১০. বাড়ির সামনে লোহার গেট

১০

বাড়ির সামনে লোহার গেট। গেটের পেছনে খাকি পোশাক পরা দারোয়ান। কিন্তু সব কেমন অন্ধকার। গেটে বাতি জ্বলছে না, পোর্চেও জ্বলছে না। দারোয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে সে অন্ধকার পাহারা দিচ্ছে। বাড়ির সামনে বাগানের মতো আছে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় সেই বাগানকে খুব অগোছালো বাগান বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই প্ৰকাণ্ড বাড়ির জন্যে কোনো মালি নেই। মিসির আলি গাছপালা চেনেন না—বোগেনভিলিয়া চিনতে পারছেন। গাছ ভরতি ফুল তাও বোঝা যাচ্ছে। অন্ধকারের জন্যে মনে হচ্ছে গাছ ভরতি কালো ফুল ফুটেছে।

মিসির আলি গেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। দারোয়ান টুল ছেড়ে উঠে এল।

মিসির আলি বললেন, আমার নাম মিসির আলি। আমি নিশির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

দারোয়ান কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে গেট খুলল। একটা কথাও বলল না। মানুষদের অনেক অদ্ভুত স্বভাবের একটি হচ্ছে অন্ধকারে তারা কম কথা বলে। মানুষ ছাড়া অন্য সব জীবজন্তু অন্ধকারেই সাড়াশব্দ বেশি করে।

‘নিশি কি আছে?’

দারোয়ান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার গলার স্বর কেমন—মিসির আলির শোনার আগ্রহ ছিল, কিন্তু সে মনে হয় কথা বলবে না।

বেল টেপা হয়েছে—কেউ সদর দরজা খুলছে না। মিসির আলি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে পাঁচটা গোলাপ। ঢাকা শহরে এখন গোলাপ চাষ হচ্ছে। সুন্দর সুন্দর গোলাপ পাওয়া যায়। পঁচিশ টাকায় যে পাঁচটা গোলাপ কিনেছেন সেই গোলাপগুলির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। ফুলের দোকানদার গোলাপের কাঁটা ফেলে দিতে চেয়েছিল—তিনি ফেলতে দেন নি। কাঁটা হচ্ছে গোলাপের সৌন্দর্যের একটা অংশ। কাঁটা ছাড়ানো গোলাপকে তাঁর কাছে নগ্ন বলে মনে হয়।

দারোয়ান আরো একবার বেল টিপে তার টুলে গিয়ে বসল। সে মনে হয় আর বেল টিপবে না। বাকি রাতটা টুলে বসে পার করে দেবে।

ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ঢাকা শহরে ঝিঁঝির ডাক শোনা যায় না। এই পোকাটা কি মনের ভুলে এদিকে চলে এসেছে? ঝিঁঝি পোকার ডাক, জোনাকির আলো, শেয়ালের প্রহর যাপন ধ্বনি কিছুই আর শোনা হবে না। সব চলে যাবে। প্রাণের বিবর্তনের মতো হবে শব্দের বিবর্তন।

পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চটি পায়ে কে যেন আসছে। নিশি? হতে পারে। বসার ঘরের বাতি জ্বলল। দরজার ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে পড়ল মিসির আলির গায়ে। কটা বাজছে দেখার জন্যে মিসির আলি তার পাঞ্জাবির হাতা গুটালেন। হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়ি নষ্ট বলে ফেলে রেখেছেন। নতুন ঘড়ি কেনা হচ্ছে না। তিনি নিদারুণ অর্থ সংকটে আছেন। পাঁচটা গোলাপ কেনার সময়ও বুকের ভেতর খচখচ করছিল।

‘আসুন ভেতরে আসুন।

দরজা ধরে নিশি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে কালো সিল্কের শাড়ি। সে খুব সেজেছে। কপালে টিপ। চোখে কাজল। গয়নাও পরেছে। গলায় সরু চেইনের লকেট। লকেটের মাথায় লাল একটা পাথর। সেই পাথর আধো অন্ধকারেও কেমন ঝলমল করছে। কী পাথর এটা? জিরকণ? একমাত্র জিরকণই এমন কড়া লাল হয়—এমন দ্যুতিময় হয়।

‘নিশি তোমার জন্যে কিছু গোলাপ এনেছি।’

‘থ্যাংক য়্যু।’

‘সাবধানে ধর। কাঁটা সরানো হয় নি।’

নিশি ফুল হাতে নিয়ে হাসল। মিসির আলি মনে মনে বললেন—বাহ্ কী সুন্দর মেয়ে। সৃষ্টিকর্তা রূপের কলস মেয়েটির গায়ে ঢেলে দিয়েছেন।

বাবা বাড়িতে নেই। মাত্র বিশ মিনিট আগে চলে গেছেন। জরুরি কল পেয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। পাইলটদের এই সমস্যা—মজা করে ছুটি কাটাচ্ছে হঠাৎ ইমার্জেন্সি কল। আপনি কি ড্রয়িং রুমে বসবেন না স্টাডিতে বসবেন?

‘এক জায়গায় বসলেই হল।’

‘আসুন স্টাডিতে বসি। আমাদের ড্রয়িং রুমটা এমন যে কেউ বসে স্বস্তি পায় না। আমি কিন্তু আপনার জন্যে রান্না করেছি। ভাত, ডাল, চচ্চড়ি আর ডিম ভাজা।

‘থ্যাংক য়্যু।’

‘ডিম ভাজা এখনো হয় নি। ডিম ফেটে রেখেছি—খেতে বসবেন আর আমি ভেজে দেব।’

‘আচ্ছা।’

‘আপনার যখন খিদে হবে বলবেন ভাত দিয়ে দেব।’

‘তোমাদের বাড়িতে কি আর লোকজন নেই?’

‘এই মুহূর্তে শুধু আমি আর দারোয়ান ভাই আছি। আমাদের একজন কাজের মেয়ে আছে—কিসমতের মা। তার জলবসন্ত হয়েছে তাকে ছুটি দিয়েছি। সে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। সে কবে আসবে কে জানে। মনে হয় আসবে না। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করে তারা ছুটিতে গেলে আর ফিরে আসে না।

নিশি মিসির আলিকে স্টাডিতে নিয়ে বসাল। মাঝারি আকৃতির ঘর। হালকা সবুজ কার্পেটে মেঝে মোড়া। দুটা চেয়ার মুখোমুখি বসানো। একটা চেয়ারের পাশে অ্যাশট্রে।

‘আপনি যেভাবে বসেন, সেইভাবে আরাম করে বসুন। পা তুলে বসুন। আজ আপনি আসুন আমি তা চাচ্ছিলাম না। কেন বলুন তো?’

‘বলতে পারছি না।’

‘আমি আপনাকে খুব ভালো করে খাওয়াতে চাচ্ছিলাম। কাজের মেয়েটি নেই ভালো কিছু খাওয়াতে পারব না। তবে আমি আপনাকে বাইরের খাবার খাওয়াতে চাচ্ছিলাম না। যা পেরেছি রেঁধেছি।

‘আমার জন্যে খাবার তেমন জরুরি না। অনেকে খাবার জন্যে বেঁচে থাকেন। আমি বাঁচার জন্যে খাই।

‘কফি খাবেন?’

‘হ্যাঁ খাব।

‘বসুন কফি বানিয়ে আনি। কফি খেতে খেতে গল্প করি। আপনার কি গরম লাগছে?’

‘না গরম লাগবে কেন?’

‘বন্ধ ঘর তো। হালকা করে ফ্যান ছেড়ে দি।’

‘দাও।’

‘আপনি পা উঠিয়ে আরাম করে বসুন।’

মিসির আলি পা উঠিয়ে বসলেন। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। একটু শীত শীত লাগছে। তাই ভালো। শীতের রাতে শীত না লাগলে ভালো লাগে না।

‘কফি নিন।

মিসির আলি কফি নিলেন। গন্ধ থেকেই বলে দেয়া যায়—কফি খুব ভালো হয়েছে। ‘ব্রাজিলের কফি বিনের কফি। আমার বাবার খুব প্রিয়।

‘কফি ভালো হয়েছে।’

‘আমাকে কেমন দেখাচ্ছে তা তো বললেন না।’

‘তোমাকে অপূর্ব লাগছে।

‘আপনি আসবেন এই জন্যেই সন্ধ্যা থেকে সাজ করছি। আপনি যখন বেল টিপলেন তখন আমার টিপ দেয়া শেষ হয় নি। এই জন্যেই দরজা খুলতে দেরি হল। কালো রঙ কি আপনার পছন্দ?’

‘হ্যাঁ পছন্দ। খুব পছন্দ।’

‘আমাকে দেখে কি আপনার শীত শীত লাগছে না?’

‘কেন বল তো?’

‘শীতকালে সিল্কের শাড়ি পরা কাউকে দেখলে শীত শীত লাগে। যে শাড়ি পরে আছে তার শীতটা যে দেখছে তার গায়ে চলে আসে।’

‘তোমার পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো।’

‘আপনার চেয়েও কি ভালো?’

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন—আমি যে সবকিছু খুব খুঁটিয়ে দেখি তা কিন্তু না। এই কাজটা লেখকরা করেন। সবকিছু দেখেন ক্যামেরার চোখে। যা দেখছেন তারই ছবি তুলে ফেলছেন।

‘আপনি কীভাবে দেখেন?’

‘আমি আর দশটা মানুষ যেভাবে দেখে সেভাবেই দেখি। দেখতে দেখতে কোনো একটা জায়গায় খটকা লাগে। তখন খটকার অংশটা ভালো করে দেখি। বারবার দেখি।’

‘বুঝিয়ে বলুন।’

‘মনে কর এক টুকরা কাপড় আমাকে দেয়া হল। আমি কাপড়টা দেখব। তার ডিজাইন দেখব, রঙ দেখব, বুনন দেখব। অন্যরা যেভাবে দেখবে সেইভাবেই দেখব। দেখতে গিয়ে হঠাৎ যদি চোখে পড়ে একটা সুতা ছেঁড়া তখন সকল নজর পড়বে ওই ছেঁড়া সুতায়। তখন দেখব সুতাটা কোথায় ছিঁড়েছে, কেন ছিঁড়েছে।’

‘আমি যে আপনার কাছে আমার পাণ্ডুলিপি দিলাম সেখানেও কি আপনি ছেঁড়া সুতা পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘বলুন শুনি।’

নিশি একটু ঝুঁকে এল। তার মুখ ভরতি হাসি। মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে। মিসির আলি বললেন—তার আগে তুমি বল তোমার কি কোনো বোরকা আছে? সউদি বোরকা যেখানে শুধু চোখ বের হয়ে থাকে।

নিশি শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ আছে।

মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন—তা হলে বলা যেতে পারে তোমার সমস্যার সমাধান আমি করেছি।

‘বলুন আপনার সমাধান।’

‘সমাধান বলা ঠিক হবে না। আমি সমস্যা ধরতে পেরেছি। সমাধান তোমার হাতে।’

‘আপনি সমস্যাটা কীভাবে ধরলেন বলুন। গোড়া থেকে বলুন। আপনার সমস্যার মূলে পৌঁছার প্রক্রিয়াটা জানার আমার খুব আগ্রহ। ধরে নিন আমি আপনার একজন ছাত্রী। আপনি আমাকে বুঝাচ্ছেন। আমি আপনার কাছে শিখছি—’

মিসির আলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন—তারপর সহজ স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তার বলার ভঙ্গিটি আন্তরিক। মনে হচ্ছে তিনি তাঁর ছাত্রীকেই বুঝাচ্ছেন—

নিশি আমি যা করলাম তা হচ্ছে তোমার লেখা পড়ে গেলাম। খটকার অংশগুলি বের করলাম। যেসব জায়গায় আমার খটকা লাগল সেগুলি হচ্ছে—

ক) তুমি তোমার লেখায় কোথাও তোমার খালা, মামা, চাচা, ফুফুদের কথা আন নি। তাদের সম্পর্কে কিচ্ছু লেখা নেই।

খ) তোমাদের কোনো কাজের লোকের দোতলায় ওঠার অনুমতি পর্যন্ত নেই অথচ শরিফা নামের কাজের মেয়েকে তোমার ঘরে ঘুমাতে দেয়া হচ্ছে। কেন?

গ) শরিফার স্বামী পাগল হয়ে গেছে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পাবনা শহরে—এই খবর তুমি জানলে কী করে? তোমার জানার কথা না।

.

আমি অগ্রসর হয়েছি এই তিনটি ‘খটকা’ নিয়ে। তুমি যে কাপড় বুনেছ তার সবই ভালো শুধু তিনটা সুতা ছিঁড়ে গেছে। কেন ছিঁড়ল। ছেঁড়া সুতাগুলিকে জোড়া লাগানো যায় কীভাবে? এই তিনটি সুতার ভেতর কি কোনো সম্পর্ক আছে? তখন আমার কাছে মনে হল তোমার যদি কোনো বোরকা থাকে—সউদি বোরকা, তা হলে খটকাগুলির মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। তিনটি সুতার ভেতর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।

তোমার কি মনে আছে তোমার বোরকাওয়ালী এক বান্ধবীর গল্প করতে গিয়ে তুমি নানান ধরনের বোরকার কথা বলেছ। মনে আছে?

নিশি বলল, মনে আছে।

বোরকা সম্পর্কে তুমি জান। তুমি হয়তো ব্যবহারও কর। এই তথ্যটা বেশ জরুরি মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরালেন। নিশির মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে। মিসির আলি বললেন—নিশি আমি এক কাজ করি। আগে তোমার সমস্যাটা বলি তারপর বরং ব্যাখ্যা করি সমস্যায় কীভাবে পৌঁছেছি।

আপনার যেভাবে ভালো লাগে সেইভাবেই বলুন। তবে বোরকা পরে আমি ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াই তা কিন্তু না। শখ করে কিনেছিলাম—একদিনই পরেছি। আচ্ছা আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বলুন।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, তুমি হচ্ছ তোমার বাবা-মার পালিতা কন্যা। যে কারণে তোমার নিজের জগৎ ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে তোমার যোগাযোগ নেই। খালা, মামা, চাচা, ফুফুরা তোমার ভুবনে অনুপস্থিত। তোমার লেখায় তারা কেউ নেই।

তোমার অসম্ভব বুদ্ধি। তুমি খুব সহজেই ব্যাপারটা আঁচ করে ফেল। তোমার নিজের জগৎ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

তোমার নীতু আন্টি সেই লণ্ডভণ্ড জগৎ ঠিক করতে চান। তিনি হঠাৎ মনে করেন যে, তোমার একজন সার্বক্ষণিক সঙ্গী থাকলে ভালো হয়। তিনি সঙ্গী নিয়ে এলেন। শরিফাকে নিয়ে এলেন। সেই শরিফাকে থাকতে দেয়া হল তোমার সঙ্গে। কেন? তোমার নীতু আন্টি ভেবেছিলেন তুমি কারণটা ধরতে পারবে না। তুমি চট করে ধরে ফেলেছ। ভালো কথা, শরিফা মেয়েটিও খুব রূপবতী।

তুমি ধরে ফেললে শরিফা তোমার বোন। হতদরিদ্র এই পরিবার থেকেই একসময় তোমাকে আনা হয়েছিল। শরিফা অবিশ্যি কিছু জানল না। মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তুমি তাকে যেতে দিলে না। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে। প্রবল অপরাধবোধ তোমাকে গ্রাস করল। তুমি সেই অপরাধবোধের কারণেই বোরকা পরে একদিন দেখতে গেলে বোনের স্বামীকে। কিছু একটা তুমি তার সঙ্গে করেছ—সেটা কী আমি জানি না। মনে হয় ভয়ঙ্কর কিছু। বোনের কাছ থেকে শোনা শারীরিক গল্পগুলি তোমাকে প্রভাবিত করতে পারে। তুমি নাটকীয়তা পছন্দ কর। আমার ধারণা তুমি তার সঙ্গে বড় ধরনের কিছু নাটকীয়তাও করেছ। এই মুহূর্তে আমার যা মনে হচ্ছে তা হল তুমি তোমার বোনের শাড়ি পরে—বোন সেজেই তার কাছে গিয়েছ। এমন কাজ তুমি কর। শরিফা সেজে তুমি হাসিব নামের একজনকে ভয় দেখিয়েছ। যদিও আমার ধারণা ভয় দেখানো তোমার উদ্দেশ্য ছিল না। তুমি গভীর রাতে তার কাছে উপস্থিত হতে চেয়েছিলে। তাই না?

‘জানি না।’

‘ভয় পাবার পর হাসিব কী করল?’

‘তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।’

‘তুমি কি তার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত সেই ঘরে ছিলে?’

না আমি চলে এসেছিলাম।’

‘জ্ঞান ফেরার পর কী হল?’

‘জানি না কী হল। আমি ঘর থেকে নামি নি। দোতলা থেকে শুনেছি খুব হইচই হচ্ছে। সকালবেলা হাসিব বাসা ছেড়ে চলে যান।’

‘কাউকে কিছু বলে যায় নি?’

‘বাবাকে বলে গেছেন। আমাকে কিছু বলে যান নি।’

‘তার থেকে কি আমরা ধারণা করতে পারি যে সে বুঝতে পেরেছিল শরিফা নয় গভীর রাতে তুমি তার ঘরে উপস্থিত হয়েছিলে?’

‘নিশি চুপ করে রইল।’

‘তুমি কি পরে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছ?’

‘করেছি। পাই নি। যে কম্পিউটারের দোকানে তিনি কাজ করতেন সেখানেও তিনি আর ফিরে যান নি।

‘তুমি যদি চাও আমি তাকে খুঁজে বের করার একটা চেষ্টা করতে পারি। হারানো মানুষ খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমার নাম আছে। তুমি কি চাও?’

‘না আমি চাই না। খাটের নিচে যে আমি শরিফাকে দেখতাম সেই সম্পর্কে বলুন। আপনার ধারণাটা কী শুনি।’

‘তুমি যে খাটের নিচে অনেক কিছু দেখতে পাও এইসব সত্যিও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। তোমার মাথার একটা অংশ এখন কাজ করছে না। সেই অংশ নানান ছবি তৈরি করে তোমাকে দেখাচ্ছে। তবে দেখালেও তুমি জান—এইসব মায়া। তুমি অসাধারণ বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। তুমি বুঝতে পারবে না তা না।’

‘আমার ছোট মা এবং বাবা এরাও কিন্তু শরিফাকে দেখেছেন?’

‘শোন নিশি আমি তো ওদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি মাথা ঘামাচ্ছি তোমার সমস্যা নিয়ে। তুমি কী দেখছ না দেখছ সেটা নিয়েই বিচার-বিবেচনা হবে। আমার এখন খিদে লেগেছে, আমাকে খেতে দাও।’

নিশি নড়ল না, বসেই রইল।

মিসির আলি বললেন, তোমার জীবনটা কাটছে একটা তন্দ্রার মধ্যে। তুমি যা ভাবছ যা করছ তা আর কিছু না—তন্দ্রাবিলাস। তন্দ্রাবিলাস নামটা খুব সুন্দর মনে হলেও তন্দ্রাবিলাসের জগৎটা মোটেই সুন্দর না। ভয়াবহ ধরনের অসুন্দর। এই জগতের সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে এ জগতের বাসিন্দারা মনে করে তাদের জগৎটাই সত্যি। যা আসলে সত্যি না। আমি মনেপ্রাণে কামনা করি—তন্দ্রাবিলাসের জগৎ থেকে তুমি একদিন বের হয়ে আসবে।

নিশি নড়ে বসল। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি কিছু বলবে?’

নিশি চাপা গলায় বলল, ‘আপনি কি আমার সঙ্গে একটু আসবেন?’

‘কোথায় যাব?’

‘আমার শোবার ঘরে।’

‘কেন?’

‘শরিফা আমার ঘরে বসে আছে। আপনি তাকে দেখবেন, তার সঙ্গে কথা বলবেন।’

‘আমি দেখতে চাচ্ছি না নিশি। তোমার ভয়ঙ্কর জগতের অংশ আমি হতে চাই না।’

‘আসুন না প্লিজ।’

‘না। শোন নিশি আমি যখন না বলি তখন সেই ‘না’ কখনো হ্যাঁ হয় না। ওই প্রসঙ্গ থাক। ভালো কথা তুমি যে ওই দিন টেলিফোনে ফট করে বলে দিলে দোকানের মালিকের মেয়ের নাম লায়লা-কীভাবে বললে? আমি অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারি নি।

‘আমি যদি বলি শরিফা আমাকে বলেছে আপনি কি বিশ্বাস করবেন?’

‘না।’

‘আপনার খিদে পেয়েছে আসুন খাবার দি।’

মিসির আলি খুব তৃপ্তি করে খেলেন। সামান্য খাবার কিন্তু খেতে এত ভালো হয়েছে।

আলু ভর্তার উপর মেয়েটি গাওয়া ঘি ছড়িয়ে দিল। গন্ধে চারদিক ম ম করছে। ‘আপনাকে কি শুকনো মরিচ ভেজে দেব? একটা বইয়ে পড়েছিলাম ভাজা শুকনো মরিচ আপনার খুব পছন্দ।’

‘দাও।’

নিশি মরিচ ভেজে নিয়ে এল। কী যত্ন করেই না মেয়েটি তার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন মেয়েটির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

একবার তাঁর ইচ্ছে হল নিজের হাতে মেয়েটির চোখের জল মুছে দেন—পরমুহূর্তেই মনে হল—না, নিশির চোখের জল মুছিয়ে দেবার দায়িত্ব তাঁর না। তাঁর দায়িত্ব জলের উৎসমুখ খুঁজে বের করা। এই কাজটা তিনি করেছেন। তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়েছে। মেয়েটি যদি তার চোখের জল মুছতে চায় তা হলে তাকেই তা করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *