০৮. ম্যারাথন কিস

ম্যারাথন কিস

চুমু প্রসঙ্গে আরেকটি গল্প বলি। গল্পের নায়ক আমার ছাত্র–বেন ওয়ালি। টিচিং অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে আমি এদের প্রবলেম ক্লাস নেই। সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা থার্মোডিনারিক্সের অংক করাই এবং ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দেই।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আন্ডার-গ্রাজুয়েটে যে সব আমেরিকান পড়তে আসে, তাদের প্রায় সবাই গাধা টাইপের। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে হা করে তাকিয়ে থাকে। প্রবল বেগে মাথা চুলকায়। অংক করতে দিলে শুকনো গলায় বলে, আমার ক্যালকুলেটরে ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে।

আন্ডার-গ্রাজুয়েট পড়াশোনা এদের তেমন জরুরি নয়। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য হাইস্কুলের শিক্ষাই যথেষ্ট। এদের কাছে ইউনিভার্সিটির ফুটবল টিম, বেসবল টিম পড়াশোনার চেয়ে অনেক জরুরি। মেয়েদের লক্ষ থাকে ভালো একজন স্বামী জোগাড় করার দিকে। এই কাজটি তাদের নিজেদেরই করতে হয় এবং এর জন্যে যে পরিমাণ কস্ট এক একজন করে তা দেখলে চোখে পানি এসে যায়।

আমার সঙ্গে রুখ কোয়ান্ডাল বলে এক আমেরিকান ছাত্রী পি-এইচ-ডি করত। এই মেয়েটি কোনো স্বামী জোগাড় করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও যে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই। মেয়েটি মৈনাক পর্বতের মত। সে আমকে দুঃখ করে বলেছিল, আমার যখন সতেরো-আঠারো বছর বয়স ছিল তখন আমি এত মোটা ছিলাম না। চেহারাও ভালোই ছিল। তখন থেকে চেষ্টা করছি একজন ভালো ছেলে জোগাড় করতে পারিনি। কত জনের সঙ্গে যে মিশেছি। ওদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার জন্যে কত কিছু করতে হয়েছে। আগেকার অবস্থা তো নেই, এখন ছেলেরা ডেটিং-এর প্রথম রাতেই বিছানায় নিয়ে যেতে চায়। না করি না। না করলে যদি বিরক্ত হয়। আমাকে ছেড়ে অন্য কোনো মেয়ের কাছে চলে যায়। এত কিছু করেও ছেলে জুটাতে পারলাম না।

কেন পারলে না।

পারলাম না, কারণ আমি অতিরিক্ত স্মার্ট। সারা জীবন ‘A’ পেয়ে এসেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রীদের একজন। ছেলেরা এ রকম স্মার্ট মেয়ে পছন্দ করে না। তারা চায় পুতুপুতু ধরনে ভ্যাদা টাইপের মেয়ে। তুমি বিদেশী, আমাদের জটিল সমস্যা বুঝতে পারবে না।

আমি আসলেই বুঝতে পারি না। আমার মনে হয় এদের কোথায় যেন কী একটা হয়েছে। সবার মাথার ব্লু-র একটা পা কেটে গেছে। উদাহরণ দেই। এটি আমার নিজের চোখে দেখা।

পুরোদমে ক্লাস হচ্ছে। দেখা গেল ক্লাস থেকে দুটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বের হয়ে গেল। সবার চোখের সামনে এর সমস্ত কাপড় খুলে ফেলল! এই ভাবেই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা চক্কর দিয়ে ফেলল। এর নাম হচ্ছে স্ট্রিকিং। এরকম করল কেন? এরকম করল কারণ এরা পৃথিবী জুড়ে যে আণবিক বোমা তৈরি হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল।

এদের এইসব পাগলামি সাধারণত ফাইন্যাল পরীক্ষার আগে আগে দেখা দেয়। আমার ছাত্র বেন ওয়ালির মাথাতে এ রকম পাগলামি ভর করল। স্প্রিংকোয়ার্টারের শেষে ফাইন্যালের ঠিক আগে আগে আমাকে এসে বলল সে

একটা বিশেষ কারণে টার্ম ফাইন্যাল পেপারটা জমা দিতে পারছে না।

আমি বললাম, বিশেষ কারণটা কি?

চুমুর দীর্ঘতম রেকর্ডটা ভাঙতে চাই। গিনিস বুকে নামটা যেন ওঠে।

আমি বেনের মুখে দিকে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি এই ছেলে?

আমি বললাম, টার্ম ফাইনালের পরে চেষ্টা করলে কেমন হয়? তখন নিশ্চিন্তু মনে চালিয়ে যেতে পারবে। টার্ম ফাইন্যাল পেপার জমা না দিলে তো এই কোর্সটায় কোনো নম্বর পাবে না।

বেন বিরস মুখে চলে গেল। দু’দিন পর পেপার জমা দিয়ে দিল। আমি ভাবলাম মাথা থেকে ভূত নেমে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। যন্ত্রণা বাড়িয়ে লাভ নেই।

ভূত কিন্তু নামল না। আমেরিকানদের ঘাড়ের ভূত খুব সহজে নামে না। ভূতগুলিও আমেরিকানদের মতোই পাগলা। কাজেই এক বৃহস্পতিবার রাতে অর্থাৎ উইক-এন্ড শুরু হবার আগে আগে বেন রেকর্ড ভাঙার জন্য নেমে পড়ল। সঙ্গে স্বাস্থ্যবর্তী এক তরুণী–যার পোশাক খুবই উগ্র ধরনের। এই পোশাক না থাকলেই বরং উগ্ৰাতটা কম মনে হত।

চুমুর ব্যাপারটা হচ্ছে মেমোরিয়াল ইউনিয়নের তিন তলায়। যথারীতি পোস্টার পড়েছে ম্যারাথন চুমু। দীর্ঘতম চুম্বনের বিশ্ব রেকর্ড স্থাপিত হতে যাচ্ছে.. ইত্যাদি ইত্যাদি।

দেখলাম ব্যাপারটায় আয়োজনও প্রচুর। দুজন আছে রেকর্ড-কিপার, স্টপ ওয়াচ হাতে সময়ের হিসাব রাখছে। একজন আছেন নোটারি পাবলিক। যিনি সার্টিফিকেট দেবেন যে, দীর্ঘতম চুম্বনে কোনো কারচুপি হয়নি। এই নোটারি পাবলিক সারাক্ষণই থাকবেন কিনা বুঝতে পারলাম না। এদের মতো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এরকম একটা ফালতু জিনিস নিয়ে কী করে সময় নষ্ট করে বুঝতে পারলাম না।

বেন এবং মেয়েটিকে নাইলনের দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কেউ সে বেষ্টনীর ভেতর যেতে পারছে না। বাজনা বাজছে। সবই নাচের বাজনা ওয়াল্টজ। বাজনার তালে তালে এরা দুজন নাচছে।

আমি মিনিট দশেক এই দৃশ্য দেখে চলে এলাম। এই জাতীয় পাগলামির কোনো মানে হয়?

পরদিন ভোরে আবার গেলাম। ম্যারাথন চুমু তখনো চলছে। তবে পাত্র-পাত্রী দুজন এখন সোফায় শুয়ে আছে। ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো। বাজনা বাজছে। সেই বাজনার তালে তালে সমবেত দর্শকদের অনেকেই সঙ্গী অথবা সঙ্গিনী নিয়ে খানিকক্ষণ নাচছে। রীতিমতো উৎসব।

আমি আমার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে বললাম, ক্ষিধে পেলে ওরা করবে কী? ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে খাওয়া-দাওয়া তো করা যাবে না।

তরল খাবার খাবে স্ট্র দিয়ে। কিছুক্ষণ আগেই স্যুপ খেয়েছে।

আমি ইতস্তত করে বললাম বাথরুমে যাবার প্রয়োজন যখন হয় তখন কী করবে?

জানি না। বাথরুমের জন্যে কিছু সময় বোধ হয় অফ পাওয়া যায়। কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। ওদের জিজ্ঞেস কর।

আমার আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করল না। ততক্ষণে ফ্লোরে উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়ে গেছে। এক জোড়া বুড়োবুড়ি উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে। ভয়াবহ লাফ-ঝাপ। তালে তালে হাত তালি পড়ছে। জমজমাট অবস্থা।

জানতে পারলাম এই বুড়োবুড়ি হচ্ছে বেন ওয়ালির বাবা এবং মা। তারা সুদূর মিনেসোটা থেকে ছুটে এসেছেন ছেলেকে উৎসাহ দেবার জন্যে। ছেলের গর্বে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল।

বেন ওয়ালি দীর্ঘতম চুম্বনের বিশ্বরেকর্ড ভাঙতে পারেনি। তবে সে খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *