০৭. ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দা

২১২ বি ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দার মতো আছে। সেখানে কবীর সাহেব চাপাচাপি করে দুটা লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার এবং টেবিল ঢুকিয়েছেন।

মিসির আলি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বাইনোকুলারে কাক-দম্পতিকে আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। মিসির আলির ধারণা কাক-দম্পতিও বিষয়টা টের পেয়েছে। মনুষ্য সম্প্রদায়ের কেউ-একজন তাদের প্রতি লক্ষ রাখছে, এটা তারা জানে। বিষয়টাতে কাক-দম্পতি মনে হয় খানিকটা চিন্তিত।

দুপুর বারোটার মতো বাজে। জসু কিছুক্ষণ আগে প্লেটে করে শিঙাড়া দিয়ে গেছে। গরম শিঙাড়া, ভাপ উঠছে, কিন্তু কেন জানি মিসির আলির খেতে ইচ্ছা করছে না। এটাও বয়স হওয়ার লক্ষণ। ক্ষিধে হবে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করবে না।

মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, বিদেশিনী এক তরুণী হোটেলের বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটির পরনে ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। মাথায় স্কার্ফ। চোখে রোদ চশমা। মেয়েটি এগিয়ে আসছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলি বাইনোকুলার নামিয়ে তরুণীর দিকে তাকালেন। তরুণী বলল, চাচাজি, কেমন আছেন? আমার নাম পারুল। চম্পার বড় বোন পারুল। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছি। আমি কি আপনার সামনের চেয়ারটায় বসতে পারি?

চম্পা-পারুলদের কেউ হোটেল খুঁজে বের করে চলে আসবে, এটা মিসির আলি ভাবেন নি। পারুল মেয়েটা যে এত রূপবতী তাও ভাবেন নি। বিস্ময় চাপা দিয়ে মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, বসতে পারো। বোরকা নেই, ব্যাপার কী?

আমি তো কখনো বোরকা পরি না। আমার ছোটবোন পরে।

তোমার ছোটবোন কি তোমার মতোই রূপবতী?

জি। আমরা যমজ বোন। তবে আমার চোখ নীল, ওর চোখ কালো।

পারুল বসতে বসতে বলল, চাচাজি, আমি দূর থেকে দেখেছি আপনি বাইনোকুলার চোখে দিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী দেখছিলেন?

কাক দেখছিলাম।

কাক?

হ্যাঁ কাক। কেন কাক দেখছিলাম, এইসব জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করবে না। আমার কাছে কী জন্য এসেছ সেটা বলো।

আপনাকে আপনার আগের বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার পা ধরে বসে থাকব।

মিসির আলি কিছু বোঝার আগেই পারুল চেয়ার থেকে মেঝেতে নেমে এসে দু’হাতে পা চেপে ধরল।

মিসির আলি বললেন, পা ধরা অতি গ্রাম্য ব্যাপার। পা ছাড়ো।

পারুল বলল, গ্রাম্য ব্যাপার হোক বা আধুনিক ব্যাপার হোক, আমি আপনার পা ছাড়ব না।

আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছ কেন?

আমরা দুই বোন মহাবিপদে পড়েছি। আপনি আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। কীরকম বিপদ শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।

কীরকম বিপদ বলো?

আমাদের মৃত শ্বশুর ফিরে এসেছেন। বাসায় ঘোরাফিরা করছেন। খাওয়াদাওয়া করছেন। আপনার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। আপনি কোথায় গেছেন জানতে চাইলেন।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমি এই মুহূর্তে যদি তোমার সঙ্গে যাই তাঁকে দেখতে পাব?

হ্যাঁ দেখতে পাবেন।

একজন মৃত মানুষ জীবিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

জি।

মিসির আলি হাতের বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, হল যাই।

.

দুর্বল মানুষের সমস্যা হচ্ছে, তারা নানান ধরনের ডিলিউশনে ভুগে। এই রোগ আবার সংক্রামক। একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে যায়। মাস হিস্টিরিয়াও আছে। মানবগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ডিলিউশনের শিকার হওয়ার ঘটনাও আছে। ইউরোপের ডাইনি অনুসন্ধান ছিল বড় ধরনের ডিলিউশন।

মিসির আলি নিশ্চিত, মল্লিক সাহেবের পরিবার দুই পুত্রবধূ ডিলিউশনে ভুগছে। তারা মৃত মল্লিককে ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখছে। মৃত মানুষকে জীবিত দেখা সাধারণ পর্যায়ের ডিলিউশন। অনেক পিতা-মাতাই তাদের মৃত সন্তানদের জীবিত দেখেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। এই বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছেন Christopher Bird। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম The Secret Life of Dead People। উপন্যাসের চেয়েও সুখপাঠ্য বই।

পারুল মিসির আলিকে তাদের মূল বাড়িতে নিয়ে এল। দোতলার একটা ঘরে ঢুকিয়ে বলল, চাচাজি, আপনি এই ঘরে অপেক্ষা করুন। আমি এখান থেকে আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব। অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখাব। আপনি কি চা-কফি কিছু খাবেন?

না।

আপনি খবরের কাগজ পড়ুন। আমি আসছি।

চারদিনের বাসি খবরের কাগজ টেবিলে পড়ে আছে। খাবার বাসি হলে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ায়, বাসি খবরের কাগজও একই রকম দুর্গন্ধ ছড়ায়।

পারুল পাঁচ দশ মিনিটের কথা বলে গিয়েছিল। চল্লিশ মিনিট পার হওয়ার পর মিসির আলির হঠাৎ করেই সন্দেহ হল—পারুল নামের মেয়েটা তাকে এই ঘরে আটকে ফেলেছে। ঘরের দরজা তালা দেওয়া। তিনি চেষ্টা করলেও সেই তালা খুলতে পারবেন না।

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে গেলেন, দরজা খুলতে পারলেন না। দরজা সত্যি সত্যি তালা দেওয়া। মিসির আলি দরজা ধাক্কাধাক্কি কিংবা ‘পারুল পারুল’ বলে ডাকাডাকির ভেতর দিয়ে গেলেন না। ঘরের ভেতরটা ভালোমতো দেখতে শুরু করলেন।

গেস্ট রুম বা অতিথি কক্ষের মতো ঘর। সিঙ্গেল খাট পাতা আছে। খাটে বালিশ এবং চাদর পরিষ্কার। এই ঘরে কেউ ঘুমায় না।

আসবাবপত্রের মধ্যে একটা আলনা আছে, জানালার কাছে লেখালেখির জন্য চেয়ার- টেবিল আছে। টেবিলে পুরোনো রিডার্স ডাইজেস্টের দু’টা কপি এবং নেয়ামুল কোরান গ্রন্থ আছে। যে জানালার পাশে টেবিল-চেয়ার আছে, সেই জানালা বাইরে থেকে বন্ধ।

ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম আছে। বাথরুম অনেকদিন ব্যবহার হয় না। বাথরুমের র‍্যাকে সাবান-শ্যাম্পু আছে। ধোয়া টাওয়েল আছে। কমোডের ওপর ফ্লাশ—বেসিনে তিন মাস আগের একটা টাইম পত্রিকা দেখে মিসির আলি অবাক হলেন। মল্লিক সাহেবের বাড়ির কারোরই টাইম পত্রিকা পড়ার কথা না।

ঘরে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। বেশিরভাগ গেস্টরুমের দেয়াল ঘড়ি ব্যাটারি শেষ হওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে থাকে। অতিথি এলেই নতুন ব্যাটারি লাগানো হয়। এই ঘড়ির কাঁটা সচল আছে। এখন বাজছে একটা পঁচিশ। মিসির আলির ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। টেনশনে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।

দেয়াল ঘড়ি ছাড়াও গাঢ় লাল রঙের একটা টেলিফোন সেট আছে। মিসির আলি রিসিভার কানে দিলেন। পাতালের নৈঃশব্দ্য। লাইন কাটা। এটা যুক্তিযুক্ত। বন্দিশালায় টেলিফোন থাকবে না।

মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। আবহাওয়া আরামদায়ক শীতল। ক্ষুধার্ত মানুষেরা সহজে ঘুমুতে পারে না, কিন্তু মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর ঘুম ভাঙল তিনটা দশে। প্রায় দু’ঘণ্টার আরামদায়ক ঘুম।

মিসির আলি মূল দরজা এবং টেবিলের সামনের জানালা পরীক্ষা করলেন। দু’টা এখনো বন্ধ। তিনি যথেষ্টই ক্ষুধার্ত বোধ করছেন। তাঁকে খাবার দেওয়া হবে কি না বুঝতে পারছেন না। তাঁকে আটকে রাখার উদ্দেশ্যও পরিষ্কার হচ্ছে না। পারুল মেয়েটা তার কাছে কী চাচ্ছে? মানুষের ধর্ম হল, যাকে সে ভয় পাবে তাকে আটকে ফেলার চেষ্টা করবে। পারুল মেয়েটা কি তাকে ভয় পাচ্ছে? কিসের ভয়? তার কোনো গোপন কথা জেনে ফেলার ভয়।

গোপন কথা দূরে থাকুক, পারুল ও তার বোন চম্পা সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্য কোনো কথাও জানেন না। তিনি শুধু জানেন, এই বাড়ির ওপর এক ধরনের অসুস্থতা ভর করে আছে।

.

রাত এগারটা বাজে। মিসির আলিকে এখন পর্যন্ত কোনো খাবার দেওয়া হয় নি। তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগের চেষ্টাও কেউ করে নি।

তিনি কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি করেছেন। ‘পারুল পারুল’ বলে ডেকেছেন। কেউ সাড়া দেয় নি।

মিসির আলির কাছে মনে হচ্ছে, তালাবন্ধ অবস্থায় তিনি ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি নিঃশব্দ, নিশ্চুপ।

মিসির আলি টাইম পত্রিকা, রিডার্স ডাইজেস্ট এবং নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের সবটা পড়ে শেষ করেছেন। নেয়ামুল কোরান পড়তে গিয়ে মিসির আলি বুঝতে পারলেন এই ঘরে আরো একজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। সে নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের অনেক জায়গায় যেসব কথা লিখেছে তা হল-

১. আমাকে কত দিন তালাবন্ধ করে রাখবি?

২. ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি, খাওয়া দে।

৩. আমি তোরে ছাড়ব না। তোরে এইভাবে আটকায়ে রাখব।

৪. হে আল্লাহপাক। হে গাফুরুর রহিম। আমাকে উদ্ধার করো।

যাকে আটকে রাখা হয়েছিল তার নাম পারুল। এই তথ্য বের করতে মিসির আলির তেমন বেগ পেতে হয় নি। বালিশে পারফিউমের গন্ধ পেয়েছেন। এই গন্ধ তাঁর চেনা

প্রাইভেট জেলখানা থেকে মুক্তির একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে। এই বুদ্ধি কতটা কার্যকর হবে তা মিসির আলি এখনো বুঝতে পারছেন না।

মূল দরজাটি কাঠের। এই দরজা কি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া যাবে? পুরোনো দরজা, শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে। কোনোরকমে দরজার এক কোনায় আগুন লাগালে দরজা পুড়ে যাবে।

আগুন লাগানোর জন্য ম্যাচ বাক্স তাঁর কাছে আছে। ম্যাচ বাক্সে এগারটা কাঠি। এগারবার জ্বালানো যাবে। কাগজ আছে। ধৈর্য ধরে দরজার একটা কোনায় আগুন ধরাতে হবে। কাজটা করতে হবে ভোররাতে। যখন সবাই থাকবে ঘুমে। দরজার আগুন বা ধোঁয়ার বিষয়টা কারো চোখে পড়বে না। বাথরুমে তিনি শ্যাম্পুর একটি বোতল দেখেছেন। কিছু কিছু শ্যাম্পু যথেষ্ট দাহ্য। শ্যাম্পুর বোতলটা নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে।

খাটের নিচে তিনি একটা ফিডার পেয়েছেন। প্লাস্টিকের ফিডারে আগুন ধরলে ধিকি ধিকি করে অনেকক্ষণ জ্বলবে। কাঠের দরজার এক কোনায় আগুন ধরে যাওয়ার কথা। দরজায় চাকু দিয়ে দাগ দিতে পারলে হতো। এতে দরজার সারফেস এরিয়া বাড়বে।

রাত তিনটায় মিসির আলি দরজা পোড়ানোর সময় নির্ধারণ করলেন। রাত তিনটা ভালো সময়। তিন প্রাইম নম্বর। পিথাগোরাসের মতে, অতি রহস্যময় সংখ্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *