০৫. বিস্ময়কর ঘটনা

মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, This is a dream. Nothing but a dream, যে বিস্ময়কর ঘটনা এই মুহূর্তে তাঁর চোখের সামনে ঘটছে সেটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। স্বপ্নে বিস্ময়কর ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে। এখানেও তাই ঘটছে। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তাঁর মশারির ছাদে একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। কুণ্ডলি ভেঙে সাপটা মাথা বের করল। এই তো এখন মশারি বেয়ে নিচে নামছে। সাপের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ থাকে—এর গায়ে ফুটি ফুটি। অনেকটা চিত্রা হরিণের মতো।

তিনি আবারো বিড়বিড় করে বললেন, This is a dream. Nothing but a dream. স্বপ্নের নানান স্তর আছে। তিনি নিশ্চয়ই গভীর কোনো স্তরের স্বপ্ন দেখছেন। এ ধরনের স্বপ্ন চট করে ভাঙে না। মানুষের মস্তিষ্ক স্বপ্নটা পুরোপুরি দেখানোর ব্যবস্থা করে। তার বেলাতেও এই ব্যাপারটিই হচ্ছে। স্বপ্নটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেখতে হবে। তাঁর মস্তিষ্ক দেখাবে। তিনি না চাইলেও দেখাবে।

যদি ঘটনাটা স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে তাঁর চুপচাপ শুয়ে সাপটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চোখ বন্ধ করলেও সাপটা চলে যাবে না। তাঁর চোখ বন্ধ না করার সঙ্গে স্বপ্নের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যদি স্বপ্ন না হয়ে থাকে তাহলে অনেক কিছুই করার আছে। শুয়ে না থেকে তাঁর উঠে বসা দরকার। হাততালি দেওয়া দরকার। সাপ শব্দ পছন্দ করে না। যেকোনো ধরনের কম্পন তার কাছে বিরক্তিকর। খাটটা দোলানো যেতে পারে। বালিশের নিচে সিগারেট আছে। সিগারেট ধরানো যেতে পারে। সিগারেটের ধোঁয়াও নিশ্চয়ই সাপটা পছন্দ করবে না।

মিসির আলি উঠে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বসতে পারলেন না। এর দুটা কারণ হতে পারে। স্বপ্নে নিজের ইচ্ছায় কিছু করা যায় না। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। কাজেই এটা স্বপ্ন। আর স্বপ্ন না হয়ে ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি উঠে বসতে পারছেন না, কারণ তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। ভয়ে স্নায়ুতে স্থবিরতা চলে এসেছে। মস্তিষ্ক উঠে বসার সিগন্যালটা ঠিকমতো দিতে পারছে না। যে সব রাসায়নিক বস্তু নিউরনের বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভেতরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বালিশের নিচে হাত দিয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরালেন। তামাকের গন্ধ পাওয়া গেল। তাহলে কি এটা স্বপ্ন না, সত্যি? স্বপ্ন হল সিনেমার পর্দায় ছবি দেখার মতো—ছবি দেখা যাবে, শব্দ শোনা যাবে তবে কোনো গন্ধ পাওয়া যাবে না। স্বপ্ন গন্ধ এবং বর্ণহীন।

তিনি গন্ধ পাচ্ছেন এবং রঙও দেখছেন। সাপের গায়ের হলুদ ফুটি স্পষ্ট দেখেছেন। এই তো এখন তাঁর হাতে বেনসন এন্ড হেজেস-এর সোনালি প্যাকেট। গাঢ় লাল রঙের উপর লেখা Special filter.

তবে এখানেও কথা আছে, গভীর স্তরের স্বপ্নে বর্ণ গন্ধ সবই থাকে। আচ্ছা এমন কি হতে পারে তিনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন না, বাস্তব ঘটনা। তাঁকে তো আগেই বলা হয়েছে এই বাড়ির দোতলায় সাপ আছে। যদি সাপ থেকেই থাকে তাহলে ঘরে সাপ আসতেই পারে। কারণ এই ঘরটায় কার্বলিক এসিড দেওয়া হয় নি।

ধরে নেওয়া যায় একটা সাপ ঘরে ঢুকেছে। আলো সমস্ত প্রাণীকুলকে কৌতূহলী করে, সাপটাকেও করেছে। সে এগিয়ে এসেছে খাটের নিচে রাখা হারিকেনের দিকে। এখানে এসে সে শুনতে পেল নিশ্বাস ফেলার শব্দ। খাট থেকে শব্দটা আসছে। সাপটা আবারো কৌতূহলী হল। সে দেখতে গেল ব্যাপারটা কী? কীসের শব্দ? শব্দটা কোথেকে আসছে? দেখতে গিয়ে সে চলে গেল মশারির ছাদে। তার কৌতূহল মিটেছে বলে সে এখন চলে যাচ্ছে। কিংবা তার কৌতূহল মেটে নি। সে চলে যাচ্ছে কারণ সে বুঝতে পারছে কৌতূহল মেটার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মিসির আলি বিছানায় উঠে বসলেন। বালিশের কাছে হাত বাড়ালেন। টর্চ লাইটটা আছে। তিনি টর্চের আলো ফেললেন। সাপটা দেখা যাচ্ছে না। খাট বেয়ে নিশ্চয়ই নেমে গেছে। তিনি কয়েকবার কাশলেন। টর্চ লাইটে টোকা দিলেন। বসে বসেই খাট নাড়ালেন। তিনি এখন বিছানা থেকে নামবেন। তাঁকে একটা কাজ করতে হবে। ছোটখাটো একটা পরীক্ষা। তাঁকে যেতে হবে বড় টেবিলটার কাছে। টেবিলের উপর ডায়েরি আছে। ডায়েরির পাতায় কিছু একটা লেখে নাম সই করতে হবে।

এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা স্বপ্ন না সত্যি তা প্রমাণ হবে ডায়েরির লেখা থেকে সকালে ঘুম ভেঙে যদি দেখেন ডায়েরিতে কিছু লেখা নেই তাহলে বুঝতে হবে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন। আর যদি দেখেন লেখা আছে তাহলে বুঝতে হবে যা দেখেছেন সবই সত্যি। মিসির আলি খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। সাপটাকে প্রথমবার দেখে যে ভয় পেয়েছিলেন, সেই ভয়টা এখন আর লাগছে না। তবে গা ছমছম করছে।

মেঝেতে কোথাও সাপটাকে দেখা গেল না। মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরিতে লিখলেন—’আজ সাত তারিখ। আমি আমার মশারির উপর একটা সাপ দেখেছি।’ লিখে নাম সই করলেন। ডায়েরি উল্টে এমনভাবে টেবিলে রাখলেন যেন সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ে ডায়েরিটা উল্টানো। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াবেন। ঘরের ভেতর দমবন্ধ লাগছে।

তিনি দরজায় ছিটকিনি না দিয়েই শুয়েছিলেন। পুরোনো আমলের বাড়ি ছিটকিনি জং ধরে আটকে গিয়েছিল। যেহেতু ছিটকিনি লাগানো নেই, আংটা ধরে টানলেই দরজা খুলে যাবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য দরজা খুলতে পারলেন না। প্রাণপণে টেনেও দরজা নাড়ানো গেল না। মনে হচ্ছে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তিনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হল না। মিসির আলি খাটে এসে উঠলেন। হই চই চিৎকার করার কোনোই মানে হয় না। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কাজেই তাঁর যা করণীয় তা হল বিছানায় চলে যাওয়া। ঘুমিয়ে পড়া এবং ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করা।

মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে রাখা চাদর বুক পর্যন্ত টেনে দিলেন। একটা হাত রাখলেন কোলবালিশের উপর। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। মাথার ভেতরে সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। এ রকম শব্দ কেন হচ্ছে কে জানে? প্রচণ্ড ভয় পাবার পরে কি মানুষের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়?

.

তাঁর ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘর ভর্তি আলো। পাখপাখালি চারদিকে কিচকিচ করছে। খাটের পাশে লিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। আজ মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স কিছুতেই সতের আঠার বছরের বেশি হবে না। লিলি হাসিমুখে বলল, চাচাজী আপনি দরজার ছিটকিনি না লাগিয়েই ঘুমিয়েছেন?

মিসির আলি উঠে বসতে বসতে বললেন, ছিটকিনি লাগাতে পারি নি।

লিলি বলল, আমি তো আর সেটা জানি না। এর আগেও দুবার এসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছি। এইবার কী মনে করে দরজা ধাক্কা দিলাম। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। চাচাজী রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?

ভালো।

নিন চা নিন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি বাসিমুখে দিনের প্রথম চা খান। নাশতা তৈরি আছে। হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেই নাশতা দিয়ে দেব।

তোমার শরীর এখন ভালো?

শরীর খুব ভালো। কাল রাতেও ভালো ছিল। ওর সঙ্গে রাগারাগি করে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। ও আপনাকে কী বলেছে? আমার মাথা খারাপ? আমার চিকিৎসা দরকার?

এই ধরনেরই কিছু।

লিলি হাসতে হাসতে বলল, ওর কোনো দোষ নেই। রাগারাগির এক পর্যায়ে আমি মাথা খারাপের অভিনয় করেছি। ও আমার অভিনয় ধরতে পারে না। চাচাজী আমার চা কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

কাল রাতের খাবারটা কেমন ছিল?

ভালো ছিল। আমি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছি।

আজ আপনাকে কই মাছের পাতুড়ি খাওয়াব। পুঁই শাকের পাতা আনতে পাঠিয়েছি। পাওয়া গেলে হয়। এমন জংলা জায়গায় বাস করি। আশপাশের দুতিন মাইলের মধ্যে হাটবাজার নেই।

মিসির আলি কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, লিলি একটা কাজ কর তো— টেবিলের উপর দেখ আমার ডায়েরিটা উল্টো করে রাখা আছে। পাতাটা খুলে দেখ কী লেখা।

লিলি টেবিলের কাছে গেল। ডায়েরি উল্টো করে রাখা নেই। বইগুলির উপর রাখা। লিলি বলল, চাচাজী টেবিলের উপর কোনো ডায়েরি উল্টো করে রাখা নেই।

লাল মলাটের বইটি ডায়েরি। সাত তারিখ বের করে দেখ তো কিছু লেখা আছে কি না।

লিলি অবাক হয়ে বলল, কিছু লেখা নেই। কী লেখা থাকবে?

মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, রেখে দাও। কিছু লেখা থাকবে না। তোমার স্বামীর ঘুম কি ভেঙেছে?

ওর ঘুম একটার আগে ভাঙবে না। সারা রাত জেগে তারা দেখেছে। আপনাকে কী কী দেখাবে সব ঠিকঠাক করেছে। আজ আপনাকে কী দেখানো হবে জানেন?

না।

শনির বলয়। এইসব দেখে কী হয় কে জানে! আমার খুবই ফালতু লাগে। চাচাজী আমি নিচে যাচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে আপনি নেমে আসুন। আজ আপনি নাশতা খাবেন চুলার পাশে বসে। গরম গরম লুচি ভেজে পাতে তুলে দেব।

তোমার লুচিগুলিও কি স্পেশাল?

অবশ্যই। অর্ধেক ময়দা আর অর্ধেক সুজিদানা মিশিয়ে কাই তৈরি করা হয়। দশ বারো ঘণ্টা এই কাই ভেজা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে রেখে দিতে হয়। লুচির কাই আমি কাল রাতেই তৈরি করে রেখেছি।

ভালো।

শুধু ভালো বললে হবে না। আপনি চলে যাবার আগে আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন। রান্নার সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট আমি বাঁধিয়ে রাখব।

অবশ্যই দিয়ে যাব। তুমি চাইলে এখনি দিয়ে দিতে পারি।

ওমা এখন কেন দেবেন? আমি তো এখনো আপনার জন্যে রান্নাই করি নি। চাচাজী যাই।

লিলি চলে যাবার পর মিসির আলি টেবিলের কাছে গেলেন। ডায়েরি হাতে নিলেন। সেখানে স্বপ্নের কথা কিছু লেখা নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? গত রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন? গভীর গাঢ় স্বপ্ন?

মিসির আলি হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেন। লুচি বেগুনভাজা খেলেন। চা খেলেন। লিলি বলল, চাচাজী আপনি ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখুন। বাগান দেখুন। লাইব্রেরি ঘর খুলে রেখেছি। লাইব্রেরির বইপত্র দেখতে পারেন।

তোমার কুকুরগুলি কি বাঁধা আছে?

হ্যাঁ কুকুর বাঁধা। বরকতকে পুঁই পাতার খোঁজে পাঠিয়েছি। বড় বড় পুঁই পাতা ছাড়া পাতুড়ি হয় না। বরকত এলেই কুকুরগুলির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আপনার কুকুরভীতি থাকবে না।

নীল ফুল ফোটে ঐ গাছটা কোথায়?

পেছনের বাগানে। বিশাল গাছ আপনি দেখলেই চিনতে পারবেন। গাছের গুঁড়িটা বাঁধানো। পেছনের বাগানে একটা ভাঙা মন্দির আছে। মন্দিরে ঢুকবেন না। সাপের আড্ডা।

কী মন্দির?

কালী মন্দির। হিন্দু বাড়ি ছিল। বাড়ির মালিক অশ্বিনী রায় শাক্ত মতের মানুষ ছিলেন। স্বপ্নে দেখে তিনি কালী প্রতিষ্ঠা করেন। খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। আমি ভাসা ভাসা জানি। সুলতানকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে বলবে।

আচ্ছা তাঁকে জিজ্ঞেস করব।

লিলি বলল, আমি ঐ দিনের মতো এক্সপ্রেসো কফি বানিয়ে আপনার জন্যে নিয়ে আসছি। ঠিক আছে চাচাজী?

ঠিক আছে।

মিসির আলি বাড়ি দেখতে বের হলেন। রাতে বাড়িটা যত প্রকাণ্ড মনে হয়েছিল দিনের আলোয় মনে হচ্ছে তার চেয়েও প্রকাণ্ড। তবে প্রকাণ্ড হলেও ধ্বংসস্তূপ। বাড়িটা যেন অপেক্ষা করছে কখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বাড়িটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ভয় ভয় করে। মনে হয় বাড়িটাও কৌতূহলী চোখে তাঁকে দেখছে। চিন্তা ভাবনা করছে। চিন্তা ভাবনা শেষ হলেই বাড়ি গম্ভীর গলায় ডাকবে, এই যে ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, দয়া করে শুনে যান।

মিসির আলি বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। তিনি বৃক্ষপ্রেমিক না। গাছপালা নিয়ে তাঁর বাড়াবাড়ি কৌতূহল নেই, কিন্তু নীল মরিচ ফুল গাছটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।

বাড়ির পেছনের জায়গাটা আশ্চর্যরকমভাবে পরিষ্কার। ঝোপঝাড় নেই, বড় বড় ঘাস নেই, গাছের নিচে শুকনো পাতা পড়ে নেই। মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝাঁট দেওয়া হয়েছে। নীল মরিচ ফুল গাছটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু বিস্ময়কর গাছ বলে মনে হচ্ছে না। তবে মরিচ ফুল গাছের পাশেই চেরী গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। পাতাশূন্য গাছ সাদা ফুলে ঢেকে আছে। মিসির আলি বিস্মিত গলায় বললেন, বাহ্ সুন্দর তো!

চেরী গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায়। এখন শীত না, তারপরেও গাছে একটা পাতা নেই কেন? জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে এসে গাছের জিনে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? নাকি এটা চেরী গাছ না, অন্য কোনো গাছ। তিনি নাম জানেন না।

ভাঙা মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের অংশটা ঝোপঝাড়ে ঢাকা। বড় বড় কয়েকটা আম গাছ জায়গাটা অন্ধকার করে রেখেছে। উইয়ের ঢিবির মতো কিছু উঁচু মাটি দেখা গেল। মন্দিরের ঠিক সামনে সারি করে লাগানো জবা গাছ। জবা গাছ এত বড় হতে মিসির আলি দেখেন নি। গাছগুলি আম কাঁঠালের গাছের মতোই প্রকাণ্ড। একটা গাছেই শুধু ফুল ফুটেছে। কালচে লাল রঙের ফুল। দেখতে ভালো লাগে না। জবা ফুল ছাড়া কালী পূজা হয় না। পূজার ফুলের জন্যই কি এই গাছগুলি লাগানো? এত প্রাচীন গাছ? মিসির আলি মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

মন্দিরের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে কী সব লেখা। পড়তে ইচ্ছা করছে।

বাবু অশ্বিনী কুমার রায়
কর্তৃক
অদ্য শনিবার বঙ্গাব্দ ১২০৮ গৌর কালীমূর্তি অধিষ্ঠিত হইল।

মিসির আলি নামফলকের দিকে তাকিয়ে আছেন। গৌর কালীমূর্তি ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। কালী কৃষ্ণবর্ণ, গৌরবর্ণ না।

চাচাজী আপনার কফি। আপনাকে বলা হয়েছে মন্দিরের কাছে না আসতে আর আপনি সোজাসুজি মন্দিরে চলে এসেছেন। আপনি দেখি একেবারে বাচ্চাদের মতো। যেটা করতে না করা সেটাই করেন।

মিসির আলি কফির মগ হাতে নিতে নিতে বললেন, গৌর কালী ব্যাপারটা কী?

গৌর কালী হল যে কালীর গায়ের রঙ গৌর। ধবধবে সাদা। বাবু অশ্বিনী রায় স্বপ্নে দেখেছিলেন মা কালী তাঁকে বলছেন—তুই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। তবে গায়ের রঙ কালো করিস না বাবা। গৌর বর্ণ করবি। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, ঠিক আছে মা করব। দেবী তখন বললেন, আমি তোর এখানে থাকব নগ্ন অবস্থায়। আমার গায়ে যেন কোনো কাপড় না থাকে। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, সেটা কি ঠিক হবে মা? কত ভক্তরা তোমাকে দেখতে আসবে! দেবী বললেন, কেউ আমাকে দেখতে আসবে না।

তোকে যা করতে বললাম তুই কর।

মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী কুমার নগ্ন গৌরবর্ণের কালী প্রতিষ্ঠা করলেন?

লিলি বলল, হ্যাঁ।

মন্দিরে কি মূর্তি আছে?

না। অশ্বিনী কুমার রায় নিজেই মূর্তিটা মেঘনায় ফেলে দিয়েছিলেন।

কেন?

গল্পটা আমি পুরোপুরি জানি না। ভাসা ভাসা জানি। দূরবীনওয়ালা, অর্থাৎ সুলতান সাহেব ভালোমতো জানে। ও আপনাকে গুছিয়ে বলবে।

আগে তোমার কাছ থেকে অগোছালোভাবে শুনি। অগোছালো গল্প শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

ঘটনাটা হল এ রকম—যেদিন দেবী প্রতিষ্ঠিত হল সেই রাতেই অশ্বিনী বাবুকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, এই বোকা ছেলে! নরবলি ছাড়া শক্তির প্রতিষ্ঠা হয়? তুই এক কাজ কর, আগামী অমাবস্যায় নরবলি দে। অশ্বিনী বাবু বললেন, এইটা পারব না মা। আমি মহাপাতক হব। দেবী বললেন, পাপ-পুণ্যের তুই বুঝিস কী? তোকে যা করতে বললাম কর। নয়তো মহাবিপদে পড়বি। অশ্বিনী বাবু স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই কাজটা পারব না মা। নরবলি ছাড়া তুমি যা করতে বলবে তাই করব। দেবী তখন বললেন, তুই যখন পারবি না তখন আমার ব্যবস্থা আমিই করব। তখন তোর দুঃখের সীমা থাকবে না। অশ্বিনী বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। দুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। খুবই কান্নাকাটি শুরু করলেন। আগামী অমাবস্যায় না জানি কী হয়!

কিছু হয়েছিল?

হ্যাঁ হয়েছিল। অশ্বিনী বাবুর বড় মেয়েকে মন্দিরের ভেতর পাওয়া গেল। বড় মেয়ের নাম শ্বেতা। বয়স আঠার উনিশ। বিয়ের কথা চলছিল। সকালে মন্দিরে ঢুকে অশ্বিনী বাবু দেখেন, মেয়ের মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। দেবীর খাঁড়ায় চাপ চাপ রক্ত।

কী সর্বনাশ!

অশ্বিনী বাবুর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। তিনি সেই রাতেই দেবীমূর্তি মেঘনা নদীর মাঝখানে ফেলে দিয়ে এলেন।

উনার কি একটাই মেয়ে ছিল?

ওনার চার মেয়ে ছিল। দুমাসের মাথায় দ্বিতীয় মেয়েটিরও একই অবস্থা হল। মন্দিরের ভেতর তাকে পাওয়া গেল মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। অশ্বিনী বাবু বাড়িঘর বিক্রি করে বাকি দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ডিব্ৰুগরে, সেখান থেকে শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িতে তাঁর তৃতীয় মেয়েটির একই অবস্থা হল। তখন তাঁর স্ত্রী সীতাদেবী মামলা করলেন স্বামীর বিরুদ্ধে। সীতাদেবী বললেন, হত্যার ঘটনাগুলি তাঁর স্বামী ঘটাচ্ছেন। দোষ দিচ্ছেন মা কালীর। ছোট মেয়েটাও বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল।

মামলার রায় কী হয়েছিল?

ওনার ফাঁসি হয়েছিল।

তুমি এতসব জানলে কী করে?

এই মামলা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমাদের দূরবীনওয়ালা সেইসব লেখা সবই যোগাড় করেছিল। আপনি চাইলে আপনাকে খুঁজে বের করে দেবে। আপনি কি চান?

না আমি চাই না।

লিলি বলল, আমাকে দেখে কি বুঝতে পারছেন যে আমার মনটা খুব খারাপ?

না বুঝতে পারছি না।

আমার মনটা খুবই খারাপ কারণ পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি। বড় বড় পুঁই পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে পাতুড়ি করতে হয়। কলাপাতা দিয়েও হয়। তবে ভালো হয় না।

মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, মন খারাপের কারণটা তো মনে হয় খুবই গুরুতর।

আপনার কাছে গুরুতর মনে না হতে পারে আমার কাছে গুরুতর। ও যেমন তারা দেখে, আমি করি রান্না। কোনো রাতে যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় ওর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ঠিক সে রকম আমি যখন রান্নার জিনিসপত্র পাই না, আমার মেজাজ খারাপ হয়। এটা কি দোষের?

না দোষের না। এত সুন্দর বাগান তুমি এখানে বেড়াতে আস না?

লিলি বলল, কখনো না। নেংটা দেবীর আশপাশে আমি থাকব? পাগল হয়েছেন? তাছাড়া গাছপালা আমার ভালোও লাগে না। চাচাজী শুনুন আমি চলে যাচ্ছি। খবরদার আপনি কিন্তু মন্দিরের ভেতর ঢুকবেন না।

আচ্ছা ঢুকব না। তোমার স্বামীর ঘুম ভেঙেছে?

হুঁ ভেঙেছে।

তার নাশতা খাওয়া শেষ?

সে নাশতা খাবে না। দুপুরে ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম না এলে ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাবে।

কেন?

রাত জাগবে। আজ সে আপনাকে নিয়ে তারা দেখবে।

আজ কি অমাবস্যা?

আগামীকাল অমাবস্যা।

মিসির আলি বললেন, কদিন ধরেই যেমন মেঘলা যাচ্ছে—অমাবস্যার রাতে যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে তো সমস্যা।

লিলি নিচুগলায় বলল, আপনার আর কী সমস্যা। সমস্যা আমার। আকাশে মেঘ দেখলে ও প্রচণ্ড রেগে যায়। হই চই করে। অমাবস্যা হল বৃষ্টির সময়। অন্যদিন বৃষ্টি না হলেও অমাবস্যায় বৃষ্টি হবেই। চাঁদের আকর্ষণ বিকর্ষণের কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

আমিও জানি না।

কফির মগটা দিন আমি নিয়ে চলে যাই। দুপুরের রান্না হলে খবর দেব চলে আসবেন। এখন নিজের মনে ঘুরে বেড়ান। শুধু দয়া করে মন্দিরে ঢুকবেন না।

মিসির আলি নীল মরিচ গাছের নিচে বসলেন। কালো সিমেন্টে বাঁধানো বেদি, বসার জন্যে সুন্দর। সঙ্গে বই নিয়ে এলে পড়া যেত। দোতলায় উঠে বই আনতে ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা গতরাতের ঘটনাটা নিয়ে কি কিছু ভাববেন! না থাক এখনো সময় হয় নি। মন্দিরের ভেতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটা যদিও নিষেধ করেছে। নিষেধ অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা হয়তো মানুষের ডিএনএর ভেতরই আছে। মানুষকে যেটাই নিষেধ করা হয়েছে সেটাই সে করেছে। ব্যাপারটা শুরু করেছিলেন আদি মানব আদম। তাঁকে কোনো ব্যাপারে নিষেধ করা হয় নি, শুধু বলা হয়েছিল—গন্ধম ফলটা খেও না। আদম প্রথম যে কাজটা করলেন সেটা হল গন্ধম ফল খাওয়া।

এডমন্ড হিলারির মা’র ছিল উচ্চতা ভীতি। তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, তুমি আর যা-ই কর বাড়ির ছাদে উঠবে না। সেই হিলারি এভাররেস্টের চূড়ায় উঠে বসে থাকলেন।

মিসির আলি মন্দিরের দিকে রওনা হলেন। ভেতরে ঢোকার দরকার নেই—তিনি শুধু উঁকি দিয়ে চলে আসবেন। পরিত্যক্ত মন্দিরে সাপ থাকা স্বাভাবিক, তবে কাল রাতের ঘটনার পর দিনের সাপ তত ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে হয় না।

মন্দিরে ঢোকার দরজাটা কাঠের। দরজায় হুক আছে। তালা লাগানোর ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু দরজায় তালা নেই। মিসির আলি ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। মেঝে শ্বেত পাথরের, ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ এসে সাবান পানি দিয়ে ধুইয়ে দিয়ে গেছে। তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা হল মন্দিরে মূর্তি আছে। গৌর কালীর নগ্ন মূর্তি।

এখানেই বিস্ময়কর সমাপ্তি না। এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হল মূর্তিটি দেখতে অবিকল লিলির মতো। যেন কোনো ভাস্কর এসে লিলিকে দেখে পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে একটা মানুষের চেহারার সঙ্গে পুরোনো মূর্তির চেহারা মিলে যাবে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। এটা খুবই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা

মিসির আলি মন্দির থেকে বের হলেন। চেরী গাছটার নিচে বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে শলার ঝাড়ু, বাগান ঝাঁট দিয়ে এসেছে। তবে সে এই মুহূর্তে বাগান ঝাঁট দিচ্ছে না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। সেই দৃষ্টিতে কৌতূহল, বিস্ময়, আনন্দ কোনো কিছুই নেই। সে তাকিয়ে আছে মাছের মতো ভাবলেশহীন চোখে।

মিসির আলি মন্দির থেকে বের হয়ে মন্দিরের পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বরকত চোখের দৃষ্টিতে এখনো তাঁকে অনুসরণ করছে। তাঁর দৃষ্টির আড়ালে যাবার জন্যেই মন্দিরের পেছনে চলে যাওয়া দরকার।

মন্দিরের পেছনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। একটা কুয়া আছে। কুয়ার পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। কুয়ার উপরে তারের জাফরি। সেখানে বাগান বিলাস গাছ। গাছ ভর্তি ফুল। অন্ধকার কুয়া, ফুলের কারণে আলো হয়ে আছে। নদীর কাছের বাড়িতে কখনো কুয়া থাকে না। এই কুয়াটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে একসময় নদী অনেক দূরে ছিল। মিসির আলি কুয়ার পাড়ে উঠলেন। পানি আছে কি না দেখতে হবে। পাথর নিয়ে ফেলতে হবে।

মিসির আলি কুয়াতে পাথর ফেলতে পারলেন না। তার আগেই তাঁকে চমকে উঠতে হল, কারণ ঝাঁটা হাতে বরকত এসে দাঁড়িয়েছে। মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে?

বরকত জবাব দিল না। চোখও নামিয়ে নিল না।

মিসির আলি বললেন, বাগান ঝাঁট দিতে এসেছ?

বরকত বলল, না।

মিসির আলি বললেন, তোমার কুকুরগুলির সঙ্গে এখনো পরিচয় হয় নি। চল যাই কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়ে আসি।

বরকত বলল, আপনেরে ডাকে।

কে ডাকে?

বরকত এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাড়ির দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। মিসির আলি বললেন, কে ডাকছে? লিলি?

বরকত জবাব দিল না। আঙুল উঁচিয়ে রাখল। মিসির আলি আঙুল লক্ষ করে এগুলেন। বরকত এখনো হাত নামাচ্ছে না। তীর চিহ্ন আঁকা সাইনবোর্ডের মতো হাত স্থির করে রেখেছে। তাকে দেখাচ্ছে কাকতাড়ুয়ার মতো।

হাতের আঙুল লক্ষ করে মিসির আলি উপস্থিত হলেন লাইব্রেরি ঘরে। বিরাট ঘর। সাধারণত লাইব্রেরি ঘরের চারদিকেই বই থাকে। এই ঘরের একদিকের দেওয়ালে বই রাখা। কোনো আলমিরা নেই। সব বই র‍্যাকে রাখা। র‍্যাকের উচ্চতা এমন যে হুইল চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে বই নেওয়া যায়।

লাইব্রেরি ঘরের ঠিক মাঝখানে হুইল চেয়ারে সুলতান বসে আছে। সুলতানের সামনে টি টেবিলের মতো ছোট্ট টেবিল। সুলতানের উল্টোদিকে আরেকটা হুইল চেয়ার।

সুলতান হাসি মুখে বলল, স্যার কেমন আছেন? মিসির আলি বললেন, ভালো।

আপনার বসার জন্যে একটা হুইল চেয়ার রেখে দিয়েছি।

তাই তো দেখছি।

সুলতান গলার স্বর গম্ভীর করে মাথা সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকিয়ে বলল, সাধারণ চেয়ার না রেখে আপনার জন্যে হুইল চেয়ার কেন রেখেছি বলতে পারবেন?

না, বলতে পারব না।

আপনি কি বিস্মিত হচ্ছেন?

সামান্য হচ্ছি।

স্যার বিস্মিত হবার কিচ্ছু নেই। আমি ব্যাখ্যা করলেই বুঝবেন আপনার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করাটা খুবই যুক্তিযুক্ত। আপনি চেয়ারটায় আরাম করে বসুন, আমি ব্যাখ্যা করছি।

মিসির আলি বসলেন। সুলতান বলল, চেয়ারের কনট্রোলগুলি দেখে নিন। পায়ের এখন আর আপনার কোনো ব্যবহার নেই। চেয়ার ঘোরানো, সামনে পেছনে যাওয়া, সবই এখন থেকে করবেন হাতে। কাজটা এক হাতেও করতে পারেন তবে দুটা হাত ব্যবহার করলে পরিশ্রম কম হবে।

মিসির আলি বললেন, আমার তো আর এই চেয়ারে বসে অভ্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি বসলাম আমার মতো। আপনি হুইল চেয়ারের রহস্যটা ব্যাখ্যা করুন।

সুলতান বলল, স্যার লিলি আপনাকে চাচাজী ডাকে। সেই সূত্রে আপনি অবশ্যই আমাকে তুমি করে বলবেন।

আচ্ছা বলব।

এখন বলি কেন আপনার জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করলাম। আমি আকাশের বিশেষ বিশেষ দিকে টেলিস্কোপ ফিট করি। তারপর আসে ফোকাসের ব্যাপারটা। টেলিস্কোপ স্ট্যান্ডে বসিয়ে এই কাজটা আমাকে করতে হয় হুইল চেয়ারে বসে। একবার টেলিস্কোপ সেট করা হয়ে গেলে সেখানে আর হাত দেওয়া যাবে না। সেটিং বদলানো যাবে না। স্যার বুঝতে পারছেন?

পারছি।

হুইল চেয়ারে বসে আমি টেলিস্কোপ সেট করলাম। তারপর হুইল চেয়ার নিয়ে সরে গেলাম—আপনি আরেকটা হুইল চেয়ার নিয়ে টেলিস্কোপের কাছে চলে এলেন। আপনাকে কষ্ট করতে হল না। আপনাকে আর দাঁড়িয়ে, হাঁটু গেড়ে কিংবা কুঁজো হয়ে টেলিস্কোপে চোখ রাখতে হবে না। হুইল চেয়ারের লজিকটা কি এখন আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে?

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ পরিষ্কার হয়েছে। খুবই যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যাটা চট করে মাথায় আসে না বলে শুরুতে হুইল চেয়ার দেখে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।

সুলতান হাসতে হাসতে বলল, আজ যেমন মন্দিরে ঢুকে আপনি একটা ধাক্কার মতো খেলেন। মন্দিরে ঢুকে দেখলেন গৌর কালীর মূর্তি দেখতে অবিকল লিলির মতো। এরও কিন্তু অত্যন্ত সরল ব্যাখ্যা আছে।

কী ব্যাখ্যা?

গৌর কালীর মূর্তি বাবু অশ্বিনী কুমার অনেক আগেই নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। এই মূর্তিই পরে আমি বানিয়েছি। হুইল চেয়ারে বসে জীবন কাটে না। নানান ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে গিয়ে মাইকেল এঞ্জেলো হবার হাস্যকর চেষ্টা। ছেনি হাতুড়ি নিয়ে পাথর কাটাকাটি।

মূর্তিটা সুন্দর হয়েছে।

মোটেও সুন্দর হয় নি। মুখের আদলটা শুধু এসেছে। আর কিছু আসে নি। নগ্ন মূর্তি বলে আপনি লজ্জায় ভালোমতো তাকান নি। ভালোমতো তাকালে ত্রুটিগুলি ধরতে পারতেন। মূর্তির একটা হাত বড়, একটা ছোট। পায়ের প্রোপরশন ঠিক হয় নি। হাঁটু যেখানে থাকার কথা তারচেয়ে উঁচুতে হয়েছে। আপনি এখন যদি দেখেন তাহলে ত্রুটিগুলি চোখে পড়বে। মূর্তিটা নগ্ন কেন বানিয়েছি সেই ব্যাখ্যা শুনতে চান? তারও ব্যাখ্যা আছে।

না। এর ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। গৌর কালীর মূর্তিটা ছিল নগ্ন। তুমি মন্দিরে গৌর কালী প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছ। অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। ইংরেজিতে সহজভাবে বলা যায় An attempt to recreate the past.

ব্যাপারটা তাই বাবু অশ্বিনী রায়ের ঘটনাটা আমাকে খুবই আলোড়িত করে। আমার মূর্তি বানানোতেও তার একটা ছায়া পড়েছে।

মিসির আলি বললেন, তোমার কি মাঝে মাঝে নিজেকে বাবু অশ্বিনী কুমার মনে হয়?

সুলতানকে দেখে মনে হল মিসির আলির এই কথায় সে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগছে। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, এই কথাটা কেন বললেন স্যার?

এমনি বললাম, মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা থেকে এটা মনে হল। কোনো মানুষকে খুব বেশি পছন্দ হয়ে গেলে জীবনযাত্রায় সেই মানুষটার ছায়া পড়ে।

সুলতান কঠিন গলায় বলল, অশ্বিনী কুমার একজন সিরিয়াল কিলার। সে ঠাণ্ডা মাথায় একের পর এক মানুষ খুন করেছে। খুনগুলি করেছে অতি প্রিয়জনদের। নিজের কন্যা। তাকে আমার পছন্দ হবে কেন?

মানুষের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ সুন্দর যেমন পছন্দ করে, অসুন্দরও করে।

সবাই করে না। কেউ কেউ হয়তো করে।

সুন্দরের পূজাও সবাই করে না। কেউ কেউ করে।

সুলতান অসহিষ্ণু গলায় বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলুন।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমার ধারণা অশ্বিনী বাবুর ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢুকে গেছে। তুমি তার মতো করে জীবন যাপন করতে চাচ্ছ। তুমি আকাশের তারা দেখ কারণ অশ্বিনী বাবু দেখতেন।

সুলতান কঠিন গলায় বলল, আপনাকে কে বলল অশ্বিনী বাবু তারা দেখতেন?

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি। এই অনুমানের পেছনে ভিত্তি আছে। তোমার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে আমি লাইব্রেরিতে সাজানো বইগুলির উপর চোখ বুলিয়েছি। চামড়ায় বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা বেশ কিছু পুরোনো বই দেখলাম। আকাশের তারা নিয়ে লেখা দুটা বই চোখে পড়েছে। একটার নাম তারা পরিচিতি, আরেকটার নাম—আকাশ পর্যবেক্ষণ। একটা ইংরেজি বই আছে Western Hemisphere Stars, এখন তুমি বল এই বইগুলি কি অশ্বিনী বাবুর?

হ্যাঁ।

উনি কি আকাশ দেখতেন?

হ্যাঁ দেখতেন। তাঁর একটা দূরবীন ছিল। ম্যাক এলেস্টার কোম্পানির চোঙ দূরবীন।

উনি তারা দেখতেন বলেই কি তুমি এখন তারা দেখছ?

সুলতান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, না ব্যাপারটা সে রকম না। আকাশের বিষয়ে আমার কৌতূহল ছোটবেলা থেকেই ছিল। তবে অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরি পড়ে আমি টেলিস্কোপ কিনতে আগ্রহী হই এটা ঠিক। তিনি আকাশ দেখতেন এবং কী দেখলেন তা খুব গুছিয়ে লিখে রাখতেন। পড়তে ভালো লাগে। তার মানে এই না যে আমি তাঁর জীবনযাত্রা অনুসরণ করছি। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না—মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এখন আমি মানুষ বলি দেয়া শুরু করব?

মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরিটা কি আমি পড়তে পারি?

অবশ্যই পড়তে পারেন। আপনি কিন্তু স্যার আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি।

প্রশ্নটা যেন কী?

প্রশ্নটা হল—আপনার কি ধারণা আমিও মানুষ বলি দিচ্ছি? গ্রাম থেকে মানুষ ধরে এনে গোপনে বলি দিয়ে মন্দিরের পেছনের কুয়ায় ফেলে দিচ্ছি? আমাকে কি অসুস্থ মানুষ বলে মনে হচ্ছে?

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছোটখাটো অসুখগুলি চট করে ধরা যায়। কিন্তু ভয়ঙ্কর অসুখগুলি মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে বাস করে। এদের চট করে ধরা যায় না। যেমন অশ্বিনী বাবুর কথাই ধরা যাক—তাঁর ভয়ঙ্কর অসুখ ধরতে অনেক সময় লেগেছিল। অশ্বিনী বাবুর সবচেয়ে কাছের মানুষ তাঁর স্ত্রী পর্যন্ত ধরতে পারেন নি। তিনটি মেয়ের মৃত্যুর পর ধরতে পারলেন।

সুলতান হতভম্ব গলায় বলল, স্যার আপনি তো দেখি সত্যি সত্যি আমাকে অশ্বিনী বাবুর দলে ফেলে দিয়েছেন। ঠিক করে বলুন তো আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন?

এখন পর্যন্ত আমি কিছুই ভাবছি না। তবে আমার অবচেতন মন নিশ্চয়ই ভাবছে। অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড খুব অদ্ভুত। অবচেতন মনকে মাঝে মাঝে আমার কাছে আত্মভোলা শিশুর মতো মনে হয়। যে শিশু নিজের মনে খেলছে। জিগ স পাজলের খেলা। একটা টুকরার সঙ্গে আরেকটা টুকরা জোড়া দিয়ে ছবি বানাচ্ছে। ছবি ভেঙে ফেলছে। আবার বানাচ্ছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কোনো ছবি তৈরি হয়ে গেলে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে আবার সেই ছবিও নষ্ট করে ফেলছে।

সুলতান শান্ত গলায় বলল, স্যার শুনুন, আমার কোনো ছবি দাঁড় করাতে হলে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। আমি জবাব দেব। অনুমানের উপর কিছু দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই।

মিসির আলি বললেন, অবচেতন মন কাউকে জিজ্ঞেস করে কাজ করে না। জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি চেতন মনের, অবচেতন মনের না। তবে চেতন মন থেকে সে যে তথ্য নেয় না, তা না। তথ্য নেয়। যেটা তার পছন্দ তাই নেয়, সব তথ্য নেয় না।

সুলতান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার আমার নিজের ারণা এই বাড়িটা আপনার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বিরাট বাড়ি। গেট সব সময় তালাবন্ধ। তিনটা কুকুর বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আপনার ধারণা হয়েছে আপনি বন্দি হয়ে গেছেন। যেই মুহূর্তে মানুষ নিজেকে বন্দি ভাবে সেই মুহূর্ত থেকে তার চিন্তার ধারা বদলে যায়। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম। যেই মুহূর্তে হুইল চেয়ারে বন্দি হয়েছি সেই মুহূর্ত থেকে অন্যভাবে চিন্তা করা শুরু করেছি। আপনার বেলাতেও তাই হচ্ছে। আপনি আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতেই পারছেন না। আপনি ধরেই নিয়েছেন আমি হচ্ছি হুইল চেয়ারে বসা অশ্বিনী বাবু।

মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি খেতে যান। আপনার খাবার দেয়া হয়েছে।

তুমি খাবে না?

না। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আপনার কারণে মেজাজ খারাপ না। আকাশ মেঘে ঢাকা, তারা দেখা যাবে না। এই জন্যে মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ নিয়ে আমি খেতে পারি না। আপনি খেতে যান, আমি অশ্বিনী বাবুর ডায়েরিটা খুঁজে বের করি। তাঁর অনেক খাতাপত্রের সঙ্গে ডায়েরিটা আছে। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।

.

পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি কথাটা সত্যি না। পাতা পাওয়া গেছে। সেই পাতায় কৈ মাছের পাতুড়ি রান্না হয়েছে। লিলি মিসির আলির পাতে মাছ তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল—দেখলেন কেমন বোকা বানালাম!

আয়োজন প্রচুর। মাছই আছে তিন রকমের। চিংড়ি মাছ, মলা মাছ আর কৈ মাছ। নানান ধরনের ভর্তা, ভাজি। কুচকুচে কালো রঙের একটা ভর্তা দেখা গেল। আরেকটার বর্ণ গাঢ় লাল। পাশাপাশি দুটা বাটিতে লাল এবং কালো ভর্তা রাখা হয়েছে যার থেকে ধারণা করা যায় যে শুধু রান্না না, খাবার সাজানোর একটা ব্যাপারও মেয়েটার মধ্যে আছে। লিলি বলল, চাচাজী এই দেখুন কালো রঙের এই বস্তু হল কালিজিরা ভর্তা। কৈ মাছের পাতুড়ি আপনার পাতে তুলে দিয়েছি বলেই এটা দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন না। কালিজিরা দিয়ে কয়েক নলা ভাত খেলে মুখে রুচি চলে আসবে। তখন যাই খাবেন, তাই ভালো লাগবে।

মিসির আলি বললেন, আমার রুচির কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও তুমি যেভাবে খেতে বলবে আমি সেইভাবেই খাব। লাল রঙের বস্তুটা কী?

মরিচ ভর্তা। শুকনো মরিচের ভর্তা।

আমি ঝাল খেতে পারি না।

এই মরিচ ভর্তার বিশেষত্ব হচ্ছে ঝাল নেই বললেই হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকনো মরিচ থেকে ঝাল দূর করা হয়েছে। বিশেষ প্রক্রিয়াটা শুনতে চান?

শুনে আমার কোনো লাভ নেই, তবু বল।

শুকনো মরিচ লেবু পানিতে ডুবিয়ে রাখলে মরিচের ঝাল চলে যায়। ভিনিগারে ডুবিয়ে রাখলেও হয়। আমি ঝাল দূর করেছি লেবু পানিতে ডুবিয়ে।

বিচিত্র ধরনের রান্নাবান্না তুমি কি কারো কাছ থেকে শিখেছ? না নিজে মাথা খাটিয়ে বের করেছ?

বেশির ভাগ রান্নাই আমি আমার নানির কাছ থেকে শিখেছি। নানি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন, তার চেয়েও বড় কথা রান্নার মন্ত্র শিখিয়েছেন। আমি প্রায় কুড়িটার মতো রান্নার মন্ত্র জানি।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, রান্নার কি মন্ত্ৰ আছে নাকি?

লিলি সহজ ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ মন্ত্র আছে। এই মন্ত্র কাউকে শেখানো নিষেধ। মন্ত্র শেখালে তার পাওয়ার চলে যায়। কিন্তু আপনি চাইলে আপনাকে শেখাব।

আমি রান্না শিখতে চাচ্ছি না। কিন্তু মন্ত্রটা শিখব।

মন্ত্রটা সত্যি শিখতে চান?

শিখতে চাই না, শুধু শুনতে চাই। যেকোনো একটা মন্ত্র বললেই হবে।

লিলি বলল, একেক রান্নার একেক মন্ত্র। ছোট মাছ রান্নার মন্ত্রটা বলি। ছোট মাছের সঙ্গে তেল মশলা মাখাতে হয়। চুলায় হাঁড়ি দিয়ে আগুন দিতে হয়। হাঁড়ি পুরোপুরি গরম হবার পর তেল-মশলা মাখা মাছটা হাঁড়িতে দিয়ে মন্ত্রটা পড়তে হয় দশবার। তারপর পানি দিতে হয়। পানি এমনভাবে দিতে হয় যেন মাছের উপর দু আঙুল পানি থাকে। এই মন্ত্রের দাম দশ—দুই মন্ত্র। পানি ফুটতে শুরু করলেই রান্না শেষ। আরেকবার মন্ত্রটা পড়ে ফুঁ দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে হাঁড়ি নামিয়ে ফেলতে হবে। তরকারি বাটিতে ঢালার আগে আর ঢাকনা নামানো যাবে না।

এখন মন্ত্রটা বল।

লিলি বলল, মন্ত্রটা অনেক লম্বা। শুরুটা এরকম-

উত্তরে হিমালয় পর্বত
ক্ষিণে সাগর
নদীতে সপ্ত ডিঙ্গায়
চাঁদ সদাগর।
আমি চুলার ধারে
ধোঁয়া বেশুমার
অগ্নিবিনা রন্ধন হবে
প্রতিজ্ঞা আমার।
অগ্নি আমার ভাই
জল আমার বোন
আমি কন্যা চম্পাবতী
শোন মন্ত্র শোন।
আশ্বিনে আশ্বিনা বৃষ্টি
কার্তিকে হিম
শরীরে দিয়াছি বন্ধন
আলিফ লাম মিম।
……

মিসির আলি মন্ত্র শুনে হাসলেন। লিলি বলল, চাচাজী হাসবেন না। এই মন্ত্র পড়ে একবার ছোট মাছ রান্না করে দেখুন। দশবার মন্ত্র পড়ার পর দু আঙুল পানি। আর কিছু লাগবে না।

মিসির আলি বললেন, লিলি আমার ধারণা মন্ত্রটা হল—টাইমিং। সেই সময় তো গ্রামেগঞ্জে ঘড়ি ছিল না। রান্নার মতো তুচ্ছ বিষয়ে ঘড়ির ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা তখন মন্ত্র পড়ে সময়ের হিসাব রাখা হত। তুমি যে মন্ত্রটা বললে এই মন্ত্র দশবার বলতে যত সময় লাগে ততটা সময় তেল-মশলা মাখানো মাছ গরম চুলায় রাখলেই হবে। তুমি এক কাজ কর। ঘড়ি দেখে দশবার মন্ত্র পড়তে কত সময় লাগে সেটা বের কর। তারপর মন্ত্র ছাড়া সময় দেখে রান্না কর। দেখবে রান্না ঠিকই হয়েছে।  

লিলি বলল, আপনার আসলেই অনেক বুদ্ধি। মন্ত্র যে কিছুই না, সময়ের হিসাব এটা আমিও টের পেয়েছি। কিন্তু আমার অনেক সময় লেগেছে। আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছেন। আপনি কি যেকোনো সমস্যার সমাধান সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলেন? এই ক্ষমতা কি সত্যি আপনার আছে?

মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি লক্ষ করলেন লিলি তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকে দেখছে। সে কি কিছু বলার চেষ্টা করছে? প্রশ্নের ভেতরেও লুকানো প্রশ্ন থাকে। মেয়েটির এই প্রশ্নের ভেতর লুকানো কোনো প্রশ্ন কি আছে?

লিলি বলল, মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করি নি। আপনি কি মধু খাবেন? মধু এনে দেব? ঐ দিন খলসা ফুলের মধু খেয়েছেন, আজ কেওড়া ফুলের মধু খান।

না।

লিলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারেন।

মিসির আলি বললেন, সুলতান চিঠিতে একটা মেয়ের কথা বলেছিল ঐ মেয়েটি সত্যি আছে? সালমা নাম, পনের ষোল বছর বয়স। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ে।

লিলি সহজ গলায় বলল, থাকবে না কেন আছে। দূরবীনওয়ালাকে বললেই সে আপনাকে দেখাবে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটা থাকে কোথায়?

লিলি বলল, মেয়েটা কোথায় থাকে তা দিয়ে কী করবেন? মেয়েটার সত্যি কোনো ক্ষমতা আছে কিনা এটা জানা জরুরি তাই না?

মেয়েটার সত্যি কি ক্ষমতা আছে?

মেয়েটার শুধু যে ক্ষমতা আছে তা না, ভয়াবহ ক্ষমতা আছে।

তুমি নিজে দেখেছ?

হ্যাঁ। আপনি তাকে দেখে খুবই অবাক হবেন। প্রথমে আপনার বিশ্বাস হবে না। ভাববেন ঠাট্টা করা হচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, তুমিই কি সেই মেয়ে?

লিলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, চাচাজী শুনুন মধু আপনাকে খেতেই হবে। ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে। দূরবীনওয়ালা যদি শোনে আপনাকে মধু দেওয়া হয় নি তাহলে খুব রাগ করবে। আমাকে বলা হয়েছে আজ যেন কেওড়া ফুলের মধু দেওয়া হয়।

মধু না খেলে সুলতান রাগ করবে?

রাগের চেয়েও যেটা করবে তা হল মেজাজ খারাপ।

মিসির আলি বললেন, নিয়ে এস তোমার মধু

লিলি বলল, সুন্দরবনের বানররা মধু কীভাবে খায় এই গল্প কি আপনি জানেন?

না জানি না।

আপনি আঙুলে মধু মাখিয়ে খেতে শুরু করুন। আমি গল্পটা করি। ছোট বাচ্চাদের যেমন গল্প বলে বলে খাবার খাওয়াতে হয় আপনাকেও সে রকম গল্প বলে বলে মধু খাওয়াব।

ঠিক আছে, শুরু কর তোমার গল্প।।

কোনো বানরের যখন মধু খেতে ইচ্ছা করে সে তখন নদীর পাড়ে চলে যায়। সারা গায়ে কাদা মাখে। তারপর রোদে বসে এই কাদা শুকায়। আবার যায় কাদায়। আবারো কাদায় হুটোপুটি করে গায়ে কাদা মাখে। আবারো রোদে শুকায়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর বানরের গায়ে শক্ত কাদার একটা স্তর পড়ে যায়। তখন সে মহানন্দে চাক ভেঙে মধু খায়। মৌমাছিরা কাদার স্তরের জন্যে তার গায়ে হুল ফুটাতে পারে না। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের মতো মৌমাছি প্রুফ কদম জামা। চাচাজী ঘটনাটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?

হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং তো বটেই।

সুন্দরবনের মধু নিয়ে আমি এর চেয়েও এক শ গুণ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প জানি। সেটা আজ বলব না। অন্য একদিন বলব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *