জন্যে চোখ লাল হয়েছে।
বলয়ে বলতে জাহানারা আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেই চমকে উঠলেন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি চোখ ফেটে রক্ত বের হবে।
বিনু বলল, আপনার শরীর খারাপ লাগলে আপনি বিছানায় শুয়ে থাকুন। আমি আপনার মাথায় পানি চালার ব্যবস্থা করছি।
জাহানারা হঠাৎ নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বলে ফেললেন, কাল রাতে শুভ্র কোথায় ছিল তুমি কি জান?
বিনু বলল, জানি।
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে জান?
বিনু বলল, উনি আমাকে বলেছেন।
কখন বলেছে?
এইত কিছুক্ষণ আগে।
শুভ্ৰ কি বাড়িতে এসেছে?
বিনু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
জাহানারা বললেন, গত রাতে শুভ্ৰ কোথায় ছিল?
বিনু জবাব দিল না।
টেলিফোন বাজছে। জাহানারা বিনুকে ইশারা করলেন। টেলিফোন সেট তার কাছে এগিয়ে দিতে। এ বাড়িতে টেলিফোন আসে খুব কম। সব সময় টেলিফোন তিনি ধরেন। কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছেন বিনু টেলিফোন ধরছে। এটা ঠিক না; ধমক দিয়ে নিষেধ করে দিতে হবে। শরীরে রাগটা উঠলে ধমক দিতে হবে। জুরের কারণে রাগ ঠিকমত উঠছে না বলে ধমক দিতে পারছেন না। ধমকটা আজকেই দিতে পারলেই সবচে ভাল হত।
জাহানারা টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি গলায় একটা মেয়ে বলল, শুভ্ৰ কি বাসায় আছে? ওকে দিতে পারবেন? খুব জরুরি।
তুমি কে?
আমার নাম মীরা। আমি ওর ক্লাসমেট।
জাহানারা কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, এটা শুত্রদের বাড়ি না। শুভ্র নামে এখানে কেউ থাকে না।
আমার কথাটা আপনি একটু মন দিয়ে শুনুন। আমি নিশ্চিত এটা শুভ্রদের বাড়ি এবং খুব সম্ভব। আপনি তার মা। শুভ্ৰকে টেলিফোন দিতে না চাইলে দেবেন না। কিন্তু একটা খবর তাকে দিতে হবে- আপনি শুভ্ৰকে বললেন আলতাফুর রহমান স্যার মারা গেছেন। রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। উনি শুভ্রকে খুব পছন্দ করতেন। তার ডেডবিডি ধানমণ্ডির বাড়িতে রাখা আছে। শুভ্ৰ যেন অবশ্যই সেখানে যায়। দয়া করে এক্ষুণি শুভ্রকে খবরটা দিন।
এই মেয়ে, তোমাকে বললাম এটা শুভ্রর বাসা না।
আমার নাম মীরা। বলবেন মীরা টেলিফোন করেছিল। স্যারের নামটা মনে রাখুন— ড. আলতাফুর রহমান। চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অব ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড এপ্লায়েড ফিজিক্স। মনে থাকবে?
জাহানারা টেলিফোন নামিয়ে রেখে শুভ্ৰকে ডেকে পাঠালেন। শুভ্ৰ সঙ্গে সঙ্গে এল। তিনি শুভ্ৰর দিকে তাকালেন না। কথা বললেন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে যেন শুভ্ৰ বুঝতে পারে তিনি রাগ করেছেন।
শুভ্ৰ, তোর একজন টিচার মারা গেছেন। নাম আলতাফুর রহমান। রোড একসিডেন্টে মারা গেছেন। তাঁর ডেডবডি ধানমণ্ডির বাসায় রাখা আছে। তুই ধানমণ্ডির বাসা চিনিস?
হ্যাঁ।
ওখানে যেতে বলেছে। টেলিফোন কে করেছে?
বুড়ো মত এক ভদ্রলোক। নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম— বলল না। তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
শুভ্ৰকে দেখে মনে হচ্ছে না— সে খুব দুঃখিত হয়েছে। কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে তার শিক্ষকের ডেড়বডি দেখতেও যাবে না।
শুভ্ৰ।
হুঁ।
তুই তোর স্যারুকে দেখতে যাবি না?
না।
যাবি না কেন?
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, উনি তো এখন আর আমার স্যার না। একটা মৃত দেহ। মৃত মানুষ কিছুই না মা। তোমার কি শরীর খারাপ?
না।
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
তুই তো আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস। পাচ্ছিস না?
পাচ্ছি।
কথা শুনতে পাওয়াটাই আসল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যা আসমানের দিকে তাকিয়ে কথা বলাও তা।
বিনুর কাছে শুনলাম তুমি পর পর দু রাত সেই প্রেতটাকে দেখছ। বারান্দায় হাঁটাহাটি করছিল। তোমাকে নাকি হয়ত ইশারায় ডাকছিল। সত্যি?
না, সত্যি না। আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি।
জাহানারা এতক্ষণ বসেছিলেন। এখন শুয়ে পড়লেন। চাঁদরে মুখ ঢেকে ফেললেন। তিনি মীরা মেয়েটার কথা ভাবছেন। মেয়েটা দেখতে কেমন?
গলার স্বর মিষ্টি কাজেই দেখতে ভাল হবে না। যে মেয়ের গলার স্বর যত মিষ্টি সে দেখতে তত খারাপ। আর যে মেয়ের গলার স্বর যত চিকন সে তত মোটা।
এটা সহজ হিসেব। এই হিসেবে কখনো ভুল হয় না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে এইসব কথা বের করা হয়েছে।
কোনো নারীর পায়ের পাতা যদি হাতির পায়ের পাতার মত থ্যাবড়া হয় তাহলে সেই নারী হয় স্বামী ঘাতকিনী। মীরা মেয়েটার পায়ের পাতা কেমন কে জানে।
যে মেয়ের চুলের আগা ফেটে যায়। সেই মেয়ে হয় স্বৈরিণী। স্বামী ছাড়াও অন্য পুরুষের সঙ্গে রাত্রি যাপন করে।
যে নারী নিতম্ব স্থূল, সে হয় কামাতুরা। কামজ্বরে কাতর।
উচ কপালী
চিড়িল দাঁতী
পিঙ্গল কেশ
ঘুরবে কন্যা নানা দেশ।
জাহানারার উঁচু কপাল, চিড়ল দাঁত এবং মাথার চুলও পিঙ্গল। তিনি নানান দেশ ঘুরেন নি। তিনি তাঁর জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন— দশের এক গোলাপলাল রোডের দোতলা বাড়ির উত্তরের একটা ঘরে।
Leave a Reply