১৩. নামে কিবা আসে যায়

নামে কিবা আসে যায়

‘সামার হলিডে’ শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সবার মনই এই সময় খানিকটা তরল অবস্থায় থাকে। অত্যন্ত কঠিন অধ্যাপককেও এই সময় নরম এবং আদূরে গলায় কথা বলতে দেখা যায়।

আমার অধ্যাপকের নাম জোসেফ এডওয়ার্ড গ্লালাস নামের সার্থকতা বুঝানোর জন্যই হয়তো ভুদ্রলোক কাচের মতো কঠিন এবং ধারালো। সামার হলিডের তারল্য তাকে স্পর্শ করেনি। ভোর ন’টায় ল্যাবে এসে দেখি সে একটা বিকারের কপার সালফেটে সলুসন বানিয়ে খুব ঝাঁকাচ্ছে। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, ভোরবেলা গ্লাসের সঙ্গে দেখা হলে সারাটা দিন খারাপ যাবে।

গ্লাসকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রবাদের কারণে নয়। মন খরাপ হলো কারণ ব্যাটার আজ থেকে ছুটিতে যাবার কথা। যায়নি যখন তখন বুঝতে হবে সে এই সামারে ছুটিতে যাবে না। ছুটির তিন মাস আমাকে জ্বালাবে। কারণ জ্বালানোর জন্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি ল্যাবে নেই। সবাই ছুটি নিয়ে কেটে পড়েছে।

আমি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ গলায় বললাম,-হাই।

গ্লাস আনন্দে সব কটা দাঁত বের করে বলল, তুমি আছো তাহলে। থ্যাংকস। এসো দু’জনে মিলে এই সশানটার ডিফারেনসিয়েল রিফ্লেকটিভ ইনবক্স বের করে ফেলি।

আমি বললাম, এটা সম্ভব না। আমি আমার নিজের কাজ করবো। এর মধ্যে তুমি আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো।

বাংলাদেশের পাঠক-পাঠিকারা আমার জবাব শুনে হয়তো আঁতকে উঠেছেন। আমার পি-এইচ-ডি গাইড এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাবান একজন অধ্যাপকের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলা যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না, তবে আমেরিকান চরিত্র সম্পর্কে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারাই বুঝবেন আমার জবাব হচ্ছে যথাযথ জবাব।

প্রফেসর গ্লাস খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল, হামাদ, এটা সামান্য কাজ। এক ঘণ্টাও লাগবে না।

আমি বললাম, আমাকে হামাদ ডাকছ কেন? আমার নাম হুমায়ুন আহমেদ। হামাদটা তুমি পেলে কোথায়?

নাম নিয়ে তুমি এত যন্ত্রণা করো কেন হামাদ? নামে কি যায় আসে? আমি একজন ওল্ডম্যান। তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি কাজটা করে নিতে। আর তুমি নাম নিয়ে যন্ত্রণা শুরু করে দিলে।

আমি ডিফারেনসিয়েল রিফ্লেকাটিভ ইনডেক্স বের করে দিলাম। ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা লাগলো। কোনো কিছুই হাতের কাছে নেই। সবাই ছুটিতে। নিজেকে ছুটাছুটি করে প্রত্যেকটি জিনিস জোগাড় করতে হয়েছে।

প্রফেসর গ্লাস আমার পাশেই চুরুট হাতে বসে খুব সম্ভব আমাকে খুশি রাখবার জন্যই একের পর এক রসিকতা করছে। রসিকতাগুলোর সাধারণ নাম হচ্ছে ডার্টি জোকস। ভয়াবহ ধরনের অশ্লীল।

বিকেল পাঁচটায় ল্যাব বন্ধ করে বাসায় ফিরবার আগে আগে গ্লাসের কামরায় উঁকি দিলাম। গ্লাস হাসি মুখে বলল, কিছু বলবে হামাদ।

হ্যাঁ, বলবো। আগেও কয়েকবার বলেছি। আজও বলবো।

তোমার নামের উচ্চারণের ব্যাপার তো?

হ্যাঁ।

উচ্চারণ করতে পারি না বলেই তো একটু এলোমেলো হয়ে যায়। এতে এতো রাগ করবার কী আছে? আমেরিকানদের জিহ্বা শক্ত।

আমেরিকানদের জিহ্বা মোটেই শক্ত নয়। অনেক কঠিন উচ্চারণ এরা অতি সহজেই করে। তোমরা যখন কোনো ফরাসি রেস্টুরেন্টে যাও তখন খাবারের ফরাসি নামগুলো খুব আগ্রহ করে উচ্চারণ করো না?

গ্লাস গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না।

আমি বললাম, এসো আমার সঙ্গে। চেষ্টা করো, বলো হুমায়ূন।

গ্লাস বললো, হেমেন।

আমি বললাম, হলো না, আবার বলো হুমায়ুন। হুমায়ুন।

গ্লাস বললো, মায়ান।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। আমেরিকায় পা দেবার পর থেকে যে জিনিসটি আমাকে পীড়া দিচ্ছে সেটা হচ্ছে শুদ্ধভাবে এরা বিদেশীদের নাম বলতে চায় না। ভেঙে-চুরে এমন করে যে রাগে গা জ্বলে যায়। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির মিজানুল হককে বলে হাকু। হাকু পারলে হক বলতে অসুবিধা কোথায়? অন্য বিদেশীরা এই ব্যাপারটি কিভাবে নেয় আমি জানি না। আমার অসহ্য বোধ হয়।

হংকংয়ের চাইনিজ ছাত্রদের দেখেছি এ ব্যাপার খুবই উদার। তারা আমেরিকানদের উচ্চারণ সাহায্য করার জন্য নিজেদের চাইনিজ নাম পাল্টে পড়াশোনার সময়টার জন্যে একটা আমেরিকান নাম নিয়ে নেয়। যার নাম চান ইয়েন সে হয়তো খণ্ডকালীন একটা নাম নিলো, মি, ব্রাউন। দীর্ঘ চার বছরের ছাত্রজীবনে সবাই ডাকবে মি, ব্রাউন। যদিও তার আসল নাম চ্যান ইয়েন। হংকংয়ের চাইনিজগুলো এই কাজটি কেন করে কে জানে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে দার্শনিকের মতো বলল,-ভুল উচ্চারণে আসল নাম বলার চেয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে নকল নাম বলা ভালো। তাছাড়া নাম আমেরিকানদের কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা হচ্ছে ফাজিলের দেশ। নামের মধ্যেও এরা ফাজলামি করে। তাই না?

নাম নিয়ে যে এরা যথেষ্ট ফাজলামি করে সে সম্পর্কে সন্দেহের কারণ নেই। এর পশুর নামে নাম রাখে যেমন, Mr. Fox, Mr. Lion, Mr. Lamb. এরা কীট-পতঙ্গের নামে নাম রাখে যেমন, Mr. beetle (গুবরে পোকা)। একটা নাম পেয়েছিলাম যার বাংলার মানে–ষাড়ের গোবর (Mr. bull durig Junior)। অবশ্যি বাংলা ভাষাতেও খাদা, গেদা, নাম রাখা হয়। তবে সেসব নাম নিয়ে আমরা বড়াই করি না। আমেরিকানরা করে। আমি একজন আন্ডার-গ্রাজুয়েট ছাত্র পেয়েছিলাম সে খুব বড়াই করে বললো–আমার নাম Back Bison (বাইসনের পাছা)।

ধরাকে সরা জ্ঞান করার একটা প্রবণতা আমেরিকানদের আছে। ঢাকা শহরে একবার এক আমেরিকানকে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখেছি। গাড়িতে একজন বাঙালি তরুণী এবং দুইজন বাঙালি যুবক। আমি জানি না, তবে আমার বিশ্বাস আমেরিকানটির খালি গায়ে গাড়ি চালানোর যুক্তি বোধহয় এদেশের গরম। আমাদের প্রাচ্যদেশীয় সভ্যতায় এই আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, এটা তারা জেনেও এই কাজ করবে। ভাবটা এরকম, আমরা কোনো কিছুই পরোয়া করি না। এরা যখন আমাদের দেশে আসবে তখন আমাদের আচার আচরণকে সম্মান করবে এটা আমার বিশ্বাস আশা করবো। তারা যখন তা করবে না তখন মনে করিয়ে দেবো যে তারা যা করছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা প্রায় কখনোই তা করি না। সাদা চামড়া দেখলে এখনো আমাদের হুশ থাকে না। যাক পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

আমি খুব যে একজন বিপ্লবী ধরনের ছেলে তা নয়। বড় বড় অন্যায় দেখি কিন্তু তেমন কোনো সাড়াশব্দ করি না। সব সময় মনে হয় প্রতিবাদ অন্যেরা করবে আমার ঝামেলায় যাবার দরকার নেই। তবু বিকৃত উচ্চারণে বিদেশীদের নাম বলাটা কেন জানি শুরু থেকেই সহ্য হলো না। একটা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম যাতে আমেরিকানরা শুদ্ধ নামে ঢাকার একটা চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরের কাগজে চিঠি লিখলাম, আমার যুক্তি আমেরিকানরা ইচ্ছে করে বিদেশীদের ভুল উচ্চারণে ডাকে। উদাহরণ হচ্ছে, শীলা নামটা সঠিক উচ্চারণ না করতে পারার কোনোই কারণ নেই। এর কাছাকাছি নাম তাদের আছে। কিন্তু যেই তারা দেখবে এই নামটা একজন বিদেশীর, অমনি উচ্চারণ করবে–শেইল (Sheila), এর মানে কী?

সাত বছর ছিলাম আমেরিকায়। এই সাত বছরে অনেক চেষ্টা করলাম ওদের দিয়ে শুদ্ধভাবে আমার নামটা বলাতে পারলাম না। ফল এই হলো যে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রটে গেল ‘হামাম’ নামের এই ছেলের মাথায় খনিকটা গণ্ডগোল আছে। তবে ছেলে ভালো।

বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসছি। আমার দেশে ফিরে যাওয়া উপলক্ষে প্রফেসর গ্লাস তার বাড়িতে একটা পার্টি দিলেন। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, এই পার্টিতে প্রথমবারের মতো সে শুদ্ধ উচ্চারণ করলো। আমার দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সুন্দর পরিণতি। আমার ভালো লাগার কথা। আনন্দিত হবার কথা। কেন জানি ভালো লাগলো না।

গ্লাস গাড়িতে করে আমাকে পৌঁছে দিচ্ছে।

আমি বললাম, এই তো সুন্দর করে তুমি আমার নাম বলতে পারছো। আগে কেন বলতে পারতে না?

গ্লাস খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো, বিদেশীদের আমরা একটু আলাদা করে দেখি। আমরা তাদের রহস্যময়তা ভাঙতে চাই না। তাদের অন্য রকম করে ডাকি। অন্য কিছু না।

অধ্যাপক গ্লাসের কথা কতটুকু সত্যি আমি জানি না। সে যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখেছে অন্যরাও সেভাবে দেখেছে কিনা তাও জানি না। গ্লাসের কথা আমার ভালোই লাগলো। আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি আমাকে তোমার মতো করেই ডাকো।

বিদায় নিয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে গ্লাস বললো, হামান, ভালো থেকো এবং আগলি আমেরিকানদের কথা মনে রেখো।

1 Comment
Collapse Comments
সিমান্ত জয় June 26, 2022 at 8:00 pm

পড়া শুরু করার আগে ভাবতেও পারিনি গল্পটি এরকম হবে।অজানা তথ্যে ভরপুর ছিল গল্পটি।হুমায়ূন স্যারের গোটা জীবন চিত্র বলা চলে গল্পটিকে।অসাধারণ।যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন,সুখে থাকুন। তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *