০৬. সায়রা বানু এবং মিসির আলি

সায়রা বানু এবং মিসির আলি মুখোমুখি বসেছেন। সায়রা বানু তার রকিং চেয়ারে। একটু আগে সে দুলছিল এখন দুলছে না। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। ভ্রূ সামান্য কুঁচকে আছে। তাকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত মনে হচ্ছে। আজ তাকে খানিকটা অসুস্থও মনে হচ্ছে। টেনে-টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এক ফাঁকে সে তার পাশে রাখা ব্যাগ থেকে ইনহেলারের শিশি হাতে নিল। দুবার পাফ নিল। মেয়েটির কি অ্যাজমা আছে? অ্যাজমা একটি সাইকো সমেটিক ব্যাধি। মনের ঝামেলা থেকে এই রোগ হয়। বেশ কষ্টকর ব্যাধি। মিসির আলি লক্ষ করলেন মেয়েটা দুলতে শুরু করেছে। সম্ভবত ইনহেলারে পাফ নেবার পর তার একটু ভালো লাগছে। সায়রা বলল, চাচা আজ যে বিশেষ একটা দিন সে বিষয়ে আপনি জানেন?

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, বিশেষ কী দিন বলো তো?

আপনি জানেন না?

জানি না।

আমার হাতে চায়ের কাপ দেখেও বুঝতে পারছেন না?

না।

আপনার কাজের মেয়ে যে নতুন শাড়ি পরেছে এটা চোখে পড়ে নি?

শাড়ি তো সে মাঝে মাঝে পরে। আজ নতুন শাড়ি পরেছে এটা খেয়াল করি নি।

সায়রা হাসিমুখে বলল, চাচা আজ ঈদ। ঈদ বলেই আপনার এখানে দিনের বেলা উপস্থিত হয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসেছি। রমজান মাসের সকালে নিশ্চয়ই চা খেতাম না। আজ আমি এসেছি আপনাকে সালাম করতে।

মিসির আলি বিব্রত গলায় বললেন, দীর্ঘদিন তেমনভাবে কোনো উৎসব পালন করা হয় না বলে বিষয়টা আমার মাথায় থাকে না।

ছোটবেলায় ঈদ করতেন না?

অবশ্যই করতাম। নতুন জামা, জুতা। ঈদের আগের রাতে নতুন জুতা বালিশের কাছে রেখে ঘুমাতাম। নাকে লাগত চামড়ার গন্ধ। এখনো আমার কাছে ঈদ মানে নাকে চামড়ার গন্ধ।

সায়রা বলল, আমি আপনার জন্য নতুন পাঞ্জাবি এনেছি। নাসরিনকে বলেছি পানি গরম করতে। আপনি গোসল করবেন। নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরবেন। ফিরনি খাবেন। আমি আপনাকে সালাম করে চলে যাব। একা যাব না আপনাকে সঙ্গে করেই যাব। আপনাকে ঈদগায় নামিয়ে দেব।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে ঈদের নামাজ পড়তে হবে?

হ্যাঁ হবে। আমার এই জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে ঈদের দিন জায়নামাজ বগলে নিয়ে বাবা ঈদের নামাজে যাচ্ছেন। আমরা দুই বোন তাড়াহুড়া করে সেমাই ফিরনি এইসব রাঁধছি। আমরা দুই দফা বাবাকে সালাম করতাম। একবার উনি যখন নামাজে যেতেন তখন। আরেকবার উনি যখন নামাজ থেকে ফিরে আসতেন তখন

মিসির আলি বললেন, সালাম কি দুবার করতে হয়?

সায়রা বলল, একবারই করার নিয়ম। দুবার সালামের ব্যাপারটা ইথেন চালু করে। ওর অনেক পাগলামি ছিল। দুইবার সালামের সে নামও দিয়েছিল—যাওয়া সালাম, আসা সালাম। চাচা আপনি এখনো বসে আছেন। যান গোসল করতে যান।

মিসির আলি বললেন, গোসল, নতুন কাপড় পরা, ঈদগায়ে যাওয়া এই অংশগুলি বাদ দিলে কি হয় না?

সায়রা বলল, হয়। কেন হবে না! তবে আমার একটা ধারণা ছিল আপনি আমার কথা শুনবেন। আমি ঠিকমতো আপনাকে বলতে পারি নি। আরো আবেগ দিয়ে যদি অনুরোধটা করতাম তা হলে অবশ্যই আপনি শুনতেন।

মিসির আলি বললেন, তুমি তো যথেষ্ট আবেগ দিয়েই কথাটা বলেছ। এরচেয়ে বেশি আবেগ দিয়ে কীভাবে বলতে?

সায়রা বলল, শৈশবের ঈদের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে যদি টপটপ করে চোখের পানি পড়ত তা হলে আপনি আমার কথায় রাজি হয়ে যেতেন। আপনি কাজ করেন লজিক নিয়ে কিন্তু আপনার মধ্যে আবেগ অনেক বেশি।

কথা বলতে-বলতে সায়রার হঠাৎ গলা ধরে গেল। সে তার মাথা সামান্য নিচু করল। মিসির আলি সায়রার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সায়রার চোখভর্তি পানি টলমল করছে। বোরকার একটা অংশ সে দু চোখের উপর চেপে ধরল। তার শরীর সামান্য কাঁপল। মিসির আলি বললেন, তুমি আরেক কাপ চা খাও। চা খেতে খেতে আমি গোসল সেরে চলে আসব। আমার জন্য কী পাঞ্জাবি এনেছ দাও পরে ফেলি।

সায়রা চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে হেসে ফেলে বলল, আমার যে চোখের পানি আপনি দেখেছেন সেটা আসল না, নকল। চোখের পানি দিয়ে যে আপনার সিদ্ধান্ত পাল্টানো যায় সেটা দেখাবার জন্য কাজটা করেছি। আমি আগেও আপনাকে একবার বলেছি যে আমি দ্রুত চোখের পানি আনতে পারি। বলি নি?

হুঁ বলেছ।

আমি যে একজন এক্সপার্ট অভিনেত্রী এটা বুঝতে পারছেন?

হুঁ।

ইথেন ছিল আমার চেয়েও এক্সপার্ট। সে যে কোনো মানুষের গলা নকল করতে পারত। তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে আপনি খুব মজা পেতেন।

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। গোসল সারবেন ভেবেই উঠে দাঁড়ানো।

সায়রা বলল, আপনাকে গোসল করতে হবে না। নতুন পাঞ্জাবিও পরতে হবে না। আপনার অভ্যস্ত জীবন থেকে আমি আপনাকে সরাব না। তবে ঈদ উপলক্ষে আপনাকে নিয়ে চা অবশ্যই খাব। নাসরিনকে চা দিতে বলি?

বলো।

আমি আজ যাওয়ার সময় নাসরিনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ঈদ উপলক্ষে আমার বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ হইচই করবে। দরিদ্র মানুষের জন্য ঈদের উৎসব অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। চাচা আমি কি ঠিক বলেছি?

বুঝতে পারছি না ঠিক কি না। তবে তোমার লজিক ভালো। তুমি যা বলবে ভেবেচিন্তেই বলবে এটা ধরে নেওয়া যায়।

নাসরিন চা নিয়ে এসেছে। সায়রা মাথা নিচু করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মিসির আলি সিগারেট ধরিয়েছেন। একটা ছোট্ট প্রশ্ন তাঁর মাথায় এসেছে প্রশ্নটা করবেন কি না বুঝতে পারছেন না। আজকের উৎসবের দিন কঠিন প্রশ্নের জন্য হয়তো উপযুক্ত না। প্রশ্নটা দুই বোনের ইবলিশ শয়তান দেখা নিয়ে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এরা ইবলিশকে দেখেছে। অথচ সময় মিলছে না। পুরো লেখাতেই সময়ের গণ্ডগোল থেকেই যাচ্ছে। সায়রা খাতায় লিখছে সে শ্রাবণ মাসের রাতে ইবলিশ শয়তানের দেখা পায় কিংবা স্বপ্নে দেখে। তার কয়েকদিন পরেই ছাদে দুই বোনের চা খাওয়ার বর্ণনা আছে। তখন বাগান বিলাসের রঙিন ঝলমলে পাতার কথা আছে। শ্রাবণ মাসে বাগান বিলাসের রঙিন পাতা থাকবে না। বেলি ফুলের গাছে বেলি ফুল থাকবে। অথচ সায়রা পরিষ্কার লিখল বেলি ফুলের সিজন না। ইবলিশ শয়তানের দেখা যদি তারা পেয়েও থাকে কে আগে পেয়েছে?

সায়রা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান। আপনার চোখে প্রশ্ন প্রশ্ন ভাব আছে। প্রশ্ন করতে চাইলে করতে পারেন।

কিছু জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না।

আপনি আমার লেখা কতটুকু পড়েছেন?

সেকেন্ড চ্যাপ্টার শেষ করেছি।

প্রথম চ্যাপ্টার শেষ করার পরে আপনার মধ্যে অনেক খটকা তৈরি হয়েছিল। সেকেন্ড চ্যাপ্টারে হয় নি?

তেমন বড় কোনো খটকা তৈরি হয় নি। ছোটখাটো কিছু সমস্যা আছে সেগুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ না।

সেকেন্ড চ্যাপ্টার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই পান নি?

মিসির আলি বললেন, একটা পেয়েছি তোমাদের ইবলিশ শয়তান বিরাট মিথ্যাবাদী। সে সত্যির সঙ্গে মিথ্যা মিশাচ্ছে না। মিথ্যার সঙ্গেই মিথ্যা মিশাচ্ছে। তোমার মা মোটেই হিন্দু মহিলা ছিলেন না। তাঁর নাম রহিমা বেগম। তোমার বাবা সংক্ষেপ করে রমা ডাকতেন।

সায়রা শান্ত গলায় বলল, এই তথ্য আমি আমার খাতার কোথাও লিখি নি। আপনি কোথায় পেয়েছেন?

মিসির আলি দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে বললেন, আমার এক ছাত্র বগুড়া আযিযুল হক কলেজে অধ্যাপনা করে। তাকে চিঠি লিখে বিষয়টা জানাতে বলেছিলাম। সে চিঠিতে জানিয়েছে।

সায়রা বলল, আমি কি চিঠিটা পড়তে পারি?

মিসির আলি বললেন, অবশ্যই পার। তিনি চিঠি এনে দিলেন। চিঠিতে লেখা—

শ্রদ্ধেয় স্যার,

আসসালাম। আমি আপনার চিঠি পেয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। আপনি যে আমার নাম মনে রেখেছেন এই আনন্দই আমার রাখার জায়গা নাই। আমার কথাটা আপনি বাড়াবাড়ি হিসাবে নেবেন না। আপনার সকল ছাত্রছাত্রী যে আপনাকে কোন চোখে দেখে তা আপনি ধারণাও করতে পারবেন না।

যাই হোক এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। আপনার চিঠি যেদিন পাই সেদিনই আমি সারিয়াকান্দি রওনা হই। বগুড়া জেলায় তিনটি সারিয়াকান্দি আছে। ভাগ্যগুণে প্রথম গ্রামটিতেই কেমিস্ট্রির টিচার হাবিবুর রহমান সাহেবের স্ত্রীর কবরের সন্ধান পাই। মহিলার নাম রহিমা বেগম। তাঁর পিতা সারিয়াকান্দি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এখন মৃত। মেয়ের কবরের পাশেই তাঁর কবর হয়েছে।

স্যার, এর বাইরেও যদি আপনি কিছু জানতে চান আমাকে জানাবেন। আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।

আপনার শরীরের যত্ন নেবেন। যদি অনুমতি পাই তা হলে ঢাকায় এসে আপনাকে কদমবুসি করে যাব।

ইতি
আপনার স্নেহধন্য
ফজলুল করিম
বগুড়া আযিযুল হক কলেজ, বগুড়া।

সায়রা চিঠি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনার অনুসন্ধানের এই প্যাটার্নটা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। আমি ভেবেছিলম আপনি আমার লেখা পড়ে চিন্তা করতে করতে মূল সমস্যার সমাধানে যাবেন। আপনি যে আবার চিঠিপত্র লিখে অন্যখান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করবেন তা ভাবি নি।

মিসির আলি বললেন, তোমার নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি নেই?

সায়রা বলল, আপত্তি আছে। আপনার যা জানার আমার কাছে জানবেন। I will answer you truthfully. বাইরের কাউকে কিছু জানাতে পারবেন না।

ঠিক আছে।

সায়রা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এখন চলে যাব। আপনি কি আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছু জানতে চান?

মিসির আলি বললেন, তোমাদের বাড়ির ইলেকট্রিসিটি বিলগুলি দেখতে চাই। তুমি যেমন গোছানো মেয়ে আমার ধারণা পুরোনো সব ইলেকট্রিসিটি বিলই তোমাদের কাছে আছে।

আপনার কি সব বিল দরকার?

হ্যাঁ সবই দরকার।

আমি বিল পাঠিয়ে দেব।

সায়রা দ্রুত ঘর থেকে বের হল। নাসরিনকে তার সঙ্গে করে নিয়ে যাবার কথা। সে নিল না। মনে হয় ভুলে গেছে।

সে আরো একটা ব্যাপার ভুলে গেছে—মিসির আলিকে ঈদের সালাম। সে বলেছিল এ বাড়িতে তার আসার উদ্দেশ্য মিসির আলিকে সালাম করা। কোনো কারণে সায়রা অবশ্যই আপসেট। ফজলুল করিমের লেখা চিঠিটা কি কারণ হতে পারে? মিসির আলি ঠিক ধরতে পারছেন না।

.

ঈদের দিনটা নাসরিনের বৃথা গেল না। মিসির আলি তাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলেন। বাচ্চা একটা মেয়ে নতুন শাড়ি পরে ঈদের দিনে ঘরে বসে থাকবে এটা কেমন কথা? তিনি তাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গেলেন। নাসরিন আগে কখনো চিড়িয়াখানায় আসে নি, সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। সে হাতিতে চড়ল। আইসক্রিম খেল চারটা। বানরের খাঁচার সামনে থেকে তাকে নড়ানোই যায় না। মিসির আলি বললেন, মজা পাচ্ছিস নাকিরে মা? নাসরিন বলল, হুঁ।

সন্ধ্যার দিকে তারা যখন ফিরছে বের হবার গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে তখন নাসরিন ফিসফিস করে জানাল সে আরেকবার জলহস্তী দেখতে চায়। মিসির আলি হাসিমুখে তাকে জলহস্তী দেখাতে নিয়ে গেলেন।

রাতে নাসরিনকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন হোটেলের মালিক হারুন বেপারীর বাসায়। হারুন বেপারী আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল। সে চোখ কপালে তুলে বলল, আপনি আসছেন এটা কেমন কথা?

মিসির আলি বললেন, ঈদের দিন বেড়াতে আসব না!

হারুন বেপারী বলল, অবশ্যই আসবেন। আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন এটা যে আমার জন্য কত বড় ভাগ্যের ব্যাপার সেইটা আমি জানি। ঠিকানা পাইলেন কই?

আপনার হোটেলে গিয়েছিলাম সেখানে একটা ছেলের কাছ থেকে যোগাড় করেছি।

হারুন বেপারী খাওয়াদাওয়ার বিপুল আয়োজন করল। শুধু খাওয়াদাওয়া না রাতে তাদের সঙ্গে সেকেন্ড শো সিনেমা দেখতে যেতে হল। গত পাঁচ বছর থেকে নাকি সে প্রতি দুই ঈদের রাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে।

মিসির আলি সিনেমা দেখার অংশ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। ক্ষীণ গলায় বলেছিলেন, ঈদের দিন সিনেমা দেখাটা আপনাদের পরিবারের ব্যাপার সেখানে আমি ঠিক…।

হারুন বেপারী কঠিন গলায় বলল, যে বলে আপনি আমার পরিবারের লোক না তার গালে যদি জুতা দিয়া দুই বাড়ি আমি না দিছি তা হলে আমার নাম হারুন বেপারী না।

ছবি দেখে মিসির আলি যথেষ্টই মজা পেলেন। ছবির নাম ‘জিদ্দি সন্ত্রাসী’। সেখানে একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসীর প্রেম হয় কোটিপতির একমাত্র কন্যা চামেলীর সঙ্গে। খবর জানতে পেরে চামেলীর বাবা শিল্পপতি ওসমান সন্ত্রাসীকে জীবিত অথবা মৃত ধরার জন্য দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। চামেলী একদিন সন্ত্রাসীকে (নাম রাজা) বাবার সামনে উপস্থিত করে বলে—দাও এখন পুরস্কারের দশ লক্ষ টাকা। এই টাকা আমি দরিদ্র জনগণকে দান করব। এদিকে জানা যায় সন্ত্রাসীও আসলে সন্ত্রাসী না। সেও আরেক কোটিপতি এবং হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির একমাত্র সন্তান। তাকে শিশু অবস্থায় চুরি করে নিয়ে যায় এক বেদের দল। সেই বেদের দলের এক ষোড়শী কন্যার সঙ্গে রাজার বিয়ে ঠিকঠাক হয়। বিয়ের রাতে জানা যায় এই বেদেনি কন্যা (তার নামও আবার কাকতালীয়ভাবে চামেলী) আসল মানুষ নয়, সে নাগিন। ইচ্ছামতো সে মানুষের বেশ ধরতে পারে আবার সাপও হয়ে যেতে পারে। নাগরাজের সঙ্গে তার বিরোধ বলেই সে লুকিয়ে বেদেনি কন্যা সেজে মনুষ্য সমাজে বাস করে।

মিসির আলির পুরো সময়টা কাটল কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক এটা চিন্তা করে বের করতে। কোন চামেলী আসলে নাগিন কন্যা এটা নিয়ে তিনি খুবই ঝামেলায় পড়লেন। নাসরিনকে বারবার জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে, এই চামেলী কি আসলে নাগিন নাকি সে আসল মানুষ? বেদে দলের সর্দার এবং নাগরাজ কি একই ব্যক্তি নাকি আলাদা।

শেষ দৃশ্যে নাগরাজ এবং নাগিন কন্যার একই সময়ে মৃত্যু হল। দুজনই সাপ হয়ে একজন আরেকজনকে দংশন করল। ভয়াবহ জটিলতা।

ছবি দেখে ফেরার পথে নাসরিন ঘোষণা করল সে তার সমগ্র জীবনে দুজন সত্যিকার ভালোমানুষ দেখেছে। দুজনকেই সে খালুজান ডাকে।

মিসির আলি বললেন, একজন যে আমি এটা বুঝতে পারছি। আরেকজন কে?

নাসরিন বলল, আরেকজন সায়রা আপামণির বাবা। উনার নাম হাবিবুর রহমান।

মিসির আলি বললেন দু জনের মধ্যে কে বেশি ভালো? ফার্স্ট কে সেকেন্ড কে?

নাসরিন গাঢ় গলায় বলল, উনি ফার্স্ট।

.

মিসির আলি বাসায় ফিরলেন রাত বারোটায়।

তাঁর বাসার কাছে গলির মোড়ে সায়রার বিশাল পাজেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ড্রাইভার বিরক্ত গলায় বলল, আপনি কই ছিলেন? রাত নটার সময় এসেছি এখন বাজে বারোটা।

বড়লোকদের ড্রাইভারের মেজাজ থাকে এমনিতেই চড়া। ঈদের দিনে সেই চড়াভাব হয় তুঙ্গস্পর্শী। মিসির আলি বললেন, কোনো সমস্যা?

ড্রাইভার বলল, সমস্যাটমস্যা জানি না। আপনের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। নিয়ে যান।

ড্রাইভার বিশাল সাইজের দুটা টিফিন কেরিয়ার বের করল।

মিসির আলি বললেন, আমরা খাওয়াদাওয়া করে ফেলেছি। খাবার দিতে হবে না।

ড্রাইভার বলল, খাবার প্রয়োজন হলে নর্দমায় ফেলে দেন আমি এইগুলা নিয়ে ফিরত যাব না। আপনার জন্য ম্যাডাম একটা চিঠিও পাঠিয়েছেন।

মিসির আলি চিঠি এবং খাবার নিয়ে বাসায় ফিরলেন। চিঠিতে সায়রা লিখেছে (বাংলায় লেখা চিঠি)।

চাচা,

এই চিঠি ক্ষমাপ্রার্থনা মূলক। আমি আজ ঈদের দিনে আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। ঈদের সালাম করতে গিয়ে হঠাৎ রাগ দেখিয়ে চলে এসেছি। সালামও করা হয় নি।

আমার রাগের কারণটা অবশ্যই আপনার কাছে পরিষ্কার। আমি চাচ্ছিলাম না আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়ের কোনো একটি বাইরের কেউ জানুক। আমার রাগ করাটা ঠিক হয় নি কারণ আপনাকে আমি একটি সমস্যা সমাধানের জন্য কমিশন করেছি। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি যা যা করার সব করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া আমি তো আগেভাগে আপনাকে বলি নি যে আপনি বাইরের কাউকে যুক্ত করতে পারবেন না।

চাচা আপনি যাকে ইচ্ছা যা কিছু ইচ্ছা জিজ্ঞেস করতে পারেন। আপনাকে ফ্রি পাস দেওয়া হল।

আপনার জন্য কিছু খাবার পাঠালাম। কোনো রান্নাই আমার না। বাবুর্চি রান্না করেছে। কোনো একদিন আমি নিজে রান্না করব এবং আপনাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াব। আমি কেমিস্ট্রির ছাত্রী। কেমিস্ট্রির ছাত্রছাত্রীরা ভালো রাঁধুনি হয় এটা কি জানেন? কারো রান্না ভালো হয়। কারো রান্না খারাপ হয়। কেন হয় সেটা কেমিস্ট্রির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আপনাকে বুঝিয়ে বলব। আমার ধারণা আপনার ভালো লাগবে।

আমার বাবা কেমিস্ট্রির শিক্ষক বলেই বোধ হয় ওনার রান্নার হাত অসাধারণ। মার মৃত্যুর পর প্রায়ই এমন হয়েছে যে ঘরে কাজের লোক নেই। রান্না করতে হচ্ছে তাও একদিন দুদিন না। দিনের-পর-দিন। বাবা সবচেয়ে ভালো রাঁধেন মটরশুঁটি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল এবং করলা দিয়ে চিংড়ি মাছ।

আপনি একদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আমি ব্যবস্থা করব যেদিন আসবেন বাবার হাতের রান্না খাবেন।

চিঠিটা দীর্ঘ হয়ে গেল। কেন দীর্ঘ হল শুনলে আপনার হয়তোবা সামান্য মন খারাপ হবে। আমার অ্যাজমার টান উঠেছে। কিছুক্ষণ আগে নেবুলাইজার ব্যবহার করেছি তাতে লাভ হয় নি। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যখন শ্বাসকষ্ট হয় তখন যদি প্ৰিয় কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখি তা হলে কষ্টটা কম হয়। আপনার কাছে চিঠি লেখার ব্যাপারটা যতক্ষণ ততক্ষণ শ্বাসকষ্ট টের পাচ্ছি না।

চাচা আপনি ভালো থাকবেন। ও আচ্ছা আপনাকে একটি বিশেষ থ্যাংকস চিঠির শুরুতেই দিতে চেয়েছিলাম ভুলে গেছি। এখন দিয়ে দেই আপনি যে কাজের মেয়েটাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এটা আমার ভালো লেগেছে। মেয়েটি অতি ভালো। তাকে রাখা হয়েছিল বাবার সেবার জন্য বাবাও মেয়েটিকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কিন্তু আমাদের কারোরই মনে হয় নি এই মেয়েটিকে লেখাপড়া শেখানো যায়। আপনার মনে হয়েছে। এই সব আপাত তুচ্ছ কর্মকাণ্ড দিয়েই কিন্তু একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়।

বিনীত
সায়রা বানু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *