১১. মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন

১১

মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দরজায় খুটখুট শব্দ শুনে জেগে উঠলেন। অনেক রাত। ঘড়ির ছোট কাঁটা একের ঘর পার হয়ে এসেছে। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, ‘কে?’ কোনো জবাব এল না। কিন্তু দরজার কড়া নড়ল। মিসির আলি অবাক হয়ে দরজা খুললেন। অন্ধকারে বরকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন।

‘সরি, আপনার ঘুম ভাঙালাম বোধহয়।’

‘কোনো অসুবিধা নেই, আপনি আসুন।’

বরকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ‘ঘুম আসছিল না, ভাবলাম আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি।’

‘খুব ভালো করেছেন। বসুন।’

বরকত সাহেব বসলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। বসে আছেন মাথা নিচু করে। এক জন অহঙ্কারী লোক এভাবে কখনো বসে না। মিসির আলি বললেন, ‘আমার মনে হয়, আপনি আপনার স্ত্রীর কথা কিছু বলতে চান। বলুন, আমি শুনছি।’

বরকত সাহেব চুপ করে রইলেন। তাঁর মাথা আরো একটু ঝুঁকে পড়ল। মিসির আলি বললেন, ‘আমি বরং বাতি নিভিয়ে দিই, তাতে কথা বলতে আপনার সুবিধা হবে। আলোতে আমরা অনেক কথা বলতে পারি না। অন্ধকারে সহজে বলতে পারি।’

বাতি নেভাবার পর ঘর কেমন অন্য রকম হয়ে গেল। গা ছমছম করতে লাগল। যেন এই ঘরটি এত দিনের চেনা কোনো ঘর নয়। অন্য কোনো রহস্যময় অচেনা ঘর। বরকত সাহেব সিগারেট ধরিয়ে মৃদু স্বরে বলতে লাগলেন, ‘আমার স্ত্রী খুবই সহজ এবং সাধারণ একজন মহিলা। বলার মতো তেমন কোনো বিশেষত্ব তার নেই। কোনো রকম অস্বাভাবিকতাও তার চরিত্রে ছিল না। তবে আমার শাশুড়ি এক জন অস্বাভাবিক মহিলা ছিলেন। বিয়ের আগে তা জানতে পারি নি। জেনেছি বিয়ের অনেক পরে।

‘আমার স্ত্রীর জন্মের পরপর আমার শাশুড়ি মারা যান। আমার শাশুড়ি সম্পর্কে এখন আপনাকে যা বলছি, সবই শোনা কথা। আমার স্ত্রীর জন্মের ঠিক আগে আগে আমার শাশুড়ি অদ্ভূত আচার-আচরণ করতে থাকেন। তার ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে রোদে বসে থাকা। এখন তিন্নি যা করে, অনেকটা তাই। আমার শাশুড়ি লোকজনদের বলতে শুরু করেন, তাঁর পেটে মানুষের বাচ্চা নয়, তাঁর পেটে বড় হচ্ছে একটা গাছ। সবাই বুঝল এটা মাথা খারাপের লক্ষণ। গ্রাম্য চিকিৎসাটিকিৎসা হতে থাকল। কোনো লাভ হল না। তিনি বলতেই থাকলেন, তাঁর পেটে বড় হচ্ছে একটা গাছ। যাই হোক, যথাসময়ে আমার স্ত্রীর জন্ম হল—ফুটফুটে একটি মেয়ে। আমার শাশুড়ি মেয়েকে কোলে নিলেন, কিন্তু বললেন, ‘তোমরা বুঝতে পারছ না, এ আসলে মানুষ নয়, এ একটা গাছ।’ এর কিছু দিন পর আমার শাশুড়ি মারা যান।

আপনাকে আগেই বলেছি, আমার স্ত্রী খুব স্বাভাবিক মহিলা ছিল। কিন্তু তিন্নি যখন পেটে এল, তখন তার ভেতরেও অস্বাভাবিকতা দেখা দিল। এক রাতে সে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘তার পেটে যে বড় হচ্ছে, সে মানুষ নয়, সে একটা গাছ।’ আমি এমন ভাব দেখালাম যে, এই খবরে মোটেও অবাক হই নি। আমি বললাম, ‘তাই কি?

সে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘কী করে বুঝলে?’

‘অনেক দূরের কিছু গাছ আমাকে স্বপ্নে বলেছে। তারা বলেছে, তোমার গর্ভে যে জন্মেছে, তাকে খুব যত্নে বড় করবে। কারণ তাকে আমাদের খুব দরকার।’

‘স্বপ্নে তো মানুষ অনেক কিছুই দেখে। স্বপ্নটাকে কখনো সত্যি মনে করতে নেই।‘

‘এটা সত্যি। এটা স্বপ্ন নয়।’

‘ঠিক আছে, সত্যি হলে সত্যি। এখন ঘুমাও।’

তিন্নির জন্মের কিছু দিন পর আমার স্ত্রী মারা গেল। তার মৃত্যুর দু’ দিন আগে তিন্নিকে কোলে নিয়ে আমি তার কাছে গেলাম। হাসিমুখে বললাম, ‘কী সুন্দর একটি মেয়ে, তুমি বলছ গাছ?’

আমার স্ত্রী ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল। শান্ত স্বরে বলল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না। কিন্তু একদিন বুঝবে।’ আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ‘এক দিন সকালবেলা দেখব তিন্নির চারদিকে ডালপালা গজিয়েছে, নতুন পাতা ছেড়েছে?’

আমার স্ত্রী তার জবাব দিল না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। যেন আমার কথায় সে অসম্ভব রেগে গেছে।

বরকত সাহেব থামলেন। ঘর অন্ধকার, কিন্তু মিসির আলি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

‘আপনি আমার স্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। আমি যা জানি আপনাকে বললাম। এখন আপনি আমাকে বলুন, কী হচ্ছে?’

মিসির আলি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। বরকত সাহেব ধরা গলায় বললেন, ‘কিছু দিন থেকে তিন্নি বাগানে একটি গর্তে চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরে আসে অনেক রাতে। আমার প্রায়ই মনে হয়, একদিন সে হয়তো আর ফিরবে না। সেখানেই থেকে যাবে এবং দেখব——’

বরকত সাহেব কথা শেষ করলেন না। তাঁর গলা বন্ধ হয়ে এল। মিসির আলি বললেন, ‘নিন, এক গ্লাস পানি খান।’ বরকত সাহেব তৃষ্ণার্তের মতো পানির গ্লাস শেষ করলেন।

‘মিসির আলি সাহেব।’

‘জ্বি বলুন।’

‘তিন্নি এখন আমাকে বলছে বাড়ি ছেড়ে যেতে। সে একা থাকবে এখানে। কাজের লোক থাকবে না, দারোয়ান মালী কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু সে একা। এবং আপনি জানেন মেয়েটি যা চায়, তাই আমাকে করতে হবে। ওর অসম্ভব ক্ষমতা। আপনি তার পরিচয় ইতোমধ্যেই হয়তো পেয়েছেন।’

‘হ্যাঁ, তা পেয়েছি।’

‘কী হচ্ছে আপনি আমাকে বলুন, এবং আমি কী করব, সেটা আমাকে বলুন। আমার শরীরও বেশি ভালো না। ব্লাড প্রেশার আছে, ইদানীং সুগারের প্রবলেম দেখা দিয়েছে। রাতের পর রাত ঘুমুতে পারি না।’

মিসির আলি দৃঢ় গলায় বললেন, ‘হাল ছেড়ে দেবার মতো এখনো কিছু হয় নি।’

‘হালই তো নেই। হাল ধরবেন কীভাবে?’

বরকত সাহেব উঠে পড়লেন। বাকি রাতটা মিসির আলি জেগেই কাটালেন। অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে সমস্ত ব্যাপারটা গোছাতে চেষ্টা করলেন। ’জিগ স পাজ্‌ল্‌’ একটির সঙ্গে অন্যটি কিছুতেই মেলে না। তবু কি কিছু একটা দাঁড় করান যায় না?

একটা পর্যায়ে জীবনকে প্রকৃতি দু’ ভাগে ভাগ করলেন–প্রাণী এবং উদ্ভিদ। প্রাণীরা ঘুরে বেড়াতে পারে, উদ্ভিদ পারে না। পরবর্তী সময়ে প্রাণের বিকাশ হল। ক্রমে-ক্রমে জন্ম হল অসাধারণ মেধাসম্পন্ন প্রাণীর–মানুষ। এই বিকাশ শুধু প্রাণীর ক্ষেত্রে হবে কেন? কেন উদ্ভিদের বেলায়ও হবে না?

ধরা যাক উদ্ভিদের বেলায়ও বিকাশ হল। এক সময় জন্ম হল এমন এক শ্রেণীর উদ্ভিদ, অসাধারণ যাদের মেধা। এই পৃথিবীতে হয়তো হল না, হল অন্য কোনো গ্রহে। একটি উন্নত প্রাণী খুঁজে বেড়াবে অন্য উন্নত জীবনকে। কারণ তারা চাইবে, তাদের আহরিত জ্ঞান অন্যকে জানাতে। তখন তারা কি চেষ্টা করবে না ভিন্‌ জাতীয় প্রাণের সঙ্গে যোগাযোগের? সেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে এমন একটি ‘প্রাণ’ তার দরকার, যে একই সঙ্গে মানুষ এবং উদ্ভিদ। এ জাতীয় একটি প্রাণ সে তৈরি করতে চেষ্টা করবে। তার জন্যে তাকে ডিএনএ অণুর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রথম পরীক্ষাতেই সে তা পারবে না। পরীক্ষাটি তাকে করতে হবে বারবার।

তিন্নি কি এ রকম একজন কেউ? মহাজ্ঞানী উদ্ভিদগোষ্ঠীর পরীক্ষার একটি বস্তু? মানুষ যদি উদ্ভিদ নিয়ে, ইঁদুর নিয়ে ল্যাবরেটরিতে নানান ধরনের পরীক্ষা করতে পারে—ওরা কেন পারবে না?

কিন্তু তারা পরীক্ষাটা করছে কীভাবে? এক জন মানুষ ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের গায়ে একটি সিরিঞ্জে করে রিএজেন্ট ঢুকিয়ে দিতে পারে। কিন্তু উদ্ভিদ কি তা পারবে?

.

হয়তো পারবে। মাইক্রোওয়েভ রশ্মি দিয়ে আমরা দূর থেকে যন্ত্র চালু করতে পারি। ওদের হাতেও হয়তো তেমন ব্যবস্থা আছে।

মিসির আলি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসলেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে। বাগানটিকে ভারি সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়।

‘আপনি আজ আর ঘুমুলেন না, তাই না?’

মিসির আলি চমকে উঠলেন। তিন্নির গলা।

’তুমিও তো দেখছি জেগে আছ।’

‘হ্যাঁ, আমি জেগেই থাকি।’

মিসির আলি কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। এ জাতীয় কথাবার্তায় তিনি এখন অভ্যস্ত। আগের মতো অস্বস্তি বোধ হয় না। বরঞ্চ মনে হয়, এই তো স্বাভাবিক। বরঞ্চ কথা বলার এই পদ্ধতি অনেক সুন্দর। মুখোমুখি এসে বসার দরকার নেই। দু’ জন দু’ জায়গায় থেকে কথা বলে চমৎকার সময় কাটান।

‘তিন্নি, আমি যে এতক্ষণ তোমার বাবার সঙ্গে গল্প করলাম–সেটা কি তুমি জান?’

‘হ্যাঁ, জানি। সব কথা শুনেছি।’

‘আমি তোমাকে নিয়ে যা ভেবেছি, তাও নিশ্চয়ই জান?’

‘হ্যাঁ, তাও জানি। সব জানি।‘

‘আমি কি ঠিক পথে এগুচ্ছি? অর্থাৎ আমার থিওরি কি ঠিক আছে?’

‘কিছু-কিছু ঠিক। বেশির ভাগই ঠিক না।‘

‘কোন জিনিসগুলি ঠিক না, সেটা কি আমাকে বলবে?’

‘না, বলব না।’

‘কেন বলবে না?’

তিন্নি জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি কি চাও না, আমি তোমাকে সাহায্য করি?’

‘না, চাই না।’

‘এক সময় কিন্তু চেয়েছিলে।’

‘তখন খুব ভয় লাগত, এখন লাগে না।’

মিসির আলি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর খুব শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি বুঝতে পারছ, তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে। তুমি বদলে যাচ্ছ। শেষ পর্যন্ত কী হবে তুমি কি জান?’

‘জানি।’

‘তুমি কি আমাকে তা বলবে?’

‘না।’

‘আচ্ছা, এইটুকু বল, তুমি কি একমাত্র মানুষ, যার উপর এই পরীক্ষাটি হচ্ছে? না তুমি ছাড়াও আরো অনেককে নিয়ে এ রকম হয়েছে বা হচ্ছে?’

‘অনেককে নিয়েই হয়েছে এবং হচ্ছে। এবং, এবং—’

‘বল, আমি শুনছি।’

‘এমন একদিন আসবে, পৃথিবীর সব মানুষ এ-রকম হয়ে যাবে।‘

‘তার মানে!’

‘তখন কত ভালো হবে, তাই না? মানুষের কোনো খাবারের কষ্ট থাকবে না। মানুষ কত উন্নত প্ৰাণী, কিন্তু সে তার সবটা সময় নষ্ট করে খাবারের চিন্তায়। এই সময়টা সে নষ্ট করবে না। কত জিনিস সে জানবে। আরো কত ক্ষমতা হবে তার।’

‘কী হবে এত কিছু জেনে?’

তিন্নি খিলখিল করে হেসে উঠল।

মিসির আলি বললেন, ‘হাসছ কেন?’

‘হাসি আসছে, তাই হাসছি। মানুষ তো এখনো কিছুই জানে না, আর আপনি বলছেন, কী হবে এত জেনে।’

‘তুমি বুঝি অনেক কিছু জেনে ফেলেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কি কি জানলে বল।’

‘তা বলব না। আপনি এখন ঘুমুতে যান।’

‘আমার ঘুম পাচ্ছে না, আমি আরো কিছুক্ষণ কথা বলব তোমার সঙ্গে।’

‘না, আপনি আর কথা বলবেন না। আপনি এখন ঘুমুবেন এবং সকালে উঠে ঢাকা চলে যাবেন। আর কখনো আসবেন না।’

‘আসব না মানে?’

‘ইচ্ছা করলেও আসতে পারবেন না। আমার কথা কিছুই আপনার মনে থাকবে না।’

‘কী বলছ তুমি।’

‘আপনাকে আমার দরকার নেই।’

তিন্নি হাসতে লাগল। মিসির আলি সারা রাত বারান্দায় বসে রইলেন। অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হতে লাগল, মেয়েটি যা বলছে, তা-ই হবে।

মানুষ যখন কোনো জটিল এক্সপেরিমেন্ট করে, তার সাবধানতার সীমা থাকে না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে, যেন তার এক্সপেরিমেন্ট নষ্ট না হয়। কেউ এসে যেন তা ভণ্ডুল না করে দেয়। যারা এই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে এই ভয়াবহ এক্সপেরিমেন্ট করছে, তারাও তাই করবে। কে রক্ষা করবে মেয়েটিকে?

ভোররাতের দিকে মিসির আলির শরীর খারাপ লাগতে লাগল। তাঁর কেবলি মনে হল, ঢাকায় কী যেন একটা কাজ ফেলে এসেছেন। খুব জরুরি কাজ। এক্ষুণি ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু কাজটি কী, তা মনে পড়ছে না। তিনি সকাল আটটায় ঢাকা রওনা হয়ে গেলেন। বরকত সাহেব বা তিন্নি–কারো কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নিলেন না। তিন্নির ব্যাপারটা নিয়ে বড়-বড় খাতায় গাদাগাদা নোট করেছিলেন। সব ফেলে গেলেন, কিছুই সঙ্গে নিলেন না। ঢাকায় পৌছার আগেই প্রচণ্ড জ্বরে জ্ঞান হারালেন।

ট্রেনের এক জন সহযাত্রী দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে পৌঁছে দিলেন ঢাকা মেডিকেলে। তিনি প্রায় দু’ মাস অসুখে ভুগলেন, সময়টা কাটল একটা ঘোরের মধ্যে। পুরোপুরি সুস্থ হতে তাঁর আরো দু’ মাস লাগল। কিন্তু পুরোপুরি বোধহয় সুস্থ হলেনও না। কিছু কিছু জিনিস তিনি মনে করতে পারেন না। যেমন এক দিন অমিতা তাঁকে দেখতে এসে বলল, ‘শুধু শুধু আজেবাজে কাজে ছোটাছুটি কর, তারপর একটা অসুখ বাধাও। সেইবার হঠাৎ কুমিল্লা এসে উপস্থিত। যেভাবে হঠাৎ আসা, সেইভাবে হঠাৎ বিদায়। আমি তো ভেবেই পাই না–।’

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘কুমিল্লা! কুমিল্লা কেন যাব!’

‘সে কী, তোমার মনে নেই।’

‘না তো।’

‘তুমি মামা একটা বিয়েটিয়ে করে সংসারী হও।’

নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে এক বার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। তিনি রাগী গলায় বললেন, ‘যাক, আপনার দেখা পাওয়া গেল। বইগুলি তো ফেরত দিলেন না, কেন?’

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী বই?’

‘কী বই মানে! বোটানির দু’টি বই নিয়ে গেলেন না আমার কাছ থেকে?’

‘তাই নাকি?’

‘আবার বলছেন তাই নাকি! আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ডঃ জাবেদ।‘

‘না, আমি তো ঠিক…।‘

মিসির আলি খুবই বিব্রত বোধ করলেন, কিন্তু কিছুই করার নেই। এর প্রায় এক বৎসর পর মিসির আলি ময়মনসিংহের এক অ্যাডভোকেটের কাছ থেকে এক চিঠি পেলেন। চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে বরকতউল্লাহ্ নামের এক ব্যবসায়ী ময়মনসিংহ শহরের বাড়ি মিসির আলিকে দান করেছেন। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কিছু টাকাও ব্যাঙ্কে জমা আছে। টাকার অঙ্কটি অবশ্য উল্লেখ করা হয় নি। মিসির আলি ভেবেই পেলেন না, অপরিচিত এক ভদ্রলোক শুধু-শুধু তাঁকে বাড়ি দেবেন কেন।

সেই বাড়ি দেখেও তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিশাল বাড়ি। অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, ‘বাড়ি অনেক দিন তালাবন্ধ আছে। বাগানের অবস্থা দেখেন না, জঙ্গল হয়ে আছে!’

মিসির আলি বললেন, ‘আমাকে বাড়িটা কেন দেওয়া হয়েছে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’

অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক বিরক্ত মুখভঙ্গি করলেন। মোটা গলায় বললেন, দিচ্ছে যখন নিন। ইচ্ছা করলে বিক্রি করে দিতে পারেন। ভালো দাম পাবেন। আমার কাছে কাস্টমার আছে—ক্যাশ টাকা দেবে।’

মিসির আলি বাড়ি বিক্রি করার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখালেন না। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আগে দেখি, বাড়িটা আমাকে কেন দেয়া হল। আজকালকার দিনে কেউ তো আর শুধু-শুধু এ-রকম দান খয়রাত করে না! দানপত্রে কি কিছুই লেখা নেই?’

‘তেমন কিছু না, শুধু বাগানের প্রতিটি গাছের যথাসম্ভব যত্ন নেবার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। উইলের কপি তো পাঠিয়েছি আমি আপনাকে।‘

মিসির আলি বাড়ি তালাবন্ধ করে ঢাকা ফিরে এলেন। বরকতউল্লাহ্ লোকটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করলেন। জানতে পারলেন যে, এর একটি অসুস্থ মেয়ে ছিল। মেয়েটির মাথার ঠিক ছিল না। মেয়েটি মারা যাবার পর ঐ বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতরই তার কবর হয়। ভদ্রলোক নিজেও অল্প দিন পর মারা যান। কিন্তু এর সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। জগতে রহস্যময় ব্যাপার এখনো তাহলে ঘটে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *