০৮. আমেরিকান মহিলা মনস্তত্ত্ববিদ

আমেরিকান মহিলা মনস্তত্ত্ববিদ বাবাকে কী বলেছিলেন আমি জানি না। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করি নি। তবে অনুমান করতে পারি যে তিনি বাবাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। বাবা দেশে ফিরেই সেই উপদেশমতো চলতে শুরু করলেন। প্রথমেই আমার শোবার ঘর বদলে দিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন শোবার ঘর বদলানোর ব্যাপারে আমি খুব আপত্তি করব। নানান ভণিতা করে তিনি বললেন—মা তোমার এই ঘরটা খুব ছোট। তুমি বড় হয়েছ তোমার আরো বড় ঘর দরকার। তা ছাড়া আমি ভাবছি তোমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেব…কম্পিউটার টেবিল সেট করার জন্যেও জায়গা লাগবে……….

আমি তাঁকে কথা শেষ করতে দিলাম না, তার আগেই বললাম—বাবা আমাকে তুমি একটা বড় ঘর দাও। এই ঘরটা আসলেই ছোট।

তাঁর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, নতুন ঘরে যখন যাচ্ছ তখন এক কাজ করা যাক। নতুন ঘরের জন্যে আলাদা করে ফার্নিচার কেনা যাক।

আমি বললাম, আচ্ছা।

বাবা বললেন, আমার পাশের ঘরটা তুমি নিয়ে নাও। বাবা-মেয়ে পাশাপাশি থাকব, কী বল? ভালো হবে না?

‘খুব ভালো হবে বাবা।’

আমার ঘর বদল হল। নতুন ফার্নিচার এল। যা ভেবেছিলাম তাই হল, পুরোনো খাট বদলে কেনা হল আধুনিক বক্স খাট। যার নিচে বসার উপায় নেই। সাইকিয়াট্রিস্ট নিশ্চয়ই বাবাকে এই বুদ্ধি দিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি— আমার আগের শোবার ঘরের কোনো ফার্নিচার নেই। সব ফার্নিচার কোথায় যেন পাচার করা হয়ে গেছে। বাবার পাশের ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। নতুন ফার্নিচার। একটা টেবিলে ঝকঝকে কম্পিউটার।

কম্পিউটার কিনে দেবার কথাও হয়তো সাইকিয়াট্রিস্ট বাবাকে বলে দিয়েছিলেন। কম্পিউটারে নানা ধরনের খেলা নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকব। খাটের নিচে কে বসে আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাব না।

নতুন ঘরে থাকতে এলাম। বাবা আমার ঘরের দরজায় লাল ফিতা দিয়ে রেখেছেন। ফিতা কেটে ঢুকতে হবে। গৃহ-প্রবেশের মতো ঘর-প্রবেশ অনুষ্ঠান।

বাবা বললেন, এসএসসিতে তুমি খুব ভালো রেজাল্ট করেছ বলে এই কম্পিউটার।

আমি বললাম, থ্যাংক য়্যু।

‘নতুন যুগের কম্পিউটার—খুব পাওয়ারফুল। টু গিগা বাইট মেমোরি। এই কম্পিউটার দিয়ে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে।’

‘অনেক কিছু মানে কী?

‘কম্পিউটার গ্রাফিকস করা যাবে। এনিমেশন করা যাবে। ইচ্ছে করলে ডিজনীর মতো— ‘লিটল মারমেইড’ জাতীয় কার্টুন ছবিও বানিয়ে ফেলতে পার। তোমার যা বুদ্ধি, ভালো কম্পিউটার পেলে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে।

‘আমার যে খুব বুদ্ধি তা তুমি বুঝলে কী করে?’

‘তোমার রেজাল্ট দেখে বুঝেছি। আমি তো কল্পনাও করি নি তুমি এত ভালো রেজান্ট করবে।’

মিসির আলি সাহেব, প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা নিয়েও আমি খুব ভালো রেজাল্ট করি। কেমন ভালো জানেন? সব পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়। আমার প্রিয় লেখক কে, প্ৰিয় গায়ক কে, প্রিয় খেলোয়াড় কে এইসবও ছাপা হয়।

ওই প্রসঙ্গ থাক। কম্পিউটার প্রসঙ্গে চলে আসি। বাবা শুধু যে আমাকে কম্পিউটার কিনে দিলেন তাই না—আমাকে সবকিছু শেখানোর জন্যে একজন ইন্সট্রাকটার রেখে দিলেন। ইন্সট্রাকটারের নাম—হাসিবুর রহমান। লোকটা লম্বা, রোগা। ইটে চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো চেহারা। বয়স এই ধরুন পঁচিশ-ছাব্বিশ। দেখতে ভালো। মেয়েদের মতো টানা টানা চোখ। একটা ভুল কথা বলে ফেললাম। সব মেয়েদের তো আর টানা টানা চোখ থাকে না।

কম্পিউটারের সব বিষয়ে হাসিবুর রহমানের জ্ঞান অসাধারণ। কিন্তু লোকটি হতদরিদ্র তার থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই। রাতে সে ঘুমায় একটা কম্পিউটারের দোকানে। তাকে অতি সামান্য কিছু টাকা সেই দোকান থেকে দেয়া হয়—এতে তার দুবেলা খাওয়াও বোধহয় হয় না, তবে এতেই সে খুশি। এত অল্পতে কাউকে খুশি হতেও আমি দেখি নি।

বাবা আমাদের বাড়িতে তাকে থাকতে দিলেন। আমাদের গ্যারেজে তিনটা কামরা আছে। একটা দারোয়ানের, একটা ড্রাইভারের। একটা কামরা খালি। সেই খালি কামরাটায় তাকে থাকতে দেয়া হল। সে মহা খুশি। সারা দিন ঘষামাজা করে ঘর সাজাল। আমার কাছে এসে ক্যালেন্ডার চাইল—দেয়ালে সাজাবে।

তার পড়াশোনা সামান্য। এসএসসি সেকেন্ড ডিভিশন। টাকাপয়সার অভাবে এসএসসি-র বেশি সে পড়তে পারে নি। কম্পিউটারের দোকানে কাজ নিয়েছে। নিজের আগ্রহে কম্পিউটার শিখেছে।

ভদ্রলোককে আমার কয়েকটি কারণে পছন্দ হল। প্রথম কারণ তিনি আমাকে অত্যন্ত সম্মান করেন। আমাকে দেখামাত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। দ্বিতীয় কারণ আমার প্রতিটি কথা তিনি বিশ্বাস করেন।

যেহেতু তিনি আমাকে কম্পিউটার শেখাতে এসেছেন প্রথম দিনই আমি তাঁকে স্যার ডাকলাম। তিনি খুবই লজ্জা পেয়ে বললেন, ম্যাডাম আপনি আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমার খুবই লজ্জা লাগছে।

‘আপনাকে তা হলে কী ডাকব?’

‘নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম হাসিব।’

‘আপনাকে হাসিব ডাকব?’

‘জি।’

‘আচ্ছা বেশ তাই ডাকব।’

আমি সহজ ভাবেই তাকে হাসিব ডাকা শুরু করলাম। ভদ্রলোক আমার কম্পিউটারের টিচার হলেও তার সঙ্গে আমার কথাবার্তার ধরন ছিল মুনিব-কন্যা এবং কর্মচারীর মতো। আমার তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। ওনারও হচ্ছিল না। স্যার ডাকলেই হয়তো অনেক বেশি অসুবিধা হত।

কম্পিউটারের নানান বিষয় আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শিখতে লাগলাম। উনিও খুব আগ্রহ নিয়ে শেখাতে লাগলেন। বুদ্ধিমতী আগ্রহী ছাত্রীকে শেখানোর মধ্যেও আনন্দ আছে। সেই আনন্দ তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠত। রাত জেগে জেগে তাঁর সঙ্গে আমি 3D STUDIO এবং MICRO MEDIA DIRECTOR এই দুটি প্রোগ্রাম শিখছি। একটা সফটওয়্যার তৈরি করছি। যে সফটওয়্যারে কম্পিউটারের পর্দায় শরিফা এসে উপস্থিত হবে। তাকে প্রশ্ন করলে সে প্রশ্নের জবাব দেবে। সহজ প্রশ্ন কিন্তু অদ্ভুত জবাব। যেমন,

প্রশ্ন : আপনার নাম?

উত্তর : আমার কোনো নাম নেই, আমি হচ্ছি ছায়াময়ী। ছায়াদের কি নাম থাকে? প্রশ্ন : আপনার পরিচয় কী?

উত্তর : আমার কোনো পরিচয়ও নেই। পরিচয় মানেই তো ব্যাখ্যা ও বর্ণনা। আমাকে ব্যাখ্যা ও বর্ণনায় ধরা যাবে না।

পর্দায় প্রশ্নের উত্তরগুলি লেখা হবে না। পর্দায় ভাসবে শরিফার বিচিত্র সব ছবি এবং উত্তরগুলি ধাতবকণ্ঠে শোনা যাবে।

হাসিব একদিন জিজ্ঞেস করলেন (খুব ভয়ে ভয়ে। আমাকে যে কোনো প্রশ্নই খুব ভয়ে ভয়ে করেন। ভাবটা এরকম যেন প্রশ্ন শুনলেই আমি রেগে যাব)—

‘শরিফা কে?’

আমি বললাম ‘শরিফা একটি মৃতা মেয়ে।’

‘ও আচ্ছা।’

‘আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন?’

‘জি করি। করব না কেন?’

‘ভূত দেখেছেন কখনো?’

‘জি না।’

‘আপনি যদি শরিফাকে দেখতে চান আমি তাকে দেখাতে পারি। ওর সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় আছে। আমি বললেই সে আসবে।’

‘জি না দেখতে চাই না। আমি খুব ভীতু।’

‘আমি ডাকলেই শরিফা চলে আসবে আপনি এটা বিশ্বাস করলেন?’

‘বিশ্বাস করব না কেন? আপনি তো আর শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি সেই ধরনের মেয়ে না।’

‘আমি কোন ধরনের মেয়ে?’

‘খুব ভালো মেয়ে।’

‘আপনি কম্পিউটারের মতো আধুনিক জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, আবার ভূতও বিশ্বাস করেন?’

‘জি ভূত বিশ্বাস করি, জিনও বিশ্বাস করি। কুরআন শরিফে জিনের কথা আছে। একটা সুরা আছে—সুরার নাম হল—সুরায়ে জিন।’

‘তাই বুঝি?’

‘জি।’

‘আপনি আমাকে একটা ভূতের গল্প বলুন তো।’

‘ম্যাডাম আমি ভূতের গল্প জানি না।

‘কিছু না কিছু নিশ্চয়ই জানেন মনে করে দেখুন। ছোটবেলায় ভয় পেয়েছিলেন এমন কিছু।’

‘খুব ছোটবেলায় একবার শ্মশান-কোকিলের ডাক শুনেছিলাম।’

‘কিসের ডাক শুনেছিলেন?’

‘শ্মশান-কোকিল। ভয়ঙ্কর ডাক। কেউ যদি শ্মশান-কোকিলের ডাক শোনে তার নিকটাত্মীয় মারা যায়।’

‘আপনার কি কেউ মারা গিয়েছিল?’

‘আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন।’

‘মৃত্যুর পর তাঁকে কখনো দেখেছেন?’

‘প্রায়ই স্বপ্নে দেখি।’

‘স্বপ্নের কথা বলছি না। জাগ্রত অবস্থায় তাঁকে কখনো দেখেছেন?’

‘জি না।’

‘শ্মশান-কোকিল পাখিটা দেখতে কেমন?’

‘দেখতে কেমন জানি না ম্যাডাম। শ্মশানের আশপাশে থাকে। কেউ দেখে না।’

‘আপনাদের গ্রামে শ্মশান আছে?’

‘জি আছে। মহাশ্মশান। খুব বড়।’

‘আমার শ্মশান দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি আমাকে আপনাদের গ্রামে নিয়ে যাবেন।’

উনি হতভম্ব গলায় বললেন, ‘থাকবেন কোথায়?’

‘কেন আপনাদের গ্রামের বাড়িতে।

‘অসম্ভব কথা বলছেন ম্যাডাম। আমরা খুবই গরিব। খড়ের চালা ঘর। মাটির দেয়াল।’

হাসিব খুবই নার্ভাস হয়ে গেলেন। তার ভাবটা এরকম যেন এখনই তাকে নিয়ে আমি তাদের গ্রামের বাড়িতে রওনা হচ্ছি। মানুষের সারল্য যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা তাকে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। তবে হাসিব বোকা ছিলেন না। আমাদের ধারণা সরল মানুষ মানেই বোকা মানুষ এই ধারণা সত্যি নয়।

.

মিসির আলি সাহেব আপনার কি ধারণা আমি এই মানুষটার প্রেমে পড়েছি?

আমার মনে হয় না। মানুষটাকে আমি করুণা করতাম। প্রেম এবং করুণা এক ব্যাপার নয়। প্রেম সর্বগ্রাসী ব্যাপার। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে অগ্নি। আগুন যেমন সব পুড়িয়ে দেয় প্রেমও সব ছারখার করে দেয়। হাসিব নামের মানুষটির প্রতি প্রবল করুণা ছাড়া আমি কিছু বোধ করি নি।

তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলতে ভালো লাগত—এই পর্যন্তই। আমি নিঃসঙ্গ একটা মেয়ে, কারো সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হওয়াটাকে আপনি নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক বলবেন না। ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক খেলনা ছিল। খেলনা নিয়ে খেলতে ভালো লাগত। হাসিবের সঙ্গে আমার ব্যাপারটাও সেরকম। সে ছিল আমার কাছে মজার একটা খেলনার মতো।

তাঁকে আমি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গল্প বলে ভয় দেখাতাম। শরিফার গল্প। আমার ছোট মা’র গল্প। মানুষটা ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যেত। দেখে আমার এমন মজা লাগত!

আমি তখন একটা অন্যায় করলাম। খুব বড় ধরনের অন্যায়। একটা নির্দোষ খেলাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবার অন্যায়। আমি তাঁকে ভয় দেখালাম। কীভাবে ভয় দেখালাম জানেন? শরিফা সেজে ভয় দেখালাম।

তিনি সে রাতে আমাকে কম্পিউটার শেখানো শেষ করে তাঁর ঘরে ঘুমাতে যাবেন, আমি বললাম, আপনি কি ভাত খেয়েছেন?

তিনি বললেন, জি না। ভাত রাঁধব তারপর খাব।

আমি বললাম, এত রাতে ভাত রেঁধে খেতে হবে না। আমি বুয়াকে বলে দিচ্ছি আপনাকে খাইয়ে দেবে। একেবারে খাওয়াদাওয়া করে তারপর ঘুমাতে যান।

তিনি সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়লেন।

হাসিব যখন ভাত খাচ্ছিলেন তখন আমি গ্যারেজে তাঁর ঘরে উপস্থিত হলাম। কেউ আমাকে দেখল না। দারোয়ান দুজনই ছিল গেটে। ড্রাইভার বাইরে। আমি কয়েক সেকেন্ড ভাবলাম তারপর হুট করে তাঁর ঘরে ঢুকে গেলাম। ঠিক করে রাখলাম অনেক রাত পর্যন্ত খাটের নিচে বসে থাকব। তিনি খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকবেন। দরজা লাগাবেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়বেন। তখন হাসির শব্দ করে তাঁর ঘুম ভাঙাব। ঘুম ভাঙতেই তিনি শব্দ শুনে খাটের নিচে তাকাবেন—আধো আলো আধো অন্ধকারে এলোমেলো চুলে শরিফা বসে আছে…সম্পূর্ণ নগ্ন এক ভয়ঙ্কর তরুণী। তাঁর কাছে কী ভয়ঙ্করই না লাগবে! ভাবতেও আনন্দ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *