০৬. জননী

জননী

ছোট বেলায় আমার ঘর-পালানো রোগ হয়েছিল।

তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। স্কুলের নাম কিশোরীমোহন পাঠশালা। থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। বাসার কাছেই স্কুল। দুপুর বারোটায় স্কুল ছুটি হয়ে যায়। বাকি দীর্ঘ সময় কিছুতেই আর কাটে না। আমার বোনেরা তখন রান্নাবাটি খেলে। ওদের কাছে পাত্তা পাই না। মাঝে মাঝে অবশ্যি খেলায় নেয়, তখন আমার ভুমিকা হয় চাকরের। আমি হই পুতুল খেলা সংসারের চাকর। ওদের ফাইফরমায়েশ খাঁটি। ওরা আমার সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলে। কাজেই ওদের পুতুল খেলায় খুব উৎসাহ বোধ করি না।

ঘর-পালানো রোগ তখন হলো। এক ঝাঁ-আঁ দুপুরে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। চমৎকার অভিজ্ঞতা। হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত সব কল্পনা করা যায়। মজার মজার দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ানো যায়। কারো কিছু বলার থাকে না।

আমি রোজই তা-ই করি। সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফিরে আসি। আমার মা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তার ছেলে যে সারা দুপুর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তা-ও তিনি জানেন না। আর জানলেও যে ভয়ংকর কিছু করতেন তা-ও মনে হয় না। তার দিবান্দ্রিায় আমি ব্যাঘাত করছি না–এই আনন্দটাই তার জন্য অনেকখানি ছিল বলে আমার ধারণা।

যাই হোক, একদিনের ঘটনা বলি। হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটা বাড়ির বারান্দায় এসে বসলাম। কালো সিমেন্টের বারান্দা। দেখলেই ইচ্ছে করে খালি গায়ে শুয়ে পড়তে। চুপচাপ বসে আছি, হঠাৎ বাড়ির দরজা খুলে গেল। ঘুমঘুম চোখে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। নরম গলায় বললেন, কী চাও খোকা?

আমি বললাম, কিছু চাই না।

বাসা কোথায়?

আমি জবাব দিলাম না। বাসা কোথায় তা এই মহিলাকে বলার কোনো অর্থ হয় না। তিনি চলে গেলেন না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখে গভীর বিস্ময় এবং কৌতূহল। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। তিনি বললেন, তুমি চলে যেও না, আমি আসছি।

তিনি ঘরের ভিতরে চলে গেলেন এবং মিনিট তিনেক পর আবার উপস্থিত হলেন। তার হাতে কী-একটা খাবার। তিনি আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন–নাও, খাও।

অপরিচিত কেউ কিছু খেতে দিলে বলতে হয়–খাব না। ক্ষিধে নেই। আমি তা বলতে পারলাম না। জিনিসটা হাতে নিলাম। খেতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঐ খাদ্য এই পৃর্থিবীর খাদ্য নয়। স্বর্গীয় কোনো অমৃত।

জিনিসটা হচ্ছে জেলি মাখানো এক টুকরো পাউরুটি। এরকম সুখাদ্য পৃথিবীতে আছে এবং তা অপরিচিত কাউকে দেয়া যায় তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। ভদ্রমহিলা বললেন, আরেকটা দেব?

আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম, তবে তা করতে বড় কষ্ট হলো। মহিলা ভেতরে চলে গেলেন এবং আরো এক টুকরা পাউরুটি নিয়ে ফিরে এলেন।

আমি দ্বিতীয়টিও নিঃশব্দে খেয়ে ফেললাম।

 ভদ্রমহিলা বললেন, তোমার নাম কী, খোকা?

আমি নাম বললাম না। এক দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। তিন নিশ্চয়ই আমার এই অদ্ভুত ব্যবহারে খুবই অবাক হয়েছিলেন, তবে তিনি হয়ত-বা তার চেয়েও অবাক হলেন যখন দেখলেন পরের দিন আমি আবার উপস্থিত হয়েছি।

তিনি আমাকে দেখে খুব হাসলেন। তারপরই খাবার নিয়ে এলেন। ব্যাপারটা রুটিনের মতো হয়ে গেল। আমি রোজ যাই, ভদ্রমহিলা খাবার দেন, আমি খাই এবং চলে আসি।

তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করেন বলে মনে হয়। বারান্দায় এসে বসা মাত্র দরজা খুলে বের হয়ে আসেন।

একদিনের কথা বলি। মেঘলা দুপুর। চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। মহিলার বারান্দায় পা দেয়া মাত্র বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল।

তিনি দরজা খুলে বললেন, বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট আসবে, ভেতরে এসো খোকা।

আমি ভয়ে ভয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম। কী চমৎকার সাজালো বাড়ি। যেন ছবি আঁকা। মানুষের বাড়ির ভেতরটা এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না।

খোকা, বস।

আমি ভয়ে ভয়ে সোফায় বসলাম। তিনি বললেন, আজ থেকে তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে, কেমন? তুমি মা ডাকবে, আমি তোমাকে খুব মজার মজার খাওয়াব। আচ্ছা?

আমি কিছু বললাম না।

তিনি বললেন, তুমি যে আমাকে মা ডাকছ এটা কাউকে বলার দরকার নেই। এটা তোমার এবং আমার গোপন খেলা।

আমি ভদ্রমহিলার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি নাশপাতি কিংবা নাশপাতির মতো দেখতে কোনো একটা ফল কেটে দিলেন। বললেন, এসো, তুমি আমার কোলে বসে খাও। তার আগে মিষ্টি করে আমাকে মা ডাক তো।

আমি মা ডাকতে পারলাম না। বিচিত্র এক ধরনের ভয়ে অন্তর কেঁপে উঠল। শিশুদের মনের গভীরে অনেক ধরনের ভয় লুকানো থাকে। তারই কোনো একটা বের হয়ে এসে আমাকে অভিভূত করে ফেলল। আমি ছুটে বের হয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় পৌঁছলাম।

ঐ রহস্যময় বাড়িতে আর কোনোদিন যাইনি। মানুষের জীবনে কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। রহস্যময় প্রকৃতি মানুষকে একই পরিস্থিতিতে বার বার ফেলে মজা দেখেন বলে আমার ধারণা সিলেটের ঐ বাড়ির মহিলার মতো এক মহিলার দেখা পেলাম খোদ আমেরিকায়। আমার বয়স তখন সাতাশ।

শীতের শুরু।

বরফ পড়া আরম্ভ হয়েছে। হোটেল গ্রেভার ইন থেকে বাসে ইউনিভার্সিটিতে আসতে খুব কষ্ট হয়। বাসের ভিতর হিটিং-এর ব্যবস্থা আছে, তবু শীতে জমে যাবার মতো কষ্ট পাই। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করার কষ্টও অকল্পনীয়। আমার ভারতীয় বন্ধু উমেশ আমার জন্য ইউনিভার্সিটির কাছে একটা ঘর খুঁজে দিল।

আমেরিকান এক ভদ্রমহিলা তার বাড়ির কয়েকটা ঘর বিদেশী ছাত্রদের ভাড়া দেন। ভাড়া খুবই সস্তা, মাসে চল্লিশ ডলার। তবে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে বাইরে। আমি বাড়িওয়ালির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার নাম লেভারেল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, আমি খুব বেছে বেছে রুম ভাড়া দেই। যাদেরকে দেই তাদের কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। তার মধ্যে সবচে কঠিন নিয়ম দুটি হচ্ছে, রাত দশটার পর কোনো বান্ধবীকে ঘরে আনা যাবে না। এবং উঁচু ভ্যলুমে স্টেরিও বাজানো যাবে না।

আমি বললাম, বান্ধবী এবং স্টেরিও–দুটোর কোনোটিই আমার নেই।

তিনি বললেন, এখন নেই, দুদিন পর হবে। সেটা দোষের নয়। তবে আমার নিয়ম তোমাকে বললাম। পছন্দ হলে রুম নিতে পার।

আমি রুম নিয়ে নিলাম। প্রথম মাসের ভাড়া বাবদ চল্লিশ ডলার দেবার পর তিনি একটি ছাপানো কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেই কাগজে আরো সব শর্ত লেখা। প্রথম শর্ত পড়েই আমার আক্কেল গুড়ুম। লেখা আছে : এই বাড়ির কোনো অগ্নিবীমা নেই। কাজেই এই বাড়ির অধিবাসীদের কেউ ধূমপান করতে পারবে না।

সব নিয়ম মানা সম্ভব কিন্তু এই নিয়ম কী করে মানব? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। একেবার ভাবলাম ডলার ফেরত নিয়ে হোটেল গ্রেভার ইনে ফিরে যাব। আবার ভাবলাম, বাসায় তো আর বেশিক্ষণ থাকব না, কাজেই তেমন অসুবিধা হয়ত হবে না।

অসুবিধা হলো।

ঘুমুতে যাবার আগে আগে সিগারেটের তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার মতো অবস্থা হ’ল। আমি গরম কাপড় গায়ে দিলাম। গায়ে পাকা চড়ালাম। মাফলার দিয়ে নিজেকে পেঁচিয়ে মাংকিক্যাপ মাথায় দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সিগারেট ধরালাম।

দৃশ্যটা অদ্ভুত। বরফ পড়ছে। এই বরফের মধ্যে জোবা-জাব্বা গায়ে এক ছেলে সিগারেট টানার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

দিন সাতেক পরের কথা। লেভারেল আমার ঘরে ঢুকে কঠিন গলায় বলল, এগারটা-বারটার সময় বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টান তাই না?

হ্যাঁ।

ধূমপান যারা করে তাদের আমি বাড়ি ভাড়া দেই না।

আমি সামনের মাসে চলে যাব।

খুবই ভালো কথা। মাসের এই কটা দিন দয়া করে ঘরে বসেই সিগারেট খাবে। ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে অসুখ-বিসুখ বাধাও তা আমি চাই না।

ধন্যবাদ।

শুকনো ধন্যবাদের আমার দরকার নেই। আমি পনেরো বছরে এই প্রথম একজনকে সিগারেট খাবার অনুমতি দিলাম।

থ্যাংক ইউ।

লেভারেল উঠে চলে গেল। তবে যাবার আগে হঠাৎ বলল, তোমার অন্য কোথাও যাবার দরকার নেই। তুমি আমার এখানেই থাকবে। আমি তোমার সিগারেটের অভ্যাস ছাড়িয়ে দেব।

দ্রমহিলা এর পর আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেন। আমার সিগারেটের প্যাকেট তার কাছে জমা রাখতে হলো। তিনি গুনে গুনে আমাকে সিগারেট দেন। তাঁর সামনে বসে খেতে হয়। তিনি নানান উপদেশ দেন, ধোঁয়া বুকের ভিতর নিও না। পাফ করে ছেড়ে দাও।

সিগারেট খাবার সময় একজন অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, এটা অসহ্য।

এছাড়াও তিনি আরো সব সমস্যা করতে লাগলেন–আমার ওজন খুব কম, কাজেই তিনি ওজন বাড়ানো চেষ্টা করতে লাগলেন। বলতে গেলে রোজ রাতে তার সঙ্গে ডিনার খেতে হয়। তিনি আমার কাপড় ধুয়ে দেন। ঘর ঝাট দিয়ে দেন। একদিন তুষার ঝড় হচ্ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে আমি ঠিকমতো ফিরতে পারব

ভেবে নিজেই ইউনিভাসিটিতে হাজির হলেন। আমি বরফের উপর দিয়ে ঠিকমতোই হাঁটতে পারছি তবু তিনি হাত ধরে আমাকে নিয়ে এলেন।

বরফের উপর দিয়ে দুজন আসছি। হঠাৎ উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, হুমায়ুন [ইনিই একমাত্র আমেরিকান যিনি শুদ্ধভাবে আমার নাম উচ্চারণ করতেন] তুমি কি দয়া করে এখন থেকে আমাকে মা ডাকবে?

আমি স্তম্ভিত।

বলেন কী এই মহিলা।

আমি চুপ করে রইলাম। লেভারেল শান্ত গলায় বললেন, তুমি আমাকে মা ডাকলে আমার খুব ভালো লাগবে। সব সময় ডাকতে হবে না। এই হঠাৎ হঠাৎ।

আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। আমাদের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না। আমি বিরাট সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলাম।

ভদ্রমহিলার আদরযত্নে খুব অস্বস্তি বোধ করি। কেউ আমার প্রতিটি ব্যাপার লক্ষ রাখছে তাও আমার ভালো লাগে না।

আমি পড়াশুনা করি, তিনি চুপচাপ পাশে বসে থাকেন। বারবার জিজ্ঞেস করেন, আমি পাশে বসে থাকায় কি তোমার অসুবিধা হচ্ছে? আমি ভদ্রতা করে বলি “না”।

ঠাণ্ডা লেগে একবার খানিকটা জ্বরের মতো হলো, তিনি তাঁর নিজের ইলেকট্রিক ব্ল্যাংকেট আমাকে দিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে একটা কার্ড, সেখানে লেখা : তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ। তোমার মা–লেবারেল।

দ্রমহিলার এখানে বেশিদিন থাকতে হলো না। ইউনিভার্সিটি আমাকে বাড়ি দিল। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বিদায়ের সময় তিনি শিশুদের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। ভদ্রমহিলার স্বামী বিরক্ত হয়ে বারবার বললেন, এসব কী হচ্ছে? ব্যাপারটা কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। লেভারেল, তুমি এত আপসেট কেন?

আমার হৃদয় খুব সম্ভব পাথরের তৈরি। এই দুজনের কাউকেই আমি মুখ ফুটে মা ডাকতে পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *