১০. বাড়ির ছাদে শামিয়ানা

১০

বাড়ির ছাদে শামিয়ানা টাঙিয়ে খালেক সাহেবের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। কেক এসেছে হোটেল সোনারগাঁও থেকে। গিফট রাখার জন্য একটা টেবিল সাজানো। টেবিলের পেছনে শুকনো মতো এক লোক খাতা-কলম নিয়ে বসে আছে। যে গিফট দিচ্ছে তার নাম ঠিকানা লিখে রাখছে।

জোয়ার্দার অস্বস্তিতে পড়েছেন। কারণ তিনি খালি হাতে এসেছেন। মেয়েটাকে পরে কিছু একটা কিনে দিতে হবে। মেয়ে কত বড় তাও জানেন না।

জোয়ার্দার খালেককে বললেন, আপনার মেয়ে কোথায়? খালেক গলা নিচু করে বলল, বিরাট বেইজ্জত হয়েছি স্যার। মেয়ের মা ঘুষের টাকার উৎসব করবে না বলে মেয়েকে নিয়ে দুপুর বেলায় কোথায় যেন গেছে। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে বলে বুঝতেই পারছি না তারা কোথায়।

জোয়ার্দার বললেন, এখন গেস্টদের কী বলবেন?

খালেক বলল, সুন্দর গল্প বানিয়ে রেখেছি। গেস্টরা সবাই খুশি মনে খাওয়াদাওয়া করে বিদায় হবে। আপনাকে একটা কথা বলি স্যার, সুন্দর মিথ্যা কিন্তু সত্যের চেয়েও ভালো।

ছাদের এক কোনায় জোয়ার্দার বসে আছেন। গেস্টরা আসতে শুরু করেছে। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসছে। একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছেন। ম্যাজিশিয়ানের সহকারী মেয়েটির পোশাক যথেষ্ট উগ্র। জোয়ার্দারের মনে হল, ঢাকা শহর অতিদ্রুত বদলাচ্ছে। অল্প কিছুদিন আগেও কোনো বাঙালি মেয়েকে এই পোশাকে ভাবা যেত না। খালেক হন্তদন্ত হয়ে আসছে।

স্যার, এক্ষুনি ম্যাজিক শুরু হবে। স্টেজের কাছে চলে যান।

আমি এখান থেকেই দেখব। ভালো কথা, আপনি কি বরকতউল্লাহ সাহেবের বোনকে চিনতেন?

অবশ্যই। উনি স্কুলশিক্ষিকা।

কত দিন আগে মারা গেছেন?

মারা যান নি তো। উনার নাম নাইমা। ইংরেজি একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

ও আচ্ছা।

স্যার, হঠাৎ উনার প্রসঙ্গ কেন?

জোয়ার্দার জবাব দিলেন না। নড়েচড়ে বসলেন। ম্যাজিক শো শুরু হয়েছে। ম্যাজিশিয়ানের সহকারী মিস পপি একটা কাঠের খালি বাক্স সবাইকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাল। ম্যাজিশিয়ান সেই খালি বাক্সের ভেতর থেকে ধবধবে সাদা রঙের একটা কবুতর বের করলেন। জোয়ার্দার অস্পষ্ট স্বরে বললেন, অদ্ভুত! তাঁর দৃষ্টি বারবার মিস পপির দিকে চলে যাচ্ছে। এ রকম কেন হবে? জোয়ার্দার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ম্যাজিক দেখা যাচ্ছে না, ম্যাজিশিয়ানের কথা শুনে ম্যাজিক কল্পনা করে নেওয়া। ব্যাপারটা যথেষ্টই আনন্দদায়ক

‘আমার হাতে আছে কিছু রিং। ভালো করে দেখুন। রিংগুলো স্টিলের তৈরি। কোনো ফাঁকফোকর নেই। এখন দেখুন কীভাবে একটা রিঙের ভেতর অন্যটা ঢুকে যাচ্ছে।’

জোয়ার্দার কল্পনায় দেখছেন। রিংগুলো শূন্যে ভাসছে। একটার ভেতর আরেকটা আপনাআপনি ঢুকছে আবার বের হচ্ছে। ম্যাজিশিয়ানের চোখে কোনো বিস্ময় নেই। কিন্তু মিস পপি চোখ বড় বড় করে এই দৃশ্য দেখছে।

জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ করে জোয়ার্দারের বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। দরজা সুলতানা খুললেন, কিছুই বললেন না। এটা ম্যাজিকের মতোই বিস্ময়কর ঘটনা। স্বামী এত রাত করে ফিরলে বাঙালি সব স্ত্রীর প্রথম প্রশ্ন হবে, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে?

সুলতানা বললেন, রঞ্জুর কোনো খবর জানো? না তো। ওর কী হয়েছে?

পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।

জোয়ার্দার বললেন, ও আচ্ছা। বাথরুমে কি টাওয়েল দেওয়া আছে? গোসল করব।

সুলতানা বললেন, এত বড় একটা ঘটনায় তোমার কোনো রি-অ্যাকশন নেই? একবার জানতে চাইলে না কেন অ্যারেস্ট করেছে? তুমি কি এই জগতে বাস কর?

জোয়ার্দার আমতা আমতা করে বললেন, কেন অ্যারেস্ট করেছে?

তুষার মারা গেছে। তার বোন পুলিশের কাছে উল্টাপাল্টা কী সব বলেছে।

মারা গেছে কীভাবে?

ক্লিনিকে অ্যাবরশন করা হয়েছিল, সেখানে মারা গেছে।

ও আচ্ছা।

সুলতানা বললেন, আবার ‘ও আচ্ছা’?

জোয়ার্দার বললেন, এক কাপ চা বানিয়ে দাও। চা খেয়ে গোসল করব।

থানায় যাবে না?

থানায় যাব কেন?

আমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। টর্চার করছে কি না কে জানে। আর তুমি বলছ চা খেয়ে গোসলে যাবে!

আমি থানায় গিয়ে কী করব? র‍্যাব-পুলিশ এসব আমি খুব ভয় পাই। রঞ্জুর অনেক টাকা। সে টাকা খরচ করবে, পুলিশ তাকে ছেড়ে দেবে। টাকাওয়ালা মানুষের এ দেশে কোনো সমস্যা হয় না।

সুলতানা বললেন, তুমি একজন অমানুষ। আমার জীবনটা তুমি নষ্ট করেছ। আমি একা থাকব, কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব না। দিস ইজ ফাইন্যাল।

জোয়ার্দার বললেন, আচ্ছা। তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। সুলতানা টেলিফোন করলেন থানায়। ওসি সাহেব বিনয়ী গলায় বললেন, রঞ্জু সাহেব তো কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন। আমরা দু-একটা প্রশ্ন করার জন্য ডেকেছিলাম। প্রশ্ন করেছি, উনি জবাব দিয়েছেন। তাঁর কথাবার্তায় আমরা সন্তুষ্ট। তুহিন নামের একটা মেয়ের কথায় কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল। এখন সব ঠিক আছে।

সুলতানা রঞ্জুকে টেলিফোন করতে যাবেন তার আগেই রঞ্জু টেলিফোন করল। রঞ্জুর কাছে জানা গেল পুলিশকে সন্তুষ্ট করতে তার দুই লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এখন সবকিছু আন্ডার কনট্রোল।

জোয়ার্দার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর সামনে ভীত মুখে অনিকা দাঁড়িয়ে আছে। অনিকার কোলে বিড়াল নেই। নতুন রাক্ষসী চেহারার কাজের মেয়েটি এক কাপ চা দিয়ে গেছে। চা খেতে ভালো হয়েছে।

অনিকা বলল, বাবা তুমি ভালো আছ?

জোয়ার্দার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।

অনিকা গলা নিচু করে বলল, বাবা তুমি এই ফ্ল্যাটে কি কোনো মেয়েকে নিয়ে এসেছিলে? মেয়ের নাম শায়লা।

জোয়ার্দার বললেন, না।

আমি জানি। তোমার খুব ঝামেলা হচ্ছে তাই না বাবা?

হুঁ।

অনিকা বলল, বাবা তোমার কি কোনো বিড়াল আছে? রঞ্জু মামা বলছিল তোমার নাকি একটা গুণ্ডা বিড়াল আছে।

জোয়ার্দার বললেন, আছে।

দেখতে পুফির মতো বাবা?

হুঁ।

বিড়ালটার কোনো নাম আছে?

আমি নাম দিয়েছি কুফি

অনিকা বলল, নামটা বেশি ভালো হয় নি।

জোয়ার্দার বললেন, তুমি একটা নাম দিয়ে দাও।

অনিকা বলল, আমি নাম দিলাম পুফি টু। আমারটার নাম পুফি ওয়ান তোমারটা পুফি টু। নাম পছন্দ হয়েছে বাবা?

হুঁ।

সুলতানা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, কঠিন গলায় বললেন, মেয়ের কানে কী মন্ত্র দিচ্ছ?

জোয়ার্দার জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। অনিকা বলল, মা! তুমি শুধু শুধু বাবাকে বকা দিবে না। বাবাকে বকা দিলে পুফি টু এসে তোমাকে কামড় দিবে।

কী বললি? বাঁদর মেয়ে কী বললি তুই?

অনিকা কঠিন গলায় বলল, আমার সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলবে না। আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও পুফি টু তোমাকে কামড়াবে। পুফি টু ভয়ংকর রাগী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *