০৯. আমার নাম মিসির আলি

‘কে বলছেন?’

‘আমার নাম মিসির আলি।

‘স্লামালিকুম।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম। কে কথা বলছ—নিশি?’

‘জি।’

‘তুমি ভালো আছ?’

‘জি।’

‘আরো আগেই টেলিফোন করতাম—আমার নিজের টেলিফোন নেই। আমি সাধারণত একটা পরিচিত দোকান থেকে ফোন করি। সেই দোকান গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ।’

‘বন্ধ কেন?’

‘জানি না কেন। খোঁজ নেই নি।’

‘একটা দোকান এক সপ্তাহ হল বন্ধ। আর আপনি হলেন বিখ্যাত মিসির আলি। আপনি খোঁজ নেবেন না?’

‘খোঁজ নেয়াটা তেমন জরুরি মনে করি নি।’

‘আমার তো ধারণা ব্যাপারটা খুবই জরুরি। বড় ধরনের কোনো কারণ ছাড়া কেউ এক সপ্তাহ ধরে দোকান বন্ধ রাখে না। আজ কি আপনি সেই দোকান থেকে টেলিফোন করছেন?’

‘হ্যাঁ।

‘ওরা দোকান বন্ধ রেখেছিল কেন?’

‘দোকানের মালিকের মেয়ের বিয়ে ছিল। তিনি দোকানের সব কর্মচারীদের নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন।’

‘ও আচ্ছা। মেয়ের বিয়েতে আপনাকে দাওয়াত দেয় নি?’

‘না। আমার সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই।’

‘কম পরিচয় থাকলেও তো আপনাকে দাওয়াত দেয়ার কথা। আপনি এত বিখ্যাত ব্যক্তি। বিখ্যাত মানুষরা খুব দাওয়াত পায়। সবাই চায় তাদের অনুষ্ঠানে বিখ্যাতরা আসুক।’

‘তুমি যত বিখ্যাত আমাকে ভাবছ আমি তত বিখ্যাত নই।’

‘আপনি কি আমার লেখাটা পড়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘পুরোটা পড়েছেন?’

‘না পুরোটা পড়ি নি।’

‘কতদূর পড়েছেন?’

‘তুমি হাসিব সাহেবকে ভয় দেখানোর জন্যে খাটের নিচে বসে রইলে পর্যন্ত। ‘বাকিটা পড়েন নি কেন?’

‘আমার যতটুকু পড়ার পড়ে নিয়েছি। বাকিটা পড়ার দরকার বোধ করছি না। আমার মনে হচ্ছে সবটা পড়ে ফেললে কনফিউজড হয়ে যাব। আমি কনফিউজড হতে চাচ্ছি না। তোমার লেখার প্রধান লক্ষ্য মানুষকে কনফিউজ করা, বিভ্রান্ত করা।’

‘আপনি একটু ভুল করছেন। এই লেখাগুলি আমি আপনার জন্যে লিখেছি—মানুষকে

বিভ্রান্ত করার জন্যে লিখি নি।’

‘তা ঠিক। হ্যাঁ আমাকে বিভ্রান্ত করা তোমার প্রধান লক্ষ্য ছিল।

‘আমার ধারণা ছিল আপনি পুরো লেখাটা পড়বেন তারপর টেলিফোন করবেন।’

‘তোমার সব ধারণা যে সত্যি হবে তা মনে করা কি ঠিক?’

‘সাধারণত আমার সব ধারণাই সত্যি হয়।’

‘শোন নিশি আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘কথা তো বলছেন।’

‘এভাবে না। মুখোমুখি বসে কথা বলতে চাই। তোমার পাণ্ডুলিপিও নিশ্চয়ই তুমি ফেরত চাও। চাও না?’

‘চাই।’

‘আমার কাছে তোমার কিছু জিনিসপত্রও আছে। হ্যান্ডব্যাগ, স্যুটকেস। বেশ কিছু টাকা।’

‘‘ওগুলি আমি নেব না।’

‘টাকা নেবে না?’

‘টাকাটা আপনি রেখে দিন। আপনি রহস্য সমাধানের জন্যে অনেক কর্মকাণ্ড করেন আপনার টাকার দরকার হয়। যেমন ধরুন আমার ছোট মার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল। কেইস কি দেয়া হয়েছিল? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী ছিল তা জানার জন্যে আপনি টাকা খরচ করেন নি?’

‘করেছি। অতি সামান্যই করেছি।

‘আচ্ছা একটা কথা—আমাদের বাড়ির ঠিকানা কি আপনি আমার লেখা পড়ে জেনেছেন না আগেই জেনেছেন?’

‘আগেই জেনেছি। থানা থেকে জেনেছি।’

‘আপনি পুরোনো পত্রিকা ঘাঁটেন নি?’

‘ঘেঁটেছি। আমি নিজে ঘাঁটি নি—একজনকে ঠিক করেছিলাম সে ঘেঁটেছে। তবে সেখান থেকে বাড়ির ঠিকানা পাই নি।’

‘আপনি যে এইসব কর্মকাণ্ড করবেন তা কিন্তু আমি জানতাম।’

‘তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে।’

‘আপনি কি আন্টির সঙ্গে দেখা করেছেন—নীতু আন্টি। তিনি তো এখন মোটামুটি সুস্থ।’

‘ওনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। উনি দেখা করেন নি। শোন নিশি আমি কি এখন আসব?’

‘না আজ না।’

‘আজ না কেন?’

‘বাবা বাড়িতে আছেন এই জন্যে আজ না। যদিও বাবা আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। বাবার ধারণা আপনি সাধারণ মানুষ নন। আপনি মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আপনার ওপর লেখা বইগুলি বাবাই আমাকে প্রথম পড়তে দেন।’

‘তোমার বাবার সঙ্গে তা হলে তো দেখা করাটা খুবই জরুরি।’

‘জরুরি কেন?’

‘তোমার বাবা যাতে বুঝতে পারেন যে আমি মহাপুরুষ পর্যায়ের কেউ নই—আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ।’

‘আপনি আমার সমস্যার সমাধান করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনি কথা বলছেন, এত আত্মবিশ্বাস থাকা কি ঠিক?’

‘না ঠিক না। তবে তোমার ক্ষেত্রে আমি ভুল করি নি।’

‘একটা জিনিস শুধু জানতে চাচ্ছি—আমি যে খাটের নিচে শরিফাকে দেখতে পাই এবং এখনো দেখতে পাই তা কি আপনি বিশ্বাস করেন?’

‘করি।’

‘আপনি কি শরিফাকে দেখতে চান?’

‘না চাই না। অস্বাভাবিক কিছু আমার দেখতে ভালো লাগে না। আমি স্বাভাবিক মানুষ। আমি আমার চারপাশে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দেখতেই আগ্রহী।’

‘পৃথিবীতে সব সময়ই কি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ঘটে?’

‘না ঘটে না।’

‘আচ্ছা আপনি আসুন।’

‘কখন আসব?’

‘আজই আসুন। রাতে আমার সঙ্গে খাবেন। আমি নিজে আপনার জন্যে রান্না করব।’

‘তুমি রাঁধতে জান?’

‘সহজ রান্নাগুলি জানি। যেমন ডিম ভাজতে পারি। ডাল চচ্চড়ি পারি। ভাত রাঁধতে অবিশ্যি পারি না। হয় ভাত নরম জাউ জাউ হয়ে যায় আর নয়তো চালের মতো শক্ত থাকে। আমি আপনাকে গরম গরম ডিম ভেজে দেব। ডিম ভাজা কি আপনার পছন্দের খাবার?’

‘হ্যাঁ খুব পছন্দের খাবার।’

‘আপনি কি আইসক্রিম পছন্দ করেন?

‘হ্যাঁ করি।’

‘আমিও খুব আইসক্রিম পছন্দ করি। বাবা পরশু হংকং থেকে দু লিটারের একটা আইসক্রিম এনেছেন। বিমানের ক্যাপ্টেন হবার অনেক সুবিধা। প্লেনের ফ্রিজে করে নিয়ে এসেছেন—এত ভালো আইসক্রিম আমি অনেক দিন খাই নি। কালো রঙের আইসক্রিম। আপনাকে খাওয়াব।’

‘আচ্ছা। আমি কি টেলিফোন রাখব?’

‘জি না আরেকটু ধরে রাখুন। আচ্ছা শুনুন এই দীর্ঘ সময় যে টেলিফোন করছেন—দোকানের মালিক বিরক্ত হন নি?’

‘না হন নি। দোকানের মালিক আমাকে খুব পছন্দ করেন।’

‘খুব যদি পছন্দ করে তা হলে আপনাকে দাওয়াত করেন নি কেন? আসলে আমার খুব রাগ লাগছে। আচ্ছা ভদ্রলোকের যে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে তার নাম কী?’

‘নাম তো জানি না।’

‘নাম জিজ্ঞেস করে দেখুন। আমার ধারণা মেয়েটির নাম লায়লা।

‘তুমি জান কী করে?’

‘আমি জানি না। আমি অনুমান করছি। আমার অনুমানশক্তি ভালো। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন।’

‘আচ্ছা জিজ্ঞেস করব। তোমার সঙ্গে কথা শেষ হবার পর জিজ্ঞেস করব।’

‘জিজ্ঞেস করতে আবার ভুলে যাবেন না যেন।’

‘না ভুলব না। এখন টেলিফোন রাখি?’

‘এক মিনিট ধরে রাখুন। কোনো কথা বলতে হবে না শুধু ধরে রাখুন। এক মিনিট পার হবার পর রিসিভার রেখে দেবেন।

‘আচ্ছা।’

‘এক মিনিট শুধু শুধু টেলিফোন ধরে রাখতে বলছি কেন জানেন?’

‘না।’

‘আচ্ছা থাক জানতে হবে না।’

মিসির আলি ঘড়ি ধরে এক মিনিট টেলিফোন রিসিভার কানে রাখলেন, তারপর রিসিভার নামালেন। মিতা স্টোরের মালিক ইদ্রিস উদ্দিন হাসিমুখে বললেন—টেলিফোন শেষ হয়েছে?

‘জি।’

‘আপনার জন্যে চা বানাতে বলেছি। চা খেয়ে যান। চায়ে চিনি খান তো?’

‘জি খাই।’

মিসির আলি বললেন, আপনার যে মেয়েটির বিয়ে হল তার নাম কী?

তার নাম আফরোজা বানু। আমরা লায়লা বলে ডাকি। মেয়ের বিয়েতে আপনাকে বলার খুব শখ ছিল। আপনার ঠিকানা জানি না কার্ড দিতে পারি নি। আপনাকে একদিন বাসায় নিয়ে যাব। মেয়ে এবং মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আপনাদের দোয়ায় ছেলে ভালো পেয়েছি। অতি ভদ্র। কাস্টমসে আছে।

যাব একদিন আপনাদের বাসায়। আপনার মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই দেখে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *