১২. পাঁচ বছর পরের কথা

১২

পাঁচ বছর পরের কথা।

মিসির আলি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ময়মনসিংহে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নীলু, হাসিখুশি ধরনের একটি মেয়ে। খুব সহজেই অবাক হয়, অল্পতেই মন-খারাপ করে, আবার সামান্য কারণেই মন ভালো হয়ে যায়।

ময়মনসিংহে আসার নীলুর কোনো ইচ্ছা ছিল না। আসতে হয়েছে মিসির আলির আগ্রহে। তিনি বারবার বলেছেন, ‘তোমাকে মজার একটা জিনিস দেখাব।’ অনেক চেষ্টা করেও সেই মজার জিনিসটি সম্পর্কে নীলু কিছু জানতে পারে নি। মিসির আলি লোকটি কথা খুব কম বলেন। তিনি প্রশ্নের উত্তরে শুধু হেসে বলেছেন, ‘গেলেই দেখবে। খুব অবাক হবে।’

নীলু সত্যি অবাক হল। চোখ কপালে তুলে বলল, ‘এই বাড়িটা তোমার। বল কী! কে তোমাকে এই বাড়ি দিয়েছে?’

‘দিতে হবে কেন, আমি বুঝি কিনতে পারি না?’

‘না, পার না। তোমার এত টাকাই নেই।’

‘বরকত সাহেব বলে এক ভদ্রলোক দিয়েছেন।’

‘কেন দিয়েছেন?’

‘ঐটা একটা রহস্য। রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছি। যখন করব, তখন জানবে।’ গভীর আগ্রহে নীলু বিশাল বাড়িটি ঘুরে-ঘুরে দেখল। বহু দিন এখানে কেউ ঢোকে নি, ভ্যাপসা, পুরোনো গন্ধ। দেয়ালে ঘন ঝুল। আসবাবপত্রে ধুলোর আস্তরণ। বাগানে ঘাস হয়েছে হাঁটু-উঁচু। পেছন দিকটায় কচু গাছের জঙ্গল। মিসির আলি বললেন, ‘এ তো দেখছি ভয়াবহ অবস্থা!’

নীলু বলল, ‘যত ভয়াবহই হোক, আমার খুব ভালো লাগছে। বেশ কিছু দিন আমি এ বাড়িতে থাকব, কি বল?’

‘কী যে বল! এ-বাড়ি এখন মানুষ-বাসের অযোগ্য। মাস দু’-এক লাগবে বাসের যোগ্য করতে।’

‘তুমি দেখ না কী করি!’

কোমর বেঁধে ঘর গোছাতে লাগল নীলু। তার প্রবল উৎসাহ দেখে মিসির আলির কিছু বলতে মায়া লাগল। যেন এই মেয়েটি দীর্ঘ দিন পর নিজের ঘর-সংসার পেয়েছে। আনন্দে-উৎসাহে ঝলমল করছে। এক দিনের ভেতর মালী লাগিয়ে বাগান পরিষ্কার করল। বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে রান্নার ব্যবস্থা করল। রাতে খাবার সময় চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘জান, এ বাড়ির ছাদ থেকে পাহাড় দেখা যায়। নীল পাহাড়ের সারি। কী যে অবাক হয়েছি পাহাড় দেখে!’

পাহাড়ের নাম হচ্ছে ‘গারো পাহাড়’।

‘আজ অনেকক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখলাম। মালী বাগানে কাজ করছিল, আমি পাহাড় দেখছিলাম।’

‘ভালো করেছ।’

‘ও ভালো কথা, বাগানে খুব অদ্ভুত ধরনের একটা গাছ আছে। ভোরবেলা তোমাকে দেখাব। কোনো অর্কিড-টর্কিড হবে। হলুদ রঙের লতানো গাছ। মেয়েদের চুলে যে রকম বেণী থাকে, সে রকম বেণী-করা। নীল-নীল ফুল ফুটেছে।’

মিসির আলি তেমন কোনো উৎসাহ দেখালেন না। নীলু বলল, ‘আচ্ছা, এই বাড়িতে থেকে গেলে কেমন হয়?’

‘কী যে বল। ঢাকায় কাজকর্ম ছেড়ে এখানে থাকব?’

‘আমি থাকি। তুমি সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে।’

‘পাগল হয়েছ নাকি? একা-একা তুমি এখানে থাকবে?’

‘আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমার এ-বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘প্রথম প্রথম এ-রকম মনে হচ্ছে। ক’দিন পর আর ভালো লাগবে না।’

‘আমার কখনো এ বাড়ি খারাপ লাগবে না। যদি হাজার বছর থাকি তবুও লাগবে না।’

‘আচ্ছা, দেখা যাবে।’

‘দেখো তুমি।’

আসলেই তাই হল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, এ-বাড়ি যেন প্রবল মায়ায় বেঁধে ফেলেছে নীলুকে। ছুটিছাটা হলেই সে ময়মনসিংহ আসবার জন্যে অস্থির হয়। এক বার এলে আর কিছুতেই ফিরে আসতে চায় না। রীতিমতো কান্নাকাটি করে। বিরক্ত হয়ে মাঝে-মাঝে তাকে একা রেখেও চলে এসেছেন। ভেবেছেন ক’ দিন একা থাকলে আর থাকতে চাইবে না। কিন্তু তা হয় নি। এ বিচিত্র বাড়িটির প্রতি নীলুর আকর্ষণ বাড়তেই থাকল। শেষটায় এ রকম হল যে, বৎসরের প্রায় অর্ধেক সময় তাদের কাটে এই বাড়িতে।

থাকলে আর থাকতে চাইবে না। কিন্তু তা হয় নি। এ বিচিত্র বাড়িটির প্রতি নীলুর আকর্ষণ বাড়তেই থাকল। শেষটায় এ-রকম হল যে, বৎসরের প্রায় অর্ধেক সময় তাদের কাটে এই বাড়িতে।

তাদের প্রথম ছেলেটির জন্মও হল এ-বাড়িতে। ঠিক তখন মিসির আলি লক্ষ করলেন, নীলু যেন পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। এক দিন কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে বলল, ‘জান আমাদের এ ছেলেটা আসলে একটা গাছ।’

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘এ-কথা বলছ কেন?’

নীলু লজ্জিত স্বরে বলল, ‘এমনি বললাম, ঠাট্টা করলাম।’

‘এ কেমন অদ্ভুত ঠাট্টা।’

নীলু উঠে চলে গেল। মিসির আলি দেখলেন, সে ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের গারো পাহাড়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ভেজা।

সেই অজানা লতানো গাছটি আরো লতা ছেড়ে অনেক বড় হয়েছে। প্রচুর ফুল ফুটিয়েছে। দিনের বেলা সে-ফুলের কোনো গন্ধ পাওয়া যায় না, কিন্তু যতই রাত বাড়ে—মিষ্টি সুবাসে বাড়ি ভরে যায়। মিসির আলির অস্বস্তি বোধ হয়। কিন্তু অস্বস্তির কারণ তিনি ধরতে পারেন না।

তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়েও খুব দুশ্চিন্তা বোধ করেন। ছেলেটি সবে হামা দিতে শিখেছে। সে ফাঁক পেলেই হামা দিয়ে ছাদে উঠে যায়। চুপচাপ রোদে বসে থাকে। তাকে নামিয়ে আনতে গেলেই হাত-পা ছুঁড়ে বড্ড কান্নাকাটি করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *